বাঙালি জীবনে ধর্মনিরপেক্ষ ইকবাল চর্চার পথিকৃৎ ভাষাচার্য শহীদুল্লাহ

গৌতম রায়
Published : 10 July 2020, 08:39 PM
Updated : 10 July 2020, 08:39 PM

মহাকবি ইকবালের জন্ম ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর, শিয়ালকোটে। তার মৃত্যু ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল,  লাহোরে। তাকে ঘিরে বাংলা ও বাঙালি সমাজের ভিতরে একটা পরষ্পরবিরোধী চিন্তা-চেতনা দীর্ঘদিন ধরে আছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে একটা বড় অংশের বাঙালি ইকবালকে অত্যন্ত উচ্চমানের একজন দার্শনিক বলে মনে করেন।

ইকবালের  মহাপ্রয়াণের পরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

স্যার মুহম্মদ ইকবালের মৃত্যু আমাদের সাহিত্যে এক শূন্যতা সৃষ্টি করল, এবং মর্মের এ আঘাত ভুলতে যথেষ্ঠ সময় লাগবে। ভারত, আজকের পৃথিবীতে যার স্থান খুবই ছোট, তার পক্ষে বিশ্ববাসীর মনে যার কবিতা অনুভূতি জুগিয়েছিল এমন এক কবি-কে হারানো খুবই বড় রকমের ক্ষতি।

মহাকবির মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ১৯৩৮ সালের ২৩ এপ্রিল স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা হচ্ছে: 

তিনি মুসলমানদের ভালো নেতৃত্ব এবং বিচক্ষণ পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমন বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তি, তেজোদ্দীপক চিন্তার উন্মেষক স্মরণীয় কাব্য রচয়িতার মৃত্যুতে মুসলমান সম্প্রদায় অপেক্ষা ভারত অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং বিশ্বসাহিত্য দরিদ্রতর হল, শুধু তোমার লেখনী সম্পদ হয়ে রইল। (অনুবাদ- ভাষাচার্য শহীদুল্লাহ)।

ইকবালের  মৃত্যুকে মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে তেজ বাহাদুর সপ্রু, সরোজিনী নাইডু,  সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরুসহ ভারতীয় রাজনীতির অনেক জ্যোতিষ্করাই 'ভারতের জাতীয় ক্ষতি' বলে বর্ণনা করেছিলেন। একই  মন্তব্য ছিল 'সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট', 'ট্রিবিউন', 'ডেইলি হেরাল্ড', 'টাইমস অব ইন্ডিয়া' ইত্যাদি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রগুলোর।

ভারতীয় রাজনীতির পরবর্তী ঘটনা স্রোতে ইকবাল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে সম্যক পরিচয়ের   অভাব থেকে এক ধরনের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী মুসলিমরা ইকবালকে তাঁদের চিন্তা-চেতনার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। এর বিপরীতে জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিমরা 'উগ্র ইসলামপন্থি'দের ইকবালকে একটা কৌণিক বিন্দুতে দাঁড় করানোর প্রবণতার সর্বশক্তি দিয়ে বিরুদ্ধাচারিতা করতে পারেনি। আবার হিন্দু সমাজের একটা বড় অংশ (তাদের ভিতর জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ এমনকি বামপন্থি চেতনার মানুষও ছিলেন) তাদের  ইকবাল সম্পর্কে সম্যক চর্চার অভাবে মহাকবির ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে একটা বিকৃত ধারণার শিকার হয়েছেন।

অবিভক্ত ভারতে মহাকবি ইকবাল-কে ঘিরে বাঙালি সমাজের এ ভুল ধারণার অবসানে প্রথম প্রয়াস চালান ভাষাচার্য শহীদুল্লাহ (জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই, মৃত্যু- ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই)। বাংলা ভাষায় ইকবালের সম্যক পরিচয় জ্ঞাপনের  ভেতর দিয়ে ইসলামের উদার, সমন্বয়বাদী, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে মহাকবি কিভাবে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে ১৯৪৫ সালেই কলম ধরেছিলেন শহীদুল্লাহ ।

