ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশ ও শাহজাহান সিরাজ

স্বদেশ রায়
Published : 15 July 2020, 04:53 PM
Updated : 15 July 2020, 04:53 PM

ক্যান্সার আক্রান্ত শাহজাহান সিরাজকে যখন শেষবারের মতো বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সে সময় এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করতে যান সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। একটি টেলিভিশনের পর্দায় এই নিউজটি দেখে খুবই ভাল লাগে। অন্তত এইটুকু আশ্বস্ত হই ক্যান্সার আক্রান্ত শাহজাহান সিরাজ হয়তো বেশিদিন বাঁচবেন না, তবে মৃত্যুর পরে তিনি তাঁর যোগ্য সম্মান জাতির কাছ থেকে পাবেন। কোনো বিভেদ বা হিংসা, দ্বেষ এখানে বাধা হবে না বা পথ আটকে থাকবে না। 

বাস্তবে বাঙালি জাতি বড়ই দুর্ভাগা। এর হাজার বছরের ইতিহাসে একের পর এক ব্যর্থতা। হাজার বছরের ইতিহাস হিসেব করলে সব থেকে বড় সাফল্য যেমন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তেমনি বড় ব্যর্থতাও হল এই বিজয়কে ধরে রাখতে না পারা। বাংলাদেশ যত দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের বিজয় বা একাত্তরের বিপ্লব বিসর্জন দেয় প্রতিবিপ্লবীদের হাতে এত দ্রুত পৃথিবীর কোন দেশেই বিপ্লব  পরবর্তীকালে প্রতিবিপ্লবীরা ক্ষমতায় আসেনি। এত দ্রুত রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিবিপ্লবীদের আধিপত্য কায়েম হয়নি। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একাত্তরের সশস্ত্র বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে সংগঠিত হয়নি। এ ছিল বাইশ বছরের একটি সুচিন্তিত ও ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া, সুসংগঠিত একটি বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধ। 

সত্তর-একাত্তরের শাহজাহান সিরাজের মতো তরুণ নেতারাও রাতারাতি ছাত্রনেতা হয়েও জাতীয় পর্যায়ের নেতাতে পরিণত হননি। ষাটের দশক থেকে দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলনের পথ বেয়েই তারা সত্তর-একাত্তরে ছাত্র নেতা হয়েও এক ধরনের জাতীয় নেতায় পরিণত হন। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা দরকার দেশের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি এ ছাত্রনেতাদের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা এ পর্যায়ে পৌঁছেছিল এক অনন্য উচ্চতায়। যে কারণে সেদিন দেশের মানুষ ইসলামের চার খলিফার মত তাদের চার নেতাকে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার খলিফা বলতেন। এর থেকে বোঝা যায় দেশ ও সমাজ তাঁদেরকে কোন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এবং এই উচ্চতায় তাঁরা কেউই কোন আকর্ষিক ঘটনাক্রমে পৌঁছাননি। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁরা প্রতি মুহূর্তে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের প্রতিটি অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। 

সুকান্ত যেমন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের নিয়ে লিখেছিলেন- "ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়,/ ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে/ গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে/ আজো রোমাঞ্চকর;"। সুকান্তকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের বাইশ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এইসব তরুণ বীরদের সম্পর্কে একই কথা বলা যায়- এরাও বীর, এরাও আকাশে জাগিয়েছিল ঝড়, এদেরও কাহিনী জেল-জুলুম, হুলিয়া আর গুলির মুখে চিরকালের রোমা কর। বাস্তবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কেউই তাঁদের জীবন কাহিনী লিখলেননা বা লিখে যেতে পারেননি। সত্যি সত্যি এদের জীবন কাহিনী লেখা হলে এদের অনেকেই আমাদের আগামী শিশুদের রূপকথার রাজপুত্র হতে পারেন। কিন্তু ইতিহাসের টানাপড়েনে প্রতিবিপ্লবীরা রাষ্ট্র ও সমাজের মগজ দখল করে নেয়ার ফলে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। 

