করোনাভাইরাস: টেস্টের মিথ্যা রিপোর্ট ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

মামুন আহমেদ
Published : 10 July 2020, 07:39 AM
Updated : 10 July 2020, 07:39 AM

ভুল করোনাভাইরাস রিপোর্ট নিয়ে ভ্রমণের অভিযোগে ইতালি থেকে বাংলাদেশী যাত্রীদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। ইতোপূর্বে জাপানসহ বেশ কিছু দেশ বাংলাদেশের সাথে বিমান যোগাযোগ বিছিন্ন করেছে একই অভিযোগে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে গুরুত্ব সহকারে। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদেশে আমাদের শ্রমবাজারসহ দেশের সার্বিক ভাবমূর্তির ওপর। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের সাথে সকল আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার জরুরি ভিত্তিতে।

কেন এমন অবস্থা সৃষ্টি হলো? মানহীন করোনাভাইরাস রিপোর্টের জন্য দায়ী কে? এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? মানসম্পন্ন রিপোর্ট আমাদের দেশে কি সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই এ লেখার অবতারণা।

নিজস্ব আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি না থাকার পরও কিছু প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাস টেস্ট করার অনুমতি পেয়েছে। এ সুযোগে তারা নমুনা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেয়া শুরু করল। আবার কিছু কিছু আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষায় প্রায় ৩০ শতাংশ রিপোর্ট ভুল হয়েছে বলে বিভিন্ন পর্যায়ে সমালোচনা আছে। এ এক অসম্ভব অকল্পনীয় অবস্থা। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আরটি-পিসিআর করোনাভাইরাস টেস্টের স্বর্ণমান (Gold Standard) হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, বাংলাদেশে এত ভুল আর ভুয়া রিপোর্ট ল্যাবরেটরি-ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের অস্বাভাবিক আর করুণ চিত্রই ফুটিয়ে তুলছে।

কোনো পরীক্ষার গুণগতমান নির্ভর করে ল্যাবরেটরির মান নিয়ন্ত্রণ (Quality Control) ও মান নিশ্চিতকরণ (Quality Assurance) ব্যবস্থার ওপর। এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত আবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে (১) সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ করে সঠিক সময়ে ও তাপমাত্রায় তা ল্যাবরেটরিতে পরিবহন; (২) মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি আর কিট ব্যবহার করে পরীক্ষা করা; (৩) প্রশিক্ষিত আর অভিজ্ঞ জনবল নিয়োজিত করা যারা ক্লিনিক্যাল কাজে অভ্যস্ত; (৪) পরীক্ষা পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা তা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দ্বারা তদারকি করা এবং (৫) সবশেষে ফলাফল যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে নির্ভুলভাবে পরীক্ষার রিপোর্ট তৈরি করা।

আমাদের ভুলটা কোথায় হচ্ছে? করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্টে মাত্রাতিরিক্ত ভুল হবার কারণ প্রধানত চারটি বলে ধারণা করা যায়। (১) সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরিবহণ না করা (২) পরীক্ষা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত RNA আলাদা করার ধাপ সঠিকভাবে অনুসরণ না করা (৩) মানহীন আরটি-পিসিআর কিট ব্যবহার করা (৪) সঠিকভাবে পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে নির্ভুল রিপোর্ট প্রস্তুত করতে না পারা। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান অস্বাভাবিক অবস্থার।

করোনাভাইরাস মহামারীর সুযোগে এক শ্রেণির অসৎ উৎপাদনকারী মানহীন নমুনা সংগ্রহের কিট এবং আরটি-পিসিআর কিট উৎপাদন করে বাজারজাত করেছে বিশ্বব্যাপী। সিধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির অনুপস্থিতি এবং ব্যাপক চাহিদার সুযোগে এসব মানহীন কিট বিভিন্ন দেশে ঢুকে পড়েছে বাধাহীনভাবে। বাংলাদেশও এর বাতিক্রম নয়। প্রতারিত হয়েছে বুঝতে পেরে অনেক দেশ মানহীন কিট ফেরত পাঠিয়েছে উৎপাদনকারীর কাছে। বাংলাদেশ সেটা করেছে কি না তা আমার জানা নেই। ল্যাবরেটরিতে আরটি-পিসিআর ব্যবহার করে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন। আর ফলাফল যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট তৈরি করতে অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। রাতারাতি নিশ্চয়ই অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তাতে ফলাফল বিশ্লেষণে সমস্যা রয়ে গেছে। সমস্যার সমাধান করা যেত আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে। তা করা হয়নি বলেই জানি।

আশার কথা আমাদের ল্যাবরেটরিগুলোতে অনেক দক্ষ-অভিজ্ঞ অণুজীব বিজ্ঞানী-মলিকুলার বিজ্ঞানী কাজ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে মান নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত সকল উপাদান ল্যাবরেটরির পরিচালক বা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার আওতাধীন থাকে না। মান নিয়ন্ত্রণে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যন্ত্রপাতি আর কিট কেনায় তাদের মতামত অপরিহার্য নয়। ল্যাবরেটরিতে সরবরাহ করা কিটের মান সবসময় সঠিক থাকে না। যন্ত্রপাতি আর কিট এর মান সঠিক না হলে যত দক্ষ জনবলই হোক না কেন মানসম্পন্ন রিপোর্ট অসম্ভব। অথচ স্বীকৃত গাইডলাইন অনুসারে করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান ব্যবহার করে মানসম্পন্ন রিপোর্ট নিশ্চিত করা যায় অনায়াসে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃত গাইডলাইন অনুসারে মানসম্পন্ন করোনাভাইরাস কিটের নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে (১) ক্লিনিক্যাল নমুনা থেকে RNA আলাদা করার উপযুক্ত Column Extraction কিট এবং (২) করোনাভাইরাসের ORF1 জিন ছাড়াও COVID-19 নির্দেশক যে কোনো দুইটি জিন (N এবং E অথবা RdRp) শনাক্ত করতে সক্ষম এমন আরটি-পিসিআর কিট। সরবরাহকৃত কিটের গুণগতমান যাচাইয়ের স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে ব্যবহারের আগে ল্যাবরেটরিতে মানের তুলনামূলক বিচার করে নেয়া। প্রশিক্ষিত আর দক্ষ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাই কেবল তা নিশ্চিত করতে পারে। বিকল্প হিসেবে মান যাচাইকারী তৃতীয়পক্ষের অনুমোদনপত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিদ্যমান বাস্তবতায় করোনাভাইরাস টেস্টের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র FDA অনুমদিত CE-IVD কিট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকলে মানহীন রিপোর্টের আশংকা অনেকটা কেটে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দ্রুত পরীক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে র‍্যাপিড টেস্টের অনুমতি দিতে যাচ্ছে। যা ব্যবহার করা হয় মূলত স্ক্রিনিং-এর উদ্দেশ্যে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করে আরটি-পিসিআর টেস্টের ফলাফলের ওপর। বিশেষভাবে বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে আরটি-পিসিআর টেস্ট স্বর্ণমান হিসেবে বিবেচিত। তাই দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বিদেশে শ্রমবাজার রক্ষা করা ও অবাধ বিদেশযাত্রার সুবিধার্থে নির্ভুল করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য।

বর্তমানে দেশে ৬৭টি আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি আছে। সবগুলোর সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এসব ল্যাবরেটরিতে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৪০,০০০ টেস্ট করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে এবং আরও সাশ্রয়ী মূল্যে। শুধু প্রয়োজন ল্যাবরেটরি ম্যানেজমেন্টে দক্ষ জনবল সম্পৃক্ত করা আর মানসম্পন্ন কিটের সরবরাহ নিশ্চিত করা। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর সমন্নয়হীনতার বেড়াজালে আমরা আটকে গেছি। ল্যাবরেটরি সুবিধার সর্বাধিক ব্যবহার বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে প্রায় অসম্ভব। ল্যাবরেটরি-ম্যানেজমেন্ট ভাড়া করা গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারে।