কোরবানির পশু-চামড়ার দাম কমানো ও বাজার সিন্ডিকেটের অট্টহাসি

Published : 30 July 2020, 04:31 PM
Updated : 30 July 2020, 04:31 PM

প্রতি বছর কোরবানি এলেই যে সিন্ডিকেটটি সক্রিয় হয়ে ওঠে, তা হলো চামড়ার বাজার সিন্ডিকেট। খবরে প্রকাশ, এ বছর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম পুনঃনির্ধারণ করে দিয়েছে। পুনঃনির্ধারিত এই দাম গত বছরের তুলনায় আবার কমবেশি ২০ শতাংশ কম। খবরে এও প্রকাশ, চামড়ার কম মূল্য নির্ধারণে মন্ত্রণালয় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার, ট্যানারি মালিকদের সংগঠন ইত্যাদির সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  

যেমনটি উল্লেখিত, এ বছর লবণ যুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকা শহরে প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০ টাকা আর ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা। গত বছর এটি ছিল ঢাকায় ৪৫-৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা। সে অনুযায়ী, কোরবানির সময় জবাই করা অন্যান্য পশু যেমন ছাগল, খাসি বা বকরি সব সবগুলোরই চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। 

আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কথা শুনে থাকি। বিশেষত ব্যবসায়িক গোষ্ঠি বা গোষ্ঠিসমূহ তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। যেমন রোজা আসলেই পেঁয়াজের সিন্ডিকেট, চাল, ডাল, চিনি, তেল এমনকি মাংসের বাজারের সিন্ডিকেট। তারা অনেকটা প্রেশার গ্রুপ। অনেক ক্ষেত্রে তারা মজুদ বা সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মুনাফা করে থাকে। পক্ষান্তরে সরকারের তরফ থেকে ভোক্তা অধিকার বা ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার নামে সরকারিভাবে কিছু দ্রব্য বাজারে সরবরাহ, বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনীর অপারেশনের মাধ্যমে মূল্য সহনীয় রাখার ব্যবস্থা করে; যদিও খুব কম ক্ষেত্রেই ফলপ্রসূ হয়। নিয়ত ভোক্তারা এটা মেনেই নিয়েছে।

প্রশ্ন হল, বাজার ব্যবস্থায় প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া কী? বাজার ব্যবস্থায় প্রকৃত বা বাজার মূল্য নির্ধারণ হয় চাহিদা আর জোগানের পারষ্পারিক দরকষাকষির মাধ্যমে। বাজারের বিভিন্ন প্রকার থাকা সত্ত্বেও পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাকেই তুলনামূলকভাবে ভোক্তাদের জন্য অনুকূল মনে করা হয়। 

সরকার ক্ষেত্র বিশেষে বাজারে হস্তক্ষেপ করে যদি তারা নিশ্চিত হয় যে কোনও একটা পক্ষের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। এরকম অবস্থা নানাভাবে নানা সময়ে সৃষ্ট এবং বিরাজ করতে পারে। সরকারের হস্তক্ষেপের প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোক্তা এবং উৎপাদক বা সরবরাহকারী উভয়ের জন্যই উত্তম বা উইন-উইন পরিস্থিতির নিশ্চয়তা প্রদান করা। সরকারি হস্তক্ষেপে কোন পক্ষ যাতে ক্ষতির সম্মুখীন বা স্বার্থ হানি না হয়, তা দেখতে হয়।

আমরা কোরবানির পশুর চামড়ার যে দর নির্ধারণ দেখি তাতে চাহিদা আর যোগানের ভারসাম্য রক্ষা হয় কি? যারা কোরবানি করেন তারা ধর্মীয় বিধি মেনে সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কেনেন এবং কোরবানি করেন। পশুর চামড়া বিক্রি করে ধর্ম প্রাণ মুসলমানেরা তা গরিব মিসকিন, অসহায় নারী পুরুষ, অভাবী লোকজন, পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে অর্থ বিতরণ করেন। তবে উল্লেখযোগ্য অংশের পশু চামড়া সাধারণত বিভিন্ন এতিম খানা, অনাথ আশ্রম, মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান সংগৃহীত চামড়া বিক্রি করে লব্ধ অর্থ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় করেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রচলিত এই নিয়মে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেন নি। সুতরাং দ্রষ্টব্য যে যদিও কোরবানির পশুর চামড়ার সরবরাহকারী আপাত দৃষ্টিতে কোরবানিকারী ধর্মপ্রাণ মুসলিম, কিন্ত এর বিস্তৃত সুবিধা পায় সমাজের একটি সুবিশাল জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় রীতি মেনে কোরবানি করা ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তাই খুব বেশি দর কষাকষির অবস্থানে থাকেন না।

