ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব: মুদ্রার উল্টো পিঠ

আমিন মোহাম্মদ ইসমাইল
Published : 13 July 2020, 09:17 AM
Updated : 13 July 2020, 09:17 AM

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভারতের ভূমিকার কথা আমরা সকলেই জানি। এদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত আমাদের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের দরুন দু-দেশই একে অন্যের কাছ থেকে নানা সুবিধা ভোগ করছে এবং পারস্পরিক উন্নয়ন সাধন করছে বলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াগুলো অন্যতম। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের আড়ালেও বেশ কিছু বিষয় আছে যেখানে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এবং ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সীমান্ত হত্যা

বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের সবথেকে বড় অমিল দেখা যায় সীমান্তে। ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত বেসামরিক কেউ ভারতের সীমানায় ঢুকে গেলে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করে ফিরিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও গত দশ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী 'বিএসএফ' প্রায় ৩৫০ জন বেসামরিক বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী 'বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ' বারবার পতাকা বৈঠক করে এর প্রতিবাদ জানালেও এখনো পর্যন্ত কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এমনকি সীমান্তের এই হত্যাকাণ্ড দু-দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নানা আলোচনাতেও উঠে এসেছে। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল ভারতের সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সর্বনিম্ন করা হবে এবং সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হবে। তবে চুক্তির সাথে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। চুক্তির ওই বছরেই বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে প্রায় ১৪ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালে সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ জনে এবং ২০২০ এর প্রথম ছয় মাসে এ সংখ্যা ২১ জন। বিএসএফের সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ দেখা যায়, ভারতের অন্য পাঁচ সীমান্তে (পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার)। এসব সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বেসামরিক মানুষ হত্যা প্রায় শূণ্যের ঘরে। ২০১৭ সালে নেপালের এক নাগরিক বিএসএফের গুলিতে নিহত হলে নেপালের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নেপালের ওই নাগরিককে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া হয়।

আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন

দুইয়ের অধিক স্বাধীন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী 'আন্তর্জাতিক নদী' হিসেবে পরিচিত। এসব নদীর ওপর কোনো দেশের একক আধিপত্য থাকে না। এসকল নদী নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনও রয়েছে। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নিয়মাবলি অনুযায়ী, কোনো উজানের দেশ আন্তর্জাতিক নদীর ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু (বাঁধ, ব্যারেজ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্লুইজগেট) নির্মাণ করতে পারবে না যা ভাটির দেশের জন্য ক্ষতিকর। একইভাবে, ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের জলপ্রবাহ কনভেনশনেও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে তা অন্য দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বা অসুবিধার সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে এত আইন থাকার পরেও সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এর কিছুই মানছে না। আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদীগুলোর ওপর একের পর এক বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার কারণে বাংলাদেশ তার ন্যায্য পানি পাচ্ছে না। ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ভারত বেশ কয়েকটি নদীতেই বাঁধ, ব্যারেজসহ বিভিন্নরকম স্থাপনা নির্মাণ করেছে। যা নিয়ে ভারতের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধুতী রায় থেকে শুরু সচেতন ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজও বিভিন্নভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। আমাদের নদীমাতৃক দেশের নদীর সংখ্যা ১২০০ থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র ২৩০টি। গঙ্গা চুক্তির ২৫ বছর হতে চললেও আমরা আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা বুঝে পাইনি। এক ফারাক্কা বাঁধের কারণেই বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গিয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২০টি নদী। এছাড়াও 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' এর মতো ভারত শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে দিয়ে আমাদের খরার মুখে ফেলছে আবার বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের হাজারো গ্রাম পানির নিচে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছরই বর্ষাকালে ভয়ানক বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে মরুকরণ দেখা দেয়।

রপ্তানিতে বৈষম্য

এ পর্যন্ত ভারতের প্রতিটি চাওয়াকেই বাংলাদেশ সরকার খুব গুরুত্বের সাথে দেখেছে এবং তা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু এদিক দিয়েও আমরা ঠিক যতটা দিয়েছি আমাদের চাওয়াগুলো সেভাবে পাইনি। শুনতে অবাক লাগলেও বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম প্রধান রপ্তানি বাজার। ভারত প্রতি বছর প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করে। কিন্তু বাংলাদেশ তার বিপরীতে গড়ে মাত্র ৮৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে যা ভারতের ১০ ভাগের ১ ভাগ। এমন অনেক পণ্য যা বাংলাদেশ বিদেশে রপ্তানি করে সেগুলোও ভারত অন্য দেশ থেকে আমদানি করছে যা ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ। এমনকি এই করোনাকালেও বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারত তাদের পণ্য বাংলাদেশে পাঠালেও করোনাভাইরাসের অযুহাতে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে ঢুকতে দিচ্ছে না। এর প্রতিবাদস্বরূপ বাংলাদেশের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা সীমান্তে ভারতের পণ্যখালাস বন্ধ করে দিয়েছে।

বৈষম্যমূলক ভিসা নীতি

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর চিকিৎসা, পর্যটন, ব্যবসা ইত্যাদি কাজে বিপুল সংখ্যক মানুষ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে যায়। জনশ্রুতি আছে যে, ভারতের সরকারি বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত নাকি বাংলাদেশের রোগীর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। পর্যটনসহ ভারতের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে প্রতিবছর প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করতে যায়। কিন্তু ভারতে থাকাকালীন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের মানুষকে বিপাকে পড়তে হয়। কারণ সে যদি হিন্দু হয় তাহলে তাকে জরিমানা গুনতে হয় ১০০ রুপি, কিন্তু সে মুসলমান হলে তাকে জরিমানা গুনতে হয় ২১০০০ রুপি যা ২০০ গুণেরও বেশি। সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি সেক্যুলার ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও ধর্মের ভিত্তিতে এমন বৈষম্যমূলক ভিসা নীতির কারণে সেখানে নানা কাজে আটকে যাওয়া বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় বলেই পত্রপত্রিকায় সংবাদ হিসেবে আসে।

এনআরসি

বাংলাদেশ যখন ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে নিজেই হিমশিম খাচ্ছে এবং তাদের ফিরিয়ে দিতে বহিঃবিশ্বের সাহায্য প্রার্থনা করেছে ঠিক তখনই ভারতে শুরু হয় নাগরিকত্ব বিষয়ে সংবেদনীল ও বৈষম্যমূলক এনআরসি কার্যক্রম এবং আসামের নাগরিকত্ব পুঞ্জি থেকে বাদ পড়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। যদিও বাংলাদেশ সরকার থেকে বরাবরই একে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা হচ্ছে এবং ভারতও বলেছে যে এনআরসি বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলবে না। তবুও অদূর ভবিষ্যতে যে তাদের বাংলাদেশি দাবি করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যাপারে চাপ প্রদান করা হবে না তা নিয়েও ভারত কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি। উল্লেখ্য, ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও রায় দিয়েছেন যে এনআরসি থেকে বাদ পড়া কেউ ভারতের নাগরিক নন।

বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে উপমহাদেশে বাংলাদেশই এখন ভারতের সবথেকে কাছের বন্ধু হওয়ার কথা। ভারতের পাশ্ববর্তী সব দেশই যখন ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছে তখন বাংলাদেশই এখন পর্যন্ত ভারত-চীন দ্বন্দ্বে নিশ্চুপ রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ভারতের যে একপাক্ষিক ও বৈষম্যমূলক বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো সমাধান করে, দুদেশের মাঝেই একটা বিজয়ী অবস্থা বিরাজ করুক এবং দু-দেশ পারস্পরিক সহযোগিতায় আরো অনেক দূর এগিয়ে যাক এটিই বাংলাদেশ ও ভারতের বুদ্ধিজীবী, সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, উদারনৈতিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সকল মানুষের চাওয়া।