বাহাত্তুরে বুঁচি শর্মা মরেন নি—তবে মরবেন

কুলদা রায়
Published : 1 Oct 2012, 04:51 PM
Updated : 1 Oct 2012, 04:51 PM

নাম বুঁচি শর্মা। বয়স বাহাত্তর। এ বয়সে মানুষকে বাহাত্তুরে পায়। কথাবার্তা ঠিক থাকে না। বিস্মরণ ঘটে। সত্যজিতের ইন্দির ঠাকুরুণের বয়স এই বাহাত্তর ছিল। তার নির্দিষ্ট ঠাঁই ছিল না। তাই ঠাঁই বদলই ছিল তাঁর নিয়তি। শেষ ঠাঁই হয়েছিল বাঁশ বাগানে। দুর্গার চোখে যখন পড়ল—তখন ইন্দির ঠাকুরুণ নিত্যদিনের মত হাঁটু গুজে বসেছিলেন। ছোট্ট দুর্গা তার গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকল, পিসি? পিসি তখন হাসে নি যেমন করে নিত্য হেসে উঠত। তিনি গড়িয়ে পড়েছেন। এরপর বাঁশের কট কট শব্দ হচ্ছে। ইন্দির ঠাকুরুণকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্মশান ঘাটে। আর শোনা যাচ্ছে গগন হরকরার গান—হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যে হল পার কর আমারে।

বুঁচি শর্মা মারা গিয়েছিলেন। বাঁশবাগানের তলে নয়—ঘরের মধ্যে। আগুনে পুড়ে। সে আগুন লাগিয়েছিল উখিয়ার বৌদ্ধপাড়ায় কিছু দুর্বৃত্ত। রোববার সকালে উখিয়ার প্রশাসন নিশ্চিত করেছিল বুঁচি শর্মা মারা গিয়েছেন। পরবর্তীতে জানা গেলো বুঁচি শর্মা মারা যান নি। নতুন করে মরার জন্য বেঁচে আছেন। একটি দৈনিক লিখেছে—
বুঁচির স্বামী যতীন শর্মা আজ সকালে এক পত্রিকাকে বলেন, 'গতকাল বাড়িতে আগুন দেওয়ার সময় আমার স্ত্রী বুঁচি শর্মা ও পুত্রবধূ সবিতা শর্মা (৩২) বাড়িতে ছিল। সবিতা শর্মা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেও বুঁচি শর্মাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে রাত ১০টার দিকে পার্শ্ববর্তী বাড়ির জঙ্গলে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি ঘটনাস্থলে এসে বুঁচি শর্মাকে দেখেন। তখনো তার জ্ঞান ছিল না। রাত ১২টা পর্যন্ত তার জ্ঞান না ফেরায় এলাকায় লোকজন ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে বুচি শর্মার মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়। স্থানীয় পল্লিচিকিত্সক রাখাল চন্দ্র কর্মকার অন্য একটি বাড়িতে সারা রাত তাকে চিকিত্সা দিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারেননি। আজ সকালে বুচিকে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সকাল নয়টার দিকে একটু নড়াচড়া করলেও তার অবস্থা এখনো অপরিবর্তিত আছে।'

উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রেদুয়ান তারেক বলেন, বুচি শর্মাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে তাঁর জ্ঞান ফিরলেও আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন।

