স্বপ্নতাড়িত ন্যানো এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 7 Jan 2015, 01:21 PM
Updated : 3 Oct 2012, 01:06 PM

"এবং আমরা ভাইরাসের মতো ক্ষুদ্রাকৃতির মেশিন বানাতে সক্ষম হব " – মারভিন মিন্‌স্কি

ইদানিং 'ন্যানো' খুব ট্রেন্ডি শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে শুরু করে বিবিধ গৃহস্থালির জিনিসে আজকাল 'ন্যানো' শব্দের প্রয়োগ খুব ঝকমারি একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু 'ন্যানো' আসলে কী? 'ন্যানো' হল ন্যানোমিটার শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ – এক ন্যানোমিটার এক মিটারের একশ কোটি ভাগের এক ভাগ (১০^-৯)। দশটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে পরপর রাখলে তবে এক ন্যানোমিটারের সমান হবে। আবার আমাদের চুলের গড়পরতা ব্যাস ৫০ মাইক্রোমিটার – যা পঞ্চাশ হাজার ন্যানোমিটারের সমান। চুলের চেয়েও সূক্ষ্মতর দৈর্ঘ্যে কার্যরত প্রযুক্তিকে ন্যানো-প্রযুক্তি বলে। এই স্কেলে বস্তুর অভূতপূর্ব গুণাগুণ প্রকাশ পায় যা সচরাচর দৃষ্ট বস্তু থেকে পৃথক। ন্যানোস্কেলে বস্তুর ভৌত-রাসায়নিক-জৈবনিক ধর্মাবলি পরমাণুর স্কেলে দৃশ্যমান আচরণ এবং বৃহৎ বস্তুতে দৃশ্যমান ঘটনাবলি থেকে আলাদা । যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ন্যানো-টেকনোলজি ইনিশিয়েটিভের (www.nano.gov) সংজ্ঞামতে,
"এক থেকে একশো ন্যানোমিটার স্কেলে বস্তুর গবেষণা এবং পদার্থের নিয়ন্ত্রণ ন্যানো-টেকনোলজির বিষয়। … এই ন্যানোস্কেলে কার্যকর বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিকে একত্রে ন্যানো-প্রযুক্তি বলে। এই ন্যানোস্কেলে বস্তুর ছবি নেয়া (ইমেজিং), পরিমাপ গ্রহণ, গাণিতিক মডেল ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ন্যানোপ্-রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত"।

এই হলো ন্যানো-প্রযুক্তির মোটামুটি সর্বজনমান্য সংজ্ঞা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের এই প্রযুক্তির অধীনে এমনসব বস্তু বা সিস্টেম আছে, যাদের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধের অন্তত একটি মাত্রার দৈর্ঘ্য ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে, এমন পদ্ধতির সাহায্যে এগুলোর ডিজাইন করা হয়েছে যেটা/যা আণবিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সাধিত হয়েছে, এবং এ সব অংশবিশেষ নিজ থেকে বা বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে ম্যাক্রোস্কেলের কাঠামো তৈরি করতে পারে। বস্তুকে কেটে-ছেঁটে ক্ষুদ্রতর করে উক্ত ন্যানোস্কেলে নিয়ে যাওয়া যায় – এটাকে বলে 'টপ-ডাউন' পদ্ধতি। আবার অণু বা পরমাণুকে একের পর এক জুড়ে (বা স্ব-সমাবেশ ঘটিয়ে) ন্যানোকাঠামো পাওয়া সম্ভব – এটার নাম 'বটম-আপ' পদ্ধতি। প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে বহুসংখ্যক ন্যানোকাঠামো বানানো সম্ভব। বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রি এই পদ্ধতিতেই কাজ করে। এভাবেই নখাগ্রের তুল্য জায়গায় লক্ষাধিক ট্রানজিস্টার বসিয়ে ইলেকট্রনিক চিপ তৈরি সম্ভব হচ্ছে। আবার রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় স্ব-সমাবেশ বা সেল্ফ-অ্যাসেম্বলি পদ্ধতিতে ধীরগতির 'বটম-আপ' পদ্ধতিতেও ন্যানোকাঠামো বানানো সম্ভব। কিন্তু ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রির মতো নিভর্রযোগ্যতা (রিলায়েবিলিটি) ও পৌনঃপুনিকতা (রিপিটেবিলিটি) সেভাবে পাওয়া যায় না।

