কেমন মৃত্যু হওয়া উচিত?

সাইফুল হোসেন
Published : 12 July 2020, 02:58 PM
Updated : 12 July 2020, 02:58 PM

১৯২৩ সালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শিকাগোর এজ ওয়াটার বিজ হোটেলে তখনকার পৃথিবীর কয়েকজন ধনী নেতা ও ব্যবসায়ী একটা বৈঠকে মিলিত হলেন। (গল্পটি পড়েছি ফোর্বস ডটকমে) মনে করা হয় যে, জীবনে যে সফলতার চূড়া স্পর্শ করেছেন সেটি উদযাপন করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের শোষণ এবং আধিপত্যের পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে তারা একসঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। ওই বৈঠকে যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা হলেন-

১. আমেরিকার বৃহত্তম ইস্পাত সংস্থার সভাপতি 

২. আমেরিকার বৃহত্তম ইউটিলিটি সংস্থার সভাপতি

৩. আমেরিকার বৃহত্তম গ্যাস সংস্থার সভাপতি

৪. নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি

৫. ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট-এর সভাপতি

৬. দেশটির সর্বশ্রেষ্ঠ স্টক স্পেকিউলেটর

৭. ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ কোম্পানির সভাপতি

৮. রাষ্ট্রপতি হার্ডিংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য এবং

৯. বিশ্বের বৃহত্তম মনিপলি কারবারি। 

বৈঠক শেষ করে ওইসব ক্ষমতাশালী লোকরা যার যার কাজে নেমে পড়েন। উদ্দেশ্য ছিল বেশি অর্থ কামিয়ে তাদের অবস্থান আরও সুসংহত করা এবং সেরাদের সেরা হয়ে টিকে থাকা। নিজেদের পুরো জীবনকে তারা উৎসর্গ করেছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতির চরমশিখরে ওঠার জন্য। তারপর সময় বয়ে গেছে স্রোতের মত। পৃথিবী এগিয়ে গেছে, এগিয়েছে তাদের জীবন, বেড়েছে বয়স। কেটে গেছে পরবর্তী ২৫ বছর। এবার যদি একটু চোখ ফেরাই তাদের দিকে। আমরা যা দেখবো তা হয়তো আমাদের চোখকে অবাক করে দেবে, মনকে অশান্ত করে দেবে। তবু দেখি চলুন। মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে এই সমস্ত মহামানব তাদের ক্যারিয়ার বা জীবনের এক ভয়াবহ পরিণতি পেয়েছিলেন। কি সেই পরিণতি! 

১. বৃহত্তম ইস্পাত সংস্থার সভাপতি চার্লস সোয়াব প্রায় পাঁচ বছর ধার করে চলেন তারপর একজন নিঃস্ব লোক হিসেবে মারা যান

২. বৃহত্তম ইউটিলিটি সংস্থার সভাপতি স্যামুয়েল ইনসুল দেউলিয়া হয়ে বিদেশের মাটিতে অসহায়ভাবে মারা যান

৩. বৃহত্তম গ্যাস সংস্থার সভাপতি হাওয়ার্ড হবসন মানসিক অবসন্নতায় পড়েন এবং পাগলাগারদে আশ্রয় নেন

৪. নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি রিচার্ড হুইটনি সবেমাত্র কারাগার থেকে মুক্ত হন

৫. ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট-এর সভাপতি, লিওন ফ্রেজার নিজের জীবন নিজেই নিয়েছিলেন;

৬. আর্থার কাটেন নামে স্টক স্পেকিউলেটর কপর্দকশূন্য হয়ে মারা যান;

৭. ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, যাকে ম্যাচ কিং নামে ডাকা হত সেই ইভার ক্রুয়েজারও তার জীবন নিজহাতে নিয়েছিলেন;

৮. রাষ্ট্রপতি হার্ডিংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য অ্যালবার্ট ফলকে সবেমাত্র কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল যাতে তিনি বাড়িতে নিশ্চিন্তে মারা যেতে পারেন