শহীদুল্লাহ ইকবালের সাহিত্য জগতের পাশাপাশি ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিস্তারে ইসলামকে সঠিক ধ্যান-ধারণা নিরিখে প্রয়োগের প্রেক্ষিতে মহাকবির অবদান সম্পর্কে কলম ধরেছিলেন। আত্মবিস্মৃত বাঙালি বাংলা ভাষায় ইকবাল চর্চার পথিকৃৎ আচার্য শহীদুল্লাহর এ বিষয়ে অবদান (বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চায়) এখন আর উল্লেখই করে না।

শঙ্খ ঘোষের  ইকবাল চর্চার বহু আগে আচার্য শহীদুল্লাহ, কবি অমিয় চক্রবর্তী এবং কামালউদ্দিন খান যে উদার, নিরপেক্ষ মননশীলতার ভিতর দিয়ে ইকবালের মহাকাব্যিক চিন্তা চেতনার বিশ্লেষণ করেছিলেন, তা বাংলা এবং বাঙালির কাছে এক পরম বিস্ময়ের বিষয়। ইকবাল ঘিরে নির্মোহ আলোচনা পাকিস্তানে হওয়া সত্ত্বেও আজও কলকাতার কিছু কিছু মানুষ নিজের পাণ্ডিত্য জাহিরে ইকবাল-কে 'সাম্প্রদায়িক' না বলে জল গ্রহণ করেন না। 

প্রগতিশীল ভাবনার সঙ্গে যুক্ত থাকা এইসব মানুষেরা এ কথাও রটান যে, ইকবাল নাকি বহুবার নিজেকে এমন বদলেছেন, যাকে স্ব-বিরোধ বলা যায়। অথচ সেই স্ববিরোধটি কোথায়- এ প্রশ্নের তারা উত্তরই দিতে পারেন না। কারণ একটু জেরা করলেই বোঝা যায়। ওই ধরনের লোকেরা সামগ্রিকভাবে ইকবালকে নিয়ে চর্চা তো দূরের কথা, 'স্যাঁরে জাঁহাসে আচ্ছা'-র বাইরে তারা ইকবালের লেখা এক পাতাও পড়েননি। এ অংশের মানুষের কাছে তাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের ইকবাল চর্চা, কবি অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ইকবালের প্রত্যক্ষ সংযোগ, কামালউদ্দিন খানের ইকবাল চর্চা- এসব বিষয় নিয়ে কোনও মাথা ব্যথাই নেই।

ইকবাল সম্পর্কে সম্যক চর্চা না থাকলে অখণ্ড ভারতে মুসলিম মানসের চেতনার বিবর্তন বোঝা যায় না। আর ইকবাল চর্চাতে ড. শহীদুল্লাহের ঐতিহাসিক অবদান ঘিরে যথাযথ অনুভূতি না জানলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি মানসকে ধারণ করতে পারা যায় না।

বিশ শতকের সূচনাপর্বে পাঞ্জাবে এক প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্প হয়। সেসময় তরুণ ইকবাল রয়েছেন লাহোরে তাঁর নিজের বাড়িতে। ভূমিকম্পে গোটা লাহোর শহর প্রায় দুলছে। শহরের চারিদিকে কান্নার রোল পড়ে গেছে। অথচ মহাকবি নির্মোহভাবে তাঁর নিজের ঘরের খাটে শুয়ে একটি বই পড়াতে নিমগ্ন রয়েছেন ।   

ভূমিকম্প ঘিরে চারিদিকের মানুষের আতঙ্ক, কোলাহল- কোনো কিছুই পাঠ নিমগ্নতা থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত করতে পারল না ইকবালকে। ইকবালকে এমন দেখে তার পরিচারক অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়লেন। পরিচারকের  ব্যস্ততা দেখে ইকবাল তাকে বললেন-

আলি বক্স, এমনভাবে ছুটোছুটি করে বেরিয়ো না তুমি। সিঁড়ির উপর গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।

