নারী, তোমার চোখেই সজ্জিত হয়ে আছে এই বিশ্ব: বিসেন্তে উইদোব্রোর কবিতা

তাপস গায়েন
Published : 30 Dec 2014, 04:13 PM
Updated : 30 Dec 2014, 04:13 PM

কবি এবং কবিতা পরিচিতি

"আমাকে দিয়েই সমসাময়িক কবিতার শুরু," এই ভাষ্যে চিলির আত্মপ্রত্যয়ী কবি বিসেন্তে উইদোব্রো (১৮৯৩-১৯৪৮), যিনি প্রতিকবিতার (এণ্টি পোয়েট্রির) প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে তার জনক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন চিলির আর এক স্বঘোষিত প্রতিকবি (এণ্টি পোয়েট) নিকানোর পাররা থেকে; এবং কবিতায় "ক্রিয়েশনইজম" তত্ত্বের প্রবর্তক হয়ে কবি উইদোব্রো লিখে যাবেন, "কবিতার বড় বিপদ হোল তার কাব্যিকতা ।" এবং তাঁর এপিটাফে উৎকীর্ণ হবে, "এইখানে শুয়ে আছে কবি বিসেন্তে উইদোব্রো/ উন্মোচন করো এই কবর/ তুমি দেখবে সমুদ্র এই সমাধি গভীরে ।"

অালোনসো দে আরসিলা'র 'লা আরাউকানা'র প্রকাশের তিনশ বছর পরে প্রশান্ত মহাসাগরবিধৌত আন্দেস পর্বতমালার এই দীর্ঘ ক্ষীণভূমি, যে দেশটিকে আমরা চিলি নামে জেনেছি, কবি বিসেন্তে উইদোব্রো ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর "জলের দর্পণ" এবং ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর "আলতাযর" কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে সেই দেশটিকে স্বাধীনতা-উত্তর লাতিন-আমেরিকার কবিতাবিশ্বে অগ্রণী করে তুলবেন । [১]

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাসা রিয়েলের মার্কেসে বিসেন্তে উইদোব্রোর জন্ম, বেড়ে উঠেছেন চিলির সান্তিয়াগোতে, বৈভব এবং প্রাচুর্যের মধ্যে, এমন এক গৃহে যেখানে চুরাশিজন গৃহকর্মীর সমাবেশ ছিল । প্যারিসে গিয়ে হাজির হয়েছেন তেইশ বছর বয়সে, ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে ; ইতোমধ্যে যিনি লিখে ফেলেছিলেন সাতটি কাব্যগ্রন্থ । জীবনের বাকি ত্রিশ বছর থেকে গেছেন সাহিত্যের উন্মাদনায়:

তিনি লিখেছেন স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষায়; লিখেছেন কবিতা, উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্র সমালোচনা, মেনিফেষ্টো, রাজনৈতিক নিবন্ধ, এবং প্যাম্পফ্লেট ; যৌথ কবিতা লিখেছেন ফরাসী কবি ম্যাক্স জেকবের সাথে এবং হ্যান্স আর্পের সাথে লিখেছেন উপন্যাস । কোনো কোনো বছর তিনি প্রকাশ করেছেন চারটি থেকে পাঁচটি বই । তরুণ বোর্হেসের সাথে মিলে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য-সঙ্কলনের কাজ । 'ফুটবল' নামে এক অপেরা (=যাত্রাপালা) লিখেছেন, যাতে অভিনয় করেছেন দিয়াগিলেভ, যার সুরস্রষ্টা ছিলেন ষ্ট্রাভিনস্কি, যার মঞ্চসজ্জা করেছেন রবার্ট ডিলাইনি ; সোনিয়া ডিলাইনি তার কবিতা নিয়ে পোশাক তৈরি করেছেন ; এডগার ভারসিজি যাতে সুর দিয়েছেন ; পাউন্ড যাকে অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যা তিনি কখনো করেন নি । তিনি ফরাসী কপি পিয়ের রেভারডি, এপোলিনিয়র, ত্রিস্তাঁ জারা এবং পেরুর কবি সেসার বাইয়েহোসহ প্রমুখের সাথে মিলে করেছেন অসংখ্য ক্ষণস্থায়ী লিটল ম্যাগাজিন । শিল্পী হুয়ান গ্রিস, পাবলো পিকাসো, এবং তোররেস গার্সিয়া প্রমুখ তাঁর প্রতিকৃতি এঁকেছেন ; তিনি যে পিস্তল ছুঁড়ছেন, তার শুটিং করেছেন অ্যার্প ; রবার্ট ডিলাইনি তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন ; আপন কবিতার চিত্রাঙ্কনের প্রদর্শনী বার্লিনে বাধিয়েছে লঙ্কাকাণ্ড । পরাবাস্তববাদের দলনেতা আঁদ্রে ব্রেতোঁ, ফিউচারিস্ট কবি মারিনিত্তি, কবি-লেখক-চিত্রশিল্পী কক্‌তো, এলুয়ার, সেতি, সোয়েনবার্গ, ব্রাক, পিকাবিয়া, রিবেরা, লিপশিটজ, লেজার–এঁরা বন্ধু থেকে শত্রু কিংবা শত্রু থেকে বন্ধু হয়েছেন । তিনি দ্বন্দ্বমূখর ছিলেন লোরকা এবং বুনুয়েলের সাথে ; গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের জন্য প্রচারপত্র লিখেছেন ; ফ্রন্টলাইনে যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখেছেন । অসংখ্য মানহানিকর প্রেমে জড়িয়ে পড়েছেন। উএসএর সাম্রাজ্যবাদিতার বিরোধিতার নিমিত্তে চিলি, বলিভিয়া, উরুগুয়ে এবং প্যারাগুয়ে নিয়ে এন্দেসিয়া নামে গড়তে চেয়েছেন নতুন এক রাষ্ট্র । [২]

তাঁর ঘটনাবহুল এবং রঙধনুময় জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ফ্রান্সে সাংবাদিকতায় নিযুক্ত ছিলেন । দুইবার যুদ্ধাহত হন এবং মিত্রবাহিনীর সাথে বার্লিনে প্রবেশ করেন, এবং যুদ্ধজনিত ক্ষত নিয়ে তিনি মারা যান জানুয়ারির ২ তারিখে, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে, তাঁর পঞ্চান্নতম জন্মদিনের দুইদিন আগে । "আমাকে দিয়েই সমসাময়িক কবিতার শুরু,"– কবি উইদোব্রোর এই দাবি কোনো অতিশয়োক্তি নয় ; তাঁর ক্রিয়েশন-তত্ত্বে তিনি ঈশ্বর-নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিন্যাস্ততার বিপ্রতীপে, সকল টাইম এবং স্পেসের বাইরে গিয়ে, কবিতায় প্রকৃতির নতুন বিন্যাস দেখতে চেয়েছেন, তাই মৌমাছি ফুলকে নয়, বরং ফুল মৌমাছিকে শুষে- এই কাব্যবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হতে চেয়েছেন ! তিনি তাঁর "আলতাযর" কাব্যগ্রন্থে নিজেকে শতাব্দীর একমাত্র কবি হিসেবে দাবী করে, নেরুদার প্রকৃতি-উদ্ভুত ইমেজারির কাব্যপ্রতিভাকে আংশিকভাবে হলেও প্রত্যাখান করেছেন । একইভাবে উইদোব্রো নিজেকে প্রতিকবি দাবী করে তাঁর সময়ের অন্য সকল কবিকে নাকচ করতে চেয়েছেন । চিলির দুই প্রধান কবি পাবলো নেরুদা এবং পাবলো দে রোকা'র সাথে তাঁর দ্বন্দ্বমুখর সম্পর্ক ছিল । তাদের এই বিবাদে চিলির স্বঘোষিত প্রতিকবি নিকানোর পাররা সবক্ষেত্রে তাঁর গুরু উইদোব্রোকে সমর্থন জানিয়ে গেছেন । নিকানোর পাররা দাবি করেন, "উইদোব্রোহীন চিলির কবিতা নেরুদার সনেট এবং গীতিকবিতা এবং পাবলো দে রোকার বিলাপ এবং সন্তাপে পর্যবসিত হোত, যা কোনোভাবেই বাস্তবতার বিপ্রতীপ অনুধ্যানে আগ্রহী হোত না, যেমন, "যে ঘোড়া হেঁটে যায়, সে কেবলি দীর্ঘতর হয়ে ওঠে ।" [১]

কবি বিসেন্তে উইদোব্রোর শ্রেষ্ঠ কাজ, "আলতাযর" শুরু হয়েছে যুদ্ধের ধ্বংসাবশের পটভূমিতে, ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কবিতাটির নামকরণ দেখা যায়, কিন্তু কবিতার কোনো খসড়া ছিল না তখনও । সাত সর্গে বিভক্ত এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে । আলতাযর [alto (আলতো) = উঁচু ; azor (এযর) = ঈগল] ইউরোপীয় সভ্যতার "এরোমেনিয়ার" তুমুল কাব্যিক উদ্ভাসন, যে উন্মাদনার শুরু হয়েছে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে উইলবার রাইটের আগমনে (ফ্রান্স সরকারের অনুরোধে) এবং পরবর্তী বছর ল্যুই ব্লেরিয়র ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার মধ্যে, উড়োজাহাজে আরোহনের পরে মারিনিত্তির উচ্ছ্বাস, "হোমারের বাক্যাকৃতির বদল এবং ল্যাটিন বাক্যের অনুসরণের কারাগার থেকে মুক্তি;" এই কবিতা লেখাকালীন যিনি অনুচ্চারিত থেকে গেছেন, তিনি হলেন লিন্ডবার্গ, বহু উর্ধে উড্ডীন এষ্ট্রোনট, যিনি বিংশ শতাব্দীর ক্রাইষ্ট, যেখানে এয়ারক্রাফট হোল ক্রুশ, কিন্তু তা সন্তাপের নয়, বরং উড্ডয়নের ! [২]

আলতাযর, যিনি এষ্ট্রোনট, তিনি প্রকৃতপক্ষে নীৎশের অতিমানব, যিনি আমাদেরকে নিয়ে চলছেন চাঁদ, নক্ষত্র ছাড়িয়ে আইনেষ্টাইনের স্থানসময় কাঠামোতে । আলতাযর তুমুল পতনের এক কবিতা, কিন্তু এই পতন পৃথিবীর দিকে নয়, বরং আউটার স্পেসে ! অনেক সমালোচক একে ইকারুস মিথের সমাঙ্গ ভেবেছেন । সাত পর্বে বিভক্ত এই দীর্ঘ কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে এলিয়ট ওয়াইনবার্গ স্প্যানিশ ভাষায় "আলতাযর" কাব্যের কোনো মূল টেক্ট পান নি, এমনকি সন্ধান পান নি কোনো অথেনটিক সূত্র ! তাই তিনি এর অনুবাদে সবরকম স্বাধীনতা নিয়েছেন, সে আলোচনা এখানে অসমাপ্ত থেকে গেল ।

আলতাযর/ অথবা প্যারাশ্যূটে ভ্রমণ (দ্বিতীয় সর্গ)

নারী, তোমার চোখেই সজ্জিত হয়ে আছে এই বিশ্ব
তোমার সম্মুখে উচ্চতর হয়ে ওঠে আকাশ
গোলাপ থেকে গোলাপে ব্যাপ্ত এই পৃথিবী
এবং বাতাস বিস্তৃত হয়ে আছে ঘুঘুদের ডানায়