৯. ওয়াল স্ট্রিটের বিখ্যাত স্টক ব্রোকার জেসি লরিস্টন লিভারমোরের শেষ সম্ভবত সবচেয়ে ট্র্যাজিক। তিনি ১৯৪০ সালে  থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের এক সপ্তাহ পরে, নিউ ইয়র্কের শেরি-নেদারল্যান্ড হোটেলে যান। হোটেলের বারে পানীয় পান করেন। এসময় তিনি তার ব্যক্তিগত নোটবুকে কিছু একটা লেখেন, তারপর একটি টুলে বসে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তার বয়স ছিল ৬২ বছর। তিনি মৃত্যুকালে পাঁচ মিলিয়ন ডলার রেখে যান অথচ মৃত্যুর মাত্র ১০ বছর আগেও তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন।

জানেন লরিস্টন তার নোটে কী লিখেছিলেন? তিনি লিখেছিলেন, "আমার প্রিয় নিনা: এটি সাহায্য করতে পারে না। আমার সাথে জিনিসগুলি খারাপ হয়েছে। আমি লড়াই করে ক্লান্ত। আর চালিয়ে যেতে পারি না। এটিই একমাত্র উপায়। আমি তোমার ভালবাসার অযোগ্য। আমি ব্যর্থ. আমি সত্যিই দুঃখিত, তবে এটিই আমার পক্ষে একমাত্র উপায়। লাভ লরি" 

এটি একটি সত্য ঘটনা, কাল্পনিক কোনও কাহিনী নয়। আপনারা যারা এইটুকু পড়লেন তাদেরকে বলি। আমরা জাতি হিসেবে ভাগ্যবান যে ১৯৭১ সালে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। তখন আমাদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি উন্নয়নশীল এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি। গেল এক দশক ধরে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রায় সাত শতাংশ, গত বছর সেটা ৮.১৫ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলার, চাল ও সবজি উৎপাদনে আমরা বিশ্বে তৃতীয়, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য। আমরা বর্তমানে বিশ্বের ৭ম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। হয়ত আমরা আরও অনেকদুর যেতে পারতাম কিন্তু তবুও আমাদের অর্জন অবহেলার চোখে দেখার মত নয়। 

আমাদের অর্থনীতি অনেক বড় হয়েছে। বাজেটের আকার বেড়েছে দ্রুত গতিতে। হতদরিদ্রের হার নেমেছে সাড়ে ১০ শতাংশে এবং সার্বিক দারিদ্রের হার নেমেছে সাড়ে ২০ শতাংশে যা ৭২-৭৩ সালে ছিল যথাক্রমে ৪৮ ও ৭৮ শতাংশ।  অনেকক্ষেত্রে অনেক অর্জন আমাদের আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সব সাফল্যের পাশাপাশি আয় বৈষম্য ও সম্পদের কেন্দ্রিভুতিকরণ হয়েছে অবিশ্বাস্যহারে। অল্প কিছু মানুষ এখানে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। এই সম্পদের একটা বড় অংশ তারা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করেছেন।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ (ছয়) বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমান। 

গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ (পাঁচ) হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে ৪ (চার) লাখ কোটি টাকা। যা দেশের গেল বছরের (২০১৯-২০২০) জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বাইরে পাচার করা ছাড়াও দেশের মধ্যে আছে অবৈধভাবে উপার্জিত টাকার পাহাড় যা মূলত 'কালো টাকা' হিসেবেই পড়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়, মুল অর্থনৈতিক চ্যানেলে তার উপস্থিতি নেই। 

