হার্ড ইমিউনিটি কি কেবলই মিথ?

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 15 July 2020, 05:35 PM
Updated : 15 July 2020, 05:35 PM

পৃথিবীর শুরু থেকে মানুষ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। আর এই লড়াইয়ে নিজেরা প্রকৃতির সাথে এক অনবদ্য সম্পর্ক রেখে চলছে। কখনো কখনো রোগের বিস্তারে মানুষ হয়েছে দিশেহারা, আবার প্রাণসংহারের পর নিজেদের অস্বিত্ব টিকে রেখেছে। ঠিক এমন একটি মহামারির কবলে পড়েছি আমরা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে, আক্রান্ত হচ্ছে। এরপরও জীবনের লড়াই থেমে নেই। কোভিড-১৯ মহামারীকে পাশে রেখে মানুষ খাদ্য সংগ্রহে নেমেছে। সৃষ্টির সেরা জীব বলেই হয়তো আমাদের এই সাহসিকতা।

কোভিড-১৯ মহামারীর আট মাসেও SARS-CoV-2 ভাইরাসটিকে রুখবার কোন পথ খুঁজে পাইনি। দুনিয়া জুড়ে শতশত বিজ্ঞানী ও গবেষক প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে বাগে আনবার রণকৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করছে। কোথাও চলছে কোভিড-১৯ ওষুধ গবেষণা, আবার কোথাও চলছে শরীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা। সম্ভবত আমরা যারা গবেষণায় আছি, তাদের জন্য এই সময়টা বড়ই চ্যালেঞ্জিং। সারা বিশ্বের মানুষ মুখিয়ে আছে একটি নির্ভরশীল ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধের আশায়। আমরা কেউ জানি না, জীবনহানির এ মিছিলটা আরও কত দীর্ঘ হবে। তবে দিনশেষে যে মানুষেরই জয় হবে তা নিশ্চিত। আমরা ঠিক একদিন ভ্যাকসিন কিংবা কার্যকরী ওষুধের সন্ধান পেয়ে যাব।

আর এইগুলো পাওয়ার আগে সারা বিশ্বে যে অর্থনীতির সংকটের মুখে পড়ছে, খাদ্য সন্ধানের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানগুলো শঙ্কায় পড়েছে, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় আপাতত আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের প্রাণ বাঁচাতে লকডডাউন দীর্ঘ করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও, আমাদের মত  নিম্ন আয়ের দেশে তা বেমানান বটে। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাই করোনাভাইরাসকে কাঁধে নিয়ে নেমে পড়েছে জীবিকা নির্বাহে। অনেক দেশই এখন প্রকৃতির কাছে অসহায়ত্ব দেখিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়েছে। তারা মনে করছে, হার্ড ইমিউনিটি (Herd immunity) রক্ষা পাওয়ার উপায়। আর এই হার্ড ইমিউনিটির হাত ধরে অনেক দেশ নিজেদের প্রাণচাঞ্চল্য ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশও সম্ভবত এটিকে আঁকড়ে ধরে হাঁটছে। 

কিন্তু কোভিড-১৯ জন্য আমাদের হার্ড ইমিউনিটি বা দলবদ্ধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর? আদৌ হার্ড ইমিউনিটি কাজে দিচ্ছে? নাকি এটি কেবলই একটি মিথ? 

যদিও আমি এপিডেমিওলজিস্ট বা মহামারী বিদ্যায় পারদর্শী নই, তবে একজন ক্ষুদ্র গবেষক হিসেবে কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি কার্যকর কিনা এই বিষয়টি আলোচনা করার আগে চলুন আমরা হার্ড ইমিউনিটির একাডেমিক দিকগুলো জেনে আসি। 

হার্ড ইমিউনিটি কী?

যখন কোন এলাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠির কোনও একটি নিদিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে নিজেদের শরীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়ে সেই রোগের বিস্তার কমিয়ে ফেলে কিংবা ঠেকিয়ে দেয় সেটিকে আমরা হার্ড ইমিউনিটি বলে মনে করি। মূলত এটি পরোক্ষভাবে ইনফেকশন ছড়ানোসর রাস্তা সীমিত করে তোলে। সাধারণত হার্ড ইমিউনিটি দুইভাবে তৈরি করা সম্ভব (তথ্যসূত্র-১)।

এক. কৃ্ত্রিম বা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে, 

দুই. প্রাকৃতিক নিয়মে শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যারা আক্রান্ত হননি তারা মূলত সুরক্ষিত এ কারণে যে তাদের আশে-পাশের মানুষ যারা আক্রান্ত হওয়ার পরও শরীরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না তারা ওই নিদিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা হার্ড ইমিউনিটি গড়ে দেয়। তবে কোভিড-১৯ আদৌ হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করে কি না তা তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। (সূত্র-২)

আরও একটু সোজা করে হার্ড ইমিউনিটি সম্পর্কে বলা যায়, যখন কারও শরীরে কোন নিদিষ্ট জীবাণু বা প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি (প্রতিরোধ ব্যবস্থা) তৈরি হয়ে যায়, তবে শরীরের ইমিউনিটির বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ওই জীবাণুকে ধ্বংস করে দেয় বা নিউট্রালাইজড করে ফেলে। অ্যান্টিবডি বিভিন্ন ধরনের হয়।

ভ্যাকসিন মূলত শরীরে অ্যান্টিবডি সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এই অ্যান্টিবডি তৈরি হলে, জীবাণু যখনই শরীরে প্রবেশ করুক না কেন, তারা সামরিক বাহিনীর মত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জীবাণুকে মেরে ফেললেও অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার যে কোষ বা সেল থাকে তা সুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই নিদিষ্ট জীবাণুকে দেখতে পেলে তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আর এভাবে কিছু অ্যান্টিবডি আমাদের দেহের নিজস্ব ব্যবস্থায় বা কোষের জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালে স্মৃতি হিসেবে থেকে যায়। একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত তা থাকে।  এই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

হার্ড ইমিউনিটি কিভাবে কাজ করে?

যদি কোনও সম্প্রদায় বা কমিউনিটিতে বেশি মানুষের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়, তবে সেখানে সামfন্য কিছু মানুষের শরীরে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। যদি কোন কমিউনিটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি সঞ্চার হয়, তবে সেই সম্প্রদায়ে ভাইরাস মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে না। একটা নিদিষ্ট সময় পর অনাক্রান্ত ব্যক্তিরাও ওই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। 

বিষয়টি জটিল হয়ে গেল কি? তবে সহজ করে তুলে ধরার জন্য সায়েন্টিফিক্যালি যে মডেল গবেষকরা ব্যবহার করে সেটার বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে। সাধারণত কোন এলাকায় হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য গাণিতিক এই ১ – ১/R0 মডেলটি অনেক জনপ্রিয়। R0 (আর নট) বলতে মৌলিক প্রতিলিপির সংখ্যাকে বুঝায়। ধরুন, একটি ভাইরাসের আর নটের মান যদি ৩ হয়, তাহলে একজন ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি দ্বারা তিনজন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাহলে হার্ড ইমিউনিটির মান হবে (১-১/৩) অর্থাৎ ০.৬৭ বা ৬৭ শতাংশ। এটি কেবলই গাণিতিক মান। তবে বাস্তবিক কতটা সত্য তা প্রমাণ করা দুরূহ বটে। (তথ্যসূত্র-৩)

আবার R0 এর মান আমরা বের করতে পারি  এই সমীকরণের  B/(A- D) দ্বারা, B হচ্ছে কোন এলাকার বার্ষিক নিদিষ্ট জন্মহার, A হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিদের গড় বয়স, এবং D হলো আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে ছড়িয়ে পড়া অন্য ব্যক্তিদের সংক্রমণের সময় বা দিন। আর এইভাবে আর নটের মান বের করে, আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, সেই এলাকার হার্ড ইমিউনিটির অধীনে পড়ছে  কি না। (তথ্যসূত্র-১)

ধরুন, একটি এলাকায় ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন ব্যক্তির শরীরে সংক্রমক ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। যদি ওই এলাকায় এই ১০০ জনের বাইরে কেউ না প্রবেশ করে, তাহলে বাকী ২০ জন তখন ওই ৮০ জনের দ্বারা আবদ্ধ থাকবেন। যদি ভাইরাসের আর নটের মান ৫ হয়, তাহলে যে ২০ জন ব্যক্তি অনাক্রান্ত ছিলেন, তাদের প্রতিজন ৫ জনকে আর আক্রান্ত করতে পারবে না। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর ওই এলাকায় আর কেউ আক্রান্ত হবেন না। 

'হার্ড ইমিউনিটি'র আওতায় পড়ার জন্য ওই এলাকার মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও আচার-আচরণের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রমিত এলাকায় যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলা হয়, সেটি ওই এলাকার মানুষদের মেনে চলার প্রবৃত্তি অনেকাংশ ইমিউনিটি গড়ে তোলার সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

হার্ড ইমিউনিটির জন্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জনসংখ্যার ঘনত্ব ও ভ্যাকসিনেশনের প্রাপ্যতা। আর আক্রান্ত ব্যক্তিকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত নয় বলেও গবেষকদের মত এসেছে। কারণ, অনেক ভাইরাসই নীরব থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়। যদি আক্রান্তদের সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে সেখানে একটি শূন্যতা তৈরি হয়, যা হার্ড ইমিউনিটি গড়ার অন্তরায় বটে। (তথ্যসূত্র-৫)

হার্ড ইমিউনিটির সুবিধাগুলো কী?

# যদি শক্তিশালী সংক্রমণশীল কোন ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমরা কোন ওষুধ বা ভ্যাকসিন তৈরি করা না গেলে, ভাইরাসের নিজস্ব গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেবে। আর তা থেকে বের হতে, আক্রান্ত এলাকায় মানুষদের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা হয়, যাতে করে প্রাকৃতিক নিয়মেই সংক্রমণশীল প্যাথোজেনটিকে রুখে দেওয়া যায়। আর সেটা করার জন্য অনেক রাষ্ট্রেই লকডডাউন পদ্ধতি অনুসরণ করে। নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত যদি ওই এলাকার মানুষকে আবদ্ধ করে ফেলা হয়, তাহলে এই সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয়। 

# অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য হার্ড ইমিউনিটি কার্যকরী হতে পারে। যেমন কোনও শিল্প এলাকায় শিল্প এলাকায় সংক্রমণ ৭০ শতাংশের বেশি হলো। তাহলে সেই এলাকায় যদি হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়, অর্থনীতিকে সচল রাখা সম্ভব হতে পারে।

# হার্ড ইমিউনিটি অবশ্যই চিকিৎসালয়ের জন্য সহায়ক। অঞ্চলভিত্তিক হাসপাতালে সংক্রমণের সময় যে চাপ, তা থেকে বের হওয়ার জন্য হার্ড ইমিউনিটি রোগীদের স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা চালু রাখতে ভূমিকা রাখবে।

# অনেক ধর্মীয় ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্যাকসিনকে বিশ্বাস করে না। তাদের সেই বিশ্বাসকে সমুন্নত রেখে হার্ড ইমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। (তথ্যসূত্র-৬)

কোভিড-১৯, হার্ড ইমিউনিটি ও বাংলাদেশ

বিভিন্ন গবেষণায় যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে SARS-CoV-2 এর 'আর নট'- এর মান ২ থেকে ৬ মধ্যে। প্রাথমিকভাবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে যে সংক্রমণ হয়েছিল তার 'আর নট' এর মান ছিল ২ দশমিক ২। অর্থাৎ ৪২৫ জন আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির মধ্যে এই আর নটের মান বের করেছিল চীনের গবেষকরা (তথ্যসূত্র-৭), যারা ৬-৭ দিনের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা সিডিসিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে R0 এর মান ৫.৭ (তথ্যসূত্র-৮)। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এটি কতটা শক্তিশালী ভাইরাস। তাই হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে আমাদের মাতামাতির চেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক যেসব আলোচনা প্রয়োজন তা রাষ্ট্রীয় প্রধানদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক বলে আমরা মনে করি। আর হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে যেসব চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে উঁকি দিচ্ছে, সেগুলোকে স্বীকার করা শ্রেয়।

তথ্য ঘাটতি

বর্তমানে কোভিড-১৯ নিয়ে ব্যাপক তথ্য ঘাটতি আমাদের রয়েছে। আমরা এখনো জানি না, এই ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমণের হার কেমন, কোন কোন রুট দিয়ে ছড়াচ্ছে, কোন কোন বয়সের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির স্থায়িত্বই বা কতদিন। ঠিক এইসব তথ্য জানা না গেলে, হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে সুবিধা হবে বৈকি। আর নটের মান যদি নিদিষ্ট না হয়, তাহলে যে গাণিতিক মডেলের উপর ভিত্তি করে আমরা হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে চেঁচামেচি করছি, তা কাজে দেবে না।

মানুষ মেরে গড়তে হবে হার্ড ইমিউনিটি?

ভ্যাকসিনের হার্ড ইমিউনিটি দ্রুত কাজে দিলেও প্রাকৃতিক উপায়ে গড়তে যাওয়া হার্ড ইমিউনিটি আমাদের জন্য বড়ই বিপদজনক। কোভিড-১৯ মত প্রাণঘাতী এই রোগের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়তে হলে আমাদের হারাতে হবে অনেক মানুষকে। ধরুন, একটি পরিবারের ১০ জন মানুষ রয়েছে। এই পরিবারের সবাই যদি আক্রান্ত হয়, তবে নিশ্চয় এই পরিবারের কারও কারও ইমিউনিটি কাজ করবে না, কিংবা কারও  কারও পুরাতন জটিল রোগ রয়েছে, যা কোভিড-১৯ দ্রুত গতিতে মৃত্যুর দিকে সঞ্চালন করবে তাতে সন্দেহ নেই। কখনো বয়স্ক আবার কখনো তরুণরা এই রোগে বেশি প্রাণ হারাচ্ছে। সেই হিসেব কষলে প্রাণের মানদণ্ডে ৭০ শতাংশের বেশি হার্ড ইমিউনিটি কোন এলাকায় গড়া কখনো সম্ভবপর হবে না।

ব্যক্তির আচরণ

হার্ড ইমিউনিটি গড়ার জন্য সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি প্রয়োজন তাহলো ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই কোভিড-১৯ সেইভাবে আমলে নেয়নি। ফলে অবাধ চলাফেলা হার্ড ইমিউনিটির অন্যতম প্রতিবন্ধক। আর এইজন্য ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন যেভাবে দরকার তা আমরা এখনও করতে পারিনি।

সংক্রমণে ভিন্নতা

কোভিড-১৯ আক্রান্ত যারা হয়েছেন, তাদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তাদের অনেকেই ক্লাস্টার সংক্রমণের শিকার আবার কখনো কখনো বিচ্ছিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটির জন্য যে একটি নিদিষ্ট এলাকায় সংক্রমণ ও মানুষের বসবাসের ঘনত্ব নির্ভর করে। সেই হিসেব কষলে, দেখা যাচ্ছে যে, কোন এলাকায় হাজারে ১ জন আবার কোন এলাকায় ২ জন। ধরুন, কোন এলাকায় ১ হাজার মানুষ বসবাস করে। যাদের মধ্যে ১ জন আক্রান্ত হলেন। যদি এই ১ জনের দ্বারা ৫ জন আক্রান্ত হতে হয়, তাহলে যে ইনকিউবেশন টাইম লাগবে তাহলো ৬ দিন। তাহলে এভাবে ৬ দিন পর আক্রান্ত হবেন ৭ জন, ১২ দিন পর হবে ৩৫ জন, ১৮ দিন পর হবে ১৭৫ জন। এভাবে আক্রান্ত হতে হতে পুরো এলাকায় মাস খানেক লাগবে। আর যদি এদের মধ্যে ইমিউনিটি সার্প্রেশন থাকে তাহলে তো কথায় নেই, সেটা অর্জন করা দুরূহ হয়ে পড়বে (তথ্যসূত্র-৯)।

দারিদ্র ও উদাসীনতা

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দারিদ্র তৈরি করতে পারে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের প্রতিবন্ধকতা। পেটের তাগিদে খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়া মানুষদের আটকে রাখা কোন কোন দেশের জন্য কঠিন হতে পারে। তার প্রমাণ বাংলাদেশ। হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করার জন্য যে সময়টুকু দরকার সেই সময়টুকু ঘরে বসে খাওয়ানোর সক্ষমতা যেমন আমাদের ক্ষীণ তেমনি, আমাদের উদাসীনতা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সহায়ক নয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, আক্রান্ত হওয়ার পর কিভাবে নিজেদের সংক্রমণের খবর লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, কিভাবে আক্রান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে অন্য এলাকায় সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়েছি। সচেতনতার অভাবে অনেকেই জানছে না, কোভিড-১৯ গুরুত্ব। ফলে মৃত্যুহার যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে, তেমনি ট্রান্সমিশনের হারও পারদচুম্বি হবে। যে কারণে, হার্ড ইমিউনিটি স্বপ্ন আমাদের জন্য অধরা থাকতে পারে।

ইমিউনিটির স্থায়িত্বকাল

ধরুন, কোন একটি রাষ্ট্র কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করলো। ঠিক এই ইমিউনিটির স্থায়িত্বকাল কত? কতদিন পর ফের এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হবেন? এই তথ্যর সমাধান আপাতত আমরা পাচ্ছি না। আর সেটা পাওয়ার জন্য অন্তত আমাদের আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে পোলিও ১৮ বছর, স্মল পক্স ৩-৫ বছর, রুবেলা ২০ বছর আর  হাম বা মিজেলসের জন্য আজীবন ইমিউনিটি তৈরি হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে (তথ্যসূত্র-১০)। তবে কোভিড-১৯ জন্য কতদিন ইমিউনিটির স্থায়িত্ব হতে পারে, তা জানা গেলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন গুড়েবালি। অ্যান্টিবডির স্থিতিকাল কতদিন পর্যন্ত তা এখনো গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। কোন কোন ব্যক্তির শরীরে অ্যান্টিবডি পরিমাণে রয়েছে ভিন্নতা, যা বিভিন্ন ফ্যাক্টরকে দায়ী করা হচ্ছে। (তথ্যসূত্র-৯)

আর এসব আলোচনায় অনেকটা স্পষ্ট যে হার্ড ইমিউনিটি গাণিতিক মডেল আর ভাসা ভাসা তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এখনো এই মডেলের বাস্তবিক প্রয়োগ আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। নানার সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়ে হার্ড ইমিউনিটির পথে পা দিতে হয়। তবে হার্ড ইমিনিউটির কথা বলে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া কখনোই কাম্য নয়। সুশৃঙ্খল নিয়মে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। 

কোভিড-১৯ তথ্য অনেকটাই অধরা আমাদের কাছে। এর গবেষণার জন্য যে সময়টুকু আমাদের প্রয়োজন তা আমাদের দিতে হবে প্রাণ সংহারের বিনিময়ে। আমরা জানি না, আমাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে ধাবিত হবে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ কতদিন, কতমাস বা কত বছর থাকবে, তা আমাদের কাছে অস্পষ্ট। বিজ্ঞানের সেরা প্রযুক্তিগুলো আমরা প্রয়োগ করেও এই ভাইরাসকে ঠেকাতে পারছি না। ওষুধ গবেষণার যে গতি বেড়েছে, তাতে হয়তো পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে খুশির সংবাদ বের হবে। তার আগে আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করেই চলতে হবে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে ঠেকাতে আমাদের হার্ড ইমিউনিটির পরিবর্তে আপাতত নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। 

হার্ড ইমিউনিটির মডেলটি এখনো অস্পষ্ট। গত পাঁচ দশকেও কোন রাষ্ট্র সফল হয়নি। যাদের সফলতার গল্প আমরা গণমাধ্যমে পাচ্ছি, তা কেবলই মিথ। বাস্তবতাকে সামনে রেখে আমাদের কোভিড-১৯ মোকাবেলা করতে হবে। 

তথ্যসূত্র

১. "Vaccination and herd immunity to infectious diseases." Nature (https://www.nature.com/articles/318323a0.pdf) 

২.  https://www.who.int/news-room/q-a-detail/q-a-serology-and-covid-19

৩. Herd Immunity: Understanding COVID-19. Cell ( https://www.cell.com/pb-assets/products/coronavirus/immuni4358.pdf)  

৪. Understanding Herd Immunity (https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1471490615002495?via%3Dihub)

৫. Herd immunity: basic concept and relevance to public health immunization practices (http://citeseerx.ist.psu.edu/viewdoc/download?doi=10.1.1.935.1796&rep=rep1&type=pdf)

৬. On the benefits of explaining herd immunity in vaccine advocacy (https://www.nature.com/articles/s41562-017-0056)

৭. Early Transmission Dynamics in Wuhan, China, of Novel Coronavirus–Infected Pneumonia (https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7121484/)

৮. High Contagiousness and Rapid Spread of Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2 (https://wwwnc.cdc.gov/eid/article/26/7/20-0282_article)

৯. Long-term and Herd Immunity Against SARS-CoV-2: Implications From Current and Past Knowledge (https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/32510562/)

১০. HERD IMMUNITY FORCOVID-19 (https://www.gao.gov/assets/710/707975.pdf)