বুঁচি শর্মা একটি বৌদ্ধ পরিবারে জন্মেছিলেন। নিজে বৌদ্ধ হয়ে জন্মান নি। পৃথিবীতে কেউ কিছু না হয়েই জন্মে। পরে পরিবার অনুযায়ী কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউবা খ্রীষ্টান, কেউবা ইহুদি হয়ে মাথায় ছোট্ট কালো গোল টুপি ধারণ করে। এটাই দস্তুর। কিছু কিছু লোক পরে বয়স বাড়ার কারণে কিছু কিছু বুঝতে শেখেন। তারা ধর্ম পালটে নেন। স্বর্গের বদলে বেহেস্তে যেতে পছন্দ করেন। কেউ বা হেভেনকে বেছে নেন প্রভু যীশুর পথে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আবার কেউবা স্বপ্নে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে ধর্মান্তরিত হন। কেউবা অসুখে ভুগে নিদান পেতে বাপের ধর্ম ছেড়ে পীরের ধর্মে যান। আবার প্রেমে পড়ে প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে চার্চে বা মসজিদে গমন করেন। নামটি ইষৎ বদলে যায়। অথবা সেই একাত্তরে অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে ধর্ম পালটে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ নাস্তিক হতে ভালোবাসেন। যে কেউই যে কোনো কিছু হতে পারেন। সেটা তার ব্যক্তিগত অধিকার। সেখানে কারো বাঁধা দেওয়ার সুযোগ নেই।ইতিহাস বলে কলিঙ্গ যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ অহিংস বুদ্ধের অনুসারীর রক্তে লাল হয়েছিল ভারত ভুখণ্ডের মাটি। পালিয়ে এসেছিলেন এই মুণ্ডিত মস্তকের বৌদ্ধরা এই বাংলায়। পরে তাদের বড় অংশ অন্তজ মানুষ হিসেবে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাদের প্রধান বানীই হল-সর্বেতে সুখিনো সন্তু। সকল প্রাণীই সুখী হোক। কেউ যেন দুঃখ ভোগ না করে।

জীবনের দুঃখ নিবারণের উপায় জানার জন্য গৌতম রাজত্ব ত্যাগ করেছিলেন। স্ত্রীপুত্র ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এক অশ্বত্থ গাছের নিচে বার বছর সাধনা করেছিলেন। বোধীত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি ঈশ্বরের ধারণাটা তার ধর্মে রাখেন নি। তিনি জীবনে নির্বান লাভ করার কথা বলেছেন।

মাঝে মাঝে তুচ্ছ লোভে পড়ে অনেক কিছুতেই আমরা গোলমাল পাকিয়ে ফেলি। আমাদের স্বাভাবিক জ্ঞান-বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করে না। আমরা অনেকের দুঃখের কারণ হয়ে পড়ি। বুদ্ধের আপত্তি এখানেই। এ কারণে নির্বানের কথা বলেছেন বুদ্ধ। তিনি বলেছেন ''কাজ করে কাজের ছায়া না পড়াই নির্বান। অনেকটা গীতার কর্মফল ত্যাগের মতন। আমি একটা কাজ করলাম। অনেক কিছু আশা করলাম না–এমন। আকাঙ্খা থেকেই দুঃখের শুরু। বুদ্ধ বলেছেন-From passion and desire, Sensuousness and lust, Arise grief and fear.এই কারণেই বুদ্ধ চেয়েছিলেন পৃথক একটা সংঘ (গ্রুপ বা মঠ) গড়ে তুলতে। যে সংঘের আলোকিত সদস্যরা সুন্দর সৎ ও নির্মল জীবন যাপন করবে। সংসারের মানুষ তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হবে। সংসার বদলে যাবে।'' তুচ্ছ লোভে পড়ে সংসারের মানুষজন অযথা গোলমাল পাকিয়ে ফেলবে না।

না, বুদ্ধের সদিচ্ছা সফল হয়নি! মানুষের লোভটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই লোভ থেকেই অহংবোধ সৃষ্টি হচ্ছে। অহংবোধের সঙ্গে মুর্খতা আর মুঢ়তা যখন যুক্ত হয় তখন মানুষের মনে শ্রেষ্ঠত্বের জেদ জেগে ওঠে।শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার সঙ্গেই ঘৃণা লুকিয়ে আছে। এ কারণেই অযোদ্ধায় মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে, সাতক্ষীরায় হিন্দু-পাড়া আগুনে পুড়েছে, রামুতে অহিংস বুদ্ধের মাথায় বাড়ি পড়ছে।

এই ঘৃণা লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে মেরেছে, খ্রীষ্টানকে প্রাণহীন করেছে। মুসলমানের দেহ ট্রেনে পুড়িয়েছে। হিন্দুকে মেরে বেহেস্ত কনফার্ম করেছে।বুদ্ধের অনুসারীদের ঘোষণা দিয়ে মারছে।এই শ্রেষ্ঠত্বের সর্বগ্রাসী ঘৃণা ঈশ্বরকে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

অথচ ঈশ্বর হিন্দুকেও সৃষ্টি করেছেন, মুসলমানকেও পয়দা করেছেন, খ্রীস্টানকে ক্রিয়েট করেছেন। ইহুদী ও বৌদ্ধকেও তিনিই নির্মাণ করেছেন। সবারই একটি করে মাথা, দুটি পা, দুটি হাত, দুটি কান, একটি মুখ। একটি প্রাণ। সবারই রয়েছে ভালোসার জন্য অমিত ক্ষমতাধর হৃদয়। সবার জন্যই নির্ধারিত রয়েছে মৃত্যু। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান কোথায়? ঘৃণার ধারণাটি কিভাবে জাগে?


বুঁচি শর্মার ঘরে আগুন দেয়া হল কেনো? তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হল কেনো? তিনি কী এই বাহাত্তুরে কারো পাকা ধানে মই দিয়েছিলেন? তিনি কি ফেসবুকের নাম শুনেছেন? তিনি কি ফেসবুকে লিখে ক্রুশেডের ডাক দিয়েছিলেন? ফেসবুক থেকে অস্ত্র হাতে লাফিয়ে পড়ে কারো টুটি চেপে ধরেছিলেন? না, বুচি শর্মা এসব কিছুই করেননি। তিনি কিছুই জানেন না। জানার কথাও নয়। ঘটনাটির শুরু হয়েছিল রামুতে। কিন্তু আদতে রামুতেও নয়– ফেসবুকে।

উত্তম কুমার বড়ুয়া নামে একজন লোক ফেসবুকে সামাজিক নেট-ওয়ার্কে যুক্ত আছেন। মাঝে মাঝে স্টাটাস দেন। নিজের ছবি দেন। গানটান শেয়ার করেন। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেন। চ্যাট করেন। ফেসবুকের নিয়ম অনুসারে কারো নোটে লাইক দেন। কিছু বিষয় শেয়ার করেন। আবার কিছু বিষয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ওয়ালে যুক্ত হয়ে পড়ে। এটা একটা ভার্চুয়াল জগত। ঘরে বসে বিশ্বের সঙ্গে যোগ দেওয়া যায়।

সেই লোকটির ওয়ালে একটি লিঙ্ক শেয়ার হয়েছে। এটা ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরাণ অবমাননা সংক্রান্ত লিঙ্ক। উত্তম বড়ুয়া বলেছেন এটা তিনি করেননি। অন্যের পোস্ট থেকে চলে এসেছে।

এই সূত্র ধরেই উত্তম কুমারকে সনাক্ত করা হয়েছে, তিনি মানুষ নন, তিনি বৌদ্ধ। সুতরাং এই অবমাননার দায় বৌদ্ধ ধর্মের উপরেই বর্তায়। সুতরাং ক্ষুব্ধ লোকজন মোবাইলে তড়িৎবেগে এলাকাতে এই ঘটানাটি জানিয়ে দেয়। লোকজন এই ভাদ্রের রাতে হাজির হয়। মিটিং করে। আক্রমণ করে রামুর বৌদ্ধ পাড়ায়। সে পাড়ায় মহুর্তের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সারা রাত ধরে উল্লাস করে একটি ধর্ম গ্রন্থের অবমাননার শোধ নিতে আরেক ধর্মের লোকজনের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুটপাট করা হয়। মানুষকে ধরে নির্যাতন করা হয়। লোকজন পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। তাদের মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শতহাত উঁচু বুদ্ধের নিরীহ নির্বান মুর্তিকেও আগুন লাগানো হয়। ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পটিয়াতে। উখিয়াতে। এর মধ্যে বুচি শর্মাকে শুদ্ধু ঘরে আগুন লাগানো হয়েছে। একই সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে কিছু হিন্দু মন্দিরেও। খ্রীস্টানরাও ভয়ে ভয়ে আছে।

বুচি শর্মা সাত চল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ধর্মের নামে অনাচার দেখে দেখে একাত্তরেও বেঁচে গিয়েছেন মরে যেতে যেতে। স্বাধীনতার পরে হাফ ছেড়েছিলেন এই ভেবে যে–এই দেশটা আর কোনো ধর্মের নামে নির্যাতন চলবে না। এখানে থাকবে ধর্ম যার যার—রাষ্ট্র সবার। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।

কিন্তু সেটা বাস্তবে হয়নি। এর মধ্যে বুচি শর্মা বাহাত্তরে পৌঁছে গেছেন। এই এতকাল পরে তিনি দেখতে পেলেন আগুনে পুড়ে মরে যাওয়ার কালে—এখানে রাষ্ট্র সবার নয়। রাষ্ট্র সেই পাকিস্তানের ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। শাসন ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেনো তারা কোনো না কোনো ভাবে দেশকে ধর্মান্ধতার কালো অন্ধকারের দিকে একটু একটু করে ঠেলে দিচ্ছে। কারো কোনো দ্বায়িত্ব নেই শুভবোধের প্রতি। দ্বায়িত্ব নেই– সংবিধানের প্রতি, মানুষের প্রতি।

ফলে সেই সাম্প্রদায়িক আক্রমণগুলো দিনের পর দিন বাড়ছে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে। রাষ্ট্রোটি আর নাগরিকের নয়—হয়ে উঠেছে কোনো একটি ধর্মের। পুষ্ট হচ্ছে ধর্মান্ধতা। নির্বাচনের আগে বা পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রাণের কোনো মুল্য থাকছে না। তারা হয়ে উঠছে কলে পড়া ইঁদুর। পুর্ণিমা নামের একটি সদ্য কিশোরীকে ধর্ষণ করতে আসা কিছু লোকজনকে ঠেকাতে না পেরে তার মাকে বলতে হচ্ছে, বাবারা, আমার মেয়েটি ছোটো। তোমরা এক সঙ্গে এসো না, সে তাহলে বাঁচবে না। —একজন একজন করে আসো।

এবং বুচি শর্মা বাহাত্তুরে এসে আগুনে পুড়ছেন ধর্মের বলি হয়ে। তিনি মারা যাননি। তবে মারা যাবেন। বেঁচে থেকে তিনি আর কোন নির্বান লাভ করবেন এ জীবনে?

এই যে ধর্মের নামে যে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনটা চলছে, তার বলি হয়ে ইতিমধ্যে গত দশ বছরে এদেশ ছেড়ে ৯ লক্ষ হিন্দু দেশত্যাগী হয়েছেন সরকারী পরিসংখ্যানের হিসেবে। বাস্তবে তো আরো বেশি দেশত্যাগী হয়েছে।

এই সাম্প্রদায়িক ঘটনা যারা ঘটায় তাদের সংখ্যা কিন্তু বেশী নয়। তারা অল্প। কিন্তু অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা-বিচার-রাষ্ট্র তাদের পক্ষে। এ কারণে এই অল্প সংখ্যক দুর্বৃত্তরাই পুর্ণিমাকে নানা সময়ে ধর্ষণ করছে। বুচি শর্মাকে আগুনে পোড়াচ্ছে। এবার বুচি শর্মা বেঁচে রয়েছে। আগামী আগুনে বাঁচবে না। ডাক্তার আসিবার পুর্বেই কয়লা হয়ে যাবে।

এক বন্ধু বললেন, আমাদের মত দেশের মানুষের যে বুদ্ধিবৃত্তিক লেভেল আছে তাতে তাদের মোবাইল-ফেসবুকের মত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মত উপযুক্ততা গড়ে উঠেনি। তারা মানুষকে বাঁচাতে নয়—মানুষকে মারতেই এই প্রযুক্তিগুলি ব্যবহারে মগ্ন আছে। এটা কঠিন কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু কঠিন কথাই তো সত্যি হয়ে হানে আমাদের বুকে যখন দেখি এই মোবাইল ব্যবহার করে সাতক্ষীরার একটি নাটকের কারণে কয়েকদিন ধরে হিন্দু পাড়া পোড়ানো হল। উৎসব করে সে আগুন উপস্থিত সবাই দেখেছে। সে আগুন গিয়ে পড়েছে দিনাজপুরে। দিনাজপুর থেকে রামুতে।

কোরান, বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটক—এগুলো সবই পবিত্র পুস্তক। এই বিশ্বাসের জগতে এই পবিত্র গ্রন্থকে অবমাননা করা ঠিক নয়। ঠিক নয় মুভি বানিয়ে নবী করিমকে অপমান করা। ঠিক নয় জাকির নায়েকের মত টেলিভিশনে অন্য ধর্মের অবমাননা করে প্রোগ্রাম করা। যে কোনো বিশ্বাস যখন কাউকে কোনো ধরনের আঘাত না করে, অপমান না করে, অশ্রদ্ধা না করে, ঘৃণা না করে–অন্যের বিশ্বাসকে যুক্তি-তর্ক-প্রমাণ সহযোগে শান্তিপুর্ণ উপায়ে খণ্ডন করে তাতে কোনো সমস্যা থাকে না। সেখানে তর্কের মাধ্যমে নতুন বিশ্বাসের জন্মের সুযোগটি ঘটে। এভাবেই আমাদের চিন্তার-ভাবের-সভ্যতার বিকাশটি ঘটে। বিশ্বাস পালটে যাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এটাই নিয়ম। কিন্তু বিশ্বাসকে সভ্য চিন্তা পদ্ধতির মাধ্যমে খণ্ডণের চেয়ে অযৌক্তিকভাবে-ঘৃণা সহযোগে-জীঘাংসা বশত বিশ্বাসীদের প্রাণ যখন বিপন্ন করে তোলে– তখন সমস্যাটি হয়ে যায়। তখন যে বিশ্বাসের হয়ে আরেকটি বিশ্বাসের অনুসারীদের অবমাননা করা হয়—তখন নিজের বিশ্বাসটিকেই আগে অবমাননা করা হয়। আরেকজনের অসভ্যতাকে রুখতে গিয়ে আরেকটি অসভ্যতার জন্ম দেয়ার মধ্যে দিয়ে নিজের অসভ্যতাকেই উন্মোচন করে দেয়। যে অপরাধের জন্য অন্যকে অভিযুক্ত করছি সে অপরাধটি আমি করতে পারি না। এটা মনে রাখলে অনেক সমস্যাকে এড়ানো সম্ভব।

তাহলে বুচি শর্মাকে কে বাঁচাবে? পুর্ণিমাকে কে রক্ষা করবে? রাষ্ট্র করবে। রাষ্ট্রেরই দ্বায়িত্ব তার সংবিধানকে মান্য করা। নাগরিকের অধিকারকে নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রে বাকস্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু সেই বাকস্বাধীনতার কারণে অন্যের বাকস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করা থেকে বিরত রাখবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত যাতে না হতে পারে সে ব্যবস্থা নেবে রাষ্ট্র। না হলে রাষ্ট্রকে পোষা হচ্ছে কেনো?

এটা কিভাবে সম্ভব? সম্ভব। রাষ্ট্রে প্রয়োজনীয় আইন থাকতে হবে। সেই আইন প্রয়োগটি হতে হবে কঠোরভাবে। আইনের শাসন ব্যবস্থা কেতাবে নয়–বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এই রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রের চোখে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, ধনি, গরীব, চেয়ারম্যান, মেম্বর, এমপি, মন্ত্রি, রাষ্ট্রপতি সবাই-ই সমান। কেউ কারো মামু, খালু, ভাই বেরাদর নয়। রাষ্ট্রের কাছে কোনো মানুষের পরিচয় মুসলমান/ হিন্দু/ খ্রীস্টান/ বৌদ্ধ নয়—রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক। রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে তার নাগরিককেই চেনে। নাগরিকের অধিকারকে নিশ্চিত করে। রাষ্ট্র যদি অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করে–তাহলে অপরাধ কমে যাবে। আর শাস্তির বদলে মাফ করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে তাহলে অপরাধ বেড়ে যাবে। পুর্ণিমার সংখ্যা বেড়ে যাবে। বুচি শর্মা বারবার আগুনে পুড়বে। যে কেউই যে কোনো নাগরিককে কোনো ধরনের অবমাননা করার দুঃসাহস পাবে।

এইখানে এসেই প্রশ্ন জাগে এই দেশে পাকিস্তান আমলের কথা বাদই দিলাম—সেটা ছিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ তো ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে সেই সাম্প্রদায়িকতাকে কবর দিয়েই জন্ম নিয়েছে, তাহলে—এই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হচ্ছে কেনো? উত্তর খুব সোজা। রাষ্ট্র এই সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের কোনো ঘটনারই বিচার আজো অব্দি করেনি। কাউকে শাস্তি দেয়নি। শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেনি। দিলে নতুন করে বুচি শর্মাকে বাহাত্তুরে এসে আগুনে পুড়তে হত না।

কুলদা রায়: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক ।