লঞ্চ দুর্ঘটনায় আইন ও বিচার প্রসঙ্গে

Published : 24 Jan 2012, 07:07 PM
Updated : 12 July 2020, 01:58 PM

রাষ্ট্র সবসময় ধনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পক্ষে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার জন্যই আইন তৈরি করা থাকে। তাছাড়া এত স্বল্পমাত্রার শাস্তি লঞ্চ দুর্ঘটনায় জারি থাকবে কেন? বলছি, নৌপথে জলযান সংঘর্ষ অথবা অন্য পথে অন্য প্রকৃতির দুর্ঘটনার কথা। এত মৃতের আত্নীয়ের আহাজারি, বিভিন্ন প্রকার সামাজিক আন্দোলন, এত প্রতিবাদের পরও কেন প্রতিবছরই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে? দুর্ঘটনা সারা পৃথিবীতেই রয়েছে। কিন্তু সেসব দুর্ঘটনা কোনও পক্ষের অসতর্কতার জন্য ঘটলে কঠিন আইনের আওতায় দায়ীদের শাস্তি পেতে হয়। সঠিক বিচার হয়। আমাদের দেশে একদম স্বল্পমাত্রার সাজার অভিযোগ আনা হয় অভিযুক্তদের। আইনের সাজার পরিমাণও অত্যন্ত কম বেঁধে দেওয়া রয়েছে। আর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় হারিয়ে যায় ন্যায়বিচারের বাস্তবতা।

গত ২৯ জুন এমএল মর্নিং বার্ডকে ময়ূর-২ যেভাবে পিষে দিল আপনারা কি সেই ভিডিও ফুটেজটি দেখেছেন? তাতে কি মনে হয়েছে চালকের কোনো অবহেলার কারণে এটি হয়েছে? আমার কাছে কিন্তু তা মনে হয়নি। আমার কাছে এমন মনে হয়েছে যে, ওই লঞ্চটিকে পিষে মারার জন্য ময়ূরের চালকের আগে থেকেই বিশেষ উদ্দেশ্য না থাকলেও তার পুরোপুরি জ্ঞান ছিল যে সে যেভাবে জলযানটি চালাচ্ছেন তাতে খুব সহজেই দুর্ঘটনা ঘটবে। সে জানত যে, তার জলযানের ধাক্কা লাগলে লঞ্চটি গুড়িয়ে তলিয়ে যাবে। আর তাতে করে অনেক মানুষ নিহত হবে। তার নিজেরটিরও ক্ষতি হবে। কিন্তু ভাবে-সাবে মনে হলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। বীরত্বের মহানকর্ম ঘটিয়েছে সে। হেলপার বা চালক আনাড়ি ও শিক্ষানবীশ এ কথা বলে চালককে যারা মৃদু ধমক দিতে চায়, এবং অবহেলার কথা আনে মামলার অভিযোগে, তাদের আমি মন থেকে মানতে পারছি না। তারা ওই অপরাধকে হালকা করে ফেলছেন। অপরাধীদের অপরাধকে লঘু করে দেখছেন।

সে কারণেই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ  থানায় মঙ্গলবার ভোরে নৌ-পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) শামছুল আলম মামলাটি দায়ের করেন। প্রাণহানির ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৮০, ৩০৪ (ক), ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় অবহেলাজনিত মৃত্যুসহ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়। যে ধারাগুলোর সাজা স্বল্পমাত্রার। এতে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদ, মাস্টার আবুল বাশার, মাস্টার জাকির হোসেন, স্টাফ শিপন হাওলাদার, শাকিল হোসেন, হৃদয় ও সুকানি নাসির মৃধার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয়ের আরও পাঁচ-ছয়জনকে সেখানে আসামি করা হয়। অথচ এখানে আসামি কিন্তু অন্য লোকজনকেও করতে হয়। যদি নিয়ম ও আইন আপনি মানেন।

তবে এখনও পর্যন্ত মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মামলাটি তদন্ত করছেন ওই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল আলম।

এমএল মর্নিং বার্ড নামে ওই যাত্রীবাহী লঞ্চটি ২৯ জুন সকালে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সদরঘাটের দিকে আসছিল। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। দুর্ঘটনার পর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ'র কর্মীরা ৩২টি মরদেহ উদ্ধার করেন। লঞ্চডুবির প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর রাত সোয়া ১০টার দিকে একজনকে জীবিত উদ্ধারের কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। ধারণা করা হচ্ছে, লঞ্চের আরও যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন।

ঘটনার পর সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও বের হয়। এতে দেখা যায়, পেছনে চলতে থাকা ময়ূর-২ এর ধাক্কায় ছোট মর্নিং বার্ড কীভাবে মুহূর্তেই তলিয়ে যায়। মনে হচ্ছিল ইঞ্জিন বন্ধের চেষ্টা না করে বরং টাগের্টের শিকার অপর লঞ্চটিকে নিচে ফেলে তলিয়ে দিতে পারাই তার কাজ।

আমাদের দেশে নৌ দুর্ঘটনার মামলায় আজ পযর্ন্ত চালক, সুকানি, খালাসীদের সাজা হয়েছে দুয়েকটি ক্ষেত্রে। এর বাইরে নৌ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী, যারা নৌযানের ফিটনেস এবং ছাড়পত্র দেন, অধিদপ্তরের বড় কমর্কতা, মাঝারি কর্তারা দায় এড়িয়ে যান। তাদের বিরুদ্ধে দুর্ঘটনা বিষয়ে মামলা হয় না। যদিও ইদানিং দুদক অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের দায়ে মামলা আনলেও তা ভয়ঙ্কর রকমের দুর্বল। ওইসব মামলা বিচারাধীন বলে এর বেশি কিছু বলছি না।

যাই হোক আসল কথায় ফিরি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যেন মৃতেরা কোনও মানুষ ছিলেন না, বরং কোনো পতঙ্গ, পিঁপড়া বা তেলাপোকা। এ যেন বিধিলিপি। সড়ক, নৌপথে কত মানুষ মারা যায় তার পরিসংখ্যান গণমাধ্যমে বহুল চচির্ত হয়েছে। সুতরাং সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত না-ই বা গেলাম। তাদের জীবন নৌ দুর্ঘটনার জন্য বিশেষত চালকের অবহেলা, জাহাজ নির্মাণে ত্রুটি, জাহাজ মালিকের লোভ, উদাসীনতা ও সেই সঙ্গে অজ্ঞতা, নৌ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী, বাংলাদেশে আভ্যন্তরীণ নৌ কতৃপক্ষের আজ পযর্ন্ত কোনো ল্যান্ডমার্ক সাজা আপনারা দেখেতে পেয়েছি কি?

আমাদের প্রজাতন্ত্রে ১৯৭৬ সালের ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্সের (অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশ) এর আওতায় বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় মামলা করতে গেলে দণ্ডবিধির ধারাও আসে। অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশের ৫৫ ধারা বলছে, ঝড়ের সংকেত থাকাবস্থায় নৌযাত্রা নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধারার শর্ত ভঙ্গ হলে অভ্যন্তরীণ নৌযান মাস্টারের তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। অধ্যাদেশের ৭০ ধারায় অসদাচরণ ইত্যাদির কারণে জাহাজ বিপদাপন্ন করার শাস্তি বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে। ধারাটির (২) অনুসারে যেখানে কোনো অভ্যন্তরীণ নৌযান দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি বা কোনো ব্যক্তি আহত বা নৌযানের বা অন্য কোনো নৌযানের সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে এবং এ ধরনের কোনো নৌযানের ত্রুটি বা অভ্যন্তরীণ নৌযানের মালিক, মাস্টার বা কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্যের অযোগ্যতা বা অসদাচরণ বা কোনো আইন ভঙ্গের দরুণ ঘটে থাকে, তবে ওই নৌযানের মালিক বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্য বা তাদের প্রত্যেকেই পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারেন।

দণ্ডবিধির মতো অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশেও শাস্তি কম। দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা যদি প্রয়োগ করা যায় অর্থাৎ অপরাধজনক প্রাণনাশের অভিযোগ আনা গেলে সাজা রয়েছে সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ড অথবা যাবজ্জীবনের। আর বাদ বাকী ধারাগুলো আনতে পারলে 'গোলে হরিবোল'। ৩০৪(ক) তে পাঁচ আর, ৩০৪(খ) মাত্র তিন বছরের সাজার সঙ্গে জরিমানাও করা যায়। আবার ইচ্ছা করলে নাও করা যায়। দণ্ডবিধিতে বোপোরোয়া চালনায়, অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় ৩০৪(ক), ৩০৪(খ) এর মতো আরো কয়েকটি ধারা রয়েছে। যা সড়ক দুর্ঘটনায়, অবাধ, বেপোরোয়া গাড়ি চালনার, অবহেলায় ব্যবহার হয়ে থাকে সেগুলোর শাস্তির মাত্রাও কম।

নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সহ আরো সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন রকমের ডেটা ও পরিসংখ্যান বলছে যে, ১৯৯১ সন থেকে এ বছর (২০২০ সাল) পযর্ন্ত সারাদেশে ৫৭০টি জলযানের সলিল সমাধি হয়েছে। নৌ দুর্ঘটনায় গত ২৯ বছরে ৩ হাজার ৬৫৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ৪৮৯ জনের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এমবি নাসরিন-১ লঞ্চডুবিতে নিহত হন ১১০ জন। নিখোঁজ হন ১৯৯ জন। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঘূর্ণাবর্তে পড়ে ডুবে যায় লঞ্চটি। ওই নৌ দুর্ঘটনায় লঞ্চটির মালিক এবং মাস্টারও নিহত হন। এ ঘটনায় করা মামলায় লঞ্চটির নকশা তদারকি দলের (সুপারভাইজার প্যানেল) দুই সদস্যের এক লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক বছর করে কারাদণ্ড হয়। অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স) অনুযায়ী গঠিত নৌ আদালতে এ রায় হয়। সে সময় আইনে এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও ২০০৫ সালে আনা সংশোধনীতে তা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর করা হয়। ক্ষতিপূরণ লাখ টাকার পরিবর্তে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা করা হয়।

সেই দুর্ঘটনার সময় 'নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলন' ও 'সুরক্ষা অগ্রগতি ফাউন্ডেশন' এর উদ্যোগে ২০০৩ সালে ঈদের আগে ও পরে, বর্ষা ঋতুতে, বৈশাখ জৈষ্ঠে কাল বৈশাখীতে নৌযান দুর্ঘটনার কারণ সমাধান, বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য দাবি-দাওয়া ও সঠিক পথ বাতলানোর কাজ করেছে। ওই সংগঠনের উদ্যোগে ­­­মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, অধিদপ্তরের প্রধান, সার্ভেয়ার, প্রকৌশলী, মন্ত্রণালয়ের সচিব, নৌমন্ত্রীর সঙ্গে ঐ সংগঠনের কয়েকজন বসেছিলেন। তারা বসেছিলেন, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিষয়েও। প্রতিবছর ৮ জুলাইকে 'নাসরিন দিবস' এর ঘোষণা চেয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আগের যে পরিমাণ ছিল সেটি হাস্যকর- মাত্র ১ লাখ টাকার।

বাংলাদেশের নৌপথ কয়েক রকমের। বাংলাদেশে ১৭/১৮টি জেলা মিলিয়ে উপকূলীয় নৌপথ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চলীয় নৌপথ, তারপর দেশের মধ্যাঞ্চলের আরিচা, পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া ঘাট, নগরবাড়ি থেকে আরিচা ঘাট, বাহাদুরাবাদ থেকে বালাসীঘাট ইত্যাদি আরো কয়েকটি নৌ চলাচল পথ রয়েছে। এসব নৌপথে একেক রকমের ব্যবস্থাপনা রয়েছে নৌ চলাচলের। কিন্তু সব ব্যবস্থাপনার সমন্বয় দেখতে পাননি তখনকার ওই আন্দোলনাকারীরা। তারা ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালেও তাদের আন্দোলনের কাজ চালিয়েছিলেন। তারপরে বেসরকারি উদ্যোগে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দুর্ঘটনার বিষয়ে আর কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশের ওই কারাদণ্ডের সংশোধনী, ক্ষতিপূরণের সংশোধনী আনতে আন্দোলনকারীদের ভূমিকা রয়েছে বলে গণমাধ্যম ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করে জানতে পেরেছি।

২৯ জুন বুড়িগঙ্গার শ্যামবাজার এলাকার যে দুর্ঘটনা ঘটলো সে মামলা নৌ অধ্যাদেশে হয়নি। হয়েছে দণ্ডবিধিতে। যেটির বিচার হবে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম অর্থাৎ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। কিন্তু অধ্যাদেশের আওতায় মামলা হলে মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত মেরিন কোর্টে মামলার বিচার চলে। সেখানে বাইরের কোনো আইনজীবীকে কেউ গুরুত্ব দেন না। ওখানে নির্দিষ্ট কয়েকজন আইনজীবী এসব মামলা করে থাকেন। তাদের সাহায্য নিতে হয় বাইরের আইনজীবীদের। ওখানে রাষ্ট্রপক্ষে একজন পাবলিক প্রসিকিউটর রয়েছেন অনেকদিন ধরে। যার কোনো পরিবর্তন নেই। এখানকার বিচারের পরিবেশ নিয়েও অনেক আইনজীবী এবং সাংবাদিকের নানাবিধ অভিযোগও রয়েছে। এ আদালতটিকে মেইনস্ট্রিম আদালত এবং উন্মুক্ত আদালত হিসেবে দেখতে চান অনেক আইনজীবী এবং ব্লাস্টসহ আরো কয়েকটি আইনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ও অ্যাক্টিভিস্টরা। তারা ঢাকার জনসন রোডের আদালতপাড়ায় এ আদালত নিয়ে আসার জন্য দাবিও তুলেছেন।

নৌ দুর্ঘটনায় বড় ধরনের প্রাণহানি হলেও শাস্তির এমন বিধান নামমাত্র বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে অধ্যাদেশের কয়েকটি ধারা আবারো সংশোধন করা প্রয়োজন।

ময়ূর লঞ্চের চালকের জ্ঞান ও ধারণা ছিল যে এভাবে লঞ্চটি চালালে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং লোকক্ষয় হতে পারে। সে এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, যা কিছু ঘটুক তাতে তার কিছু যায় আসে না। ভিডিও ফুটেজ দেখে তা-ই মনে হয়। তার বিরুদ্ধে অপরাধজনক প্রাণনাশের অভিযোগ আনা উচিৎ ছিল। অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনাটাকে আমি আইনজীবী ও একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সমর্থন করি না। অপরাধজনক প্রাণনাশের অভিযোগ আনা হলে শাস্তির পরিমাণ ছিল বেশি। আর অবহেলার শাস্তির মাত্রা অত্যন্ত কম। গত ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় 'এমএল মনিং বার্ড'কে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার সময় ঘাতক 'ময়ূর-২' লঞ্চটি মূল মাস্টার নয় একজন শিক্ষানবিশ চালাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। লঞ্চের কোনো ত্রুটি নয়, মাস্টারের ভুলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এবং শিপ সার্ভেয়ার মো. মনজুরুল কবির সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যে তিনি দুর্ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। সিসিটিভির একটা ফুটেজ দেখেন তিনি। তিনি বলেন, "একটি দুর্ঘটনার পেছনে অসংখ্য কারণ থাকতে পারে। বৈরি আবহাওয়া হতে পারে, নির্মাণ ত্রুটি হতে পারে, ইকুইপমেন্ট ফেইলিওর হতে পারে। তদন্তে দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট বিষয়টি উঠে আসে।"

তিনি বলেছিলেন, "আমাদের প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, এই দুর্ঘটনায় ওপরের কোনো কারণই কাজ করেনি। আপতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে ওখানে (ময়ূর-২ লঞ্চ) মাস্টার ও অন্যান্য যারা কাজ করেছেন তাদের 'হিউম্যান ফেইলিওর'। দুর্ঘটনার অবস্থায় 'সিচুয়েশনাল অ্যাওয়ারনেস' ওই পার্টিকুলার পরিস্থিতিতে সে তার দায়িত্বটা হ্যান্ডেল করতে পারেনি, আমার কাছে এটা মনে হয়েছে।"

তিনি বলেন, "দুর্ঘটনার সময় ময়ূরের মূল মাস্টার নয় একজন শিক্ষানবিশ মাস্টার চালাচ্ছিলেন বলে আমরা শুনেছি। আমাদের পক্ষে এ মুহূর্তে এটি সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, তবে তদন্তে হয়তো পুরো বিষয়টি উঠে আসবে।"

ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া নদীর পাশের একটি সিসি ক্যামেরায় ভিডিওতে দেখা গেছে, বিশাল আকৃতির ময়ূর-২ ও অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট মনিং বার্ড পাশাপাশি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা এগিয়েই ময়ূর-২ 'মর্নিং বার্ড' এর ওপর উঠে যায় এবং উল্টে গিয়ে তলিয়ে যায় যাত্রী বোঝাই লঞ্চটি।

সেই ভিডিও দেখে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, "যেভাবে ঘটনা ঘটেছে, আমার মনে হয়েছে এটা পরিকল্পিত। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।" এই দুর্ঘটনায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ৭ সদস্য বিশিষ্ট ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

আমরা জানি এ পযর্ন্তই। দশ বছরেও মামলার রায়ের মুখ দেখা যাবে কিনা তা এ বিচারব্যবস্থায় আমরা নিশ্চিত নই। কেননা মামলার সাক্ষীদের সঠিক নিয়মে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে হ্যান্ডেলিং করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে নিহতের আত্মীয়-পরিজন, পরিবারের সঙ্গে আসামিদের হয়ে যায় আপস। সাক্ষীদের আদালতে আনতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রপক্ষ। তাদের সাক্ষী আনতে অবহেলাও থাকে।

ঘটনার তদন্ত ও বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের যথাযথ ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্র কবে নিশ্চিত করতে পারবে সেটা সুশাসনের প্রতিজ্ঞা ও তা কার্যকর করতে রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবগের্র ওপর নির্ভর করতে হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অসহায় দর্শকমাত্র।