তোমার থেকে প্রস্থান নিয়ে তোমার স্থানে রেখে আসি নক্ষত্র
অপসৃয়মাণ জাহাজের মতো তোমার আলো নিভে আসে
এবং আমার আনন্দিত গান বিশ্বস্ত এবং বিষণ্ণ সাপের মতো
তোমাকে অনুসরণ করে,
কোনো এক নক্ষত্রের পিছন থেকে যখন তুমি উঁকি দাও

মহাকাশে কি সেই সংগ্রামের উন্মাদনা ?
নক্ষত্রের মধ্যে আলোর সেই বল্লম
দানবীয় বর্মের সেই দীপ্তি
কোন্‌ রক্তপিপাসু নক্ষত্র আছে বশ্যতার অনীহায় ?
যেখানেই তুমি আছো অসুখী স্বপ্নচর,
অসীমের অনুমোদনকারী
যেন তুমি হেঁটে যেতে পার ভেদ করে স্বপ্নের অরণ্য

জনহীন সমুদ্রে আমি আছি নিরুদ্দিষ্ট
একাকী, যেন রাতের গভীরে পাখির পালক পতন
আমি আছি এইখানে শীতের টাওয়ারে
স্মৃতিতে ব্যাপ্ত সমুদ্রগামী তোমার ঠোঁট
ব্যাপ্ত আছে স্মৃতিতে তোমার চুল, আনন্দিত তুমি
প্রবহমান উজ্জ্বল যেন পাহাড়িয়া স্রোত
পুনরায় আমি প্রশ্ন রাখি তুমি কি থেকে যাবে অন্ধ
যার জন্য ঈশ্বর দিয়েছেন তোমাকে ঐ হাত

তোমার ঐ বক্র ভ্রুযুগল দু'চোখের সৈন্যদের জন্য বেঁধে দিয়েছে সেতু
বাতাসে জয়োৎসব ফুলের অহংকারে বন্দী
আমার হয়ে তোমার সাথে কথা বলে পাথরে উচ্চকিত শব্দ
আকাশহীন পাখির তরঙ্গ আমার হয়ে তোমার সাথে কথা বলে
আমার হয়ে তোমার সাথে কথা বলে বায়ুশূন্য ভূচিত্রের বর্ণ
তোমার স্মৃতিতে ঘুমিয়ে আছে বাকরুদ্ধ ভেড়ার পাল
অবারিত প্রবাহ আমার হয়ে তোমার সাথে কথা বলে
উদ্বর্তিত ঘাস দুঃসাহসিকতায় লিপ্ত,
দিগন্তের দুঃসাহসিকতায় স্পর্ধিত আলো এবং রক্ত
অরক্ষিত একটি ফুলের মতো যা
সামান্য বাতাসে উড়ে যায়

তোমার ভঙ্গুর চাহনিতে হারিয়ে যায় প্রেইরি
দৃশ্যমান তোমার গতিতে লুপ্ত হয়ে আসে পৃথিবী
তোমার উপস্থিতিতে প্রতিটি জিনিষ হয়ে ওঠে মেকি
দ্যুতিময় তোমার ভয়ঙ্কর আলোয়
বিস্মৃতিবিলুপ্ত ক্লান্তিহীন এই নিষ্পাপ ঐক্য
নিস্তব্ধতা এবং সমুন্নত ভয়ে উদ্ভুত
ধাবমান অন্তর্মুখী এই অশ্রুবিন্দু

তুমি সময়ে উৎকীর্ণ করো দ্বিত্বতা
এবং আকাশে ব্যাপ্ত অসীমতার অনুভব
যা কিছু তোমার থেকে দূরে তাই যেন নশ্বর
রাতে অপমানিত পৃথিবী থেকে তুমি নিক্ষিপ্ত করো সব যন্ত্রণা
এসবই তাদের জন্য যারা মনে করে তুমি আস্বাদন পেয়েছ চিরন্তনের