কতটা এলোমেলো হয়ে গেছে সেটা কিছুটা প্রকাশ করার জন্য ছোট্ট একটা ঘটনা উল্লেখ করি। শাহজাহান সিরাজেরই সতীর্থ চার খলিফার আরেক খলিফা আবদুল কুদ্দুস মাখন ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মারা গেলে তৎকালীন বাংলাদেশের অন্যতম বহুলপ্রচারিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক এটাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে লিড নিউজ করেছিল। অন্যদিকে, তখন বর্তমান ভোরের কাগজে আবদুল কুদ্দুস মাখনের মৃত্যু সংবাদ শেষের পাতায় খুবই সাধারণভাবে ছাপা হয়। সেদিন বিকেলে তৎকালীন ভোরের কাগজের অন্যতম ব্যক্তিত্ব বেনজীর ভাইয়ের সঙ্গে (বেনজীর আহমদ) 'সচিত্র সন্ধানী'র গাজী ভাইয়ের আড্ডায় দেখা হয়। বেনজীর ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- মাখন ভাইয়ের নিউজটার এই ট্রিটমেন্ট কেন আপনাদের পত্রিকায়? বেনজীর ভাই কিছুটা হালকা স্বরে বলেন- আরে মাখনের মতো একজন হুইস্কি খাওয়া (উনি বলেছিলেন মদ খাওয়া) লোক মারা গেছে তার জন্য এর থেকে বেশি কি ট্রিটমেন্ট হতে পারে।  কথাটা শুনে এতই কষ্ট পেয়েছিলাম যে কারণে কোন উত্তর দেবারই প্রয়োজন মনে করিনি। এমনকি ওই আড্ডায়ও বেশিক্ষণ থাকিনি। বাংলার বাণীতে সাবেক ছাত্রনেতা, রাজনীতিক ও সাংবাদিক শফিকুল আজিজ মুকুল ভাইয়ের টেবিলে যাই। মুকুল ভাই তার স্বভাবসুলভ হাসি দিতে গিয়েই থেমে যান। কিছুটা গম্ভীর মুখে আমাকে বলেন- কি! তোমার মন খারাপ কেন, কাকীমার শরীর খারাপ নাকি (ওই সময় আমার মায়ের শরীরটা ভাল ছিল না)? আমি বলি- না, মন খারাপ নয়, মা ভাল আছেন। বলে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসি। তারপরে এক পর্যায়ে কথায় কথায় আবদুল কুদ্দুস মাখন ভাই সম্পর্কে বেনজীর ভাইয়ের মন্তব্যটি তাঁকে বলি। এবার তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ও- হো হো- হাসিতে অফিস ভরিয়ে তোলেন আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলেন- ' এই জন্য মন খারাপ! এতটা বয়স হয়েছে তারপরেও এখনো রাষ্ট্র ও সমাজকে স্বচ্ছ আয়নায় দেখতে পাও না? এটাতো ঠিক না। তোমার কাছে এটা আশা করিনি।' 

তারপরে তিনি বললেন- 'প্রতিবিপ্লব যে আমাদের মগজ দখল করেছে এবং সেই মগজ দখলের হাত থেকে আমরা কেউই রেহাই পাইনি এ তো তারই প্রমাণ। বেনজীর তোমার অনেক আপনজন বলেই তুমি কষ্ট পাচ্ছো। কিন্তু এই চিন্তার অস্বচ্ছতা, বৈপরীত্য আমাদের সকলের  ভেতরে ঢুকে গেছে। এখান থেকে মুক্ত হতে আমাদের দীর্ঘদিন লাগবে'। বাস্তবে প্রতিবিপ্লব আমাদের মগজ যে কতখানি দখল করেছে তা ওই ভোরের কাগজের অন্য একটি ঘটনাতেই বোঝা যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় নেতা হিসেবে গোলাম আযমের পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার প্রগতিশীল পত্রিকার ভিতর এই ভোরের কাগজেই প্রথম ছাপা হয়। 