যাহোক, এই ন্যানোপ্রযুক্তির ফলে বস্তুর অভিনব এবং প্রিয়দর্শী গুণাবলিকে কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব আনা সম্ভব হয়েছে। এই প্রযুক্তির সার্থক প্রয়োগের ফলে কমপিউটারকে আরও ছোট, দ্রুতগতির ও দক্ষ করা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, তরুণ-তরুণীদের হাতে যে সব পাতলা 'আইপড' দেখা যায়, যাতে বহুসংখ্যক মিউজিক ফাইল সঞ্চয় করে রাখা সম্ভব হচ্ছে, সেটা সম্ভব হয়েছে জায়ান্ট ম্যাগনেটো-রেজিস্ট্যান্স (ফিজিক্স নোবেল, ২০০৭) আবিষ্কারের ফলে । এই প্রযুক্তির ফলে অত্যন্ত স্বল্পপরিসরে প্রচুর তথ্য সঞ্চয় করে রাখা সম্ভব। ন্যানো-প্রযুক্তির এ এক লাগসই প্রয়োগ।

ন্যানোর প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তর আসবে। এতে করে উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তি, দক্ষ ড্রাগ-ডেলিভারি ও ডায়াগনোস্টিক প্রক্রিয়ার প্রভূত উন্নতি সাধন সম্ভব হবে। বর্তমানে ক্যান্সারাক্রান্ত ব্যক্তিকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এর ফলে দুষ্ট কোষের পাশাপাশি সুস্থ কোষও মারা যায়। কিন্তু ন্যানো-প্রযুক্তির ফলে এমন সব ন্যানো-কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে যা দিয়ে শুধুমাত্র আক্রান্ত টিস্যুতেই ওষুধ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এভাবে ইলেকট্রনিক্স ও বায়েটেকনোলজির যুগপৎ সম্মিলনে চিকিৎসাক্ষেত্রে দারুন ফলাফল হাতে পাব। অন্যদিকে, বিশেষ ন্যানো-আবৃতির কেলাস-সমৃদ্ধ দ্রবণ দ্বারা পেইন্ট করা সোলার প্যানেল থেকে অধিকতর দক্ষতায় সৌরশক্তি নিষ্কাশন সম্ভব। তাছাড়া ক্ষুদ্র বহনযোগ্য সোলার চার্জার বানানো সম্ভব হবে যার ফলে মুঠোফোন বা আইপড যখন-তখন চার্জ করা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে, কৃষিতে ন্যানোদ্রব্য সম্বলিত সার জমির উর্বরতা বাড়াবে। ন্যানো-কীটনাশক পরিবেশের ক্ষতি না করে এবং উপকারী কীটপতঙ্গকে আঘাত না করে ক্ষতিকর কীট ও ছত্রাককে দূরে রাখবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ন্যানোর প্রয়োগ বায়োটেকনোলজির বিষয়। এই খাতে আছে ন্যানোর অভিনব সব সম্ভাবনা। পরিবেশ রক্ষায়, পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে, পানির বিশুদ্ধকরণে ন্যানো-প্রযুক্তি সম্বলিত ছাঁকনি ব্যবহারে, শিল্পকারখানার বর্জ্য শোধনে ন্যানো-প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে এখনই। ন্যানো-প্রযুক্তির এ সব যুগান্তকারী অবদান আমাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