এই যে তোমার অপসৃয়মাণ নক্ষত্র
ক্লান্তিকর দূরত্বে তোমার নিশ্বাসপ্রশ্বাস
তোমার ভঙ্গী এবং যেভাবে তুমি হেঁটে যাও
তোমার চুম্বকবলয়িত ভূমি যা তোমাকে জানায় অভ্যর্থনা
এবং এই সেই অসংখ্য রাত যা আমাদেরকে করে পৃথক

তথাপি তোমাকে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে
আমরা একই নক্ষত্রে গ্রথিত
একই সঙ্গীত যা আমাদেরকে বেঁধেছে
তারই বিস্তৃতি একজন থেকে অন্য জনের দিকে
সেই দীর্ঘ ছায়া যা বৃক্ষের মতো দুলে ওঠে
আমরা হয়ে উঠি সেই এক চিলতে আকাশ
সেই বৃক্ষকাণ্ড যেখানে অদ্ভুত অভিযান পার হয়ে যায়
গ্রহের অভিযান বিস্ফোরিত হয় স্বপ্নের পাপড়ি হয়ে

আমার প্রশংসার প্রাচীর টপকে যাবার নিমিত্তে
নিরর্থক তুমি এড়িয়ে যেতে চাও আমার কন্ঠস্বর
আমরা একই নক্ষত্রে গ্রথিত
তুমি বাঁধা পড়ে আছো রাতের পাখির সাথে, চাঁদের নাইটেংগেলে
যে পাখির গলায় উচ্চারিত হ্য় যজ্ঞের একটি পবিত্র রীতি

আমাকে ব্যাপ্ত রেখে আমার বুকে প্রতিধ্বনি তোলে রাতের চিহ্ন
মাটির গভীরে তার শেকড়, আর অন্তেষ্টিক্রিয়া
আমাকে ভাবায় উজ্জ্বল প্রহেলিকা এবং প্রতীক যা
উৎকীর্ণ করে আকস্মিকতা এবং সেইসব দীপপুঞ্জ
যাদের ভাগ্যহীন যাত্রা আমার চোখের বিশৃঙ্খলায়
স্পেসের মধ্যে ফুলের উৎকন্ঠা আর অস্তিত্বহীনতার
নাম নিয়ে আমি অনুক্ষণ ভাবি
অগণিত মরুভূমির নাম
কিংবা ইচ্ছা কিংবা আকস্মিকতা যা এটি প্রকাশ করে
কিংবা এই মরুভুমিতে প্রতিটি নক্ষত্র ব্যক্ত করে একটি মরূদ্যান
কিংবা প্রকাশ করে দুঃসংবাদ এবং মৃত্যুর ব্যানার

তোমার নিশ্বাসপ্রশ্বাসই আমার জলহাওয়া
তোমার চাহনির অবিশ্বাস্য নিরাপত্তায় নিহিত গ্রহপুঞ্জের সখ্য,
যেখানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে নিজস্ব বীজের ভাষা
তোমার উদ্ভাসিত মুখাবয়ব যেন ঈশ্বরের বৃত্তায়িত জ্যোতি
আকাশে প্রস্ফূটিত লতাগুল্মের চেয়ে অধিক স্থায়িত্বে যা বিদ্যমান
ঘূর্ণাবর্তহীন মহাবিশ্ব, আনত এক অশ্বের মতো
বাতাসে দেখে নিচ্ছে নিজের ছায়া
পুনরায় আমি প্রশ্ন রাখছি
ঈশ্বর যে তোমাকে ঐ চোখ দিয়েছেন তারই জন্য কি তুমি থেকে যাবে নির্বাক ?