এ প্রতিবিপ্লব বাংলাদেশে এত সহজে ঘটতো না যদি মুক্তিযুদ্ধের বা বিপ্লবের শত শত সিপাহশালার ভুল না করতেন। আবদুল কুদ্দুস মাখন মারা যান ১০ ফেব্রুয়ারি। সম্ভবত ১২ বা ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে তাঁর  স্মরণসভায়  এসেছিলেন ষাটের দশকের সকল ছাত্রনেতা। সেখানে আব্দুর রাজ্জাক থেকে শাহজাহান সিরাজ সবাই ছিলেন। এই স্মরণসভায় তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশের এই প্রতিবিপ্লব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে আ স ম আব্দুর রবকে উদ্দেশ্য করে বলেন- 'রব, সেদিন যদি তোমরা ক্ষমতার জন্য তাড়াহুড়ো করে ভুল না করতে, স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির ভিতর ভাঙন সৃষ্টি না করতে তাহলে আজ বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিবিপ্লবীরা চেপে বসে না। বঙ্গবন্ধুও নিহত হন না। রাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে চলতো এবং আজ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয় না বাংলাদেশের। বরং বঙ্গবন্ধুর পরে তাজউদ্দীন ভাই, তাজউদ্দীন ভাইয়ের পরে মণি ভাই, মণি ভাইয়ের পরে রাজ্জাক ভাই এমনিভাবে একদিন তুমি আ স ম আব্দুর রব- তুমিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে এবং সেটাই ছিল বাংলাদেশের ধারাবাহিকতা"। 

বাস্তবে বাংলাদেশের এই ধারাবাহিকতা যাদের হাতে নষ্ট হয়েছে শাহজাহান সিরাজও তাদের একজন। শাহজাহান সিরাজের মতো মুক্তিযুদ্ধের এমনি স্তম্ভরা বাংলাদেশকে স্বাধীনতার ধারায় প্রবাহিত হওয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।  যার ফলে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশে আজ মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতাশালী ।  আর এ সবকিছুর দায়ের একটি ভাগ ইতিহাস শাহজাহান সিরাজের ওপরে চাপাবেই। তা বলে তাঁর মৃত্যুতে আমরা দুঃখ প্রকাশ করব না তা নয়, শোক প্রকাশ করব না, তাও নয়। কারণ শাহজাহান সিরাজরা কখনোই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ফারুক-রশিদের মত একাত্তর সালের শেষভাগে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। এমনকি জিয়াউর রহমানের মত ছাত্র-জনতার চাপের মুখে মুক্তিযুদ্ধে যেতে বাধ্য হওয়া মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন না। ষাটের দশক থেকে ধীরে ধীরে যারা বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সোপানে এগিয়ে নিয়েছিলেন- তাঁদের একজন শাহজাহান সিরাজ। এদেশের মুক্তি সংগ্রামের ষাটের দশকের কোন ঘটনা থেকেই বিচ্ছিন্ন করা যাবে না শাহজাহান সিরাজদেরকে। তার জন্য আবহমান কাল ধরেই এ জাতি তাঁদেরকে শ্রদ্ধা করবেই। 

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুথানের সূচনা পর্বে ২০ জানুয়ারি আসাদ নিহত হবার পর রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ দ্রুত মোড় নিতে থাকে। এ সময়ে তৎকালীন ছাত্র নেতারা একের পর এক  গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন। 

এই ঘটনা প্রবাহের স্রোতে এসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সমাবেশ করা। তাই ২৪ জানুয়ারির আগের তিনদিন তেজগাঁওয়ের শ্রমিক এলাকায় শ্রমিকদের সুসংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় শাহজাহান সিরাজের ওপর। ওই এলাকার শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম করতে শাহজাহান সিরাজ যে পরিশ্রম করেছিলেন ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তা ইতিহাসের একটি অংশ। এমনকি ২৪ জানুয়ারি সকালে তিনি শাহাবাগ মোড়ে শ্রমিক মিছিলের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারেন মিছিলের শেষ অংশ এখনো তেজগাঁওয়ে আছে। এরপরেই তিনি যে দায়িত্ব পালন করেন তা ইতিহাসের মোড় ঘোরাতে যথেষ্ট সাহায্য করে। তিনি বুঝতে পারেন এই বিশাল জনতার স্থান সংকুলান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হবে না। অতএব, ভিন্ন কোনও সিদ্ধান্তের দরকার। মিছিল সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে দৌঁড়ে চলে যান ইকবাল হলে ওই সময়ের আন্দোলনের মূল নেতা তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের কাছে। তোফায়েল আহমেদ বিষয়টি শুনেই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেন মিছিলের মোড় ঘুরিয়ে দাও পল্টনের দিকে। ছাত্র জনসভা পল্টনেই হবে। পল্টনের ওই জনসভা সেদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণঅভ্যুথান ঘটিয়েছিল। আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলার একক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সসম্মানে জেল থেকে মুক্তি পান। তারপরে শেখ মুজিবুর রহমান 'শেখ সাহেব' ও 'মুজিব ভাই' থেকে 'বঙ্গবন্ধু'তে রূপান্তরিত হন। আর তারপরের ইতিহাসটুকু শুধু মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের মুক্তি সংগ্রামের এই বাঁককে বিশ্লেষণ করতে গেলে কখনোই শাহজাহান সিরাজদেরকে বাদ দেওয়া যাবে না। তাদেরকে অশ্রদ্ধাও করা যাবে না।

কিন্তু এরপরেও প্রশ্ন আসে এ ধরনের প্রখর বুদ্ধিসম্মত ছাত্রনেতারা কেন স্বাধীনতার পরপরই ভুল করলেন, কেন তাঁরা জাসদ সৃষ্টি করতে গেলেন?  ইতিহাসের কোন মোটা দাগে এটাকে বিশ্লেষণ করা যাবে না। সেটা করা ঠিকও হবে না।  এবং সত্যি বলতে কি ভবিষ্যত ইতিহাস সেভাবে বিশ্লেষণও করবে না। শুধু একপক্ষকে দোষারোপ করে এটাকে শেষ করে দেওয়া যাবে না। এর অনেক গভীরে যেতে হবে।  যেমন খুঁজতে হবে কেন সেদিন ভাঙন হলো। পাশাপাশি এটাও খুঁজতে হবে কেন ভাঙন ঠেকানো গেল না। ইতিহাসে একপক্ষীয় ভুলে বা একপক্ষীয় কারণে খুব কম ঘটনাই ঘটে। তারপরও যদি কোন ঘটনায় শুধু একপক্ষের ভুল বা দোষ থাকে সেটা সঠিকভাবে তুলে না আনা পর্যন্ত ইতিহাসের ওই ঘটনা প্রবাহর গতি-প্রকৃতি সত্যি অর্থে জানা হয় না। বাংলাদেশের ইতিহাসের এ অধ্যায় অবশ্যই একদিন সঠিকভাবে সবার সামনে উঠে আসবে আর সেটা প্রয়োজনও। 

তবে এটা ঠিক বর্তমান পৃথিবীর চেয়েও দুই পরাশক্তিতে বিভক্ত সত্তরের দশকের পৃথিবী অনেক বেশি জটিল ছিল। ওই জটিলতার রাজনীতিতে জাসদের তরুণ নেতারা যে হাবুডুবু খেয়েছিল তাও সত্য। মেজর জলিল থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা অনেক রক্ষণশীল চিন্তার এবং মৌলবাদী শক্তি সেদিন জাসদের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল।  এবং ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো যে মৌলবাদী শক্তির বা পাকিস্তানি মানসিকতার শক্তির বড় আকারের  বিজয় হল তার দায় কখনোই জাসদ এড়াতে পারবে না। তারপরও সত্য মেজর জলিল যেমন মৌলবাদী, জিয়াউর রহমান যেমন মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক- শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, কর্নেল তাহের ও সর্বোপরি সিরাজুল আলম খানকে আর যাই হোক মৌলবাদী বলা যাবে না। রাজনীতির হঠকারিতায় তাদের পা পিছলে গেছে। কেন পিছলে গিয়েছিল, কেন তাঁরা হঠকারিতার পথে গিয়েছিলেন সে ইতিহাস একদিন পরিষ্কার হবেই। পরিষ্কার হবে বা হিসেব হবে তাঁদের এই পদস্খলনের কারণেই বাংলাদেশেকে কী মূল্য দিতে হয়েছে। তবে শাহজাহান সিরাজদেরকেও কম মূল্য দিতে হয়নি। রাজনীতির মূলস্রোত থেকে ছিটকে পড়ে স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজকে যোগ দিতে হয়েছিল বিএনপিতে। শুধু এখানেই শেষ নয় স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার পাঠক, স্বাধীনতার মূল নেতা বঙ্গবন্ধুর এই খলিফাকে জীবনের এক প্রান্তে এসে এটাও বলতে হয়েছে, ২৬ মার্চ জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি যেদিন এ কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের সমাবেশে বলেছিলেন- সেটা ছিল বাস্তবে তাঁর মৃত্যুর সমান। 

অবশ্য জীবন সায়াহ্নে এসে শাহজাহান সিরাজ বলেছিলেন, বিএনপিতে যোগ দেওয়া তার জীবনের মস্ত বড় রাজনৈতিক ভুল। শাহজাহান সিরাজের বাহাত্তর পরবর্তী সকল রাজনৈতিক পদক্ষেপের, সকল ভুলের মাশুল তাদেরই হাতে গড়া বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে নানানভাবে। একটি প্রগতিশীল মুক্তি সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আসা দেশটিতে আজ মৌলবাদীরা শক্তিশালী অংশ। ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করেন সাধারণ মানুষের ভাগ্য। এমনি নানানভাবে রক্তক্ষরণ হচ্ছে দেশটির। এর মূল কারণ পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশ যে 'একাত্তরের বাংলাদেশকে ' হারিয়েছে তা এখনো ফিরে আসেনি, আদৌ ফিরে আসবে কিনা- কেউ জানে না। তারপরে এই ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশে দাঁড়িয়েও যখন শাহজাহান সিরাজের মৃত্যু সংবাদ আসে তখন প্রতিটি বাঙালিই স্মরণ করবে তার ষাটের দশককে, তার ১৯৭১-কে এবং স্যালুট জানাবে এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীকে। এই উদার হৃদয় আমাদের সকলের থাকতে হবে। যারা তাদের তারুণ্য ও যৌবন দিয়ে আমাদের গোটা জাতিকে মুক্তির আন্দোলনে নিয়ে এসেছিল, একটি জাতিকে একটা মুক্ত স্বদেশ দিয়েছে, তাদেরকে জাতি শ্রদ্ধা জানাবেই। তাদের যে কারো মৃত্যুতে নতমস্তকে আমরা শ্রদ্ধাই জানাবোই। এই বাংলার মাটিতে তাঁদের ভুলভ্রান্তি ও অপরাধ সবকিছুরই বিচার হবে ন্যায়ের দণ্ডে। তা বলে বাঙালি কখনোই তাদেরকে ফাঁসি দেবে না। কারণ আমাদের  এই মানচিত্রে এই লালসবুজ পতাকায় তাঁদের শ্রম, তাঁদের ঘাম, তাঁদেরই রক্তমাখা।