ন্যানো-কৌশল আমাদের জীবমণ্ডলে লক্ষ-কোটি বছর ধরেই কাজ করে চলেছে। গাছের পাতার কথাই ভাবুন – পাতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অতিক্ষুদ্র ক্লোরোপ্লাস্টে রাসায়নিক খাদ্য উৎপাদনে সর্বদা চলছে সৌরশক্তির ব্যবহার। জীবনের প্রতিটি ঘটনাই আণবিকস্তরে ন্যানো-প্রযুক্তির ফসল। আমাদের কোষের ভেতরে মাইটোকন্ড্রিয়া বা রাইবোজোম নামক অসাধারণ সব ন্যানোমেশিন কাজ করছে – প্রথমটি কোষের পাওয়ার-হাউজ এবং পরেরটি জেনেটিক তথ্য থেকে প্রোটিন উৎপাদনের কাজ করে। মাত্র কিছুদিন হল মানুষ প্রকৃতির এই ন্যানো-কান্ডকারখানা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। ১৯৫৯ সালে রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর এক বিখ্যাত বক্তৃতায় 'দেয়ার্স প্লেন্টি অব রুম অ্যাট দ্য বটম'-এ অণুর জগৎকে নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনার কথা বলেন। সেই থেকে মানুষ ন্যানো-প্রযুক্তির সমঝদার। প্রকৃতি যা করে অত্যন্ত ধীরলয়ে জলীয় দ্রবণে- ন্যানো-প্রযুক্তি তাই করবে দ্রুততার সঙ্গে, শুষ্ক পরিবেশে এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে। এই হল ন্যানো-প্রযুক্তি তথা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের প্রযুক্তির সারাৎসার।

এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। ন্যানো-প্রযুক্তি নিয়ে আমার নিজস্ব পড়াশোনা শুরু হয় ১৯৯৮/৯৯ সাল থেকে। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এবং সীমিত লভ্য বইপত্র ঘেঁটে ন্যানো-ইলেকট্রনিক্সের সম্পর্কে একটা ধারণা গড়া শুরু হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সাবেক শিক্ষক (এবং অধুনা পূর্ব-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) ডক্টর আনিসুল হক ছিলেন আমাদের হাতের কাছের ন্যানো-বিষয়ক সর্বোত্তম বিশেষজ্ঞ। তড়িৎ-কৌশলে স্নাতকোত্তর শিক্ষার অংশ হিসেবে ২০০১ সালে 'কোয়ান্টাম ফেনোমেনা ইন ন্যানোস্ট্রাকচার্স' শীর্ষক একটি কোর্স আমি নিয়েছিলাম। কোর্সটি পড়াতেন অধ্যাপক হক। তিনি তখন পার্ডু ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত অধ্যাপক সুপ্রিয় দত্তের ততোধিক বিখ্যাত দুটি বই থেকে ন্যানো-ইলেকট্রনিক্স বিষয়ক তাত্ত্বিক নির্মাণটি আমাদের শেখাতেন। অধ্যাপক হকের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর কোর্সটি এবং IEEE Proceedings-এর এপ্রিল ১৯৯৯ বিশেষ সংখ্যার সাহায্যে ন্যানো সম্পর্কে আমার ধারণা পোক্ত হতে থাকে। সেই সময়কার ন্যানো সম্পর্কিত আমার ধ্যান-ধারণার সর্ব্বোচ্চ পরিণতি থেকে আমি 'বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপের' জন্য একটি প্রস্তাবনা লিখি। সেখানে লিখেছিলাম,

"সমন্বিত বর্তনী বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আবিষ্কারের পর থেকে ইলেকট্রনিক বর্তনীকে ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর আকৃতিতে নিয়ে যাওয়ার এক অনতিক্রম্য প্রবণতা দেখা দিয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। আজকের দিনের (২০০১) একটি মাইক্রোচিপে প্রায় ১ বিলিয়ন ট্রানজিস্টর বসানো থাকে এবং এ রকম একটি চিপে সর্বনিম্ন ০.১৭৫ মাইক্রন পরিমাণ ক্ষুদ্র ডিভাইস বসানো যাবে। এর চেয়ে ক্ষুদ্রতর হলে কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই ক্ষুদ্রতর ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব হবে না যদি না একেবারে নতুন কোনও প্রযুক্তির হদিস পাওয়া যাচ্ছে। মিনিয়েচারাইজেশানের এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করাই ন্যানো-প্রযুক্তির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

… বলা হচ্ছে, একুশ শতকে 'মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও কল্পনাশক্তি, নতুন প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহার হবে উন্নতির প্রধানতম চাবিকাঠি' – এ কথা স্মরণ করে উন্নত দেশগুলি আগেই সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগুলির তালিকা প্রস্তুত করে ফেলেছে। জাপানের কথাই ধরা যাক। জাপান একুশ শতকের উপযোগী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সীমানাক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। এই তালিকার শীর্ষস্থানে আছে মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্স/ন্যানো-প্রযুক্তি এবং এ সংক্রান্ত গবেষণা। এই যখন পরিপ্রেক্ষিত. তখন আধুনিক বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কি এখনও 'অদ্ভূত উটের পিঠে'ই চলতে থাকব? এ দেশের একজন তরুণ ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমি মনে করি একুশ শতকে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঠিকতম প্রযুক্তিটি হল ন্যানো-প্রযুক্তি ও এ সংক্রান্ত গবেষণা এবং তার লাগসই প্রয়োগ"।

বলে রাখা ভালো, আজকাল ইন্টেল প্রসেসরে ন্যূনতম ফিচার-সাইজ থাকে ২২ ন্যানোমিটার যা উপরের লেখায় কথিত ক্ষুদ্র ডিভাইসের আকৃতির তুলনায় ৮ গুণ ছোট। আরও বলা দরকার যে, উপরোক্ত 'বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ' আমি পাইনি এবং ন্যানো-সংক্রান্ত আমার স্বপ্নকল্পনাও পরবর্তীতে বাধাগ্রস্ত হয় দুটো কারণে। মার্কিন মুলুকের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ন্যানোকাঠামো নিয়ে কাজের জন্য গাবেষণাবৃত্তি পেয়েও দু'দুবার ভিসা প্রত্যাখ্যান। অন্যদিকে, কানাডায় আমার গবেষণা সুপারভাইজারের ন্যানো নিয়ে কাজ করতে অনিচ্ছা। তবে গবেষণার কাজে আমি যে সব 'ক্লিনরুম ইকুইপমেন্ট' ব্যবহার করছিলাম, সে সব দিয়েই দিব্যি অনেক ন্যানো-কাঠামো নির্মাণ সম্ভব।

২০০৭ সালের দিকে জমাটবাঁধা এই ন্যানো-স্বপ্ন আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে যখন আমার পিএইচডি সুপারভাইজার ডক্টর জামাল দীন একটি ১০ মিলিয়ন ডলার ন্যানো গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের জন্য লেখালেখি শুরু করেন। ততদিনে আমার পিএইচডি গবেষণা শেষ পর্যায়ে এবং ২০০৮ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের আগ মুহুর্তে আমার অধ্যাপক মহাশয় ঐ ন্যানোকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড পেয়ে যান। দেশে ফেরার পর আমি সাহস করে 'ন্যানো' নামের একটি বইও লিখে ফেলি আমার গবেষণা-অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে। বইটি প্রকাশ পায় ২০১০ সালে। সেখানে আমি লিখেছি,

"ন্যানো-গবেষণায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। কেন্দ্রীয়ভাবে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যেখানে ন্যানো-গবেষণার সব পরিকাঠামো থাকবে। যেটা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনমতো শেয়ার করতে পারবে।… বাংলাদেশ সরকার যদি কেন্দ্রীয় পরিকাঠামো (ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশ, কিংবা ন্যানো-টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার অব বাংলাদেশ জাতীয় কিছু) তৈরি করে দেয় এবং বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে গাবেষণা-সহযোগিতার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা যদি করা যায়, তবে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমাদের দেশ এশিয়ার মধ্যে ন্যানো-বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হবে।… আমাদের অবশ্যই সে মেধা ও ধীশক্তি আছে"। (পৃঃ ১৩২-১৩৪)

