সাহারা খাতুন: সরলতায় মোড়ানো নেতার মুখ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 10 July 2020, 08:59 PM
Updated : 10 July 2020, 08:59 PM

এখন যারা আওয়ামী লীগ করেন বা নেতা বলে পরিচয় দেন তাদের অনেকের নাম সাহেদ বা পাপিয়া। তাদের গায়ে মুজিব কোট থাকে। নারী হলে শাড়িতে বা কামিজে বঙ্গবন্ধু বা নৌকার ব্যাজ। আগের নেতাদের লেবাস লাগতো না। তাঁরা গায়ে যাই চাপাক আর বুকে যা কিছুই লাগাক, কিংবা না লাগাক মানুষ জানতো তাঁদের নাম তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল কিংবা মনসুর আলী। সে যুগের শেষ প্রতিনিধিদের একজন চলে গেছেন। যাঁর জীবনব্যাপী কোন ঘুষ,দুর্নীতি বা টাকা আত্মসাৎ-এর কোনও কেইস নাই। দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন তিনি। কিন্তু নিজেই লাজুক হয়ে থাকতেন অন্যদের দাপটের কাছে। আকর্ষণ করার মতো বাহ্যিক তেমন কিছু ছিল না তাঁর। যা ছিল তার নাম, সরলতা আর দলের জন্য ভালোবাসা ও আনুগত্য। 

এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছে। মহাখালী, গুলশান এবং বনানী এলাকায় তেমন একটা বিক্ষোভ কখনোই হতো না। তবে নিয়মিত আওয়ামী লীগের একটি ছোট মিছিল আমতলী হয়ে মহাখালী রেলগেট পার হবার চেষ্টা করতো। সবসময় এর নেতৃত্ব দিতেন তামাটে বরণ, আর একহারা গড়নের এক নারী। সাদা শাড়ির ওপর কালো কোট বলে দিত সাহারা খাতুন একজন আইনজীবী। কিন্তু পুলিশের লাঠি ছিল ভ্রূক্ষেপহীন এবং সাহারা ছিলেন তার অবধারিত শিকার।

জলখাবার রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে রায়ট ডিভিশনের এক অফিসারকে বলেছিলাম, "এই মহিলাকে এত পিটিয়ে আপনারা কী সুখ পান?" তার জবাব ছিল, "মহিলাকে পেটাবো কেন, ছেলেগুলোকে মারতে গেলেই উনি লাঠির সামনে এসে দাঁড়ান। আমারা যাই মব কন্ট্রোল করতে, ফুল তুলতে নয়। ব্যাস তাঁর কপাল ফাটে, ঠোঁট কাটে, হাত ভাঙ্গে।" বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তখন আজকের মতো ধনী ছিলনা। কিন্তু দলে সাহারা খাতুনের মতো নেতারা ছিলেন।

এখনকার আওয়ামী লীগ আর তখনের আওয়ামী লীগে আকাশ জমিন ফারাক। রাজপথের আওয়ামী লীগ মানুষের জনগণের দল। তখন এতো মুজিব কোট ছিল না। এতো লীগারও না। সে কঠিন সময়ে একজন সাধারণ আইনজীবী হিসেবে সাহারা খাতুনের কথা আপনি ভুলতে পারেন, কিন্তু সময় ভুলবে না। আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাবার পথে ট্রেন বাস বা যে কোন পথে ঢাকায় ঢুকলেই দেখতাম বড় বড় দেয়াল লিখন। তাতে লেখা- "এড: সাহারা খাতুন-কে নৌকায় ভোট দিন"। কতোবার যে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু হার মানেন নি। যার ফলে তিনবার জয়ী হয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পদে ছিলেন। সে পদ কখনো কারো জন্য সুখের কিছু হয় না। তাঁর বেলায়ও হয়নি। তাঁর সময়ে ঘটে গিয়েছিল দেশের ইতিহাসেে এক ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ড। দেশ কাঁপানো মনভাঙা সেই হত্যাকাণ্ডে উজাড় হয়ে গিয়েছিল আমাদের সাহসী বিডিআর বাহিনীর অফিসারের দল। সে দুর্ঘটনায় হতবিহ্বল সাহারা খাতুনকে দেখেছিলাম মিডিয়ার সামনে অসংকোচ কিন্তু অসহায়। তাঁর বিডিআর সদর দপ্তরে ছুটে যাওয়া প্রশংসিত হয়েছিল দেশজুড়ে। কিন্তু ঘটনার বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা আর চটজলদি অ্যাকশনের অভাব নিন্দিতও করেছিল তাঁকে। এরপর ঘটে সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনি হত্যাকাণ্ড। সে কলংকিত ঘটনার বিচার দ্রুত হবে বলে ঘোষণা দিলেও তা না হওয়ায় তাঁকে পড়তে হয়েছিল সমালোচনার মুখে। 

তার কিছুদিন পরই তিনি এসেছিলেন সিডনি। সে সময় তাঁর সাথে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়া ও আড্ডার সুযোগ হয়েছিল আমার। একসাথে ডিনার করতে করতে তাঁর সারল্য আর সহজ কথা বলায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি অকপটে যেভাবে সত্য বলছিলেন আর রাখঢাক না রেখেই ঘরের কথা বলছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল আওয়ামী লীগের মতো বিশাল ও জটিল নেতাদের দলে তিনি কতোদিন এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন! বেশিদিন লাগেনি। কিছুদিন পর তাঁকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী করে বদলি করা হয়। এরপর আর মন্ত্রী না থাকলেও বরাবরের মতো ছিলেন দলের পুরোভাগে। এখনকার মৌসুমী নেতাদের দেখে তাঁকে বোঝা যাবে না। তিনি শেখ হাসিনার হয়ে যেমন আইনি লড়াই করেছেন, তেমনি দলের বহুকর্মীর মামলাও করে দিয়েছেন বিনা পারিশ্রামিকে। 

তবে আমার মতে তাঁর বড় অর্জন সরলতা আর সহজ জীবনের মধ্য দিয়ে লাইম লাইটে থাকা। তিনি এমন কোন কথা বলতেন না যা চটকদার। চমকে দেয়ার মতো কোন ব্যক্তিত্বও ছিলেন না তিনি। কেবল নিষ্ঠা আর ত্যাগ দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় দলের শীর্ষপদে থাকা কঠিন কাজ। আজকের আওয়ামী লীগে ভোটে হারার জন্য দাঁড়ায় না কেউ। আর হার বলে কিছু নাইও। নাই কোন প্রতিযোগিতা- প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সব একতরফা। তাঁদের সময় রাজনীতি ছিল। মানুষ ভোট দিতে যেত। তাই তিনি হারলেও সম্মান নিয়ে রাজনীতি করতেন আর জিতলে তা ছিল আর গৌরবের জয়। 

সাহারা খাতুনের মৃত্যুর সাথে সাথে সে যুগের আরেকটি প্রদীপ নিভে গেল; তাদের যুগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষের রাজনীতি হিসেবে চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে। সাহারা খাতুনের মৃত্যু আমাদের রাজনীতির জন্য যতটা, ততোটাই সাধারণ মানুষের গণতন্ত্রকে জানিয়ে দিল, আমরা অভিভাবক শ্রেণির সাদামাটা মানুষদের প্রায় সবাইকে হারিয়ে ফেলছি। বিদায় আপা।