কিম আবার পুরোনো স্ক্রিপ্টে ফিরে গেছেন

Published : 10 July 2020, 10:58 AM
Updated : 10 July 2020, 10:58 AM

দীর্ঘদিন ধরে চলমান টেলিভিশন সিরিজের শীর্ষ চরিত্রের মতোই উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন তার চিরচেনা নাটুকেপনা দিয়ে কোরীয় উপদ্বীপের সর্বশেষ সংকট শুরু করলেন। এই মাসের শুরুর দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরে, কিম সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার কূটনীতিকদের যে বিল্ডিংটিতে অতীতে মিটিং আয়োজন করা হতো তা উড়িয়ে দিয়েছে। সীমান্তে আবার সেনা উপস্থিতি বাড়িয়েছে এবং দক্ষিণের বিরুদ্ধে নতুন করে সহিংসতার হুমকি দিয়েছে। মে মাসে কিমের 'পারমাণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধে উত্তর কোরিয়া' এর বিনিয়োগ বাড়িয়ে তোলার ঘোষণার পরই বোমা হামলার মত দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রদর্শনী।

যদিও ২৪ জুন, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছিল যে দেশটির কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশন দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে 'সামরিক কর্মপরিকল্পনা' স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই অন্তর্বর্তীকাল কতদিন স্থায়ী হবে তা এখন সহজেই অনুমেয়। কিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে 'দেশের যুদ্ধ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত' করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার রূপরেখা বিবেচনা করা হয়েছিল বলেও জানা গেছে। এবং সঙ্গত কারণেই ওয়াশিংটন এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ অবস্থাটি উপেক্ষা করছে।

রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্পের তৈরি টিভি সম্মেলনের সাথে দুই বছর খেলার পরে কিম এখন দৃঢপ্রত্যয়ী যে 'ব্রোম্যান্স' কাহিনীটি ইতিমধ্যেই আবেদন হারিয়ে ফেলেছে এবং তার পুরানো পদ্ধতিই তার উচ্চ রেটিং বজায় রাখবে।

ট্রাম্পের নিস্প্রভতা থেকে তার রাজনৈতিক লাভ আদায় করে নেওয়ার পরে কিম এখন স্পষ্টতই উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তি জাহির করছে। এই পয়েন্টটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য, তিনি পারমাণবিক কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা জেনারেলকে কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের সহ-সভাপতির পদে পদোন্নতি দিয়েছেন। পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশটির কৌশলগত সাফল্যে অবদান রেখেছেন এমন ৬৯ জন জেনারেলকেও পুরস্কৃত করেছেন।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে হ্যানয়-তে পারমাণবিক সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই, কিম কথা এবং কাজ উভয় ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্য বজায় রেখেছেন। গত বছরের এপ্রিলে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, ট্রাম্পের উত্তর কোরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মেয়াদ গত বছরের শেষ অবধি ছিল। তারপর থেকে উত্তর তার স্বল্প-পরিসরের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে (লক্ষণীয়ভাবেই সাফল্য লাভ করছে), একটি ক্ষেপণাস্ত্র উত্পাদন কেন্দ্রকে প্রসারিত করেছে এবং তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জন্য নতুন সুযোগ সুবিধা তৈরি করেছে।

স্পষ্টতই, উত্তর কোরিয়ার গোপন আয়ের উৎস ও বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য ট্রাম্পের 'সর্বাধিক চাপ' প্রয়োগের প্রচারণা দেশটিকে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্রের কর্মসূচি থেকে ফিরিয়ে আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকান কর্মকর্তারা সেই হিসাবে অনেকটা গত মাসেই জিনিসটা স্বীকার করে নেয় যখন মার্কিন বিচার বিভাগ ২৮ জন উত্তর কোরিয়ান এবং পাঁচজন চীনা কর্মকর্তা এবং ব্যাংকারকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য অভিযুক্ত করেছিল। ২০১৪ সাল থেকেই অভিযোগ উঠছে যে, চীনের সহায়তায় বিশ্বব্যাপী উত্তরের নেটওয়ার্কের সংস্থাগুলির মাধ্যমে কিম তার পারমাণবিক অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র এবং উচ্চ-প্রযুক্তি প্রোগ্রামগুলিতে ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে।

কিম একইতালে উত্তর কোরিয়ার প্রচলিত সামরিক ক্ষমতার বিশালতা বাড়িয়ে চলেছে। যদিও এর সামরিক সরঞ্জাম সবদিক দিয়েই মার্কিন সজ্জিত আস্ত্রশস্ত্র এবং বিমানের তুলনায় অনেকটাই খারাপ অবস্থানে আছে, তবুও উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি তার অস্ত্রগুলির নিখুঁততা এবং পাল্লা উভয়ই উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানীকে নিজের দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখতে তার ১.১ মিলিয়নের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ৭০%ই "ডিমিলিটারাইজড/অ-সামরিকৃত" অঞ্চলের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যেই রেখেছে। অনুমান অনুসারে, একটি প্রধান মার্কিন সামরিক স্থাপনাসহ সিউল এলাকায় উত্তর কোরিয়া কেবল ১০ মিনিটের মাঝে ২৫,০০০ আর্টিলারি রাউন্ডের বৃষ্টি ঝরাতে পারে।

নিশ্চিতভাবেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী কোরিয়া উপদ্বীপে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে বড় প্রযুক্তিগত সুবিধা পাবে। তবে একটি স্বল্পকালীন দ্বন্দ্ব সিউলের জন্য ধ্বংসাত্মক হবে। কেননা এটি প্রায় ২৫ মিলিয়ন লোকের আবাসস্থল যা দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং এর জিডিপির ৭০%।

এই পটভূমিতে, সেখানে অবস্থিত মার্কিন বাহিনীর জন্য আর্থিক সহায়তা চারগুণ করার জন্য ট্রাম্পের দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা আশ্চর্যজনকভাবেই দায়িত্বজ্ঞানহীন। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যয়-ভাগাভাগির মেয়াদোত্তীর্ণ চুক্তি পুনর্নবীকরণের জন্য আলোচনা কানাগলিতে গিয়ে ঠেকেছে, তবে নতুন অস্থায়ী চুক্তিটি মার্কিন সুবিধাগুলিতে কর্মরত ৪,০০০ দক্ষিণ কোরিয়ানদের কমপক্ষে কাজ চালিয়ে নিতে দিচ্ছে। তবে সিউল সাময়িকভাবে এই বেতনগুলি পরিশোধ করলেও, এই চুক্তি দক্ষিণ কোরিয়ানদের চোখে ট্রাম্পের অবস্থানকে থোড়াই উন্নত করবে।

কিম এই বিষয়টি থেকে আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন যে ট্রাম্প জাপানকেও চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছে, দাবি করেছে যে, জাপানকেও তার সীমান্তের মধ্যে মার্কিন বাহিনীর জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষার জন্য জাপান গুরুত্বপূর্ণ, তবে দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক তেমন জোরালো নয়। গত বছর, মার্কিন চাপের মুখে ফিরে আসার আগে দক্ষিণ কোরিয়া হুমকি দিয়েছিল দ্বিপক্ষীয় গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করার ব্যবস্থা থেকে সরে যাওয়ার। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বেশিরভাগ জাপানীরই আন্তর্জাতিক ব্যাপারে ট্রাম্পের পরিচালনার বিষয়ে কোনও আস্থা নেই। এই জাতীয় কারণগুলি অনিবার্যভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ককে বিড়ম্বনায় ফেলবে, যার সব কিছুই কিমকে উপকৃত করবে।

এই অঞ্চলে মার্কিন জোটকে ক্ষতিগ্রস্থ করার পাশাপাশি ট্রাম্প চীনের সাথেও উত্তেজনা বাড়িয়ে কিমের পক্ষেও সুবিধা করে দিচ্ছেন। যার ফলে চীন এখন তার ক্লায়েন্ট দেশে লাগাম লাগাতে কম ঝুঁকবে। কিম সাম্প্রতিক সময়ে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছেন কেননা চীন উত্তর কোরিয়ার ৯০% এরও বেশি ব্যবসার অংশীদার, এবং গত জুনেই তিনি পিয়ংইয়াং সফর করেছিলেন। এই বৈঠক এবং অন্য সকল কিছুই নির্দেশ করে যে চীন কিমের আচরণ সম্পর্কে বিশেষ অবাক বা উদ্বিগ্ন নয়।

এর মানে এই নয় যে কিম মসৃন পথে আছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, সীমিত খাদ্য উত্পাদন এবং বিভিন্ন সংস্কার ব্যর্থতার কারণে উত্তর কোরিয়া মারাত্মক অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। গত ডিসেম্বরে ওয়ার্কার্স পার্টি অফ কোরিয়ার বার্ষিক অধিবেশনে বক্তৃতার পরে, ফেব্রুয়ারি এবং এপ্রিল মাসে কিমের প্রকাশিত মন্তব্যগুলি বোঝায় যে তিনি এই বছরের প্রথমার্ধটি অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দিতে মনোনিবেশ করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারীর জন্য চীনা সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া, নিঃসন্দেহে উত্তরের ভাঙ্গা অর্থনীতিতে আঘাত করেছে। এবং যেহেতু কিম তার পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপর কঠোর তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন তা অভ্যন্তরীণ সমস্যা আরও বাড়াতে পারে।

অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিসহ বা ছাড়াই, কিম তার পরিবারের ভাল রিহার্স করা নাটুকেপনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা কম। তার প্রয়াত বাবা এবং দাদার অতীত পারফরম্যান্সের মতো, তার নাটুকেপনায় এক দশক আগে দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বীপপুঞ্জে গুলি চালানোর মতো সহিংসতা, চাঞ্চল্যকর উস্কানি এবং সম্ভবত সামরিক ঘটনার হুমকিও থাকবে। সমস্ত লক্ষণই উত্তরের অংশে আরও ঝামেলার ইঙ্গিত দেয়। কোরিয়ান উপদ্বীপে দীর্ঘকাল ধরে চলমান সাইকোড্রামার শীর্ষস্থানীয় চরিত্রটি এখন নতুন হতে পারে তবে নাটকটি এখনও একই রকমই আছে।