২০১০ সালে বিখ্যাত জিন-বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের সঙ্গে বায়ো-টেকনোলজি ও ন্যানো-টেকনোলজি নিয়ে একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান-বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ আমার ঘটে এবং সেখানেও আমরা এমনই একটি প্রতিষ্ঠানের কথা বলি। এ সব হইচইয়ের ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন গত ২১শে সেপ্টেম্বর "আন্তর্জাতিক ন্যানো-প্রযুক্তি কর্মশালা-২০১২"তে পাবলিক-পাইভেট পার্টনারশিপে একটি ন্যানোকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন, তখন আমার যারপরনাই আনন্দ হচ্ছিল। সুদীর্ঘ প্রায় একযুগের এক ব্যক্তিগত স্বপ্নের এমন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ঘোষণা সত্যিই শিহরণ জাগায়! তবে কেউ যেন মনে না করেন, কেবল নিজের বাদ্য বাজানোর জন্যই এই লেখা ফেঁদেছি! চুনোপুটিদের চেঁচামেচিতে কবেই বা এ দেশে চরকি ঘুরেছে? আসলে আমাদের মতো আরও কয়েকজন একই সময়ে প্রায় কাছাকাছি স্বপ্ন দেখেছিলেন; ঠিক সময়ে ঠিক মানুষরা ঠিক জায়গায় কলকাঠি নেড়েছেন বলেই আজ এই পথচলা সম্ভব হয়েছে।

গত ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২'তে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হল আন্তর্জাতিক ন্যানো-প্রযুক্তি কর্মশালা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এর সমাপনী ঘোষণা করেন। কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের গবেষকরা। সেই সঙ্গে অনেক দেশীয় প্রতিষ্ঠানের গবেষক এবং ছাত্র-ছাত্রীরাও অংশ নেন। কর্মশালাটির সহ-আয়োজক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। কর্মশালাটির শেষে কিছু সুনির্দিষ্ট রেকমেন্ডেশন প্রস্তাব করা হয় যার অন্যতম হল বাংলাদেশের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ন্যানো-গবেষণা কেন্দ্র, ন্যানো-বিষয়ক একটি জাতীয় নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য খাতসমূহ চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হল – স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, কৃষি ও পরিবেশ, জ্বালানি, আইসিটি/মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি। ক্যাপাসিটি-বিল্ডিং বা অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি শিক্ষায় ন্যানোর অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে সুপারিশ করা হয়। আমি ও আমার সহকর্মী (সাজিদ মুহাইমিন চৌধুরী) এই কর্মশালায় কারিকুলাম বিষয়ে একটি পোস্টার প্রদর্শন করি। সেখানে আমাদের বক্তব্য ছিল এ রকম – জুনিয়র, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কারিকুলামে ন্যানোর অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন; তাহলে ২০২১ সাল নাগাদ আমরা যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত গবেষক-সম্প্রদায় হাতে পাব যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত ন্যানোকেন্দ্রে কাজ করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সবগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডিসিপ্লিনে অন্তত একটি ন্যানো-বিষয়ক পরিচিতিমূলক কোর্স থাকতে হবে বলেও আমরা উল্লেখ করেছি।

প্রস্তাবিত ন্যানোকেন্দ্র সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, যেহেতু ন্যানো-প্রযুক্তি অত্যন্ত মাল্টিডিসিপ্লিনারি ধরনের একটি বিষয় – এখানে রসায়ন যেমন লাগে, পদার্থবিদ্যাও দরকার হয়। ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং যতখানি প্রয়োজন, মেটেরিয়াল্‌ সায়েন্সও ততখানি প্রয়োজন। বায়োকেমিস্ট্রি লাগে, আবার মাইক্রোবায়োলজিও লাগে। ফার্মেসি তো বটেই। কাজেই এই ন্যানোকেন্দ্রটি একটি একক প্রতিষ্ঠান হলেই ভালো। ঢাকা থেকে দূরে মনোরম ঝঞ্ঝাটমুক্ত স্থানে একটি পোস্ট-গ্রাজুয়েট গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি গড়ে উঠবে। এই প্রতিষ্ঠানে শুধু মাস্টার্স ও পিএইচডি গবেষণা হবে। ন্যানো-প্রযুক্তির সব শাখার মোটামুটি সব ইকুইপমেন্ট সেখানে থাকবে। ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সমানভাবে এগুলো ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। এ রকম একটি পরিকল্পনা শ্রীলঙ্কায় নেয়া হয়েছে।