তোমার কন্ঠস্বর আনে আমার পরিপূর্ণ নিরাপত্তা
হৃৎপিণ্ড স্পন্দনে তোমার থেকে উদ্ভুত কণ্ঠস্বর
যার মধ্যে ঝরে পড়ে মহাকাল, এবং
চূর্ণ হয়ে রূপান্তরিত হয় দীপ্তিময়ী ফসফরাস পুঁতিতে
তোমার জন্ম না হলে আমার জীবন কেমন হত ?
আবরনহীন এক ধুমকেতু যার মৃত্যু হয় শীতে

বিস্মৃত কোনো বইয়ের পাতায় তোমার নাম, আমি পেয়েছি তোমাকে
অশ্রুবিন্দুর মতো, বুকে জেগে আছে বোবা কষ্ট
পায়রা উড়ে যাবার শব্দে জেগে ওঠে তোমার নাম
তুমি বয়ে নিয়ে চলেছ অন্য কোনো উচ্চতর জীবনের স্মৃতির বৈভব
কোথাও সন্ধানপ্রাপ্ত এক ঈশ্বরের
এবং তোমার সত্তার গভীরে তুমি উচ্চকিত করো যা তুমি ছিলে
যেন কবির চাবির গোছায় বিগত বছরের পাখি

জলমগ্ন স্বপ্নে আমি দেখি স্বপ্ন
তোমার দীর্ঘ চুলের বিনুনীতে জন্ম হয় দিনের
রাতের জন্ম হয় যখন আলগা হয়ে আসে তোমার দীর্ঘ চুল
শূন্যতার গভীরে জীবন দেখে নেয় নিজেকে
এই পৃথিবীতে শুধু তোমার চোখই সজীব
একমাত্র এই নভোমণ্ডল যার কোনো জীর্ণতা নেই
উচ্চতায় নোঙ্গর করেছে সাবলীল ত্বক
সকল জাল এবং কৌশল থেকে মুক্ত
তারই নিজের আলোর শক্তিতে পূর্ণ
যেহেতু তুমিই পরিমাপক প্রতিটি জিনিষের
তাই তোমার পশ্চাতে শঙ্কা অনুভব করে এই জীবন
তোমার যাবার পথে এই বিশ্ব হয়ে ওঠে রাজকীয়
জেগে ওঠে আকাশ থেকে অশ্রুপতনের ধ্বনি
আমার ঘুমন্ত সত্তা থেকে যখন তুমি মুছে ফেলো
বেঁচে থাকার অনুভবের তিক্ততা তখন
আমার কাধের উপর লঘু হয়ে ওঠে এই বিশ্ব


তোমার চুলে প্রবাহিত বাতাসগুঞ্জন শ্রবণের আনন্দ
(যা আমি বহুদূর থেকে অনুমান করি)
যখন জাহাজের ফাউন্ডার এবং নদী প্রবাহিত পতিত গাছ বরাবর
ঝড়ের মধ্যে তুমি তখন অস্তিত্বের প্রদীপ
বাতাসে উড্ডীয়মান তোমার চুল
তোমার চুল যেখানে সুন্দর স্বপ্নের নিমিত্তে সূর্য ছুটছে সেখানে
এই বিশ্বের গালিচায় তোমাকে দেখার আনন্দ যেন
তন্দ্রাচ্ছন্ন রাজকুমারীর হাত
তোমার চোখ যার মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সুগন্ধি পিয়ানো
সহসাই যেন শরীর জুড়ে অবসাদ
একটি ফুল এখন আর ছড়ায় না সুগন্ধ
তোমার চোখ সম্মোহিত করে নির্জনতা
যেভাবে সংঘর্ষের পরে চাকা থেকে যায় ঘূর্ণায়মান

জলের পাটাতনে সঞ্চারণশীল আলোকরশ্মি যা তুমি
কান পেতে শুনতে থাকো, তাকে দেখার আনন্দ
এবং দীর্ঘক্ষণ যাবৎ তুমি যে থাকো নিরালম্ব
সমুদ্রের চালুনি ভেদ করে পার হয়ে যায় হাজারো নক্ষত্র
যেন কোনো কিছুরই নেই এতো আবেগ
কোনো মাস্তুল আকাঙ্ক্ষা করছে না বাতাস
কিংবা অন্ধ কোনো উড়োজাহাজ স্পর্শ করছে না অসীমকে
কিংবা বিলাপশেষে ঘুমিয়ে নেই শীর্ণ পায়রা
কিংবা কবিতা-পংক্তির প্যারাবোলা থেকে
অধিক সুন্দর নয় অবগুন্ঠিত ডানার রঙধনু
প্যারাবোলার সান্ধ্যকালীন সেতু সত্ত্বাকে বাঁধছে সত্ত্বার সাথে

মাথা উত্তোলিত, বাতাসে উড়ন্ত চুল
আমার জন্ম সেইখানে যেখানে বিশ্রাম পেয়েছে আমার চোখ
পাহাড়ের উপরে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, নৌকার
সাইরেন যা সাহায্য করছে তার আত্মার নির্গমনে
এইসব কিছু থেকে তুমি অধিকতর সুন্দর
বাতিঘর কাউকে বাঁচাবার নিমিত্তে খুঁজছে কুয়াশা
বাতাসে সন্তরণরত পরিযায়ি পাখি থেকে তুমি অধিকতর সুন্দর
গ্রীষ্মের সমুদ্রের গুঞ্জন তুমি
তুমি ধ্বনি অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের ব্যস্ত সড়কে

তোমার চোখেই আমার গৌরব
অন্তর্গত উজ্জ্বলতায় দীপ্যমান তোমার রাজকীয়তায় আমি সজ্জিত
আমি বসে থাকি তোমার চাহনির সবচেয়ে সংবেদনশীল কোণে
তোমার পতনহীন অক্ষিপক্ষের স্থির নির্জনতায়
তোমার চোখের গভীর থেকে উঠে আসছে অশুভ সংকেত
এবং সমুদ্রবাতাস ছোট্ট ঢেউ তুলছে তোমার চোখের আইরিসে

তোমার ফেলে আসা বীজপত্রের আখ্যান তুলনাহীন
সেই কন্ঠস্বরে, উজ্জীবিত করার লক্ষ্য, খুঁজে ফিরছি মৃত নক্ষত্র
তোমার কন্ঠস্বর মহাকাশে গড়ে তুলছে সাম্রাজ্য
এবং সেই উত্তোলিত হাত যেন ধরে রেখেছে বাতাসে ঝুলন্ত সূর্য
এবং সেই চাহনি অসীমে লিখে রাখছে এই বিশ্ব
এবং সম্মুখে আনত তোমার মাথা শুনছে মহাকালের গুঞ্জন
এবং উচুনীচু রাস্তায় তোমার পদক্ষেপ যেন এক উৎসব
বিদ্যুতের চমক তোমার চোখের পাতায় ভর করে নেমে আসে মাটিতে
এবং এই চুম্বন তোমার রঙধনুময় ঠোঁটে একে দিচ্ছে স্ফীতি
এবং সেই হাসি তোমার জীবনের সম্মুখে হয়ে উঠছে ব্যানার
এবং সেই রহস্য যা তোমার হৃদয়ের স্পন্দনকে বয়ে নিয়ে যায়
তা তোমার স্তনের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকে

যদি তুমি মারা যেতে
তাহলে, তাদের প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ সত্ত্বেও
এইসব নক্ষত্র হারিয়ে ফেলবে তাদের পথ
কী হয়ে উঠবে তখন এই মহাবিশ্ব ?

নিউইয়র্ক, জুন ২২, ২০১৪
ইংরেজীঃ এলিয়ট ওয়াইনবার্গার

ঋণস্বীকারঃ
[1] http://hispanicissues.umn.edu/assets/doc/07_Huidobro_Oliphant.pdf; Dave Oliphant, "Huidobro and Parra: Worlf-Class Antipoets."

[2] Altazor/Vicente Huidobro; Translated and introduced by Eliot Weinberger; Wesleyan University Press, Connecticut, 2003.