মহামারীকালে কোরবানি ঈদ: বিনিয়োগ আতঙ্কে খামারিরা

মুহাম্মদ নুরুল আমিন সিদ্দিকী
Published : 24 Jan 2012, 12:13 PM
Updated : 9 July 2020, 08:33 AM

"আমি যদি এই ঈদে আমার গরুগুলো বিক্রি করতে না পারি, অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। গরু লালন-পালনের জন্য আমি ইতোমধ্যে অনেক টাকা বিনিয়োগ করে ফেলছি। এবার ক্ষতি হলে, পরিবারের খরচ চালানো আমার জন্য অনেক কঠিন হবে," ফরিদপুর জেলার এক খামারি মকবুল মোল্লা থেকে এই কথাগুলো শুনছিলাম দু'দিন আগে। মকবুল গতবছর কোরবানির ঈদে নয়টি গরু বিক্রি করে ২৭০,০০০ টাকা লাভ করেন। এরপর ৫০০,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে এবারের কোরবানির ঈদের জন্য ১৭টি গরু মোটাতাজাকরণ করছেন। কোভিড-১৯ সংকটের মাঝে আশেপাশে থেকে অনেক ভুল তথ্য শুনে এবং কোরবানি হাট নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায়, মকবুল এখন দেশের বাকি অসংখ্য খামারিদের মতই আতঙ্কগ্রস্থ।

প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি খামারি কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে গরু মোটাতাজা করে থাকেন। তবে এ বছরের গরু কেনাবেচা নিয়ে খামারিরা অনিশ্চিত। গতবছর মূলত কোরবানির প্রাণি হিসাবে বিক্রি করতে সারা দেশে প্রায় এক কোটি আঠারো লাখেরও বেশি প্রাণিসম্পদ লালন-পালন করা হয়েছিল এবং এ বছরও সংখ্যাটি এর কাছাকাছি হওয়ার আশা রয়েছে।

কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে প্রাণিসম্পদ খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, খামারিরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন এবং ব্যবসায়ীরা বিক্রয় নিয়ে লড়াই করছে। একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে কৃষকদের গরু ও গাভী পালন থেকে আয় প্রায় ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং ব্যবসায়ীদের গড়ে ৪২ শতাংশ বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। প্রাণির খাবারের স্বল্পতা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে, অনেক খামারিরা গবাদিপশুদের খাওয়ানো কমিয়ে দিয়েছেন, যা প্রাণিসম্পদের সঠিক বেড়ে ওঠাই প্রভাব ফেলেছে। ফলে বার্ষিক গরুর মাংসের বাজার এখন ঝুঁকির মধ্যে যার আনুমানিক মূল্য ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

কোভিড-১৯ প্রাণিসম্পদ খাতে ঋণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়ের মডেলের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী জুনের শেষ অবধি ঋণের কিস্তি শিথিল করা হয়েছে, অর্থাৎ জুন পর্যন্ত ঋণগ্রহীতা কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে সেটিকে খেলাপি বা বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। দেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশ হলো গবাদিপশুর খামারিদের জন্য ঋণ। এই সল্পমেয়াদি ঋণগুলো সাধারণত গবাদিপশু বিক্রির পরে পরিশোধ করতে হয়। আসন্ন কোরবানি ঈদে খামারিদের গরু বিক্রি নিয়ে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে তার পাশাপাশি এখন ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের আশঙ্কা করছে।

কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি এবং সুরক্ষার অভাবে গ্রাহকদের হাটবিমুখ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমরা কোরবানির প্রাণি বেচা-কেনার জন্য ই-কমার্স প্লাটফরমগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা লক্ষ্য করেছি। খামারিদের লোকসান থেকে বাঁচাতে এবং আরও বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে, ই-কমার্স প্লাটফর্মগুলো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গরুর হাটগুলোতে প্রচুর নগদ লেনদেন ব্যবসায়ী এবং গ্রাহকদের মধ্যে করনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেবে। অর্থ প্রদানের সুবিধার্থে এবং এই ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য, মোবাইল মানি অ্যাপের মতো ডিজিটাল সেবাগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

কোরবানির ঈদের আর মাত্র ৬ সপ্তাহ বাকি এবং এই সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন যাতে কোভিড-১৯ সংক্রমণকে সীমাবদ্ধ রেখে কোরবানির নিরাপদ এবং কার্যকরী হাটব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। কার্যক্রমগুলি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কেবল ঈদের ঠিক আগে যে বড় হাট বসে তার জন্য অপেক্ষা করলে চলবে না। কারণ খামারিরা এখনি তাদের প্রাণিগুলো স্থানীয় বাজারে আনতে শুরু করেছেন। ফলে সংকট কাটাতে নিম্নের সুপারিশগুলো কাজে লাগিয়ে সকল অংশীদারদের নিরাপদ ও দক্ষ বাজার নিশ্চিতের সময় এখনি।

. কোভিড-১৯ খামারিদের কাছে প্রাণি খাদ্য উপকরণ সরবরাহ অনেকাংশে ব্যাহত করেছে, যা খামারের উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। নীতি নির্ধারকদের প্রয়োজন প্রাণিসম্পদ বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সক্ষম করা যাতে ঈদের পূর্বে খামারিদের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপকরণ এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যায়।

. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রতিটি হাট কমিটির জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধিসহ গবাদিপশুর হাট পরিচালনার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দ্রুত পাঠাতে হবে এবং কৃষক, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য বাজার কর্মীদেরদের কাছে হাট সম্পর্কিত সঠিক তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

. সিটি কর্পোরেশন এবং হাট কমিটিগুলিকে গ্রাহকদের মাঝে আস্থা তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করে, নির্ভরযোগ্য উত্স থেকে স্বাস্থ্যকর গবাদিপশু নিশ্চিত করে গ্রাহকদের হাটে আসতে উত্সাহিত করা যেতে পারে। ব্যবসায়ী এবং গ্রাহকদের হাটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশিকা কঠোরভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন। নিরাপদ হাট নিশ্চিত করতে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে যেমন ভেটেরিনারি কর্মীদের মোতায়েন করা, শরীরের তাপমাত্রার চেকের ব্যবস্থা করা, সামাজিক দূরত্বের জন্য চিহ্ন স্থাপন করা, নিয়মিত হাট পরিষ্কার করা, হাত ধোঁওয়ার ব্যবস্থা করা, ভিড় কমাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতার প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা এবং কোভিড-১৯ বিস্তারকে সীমাবদ্ধ রাখতে জনস্বাস্থ্য বার্তা দেয়া ইত্যাদি।

. সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গরু বেচা-কেনার জন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া এবং আরও খামারি, ব্যবসায়ী, গ্রাহক এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মাঝে প্ল্যাটফর্মগুলির প্রচলন করা।

. নগদ টাকা লেনদেনের সাথে যুক্ত কোভিড সংক্রমণ ঝুঁকি হ্রাস করতে, কর্তৃপক্ষকে লেনদেনের বিকল্প পদ্ধতিগুলি কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মোবাইল মানি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার মাধ্যমে লেনদেনের সংখ্যা, লেনদেনের সীমা ইত্যাদির ক্ষেত্র বেগবান করতে পারে তবে তা এই সংকটে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত লেনদেনকে নিশ্চিত করবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ই-ওয়ালেটের ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য আরো পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।