তাঁরা এটাও নিশ্চিত করেছে যে, প্রতিষ্ঠানটির বেতন-কাঠামো এমন হবে যাতে গবেষকরা বিদেশ চলে যাবেন না। শ্রীলঙ্কার মডেলটিতে বাজেট ধরা হয়েছে ৫ মিলিয়ন ডলার যার অর্ধেক সরকার দেবে, বাকি অর্ধেক দেবে বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানি। আমরাও এভাবে এগুতে পারি। এ ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশ বড় অঙ্কের হয়। কাজেই সেটাও চিন্তার বিষয়। এটার সুরাহা এমনভাবে করা যায় – সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দকৃত গবেষণা খাতের একাংশ (ধরা যাক ৪০%) ন্যানোকেন্দ্রে খরচ করতে হবে – এ রকম একটি শর্ত আরোপ করে দিলে ন্যানোকেন্দ্রের খরচ কিছুটা উঠে আসবে। শ্রীলঙ্কার মডেলে এমনও শর্ত আছে যে, ন্যানোকেন্দ্রে যদি কোনও একটি গবেষককে প্রয়োজন হয়, তবে ওই গবেষকের প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ঐ ন্যানোকেন্দ্রে কাজ করতে দিতে বাধ্য থাকবেন।

এভাবে একটি চমৎকার ব্যবস্থাপনায় একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব যা আমাদের জাতীয় অহংকারের বিষয় হতে পারে। অবশ্যই ন্যানোকেন্দ্রের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনায় যাঁরা থাকবেন তাঁদের প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ হতে হবে – কেবলমাত্র গবেষক বা ব্যবস্থাপক নন। এমন সব প্রফেশনালকে রাখতে হবে যাঁরা গবেষণাও বোঝেন, আবার ব্যবস্থাপনাতেও দক্ষ, সরকারি মহলে দৌড়ঝাঁপের ব্যাপারে যাঁ(দে)র কোনও বাধ্যবাধ্যকতা থাকবে না, কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির দরজায় দাঁড়াতেও লজ্জা থাকবে না।

তাত্ত্বিক গবেষকরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশে এত খরচ কেন? তাত্ত্বিক গবেষণার দরকারও যেমন আছে, ফলিত গবেষণারও দরকার আছে। তাত্ত্বিক গবেষণায় মগজের ব্যায়াম যতখানি ঘটে হাতের ব্যায়াম ততটা হয় না। তৃতীয় বিশ্বে হাতে-কলমে ফলিত গবেষণা না থাকলে প্রযুক্তির প্রসার বন্ধ হয়ে যাবে। এতে আমদানীমুখী অর্থনীতির দিকে বেশি ঝুঁকতে হবে, যা জিডিপিতে প্রভাব ফেলবে। আমাদের দেশে তাত্ত্বিক গবেষক অনেকই আছেন- ট্রানজিস্টরের গেইট-লেংথ কত ছোট করলে 'ওয়েভ ফাংশন পেনিট্রেশন' পদ্ধতি ফলপ্রসূ হবে, কিংবা দূর গ্যালাক্সির ব্ল্যাক-হোলের ঘটনা, দিগন্তে কী ধরনের কণিকারা খেলা করে, অথবা ল্যাটিস গেজ থিওরি কীভাবে সহজে গণনা করা যায় – তেমন গবেষক পাওয়া দুর্লভ নয়।

কিন্তু একটি মুঠোফোন বানানোর মতো দক্ষ জনবল আমাদের নেই, অথচ মুঠোফোনের গ্রাহকসংখ্যা ৯ কোটির বেশি! গত চল্লিশ বছরে আমাদের প্রকৌশল শিক্ষা-গবেষণা বহুলাংশে কম্পিউটার-গণনাভিত্তিক হয়ে গেছে, বিভাগে-বিভাগে কমপিউটার সফটওয়্যারের জয়জয়কার (হাতে-কলমে গবেষণা করা যায় এমন রিসার্চ-গ্রেড ল্যাব আমার নিজের বিভাগেই দুটোর বেশি নেই, অথচ বিভাগে ডক্টরেট শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ)! এ অবস্থা কোনওমতেই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মেধারপ্তানির প্রতিষ্ঠান হলে চলবে না। এ জন্য চাই একটি 'টেকনোলজি রোডম্যাপ'। ২০২১ সাল নাগাদ আমাদের দশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে এবং সেখানে টিকে থাকতে হলে (টেকসই উন্নয়ন) আমাদের ফলিত ও প্রকৌশল গবেষণার প্রয়োজন। একটি সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত 'টেকনোলজি রোডম্যাপ' জাতিসংঘ প্রণীত মানব-উন্নয়ন সূচকে (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডেক্স) সরাসরি অবদান রাখে।

মানব-উন্নয়ন সূচকে আমরা অনেকখানি এগিয়ে, কিন্তু এই অগ্রগতি ধরে রাখতে চাই হাতে-কলমে প্রযুক্তি-গবেষণা। দিস্তায়-দিস্তায় কাগজ খরচ করে করা গবেষণার অবদান সরাসরি মানব-উন্নয়ন সূচকে যায় না, যায় হাতে-কলমে প্রযুক্তি ও প্রকৌশল গবেষণার সরাসরি অবদান। মঙ্গলে যাবার কক্ষপথ আমি হাজারবার গণনা করতে পারি, কিন্তু ফলিত গবেষণায় প্রাপ্ত রকেট-প্রচালন সংক্রান্ত প্রযুক্তি হাতে না থাকলে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে এক হাজার ফুট উড্ডয়নও সম্ভব নয়। কাজেই টেকনোলজির উন্নয়ন ছাড়া মধ্যম-আয়ের দেশ হিসেবে আমরা টিকে থাকতে পারব না। দেশীয় গবেষণায় এবং শিল্পোন্নয়নে তাই এই প্রস্তাবিত ন্যানোকেন্দ্র ব্যাপক প্রভাব রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।

গত দশ বছরে ভারত ও চিন গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে খরচ দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। ভারতের বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় 'ন্যানোমিশন' ঘোষণা দিয়ে ২০টি আঞ্চলিক কেন্দ্র উন্নয়নে কাজ করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্থান ও মায়ানমার (এবং নেপাল ও ভুটান) ছাড়া আর সবাই ন্যানো-গবেষণা শুরু করে দিয়েছে তোড়জোড় বেঁধে। আমরাই বা শুধু কেন অদ্ভুত উটের পিঠে চলব?

শুধু একা স্বপ্ন দেখলেই হয় না, আরও অনেক স্বপ্নচারী মানুষও দরকার। আমাদের সৌভাগ্য, এ রকম ন্যানো-স্বপ্নচারী একাধিক মানুষের খোঁজ আমরা পেয়েছি, তাঁরা একত্রিত হয়ে এ সম্পর্কিত প্রথম ওয়ার্কশপটি আয়োজন করতে পেরেছেন। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বপ্নকে জীবদ্দশাতেই খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখে উচ্চারিত হতে শোনা- এতসব অসম্ভব ব্যাপার ঘটলে কার না ভালো লাগে! আর সে জন্যই ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাসে ভরা এই রচনা। কিন্তু সব উচ্ছ্বাসের পেছনে বাংলাদেশে যেমন ব্যর্থতার কান্না লুকিয়ে থাকে, ন্যানোতেও যেন সে বিষাদের ছোঁয়া না লাগে সেটা দেখাই আমাদের কর্তব্য।

আমাদের কর্মশালার তৃতীয় দিনে আমাদের ওলামা-মাশায়েখরা এক উদ্ভট কারণে হরতাল ডেকে বসলেন। ফলে মিরপুর থেকে আমাকে রিক্সায় চড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। দেশের যা অবস্থা তাতে প্রস্তাবিত ন্যানোকেন্দ্রটি যেন আবার রিক্সায় চড়ে যাত্রা শুরু না করে সেটিই এখন দেখার বিষয়। ন্যানো-ট্রেনটি যেন আবার মিস না হয়ে যায় – সেটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা হওয়া উচিত।

তথ্যসূত্রঃ
১। 'ন্যানো', ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, পড়–য়া, ঢাকা, ২০১০।
২। ২০১০ সালের ২১শে নভেম্বর '৪র্থ আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন ও জহুরুল হক স্মারক বক্ততা', সার-সংক্ষেপ দৈনিক প্রথম আলো, ৫ ডিসেম্বর ২০১০।

[এই প্রবন্ধটি প্রফেসর আনিসুল হকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হল; অধ্যাপক হকের হাত ধরে আমরা অনেকেই ন্যানোর জগতে প্রবেশ করেছি।]

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী: বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।