পক্ষান্তরে, পশু চামড়ার ক্রেতা বা চাহিদার দিকটি সুবিস্তৃত। এখানে পশু চামড়া অনেক শিল্প পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অতি প্রয়োজনীয় জুতা থেকে শুরু করে বিলাসী জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য দেশ বিদেশের বাজারে খুবই আকর্ষণীয়। অনেক চামড়াজাত পণ্য অতি প্রয়োজনীয় বিধায় এগুলোর চাহিদা তেমন কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বাড়লে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, আগে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেত তাদের বইখাতা হাতে করে নিয়ে। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন পলিথিনের ব্যাগে করে বইখাতা বহন করত। কিন্ত বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছেলেমেয়েরা বই খাতা কাপড় বা অনেকে চামড়ার তৈরি ব্যাগে করে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায়। এটি ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির বহিঃপ্রকাশ। এসব কারণেই দেখা যায় চামড়াজাত পণ্যের বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল। তাই চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদনকারীরা বছর বছর পণ্যের দাম বাড়লে, উল্লেখযোগ্য মুনাফা করে এবং করার কথা।

তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, যে চামড়ার বাজারে কোন পক্ষ তুলনামূলক দুর্বল? উত্তর খুব সহজ, কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য থাকে কোরবানিকারী বা হকদার পক্ষ। চামড়া একদিনের জায়গায় দুদিন রাখলেই পচন শুরু হবে। দুর্গন্ধের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। প্রক্রিয়াকরণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় বা না জানার কারণে কোরবানিকারী তা যত দ্রুত সম্ভব বিক্রি করেন এবং অর্থ অংশীজনের মাঝে বণ্টন করেন। কাঁচা চামড়ার বাজারে তাই সরবরাহ পক্ষ তাই তুলনামূলকভাবে দুর্বল।

দুর্বলের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে ঠকার। কারণ দর কষাকষির শক্তি সীমিত বা ক্ষেত্র বিশেষে নাই বললেই চলে। নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের উচিত দুর্বলের স্বার্থ রক্ষা করা। এটা সত্যি যে, কোরবানিকারী ধর্মপ্রাণ মুসলিমের কেবল চামড়ার সঠিক মূল্য নির্ধারণ, প্রাপ্তি ইত্যাদির জন্য কোন সংঘ বা সিন্ডিকেট তৈরি করতে পারে না। ধর্মীয় অনুভূতি থাকায় এটি সমীচীনও মনে হয় না। পক্ষান্তরে চাহিদার অংশে ট্যানারি মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। তারা সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষের সাথে সখ্য সম্পর্ক রাখে। বাজারে কর্তৃত্ব দেখাতে অনেক সময় শক্তি ও প্রদর্শন করে থাকে। চামড়ার বাজারে সিন্ডিকেটের শক্তিমত্তার মহড়া এর আগে কম দেখা যায় নাই। সকলেরই মনে পড়বে বিগতদিনে কিভাবে তারা চামড়া না কিনে সমাজের সাধারণ ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের বিপদে ফেলেছিল।

এবারে অর্থনীতির চালচিত্র একেবারেই ভিন্ন। করোনাভাইরাসের কারণে শুধু অর্থনীতিই নয়, সমাজ বিশ্বাসেও ফাটল ধরেছে। মানুষের দুর্দশা-দুর্বিপাক এমনকি মহামারীকেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠেছে। মানুষ উচ্চমূল্যে সুরক্ষা ও জীবনরক্ষা সামগ্রী কিনতে বাধ্য হচ্ছে। কোরবানিতে এবার পশুর চাহিদা এমনিতেই কম। প্রান্তিক খামারি ও পশুপালনকারী ন্যায্যমূল্য পাবে কিনা তাতে সংশয় দেখা যাচ্ছে। 

সবদিক বিবেচনায় পশু কোরবানি কম হলে, চামড়ার সরবরাহ কম হবে। চাহিদা স্থিতিশীল ধরলে এবং সরবরাহ কম হলে, চামড়ার দাম কমার কথা নয়। বরং বাড়ার কথা। বাজার ব্যবস্থায় এটিই হওয়ার কথা। কিন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি ঠিক উলটো। স্বাভাবিক বাজার ব্যবস্থাপনার সূত্র যদি না খাটে, সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার। সরকার হস্তক্ষেপ করে যদি দুর্বলের স্বার্থরক্ষাই না করতে পারে, তাতে সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে যায়। সরকার নির্ধারিত দামে সিন্ডিকেট চামড়া কিনবে এমন ঘোষণা এলেও, বাজারকে ব্যর্থ করে দিয়ে তারা অতীতের অট্টহাসি হাসবে না সে নিশ্চয়তা আছে কি?