প্রশ্ন হচ্ছে- যারা অবৈধভাবে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছেন, বিদেশে টাকা পাচার করছেন, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জমি, বাড়ি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন যায়গায় টাকা রাখছেন তাদের এই কাজের মূলত অনুপ্রেরণাটা কী? তারা কি জানেন এই টাকা তারা কেন আয় করে বিদেশে জমাচ্ছেন? তাদের কি সুনির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য আছে নাকি তারা একটা নেশার মধ্যে পড়ে শুধু বৈধ-অবৈধ উপায়ে আয় করছেন? তারা তাদের জীবন সায়াহ্নে কী অনুভব করবেন? তারা কি তাদের মৃত্যুকালে ( যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়), শেষ বিছানায়- শুয়ে ভেবে উত্তর পাবেন কেন তারা তাদের জীবন এমনসব কাজে উৎসর্গ করেছেন যার কার্যত বিশেষ কোনও মূল্য নেই? নাকি তারা ভাববেন 'না সব ঠিক আছে, ছেলেমেয়েদের সাত জনমের আয় করে দিয়েছি, এখন সুখে মরতে পারব'? তাছাড়া তারা কি সম্পদের মালিক থেকে মরবেন? নাকি মারা যাওয়ার পূর্বেই নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য হয়ে মরবেন? তারা কি পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় কিছু টাকা পয়সা সাথে করে নিয়ে যাবেন পরলোকে সুখ কেনার জন্য? নাকি সব রেখে যাবেন পৃথিবীতে? তারা কি মানুষের ভালবাসা নিয়ে মরবেন? নাকি ঘৃণা নিয়ে মরবেন? 

যে সত্য ঘটনা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানে দেখা গেছে সেই সময়ের পৃথিবীর সেরা ধনী মানুষেরা তাঁদের জীবনকে নিরাপদ করতে গিয়ে অনিরাপদ করে ফেলেছিলেন। আমার মনে হয়, তারা জীবনের সুন্দর দিকগুলো, মধুরতম দিকগুলো উপেক্ষা করেছিলেন। সম্পদ আয় করে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা করে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের প্রয়োজনে এবং সমাজে পিছিয়ে পড়া ও অসহায় মানুষের সহযোগিতায় মনোযোগ তাঁরা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেজন্য তারা বরণ করেছেন জীবনের এক অনাকাঙ্ক্ষিত শেষ পরিণতি। কেউ কেউ হয়ত বলবেন- তখন মহামন্দা চলমান ছিল, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ঝামেলা ছিল। কিন্তু যারা এত ধনী ছিলেন তারা তাদের নিজের জীবন এবং সংসারটাও সামলাতে পারেননি? ( তারা অবৈধভাবে আয় করেছিলেন এমনটি বলছি না)।  

যারা অবৈধ উপার্জন, সামাজিক অপরাধ, রাষ্ট্রীয় অপরাধ এবং টাকা পাচারের মত ঘৃণ্য কাজের সাথে জড়িত তাদের উচিত নিজের জীবনকে গোছানো, নিজের কাছে ফিরে যাওয়া, একটু থিতু হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা যে- কেন তারা এসব করছেন? তাদের জীবনের লক্ষ্য কী? তারা কি পরিবারের সদস্যদের ভালবাসেন? তারা কি এমন মৃত্যু চান যা সম্মানের? তারা কি মনে করেন তাদের মৃত্যু হলে সমাজ তাঁকে ভালবেসে স্মরণ করবে? তারা কি সৎভাবে বাঁচতে  পারতেন না? তারা কি তাদের সন্তানদের এমন উত্তরাধিকার দিয়ে যাবেন যা তারা সম্মানের সাথে উচ্চারণ করতে পারবে? যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তাদের নিজের কাছে সন্তোষজনক হয় তাহলে বলার কিছু নেই। 

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয় মৃত্যু হওয়া উচিত সদ্যপ্রয়াত লতিফুর রহমানের মত যার মৃত্যুতে তার নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নিজের অজান্তেই চোখের জল ফেলেছেন, দেশের সাধারণ মানুষ হৃদয়ে ব্যথা অনুভব করেছেন। যিনি দেশকে ভালবেসেছেন অকৃত্রিমভাবে এবং যার স্বপ্ন ছিল দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে। যে মৃত্যুতে দেশের মানুষ স্বস্তি পায়, ঘৃণা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করে না সেই মৃত্যু কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। পৃথিবীতে যদি বারবার জীবনযাপন করার সুযোগ থাকতো তাহলে প্রথম জীবন যাচ্ছেতাই করে কাটিয়ে দ্বিতীয়বার ভাল জীবনের প্রত্যাশা করা যেত হয়ত।