এরপর লাহোরের স্থানীয় এক সরকারি কলেজের অধ্যাপক ও জ্ঞানযোগী আলাম্মা মোহাম্মদ ইকবাল আবার পাঠ নিমগ্নতায় ডুবে গেলেন।

আচার্য শহীদুল্লাহও যখন ইকবাল চর্চা করেছেন, তখন সেরকম ধ্যানমগ্নই ছিলেন। তিন লিখছেন-

তাঁহার মাতাপিতা পরম ধর্ম পরায়ন ছিলেন। তাঁহার  পূর্বপুরুষ কাশ্মীরবাসী  ব্রাহ্মণ ছিলেন। ইকবাল এই বংশ গৌরব ভুলিতে পারেন নাই।

এ প্রসঙ্গে ইকবালেরই একটি  কবিতার বঙ্গানুবাদ করেছেন শহিদুল্লাহ-

 আমাকে দেখো, কেননা হিন্দুস্থানে তুমি দেখিবে না/ এক ব্রাহ্মণ-সন্তান যে হইয়াছে রূমির ও শম্স-ই-তবরীযের  রহস্যবিদ।

সাধারণভাবে আমাদের ধারণা উনিশ শতকে অভিজাত বা অনভিজাত- যে কোনও মুসলিমের কাছেই  ইংরেজি শিক্ষা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। শহীদুল্লাহ লিখছেন:

সে যুগে মুসলমান সন্তানের পক্ষে ইংরেজি শিক্ষা পাপ বলিয়া গণ্য হইত। যাহারা পড়িত, লোকে তাহাদিগকে খ্রিস্টান বলিত। কিন্তু ইকবালের পিতা শেখ নূর মোহাম্মদ ইংরেজি শিক্ষা দিতে উৎসুক ছিলেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন,  কালের সঙ্গে তালে তালে না চলিতে পারিলে মুসলমান সমাজ উঠিতে পারিবে না।

ছাত্র জীবন থেকেই ইকবালের মেধা, সত্যবাদিতা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের যে পরিচয় শহিদুল্লাহ এঁকেছেন,  সেই ছবি সাধারণ বাঙালির কাছে অজানা। শহীদুল্লাহ লিখছেন- 

তাঁহার ছাত্র জীবনের একটি ঘটনা অনেকের নিকট হতে মুখোরোচক হইবে। তিনি একদিন কিছু বিলম্ব করিয়া ক্লাসে উপস্থিত হন। শিক্ষক কৈফিয়ত চাহিলেন। ইকবাল ত্বরিত উত্তর দিলেন, 'স্যার ইকবাল (এই 'ইকবাল' শব্দটির অর্থ সৌভাগ্য) বিলম্বে আসে। মাস্টার সাহেব তাঁহার এই  উপস্থিত উত্তরে চমৎকৃত হইলেন।

ইকবালের জ্ঞান সাধনা প্রসঙ্গে শহীদুল্লাহ এক আরবি কবির উক্তি উদ্ধৃত করেছেন:

শ্রম অনুপাতে করো উন্নতিসাধন, যে চায় উন্নতি করে রাত্রি জাগরণ। যে জন মুকুতা চায় ডুবে সিন্ধু জলে। তবে তো সৌভাগ্য লাভ ভাগ্যেষতার ফলে। শ্রম বিনা উন্নতি যে করে আকিঞ্চন, অসম্ভব আশা তার, বিফল জীবন।

উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপে গিয়ে প্যান-ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ইকবালের পরিচয় ও একাত্মতা গড়ে ওঠে। প্রথম জীবনে লন্ডনে ছাত্র অবস্থায় সেখানকার ভারতীয় মুসলিম ছাত্রদের সংগঠন আঞ্জুমান-ই-ইসলাম ঘিরে ব্রিটিশদের নানা ওজর আপত্তির নিরিখে এ সংগঠনের নাম করণের সঙ্গে 'প্যান ইসলামিক ' শব্দটি যুক্ত করে সেই বয়সেই ইকবাল অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে,  সাধারণভাবে উনিশ-বিশ শতকের নবজাগরণ ঘিরে যাঁরা আলোচনা করেন, তাঁরা এই জাগরণে মুসলিম সমাজের ভূমিকার প্রায় উল্লেখই করেন না। বিশ শতকের সূচনাপর্বে বাঙালি মুসলমানের ভিতরে আধুনিক শিক্ষার প্রতি যে ধীরে ধীরে উৎসাহ তৈরি হতে শুরু করেছিল, তার প্রমাণস্বরূপ ইকবালের জীবন ও কর্ম আলোচনা প্রসঙ্গে মহাকবির প্রথম লন্ডন আগমন ঘিরে সেই সময়ে লন্ডনে অধ্যায়নরত আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর (পরবর্তী কালে ডক্টরেট) কথা আচার্য শহীদুল্লাহ উল্লেখ করেছেন।

এ আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী হলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান শিক্ষাবিদ।

বাঙালি মুসলমানের ভেতরে যদি বিশ শতকের সূচনাপর্বে আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে এতই অনীহা থাকে তাহলে বাঙালি ছেলে আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনো এবং আঞজুমান-ই-ইসলাম নামক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া (যে সংগঠনের কাজ ব্রিটিশরা আদৌ ভালোভাবে নেয়নি) সম্ভবপর হতো না।

ইকবাল তাঁর জীবনে বহু মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন। দেশে-বিদেশে বহু পণ্ডিতের প্রত্যক্ষ ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল,  কিন্তু এসব সত্ত্বেও তাঁর বাল্য শিক্ষক মীর হাসানের প্রভাব ইকবালের বাকচাতুর্য নির্মাণের প্রধান স্তম্ভ ছিল বলে শহীদুল্লাহ মন্তব্য করেছেন।

তিনি লিখছেন:

একবার পাঞ্জাবের দুই প্রখ্যাত রাজনৈতিজ্ঞ  ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠকী আলাপে ইকবাল বললেন যে, ইহাদের একজন শয়তানের তাবেদারী করিতেন এবং তাহাকে  খুশি করার জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। অপরজনকে শয়তান ভয় করিত এবং তাহার সহিত বন্ধুত্ব করতে আগ্রহান্বিত  হইয়া বলিল, 'আমরা উভয়েই এক, আসুন হাত মিলিয়ে চলি।

শহীদুল্লাহ লিখছেন:

ইংরেজ সরকারের স্যার পদবি গ্রহণের সময় 'সরকার কী দহ্ লিজ পে সর হো গয়ে  (সরকারের চৌকাঠে ইকবাল নত করিয়াছেন শির)- যারা বলিয়াছিলেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই পরবর্তীকালে দেখিয়েছেন যে, ইকবাল ব্রিটিশ সরকারের নীতির সমালোচনায় কখনো পিছপা হন নাই। সাইমন কমিশনের সাক্ষ্যে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, 'ব্রিটিশের বন্দুকের তলায় হিন্দুরা মুসলমানদের শাসন করিতেছে।' শহীদগঞ্জ মসজিদ ব্যাপারে প্রিভি কাউন্সিলে মামলা দায়ের করার ব্যাপারেও ইকবাল বলিয়াছিলেন যে,  ব্রিটিশের ন্যায়বিচার শক্তির উপর তাঁহার আস্থা নাই। 

আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ভারতবর্ষের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকরা যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদে খানিকটা দ্বিধান্বিত তখন কোনওকিছুর ভ্রূকুটি না করে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি জালিওয়ানালাবাগের ওই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইকবালের সোচ্চার উচ্চারণ নিয়ে আমাদের দেশে প্রায় আলোচনা হয় না বললেই চলে।

শহীদুল্লাহ লিখছেন: 

ইকবালের জীবনের শেষভাগে পৃথিবীর ও ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক কিছু গুরুতর ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর প্রথম মহাসমর, ভার্সাই সন্ধি, ভারতবর্ষে রাওলাট অ্যাক্ট, জালিওনালাবাগের  হত্যাকাণ্ড, খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন,  তুর্কিতে সাধারণতন্ত্র স্থাপন ও খিলাফতের বিলোপ সাধন- এইগুলি পৃথিবীর ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় থাকবে। ইকবাল কোনও  আন্দোলনে আন্দোলিত হন নাই। তিনি ভীষণ ঝড় ঝঞ্ঝাতের মধ্যে হিমালয় গিরির ন্যায় অটল অচল থাকিয়া নিজের ধ্যানেই মগ্ন রহিলেন। রাজনৈতিক চেতনা তাঁহার তীব্র ছিল। রাজনীতিতে তিনি এক প্রকার বিপ্লবীই ছিলেন। কিন্তু তিনি সমসাময়িক রাজনীতিতে কোন ও প্রধান অংশগ্রহণ করেন নাই। এ বিষয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের সহিত তুলনীয়। রাজনৈতিক নেতা হইবার আকাঙ্ক্ষা ইকবালের কোনো কালেই ছিল না।

তবু তাঁহার  বন্ধু-বান্ধবদিগের সনির্বন্ধাতিশয্যে তিনি  ১৯২৬   সালে পাঞ্জাব লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের  সদস্য পদপ্রার্থী হন। তাহাতে অনায়াসে কৃতকার্য হইয়া তিনি প্রদেশের রাজনীতিতে যোগদান করিয়া কয়েকবছর সুনামের সহিত মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে ব্যাপকভাবে সুনিশ্চিত অভিমত ব্যক্ত করেন। এই সদস্যরূপে কাউন্সিলের অধিবেশনে তিনি কৃষক ও মজুরদের সমস্যা,  রাজস্ব ও আয়কর ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকটি মূল্যবান মতামত প্রকাশ করেন।

পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য কখনো সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি এ সম্পর্কে ইকবাল খুব স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, 'লোকে নিজের কোনো না কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাউন্সিলে যায়, আমার তো নিজের কোন স্বার্থ নাই'।"

১৯৩০  সালের ২৯ ডিসেম্বর সারা ভারত মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন ইকবাল। সেই অধিবেশনে তাঁর ভাষণকে ঘিরে তাঁকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের এবং পাকিস্তানের অন্যতম স্থপতি বলা হয়। এ সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে শহিদুল্লাহ লিখছেন: 

ইহা লক্ষ্য করিবার  বিষয় যে, তিনি ওই অভিভাষণে পাকিস্তান পরিকল্পনার আভাস দান করেন। তাহার পূর্বে অবশ্য  ১৯২৫ সালে পাঞ্জাবের 'বীরকেশরী নেতা'  ও ভারতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি ও নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রথম সভাপতি লালা লাজপত রায় এইরূপ মুসলিম স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের প্রস্তাব করিয়াছিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ও আরো কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রের ঐ রূপ মত ছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদী কোনও  সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দই  ইহার গুরুত্ব তখনও উপলব্ধি করেন নাই। এমনকি ১৯৩৩  সালে জয়েন্ট কমিটি অফ কনস্টিটিউশনাল রিফর্মের বিবরণীতে প্রকাশ যে, মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দই ইহাকে ছাত্রদের স্বপ্ন (স্টুডেন্টস ড্রিম), উদ্ভট ও অবাস্তব বলিয়া মন্তব্য করিয়াছিলেন।

 এ প্রসঙ্গে চৌধুরী খালিকুজ্জামান এর 'পাথ ওয়ে টু পাকিস্তান' গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করেও শহীদুল্লাহ দেখিয়েছেন ইকবালের ওই ভাষণ সেই সময় কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। এমনকি সম্মেলনের কার্যবিবরণীতে পর্যন্ত কোনো প্রকার লিখিত বিবরণ বা প্রস্তাব হিসেবে সেটি গৃহীত হয়নি ।

বিষয়টি নিয়ে শহীদুল্লাহ জিন্নাহের  জীবনীকার হেক্টর বালিথোর  'জিন্না, ক্রিয়েটার  অব পাকিস্তান'  গ্রন্থ থেকেও বিস্তারিত উদ্ধৃতি দিয়েছেন।

ইকবালের রচনাবলীর যে সামগ্রিক পরিচয় শহীদুল্লাহ তাঁর ইকবাল সম্পর্কিত  গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, তা নিয়ে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে আলোচনাই হয়নি- এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্য, পরিতাপের বিষয়। ইকবাল রচিত 'বাঙ্গ-ই-দরাবাংলা (ঘণ্টাধ্বনি), আসরার ও রুযুম (রহস্য ও গুপ্তকথা), পয়াম ই মশশিক (প্রাচ্যের বাণী), যবূর ই আজম (আরব দেশীয় মহাগীতি) , জাওঈদ নামা (অমর গীতি),  বাল ই জিব্রীল- (জিব্রাইলের ডানা), যর্ ব ই কলীম (মুসার যষ্টি আঘাত),  পস্ চি বায়দ কর্দ (অতঃপর কী কর্তব্য),  আরমুগান-ই-হিজাব (হিজাবের উপঢৌকন),  দি রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট অন ইসলাম ইত্যাদি গ্রন্থাবলী ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্যশীল,  সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিকতার  এক জীবন্ত দলিল।

আচার্য শহীদুল্লাহ যেভাবে ইকবালের ভাবনা, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের নিরিখে আজ থেকে প্রায় আশি-নব্বই বছর আগে বাংলার তথা বাঙালির সমাজ জীবনের সামনে তুলে ধরে গেছেন, তা আজকের দিনের প্রেক্ষিতে আবার নতুন করে মানুষের সামনে তুলে ধরা একান্ত জরুরি।

শহীদুল্লাহ ইকবালের অনুবাদ করে লিখছেন: 

হে ভারত তোমার দৃশ্য কাঁদায় আমাকে, সকল উপাখ্যানের মধ্যে তোমার উপাখ্যান উপদেশপ্রদ।

তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ 'জাওঈদ  নামা'-র অনুবাদে শহীদুল্লাহ লিখছেন:

দেশের সাথে দেশবাসীর এক বিশেষ সম্পর্ক আছে , কেননা তাহার মাটিতে একরূপ জাতীয়তার উদয় হয় ।…(হে ব্রাহ্মণ! ) তুমি মনে করে পাথরের মূর্তিতে খোদা আছেন,  আমার কাছে স্বদেশের ধূলির প্রতিটি কণাই দেবতা।

এটি-ই  হলো মহাকবি ইকবালের জীবনবোধের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। ভারতীয় সংস্কৃতির এ সুমহান ঐতিহ্য বাংলা তথা বাঙালি সমাজের কাছে প্রথম বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছিলেন ভাষাচার্য শহীদুল্লাহ। তাঁর এই ইকবাল চর্চা ছিল পবিত্র ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির ভিতরেই সমন্বয়ী চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের এক শুভ সূচনা। পশ্চিমবঙ্গে যেটুকু সামান্য ইকবাল চর্চা হয়, সেখানে কেবল উঠে আসে শঙ্খ ঘোষের নাম। উচ্চারিত হয়ই না বিশ্ব নাগরিক কবি অমিয় চক্রবর্তীর ঐতিহাসিক অবদান। পশ্চিমবঙ্গেরএকটি বড় অংশের উন্নাসিক বাঙালি নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও, মধ্যবিত্ত হিন্দু মেট্রোপলিটন মানসিকতার উপরে নিজেদের আজ পর্যন্ত মেলে ধরতে পারেন নি। তাঁরা খোঁজই রাখেন না মহান মানবপ্রকৃতিবেত্তা কামালউদ্দিন খানের ইকবাল চর্চা সম্পর্কে। 

ভাষাতত্ত্বের প্রশ্নে ড. শহীদুল্লাহ নিয়ে সামান্য আলোচনা পশ্চিমবঙ্গে হয়। কিন্তু বাঙালি মানসে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজকে বপনের ক্ষেত্রে ইকবালের ঐতিহাসিক অবদান নিয়ে ভাষাচার্যের কাজকে কেউ স্মরণ করেন না। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধর্মনিরপেক্ষ বুনিয়াদ তৈরিতে এটি কতোখানি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল সেই আলোচনাও উপেক্ষিত রয়ে যায়।