এ কেবল ভাইরাসের খেলা নয় 

হাবিবুর রহমান
Published : 8 July 2020, 04:05 PM
Updated : 8 July 2020, 04:05 PM

রেনেসাঁ ও এনলাইটেনমেন্ট পরবর্তী পৃথিবীতে একচ্ছত্রভাবে মানুষ-কেন্দ্রিক যে বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য রচিত হয়েছে, তা সর্বোতভাবেই পাশ্চাত্যের মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। যার ফলে আধুনিকতাবাদ ও উপনিবেশবাদ সারা পৃথিবীতে পাশ্চাত্যমুখী মানব শ্রেষ্ঠত্ববাদকে পুঁজি করে অ-পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতার দোহায় দিয়ে শোষিত করেছে। এই অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন সময়ের ব্যবধানে কিছু হয়েছে, কিন্তু কুশাসনের নানান বীজ উপনিবেশবাদ রেখে এসেছে। সেই সাথে নিজেদের সুদূরপ্রসারী আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের উর্বরভূমিও প্রস্তুত করে এসেছে। এ উপনিবেশ-সাম্রাজ্য-পুঁজিবাদী শোষণের গভীর প্রেম সারা পৃথিবীর জন্য অবৈধ সব শোষণ ও বিধ্বংসী ঘটনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে একটা নয়, দুই দুইটা। শীতল যুদ্ধ হয়েছে এবং এখনো চলছে। সীমান্তযুদ্ধ ক্রমেই উত্তপ্ত করে চলেছে পৃথিবীকে। কাটাতারে ফেলানীর মত মানুষ জড় লাশ হয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাসহ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় রিফিউজি সংকট বাড়ছে। তাদের পুঁজি করে ভূ-রাজনৈতিক শোষণের নতুন কৌশল এখন বিশ্ব-রাজনৈতিক বাজারের কড়কড়ে পণ্য হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন ওদের আরেক বদ শাসক। যার হাত থেকে প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে ভাইরাসের জগৎ রেহাই পায় নি। 

মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ববাদী কৌশলের বলি হয়ে প্রকৃতি সেই উপনিবেশী আমল থেকে শোষণের শিকার হয়ে আসছে ।

আমাজন পুড়লো। অস্ট্রেলিয়ায় বন ও নিরীহ প্রাণী পুড়লো। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে প্রতি বছর আবহাওয়ার গতি বদলাচ্ছে৷ সিডর, আইলা, মহাসেন ও আম্পান প্রতিবছর হানা দিচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন যুদ্ধ নিয়ে হাজির হলো অদৃশ্য দানব করোনাভাইরাস। প্রচলিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাদ দিয়ে যদি দেখা যায় তাহলে বুঝতে এখন কারো কষ্ট হবে না এটাও আধিপত্যবাদী দেশগুলোর মানব-কেন্দ্রিক উন্নয়ন ও আধিপত্য নীতির চূড়ান্ত এক ফসল। তবে সাম্প্রতিক সব বড় সংকটের চেয়ে করোনাভাইরাস এখানে স্বাতন্ত্রতা দেখিয়েছে এমনভাবে যে সে জন্ম নিয়েছে অন্যসব বিধ্বংসী নীতি-জ্ঞান-অস্ত্র-কৌশলের মতই আধিপত্যবাদীদের উদরে।

প্রমোদ নায়ারারের (২০১৪) উত্তর-মানবতাবাদী তত্ত্বের বরাত দিয়ে বলা যায় এই ভাইরাস মানুষকে স্বয়ম্বর, পারঙ্গম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্ম যে ভুল করেছে, তার মাশুল দিয়েছে মানুষ এতদিন ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তরাক্তি, মৃত্যু, ধ্বংস ও দখল-আধিপত্যের মাধ্যমে। প্রকৃতি ও ভাইরাস এবার মানুষের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ভাইরাসও প্রকৃতি জগতেরই উপাদান। তাকে পুঁজি করে মানুষ এতদিন ফাঁয়দা লুটেছে, এখন সে প্রকৃতির অংশ হয়েই জবাব দিচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে। অরুন্ধতী রায় ৩ এপ্রিল Financial Times  এ "The pandemic is a portal" শীর্ষক প্রবন্ধে যেমনটি বলেছেন পুঁজির প্রবাহমানতার মত এই ভাইরাসও ধেয়ে চলেছে। তবে পার্থক্য হল এই যে করোনাভাইরাস পুঁজির মত লাভ দেখছে না বরং পুঁজির নিয়ন্ত্রক মোড়লদেরকেই আগে ঘাঁ দিয়েছে। তাদের অভিবাসন নীতি, বায়োমেট্রিক টোপ, ডিজিটাল নজরদারি থেকে আরম্ভ করে তথ্য সংশ্লেষণের সব সূক্ষ্ম শোষণ-নিয়ন্ত্রণের মুখে চপেটাঘাত করেছে এই ভাইরাস। অরুন্ধতী আরো বলেন যে, বাজারে থাকা শ্রমিকদের থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাস তাবৎ সব ধনিক সমাজকে এমন করে নাকানিচুবানি দিবে এ ভাইরাস- তা পুঁজিবাদী সমাজ কি ঠাওর করতে পেরেছে কোনোদিন? তবে আগে অনেক কিছুকে আজগুবী অনুমান মনে হলেও মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে ওই অসভ্য ধনিক মোড়লদের দলাদলিতে পৃথিবীটা আর প্রকৃতির মত নিরাপদ থাকছে না। সংকট নিয়েও এই পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব চলছে।

অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক বা মানুষ-কেন্দ্রিক পৃথিবীর এমন অতিমারী আর নির্মম পরিণতি মোড়লপনার পৃথিবীর দীর্ঘ দিনের ক্ষরণের ফসল। যাদের সাথে শত্রুতা না করেও কত দেশ ধুঁকে চলেছে, সেই পরাক্রমশালীরাই ধুঁকছে ছোট্ট এক দানবের হাতে। তাদের ঘরেই হানা দিয়েছে, তছনছ করে দিয়েছে তাদের গোছানো সংসার। উন্মোচন করে দিয়েছে তাদের এতদিনের অর্জিত মানব-শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের শক্তির বড়াই। এখনো পর্যন্ত তাদের তাবৎ বিজ্ঞান ও গবেষণা পারে নি কোনো সফল ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে। ঠেকাতে পারে নি অগুণতি মৃত্য। সাথেসাথেই বিশ্বায়নের গতিতে এ ছোট্ট ভাইরাস সাম্রাজ্যবাদের মত পাড়ি জমিয়েছে সব দেশ ও মহাদেশে। ওকে রুখতে পারে নি উত্তর-আমেরিকা-ইউরোপ ও চীন-কোরিয়া-জাপানকেন্দ্রিক বিজ্ঞান ও রাজনীতি। এই স্বাস্থ্য সংকট যাবতীয় জীবনের জন্য হুমকি হয়ে এসেছে। যা আবার বাংলাদেশের মত দেশগুলোর জন্য অশনিসংকেত বহন করে। বিশ্বের রাজনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থার মোড়লদের ঘরে সংকট বাড়লে তা সারা পৃথিবী, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত দেশগুলোর জন্য বড় সংকট তৈরি করবে৷ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের ঘরের আগুনের আঁচ আমাদের মত দেশগুলোতে বেশী ধ্বংস সৃষ্টি করেছে সবসময়। সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতার সাথে সাথে নির্মম সব স্বার্থপরতার খবরে শিউরে উঠছি আমরা। করোনা উপসর্গ দেখা না দিলেও আপন মাকে বনে ফেলে আসার খবর দেখেছি আমরা। করোনাভাইরাসে মৃত বলে নিজের আত্মীয়জন লাশ দাফনে উপস্থিত হয় নি; প্রশাসনকে দাফন করতে হয়েছে লাশ।                

দেশে-বিদেশে লকডাউন ও আইসোলেশনের সাথে মানুষের ভেতরে সন্দেহবাতিকতা ও স্বার্থপরতা প্রকটতর হচ্ছে। এটা হুট করে হয়নি। স্বার্থপরতার ভেতরে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ তসরুফ করা বড় একটা চর্চা। যুগেযুগে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমাদের সমাজে অন্যের সম্পদ, তা ত্রাণ হোক বা জনগণকে ঠকিয়ে দুর্নীতির আশ্রয়ে অর্থ উপার্জন হোক, লুণ্ঠনের সংস্কৃতি চলে এসেছে। করোনার সময়ে অন্যান্য অন্যায়ও চলছে। মাস্ক, চিকিৎসা সামগ্রী ও চিকিৎসাব্যয় নিয়ে হরিলুট চলছে। ভেজাল দিয়ে ও মজুদ করে মুনাফা অর্জনের চর্চাও আগে থেকেই চলে এসেছে। এখন মানুষ অফুরন্ত সময়ে সব দিকে নজর দিতে পারছে মিডিয়ার চোখ দিয়ে, তাই সব কিছু নিয়ে অসন্তোষও বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু অন্যসময়ে এসব নিয়ে গা-সওয়া ভাব করেছি আমরা যতক্ষণ না কোনো অন্যায় আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত করেছে। 

বিদেশের অনুকরণে বিভিন্ন কায়দায় মানুষকে সচেতন করতে চেষ্টা করা হয়েছে। ছুটি ও লকডাউন দিয়েও মানুষকে নিরাপদ পরিবেশ যেমন দেওয়া যায় নি, ঠিক তেমনি আস্বস্তও করা যায়নি তাদেরকে। সরকার ও প্রশাসনের প্রতি এই সন্দেহ ও অবিশ্বাসও অতি পুরনো ও অনেকাংশেই যৌক্তিক। অনেক সময় পেয়েও দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক চেষ্টা ও পরিশ্রমকে ব্যর্থ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস মোকাবেলার কেন্দ্রিয় দায়িত্বে থাকা  স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নানান ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কোভিড-১৯ কে নমনীয় করে দেখানো ও ফাঁপা বুলিতে করোনা নিয়ে তাদের প্রস্তুতির স্বয়ংসম্পূর্ণতা জানিয়েছেন। মাস্কের গুণগতমান নিয়ে কিংবা একটা পিসিআর মেশিন বসানো নিয়ে কথা বলতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।   এসবই সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও শাসক-প্রশাসকদের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বাড়াবে। ১৫ মার্চ সিএনএন এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারি এমনটাই মত দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন আইশোলেশন নয়, বরং সঠিক ও সত্য তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে সরকারকে সংযোগ বাড়াতে হবে।

তরুণ প্রজন্ম ও নিম্নবিত্তের সংকটগুলো বেশি গভীর হলো। কর্মহীনতা ও সম্ভাবনার ঘাটতি তৈরি হয়ে গেল। বৈষম্য ও হতাশার বোঝা ভারী হয়ে গেল। নিম্নবিত্তের সাথে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি প্রশাসন যে নির্মম আচরণ করল, তা সবাইকে আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের সুবিধা, অর্জিত শিক্ষা/যোগ্যতা অনুযায়ী নানামুখী কর্মের সুযোগ, শিক্ষক ও গবেষকদের শিক্ষাদান ও গবেষণার পরিবেশ ও শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের বাহন হিসেবে দেখার মত দর্শন নিয়ে যদি মানসম্মত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতো, তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে উপকার হতো। এতসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীরা অনিশ্চিয়তায় তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটাতো না। শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য একচ্ছত্রভাবে সরকারি চাকরিমুখী হতো না। দেশের কাঁধে এত সংখ্যক শিক্ষিত বেকার মানুষের বোঝা তৈরি হতো না। এতসংখ্যক শিক্ষার্থীরা একসাথে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো না। এমন অনেক না-হওয়ার কথা বলা যাবে।  অপরিকল্পিত শিক্ষানীতি ও বৈশ্বিক দাতাদের শর্ত মানতে গিয়ে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষ মানবসম্পদ, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, গবেষণা, আবিষ্কার যেমন হচ্ছে না, তেমনি  ইতিহাস ও বিজ্ঞানমনস্ক আলোকিত তারুণ্যের বদলে দেশের ভাগ্যে জুটছে অন্ধতা ও আক্রমণাত্মক মানসিকতার ব্যাপক একটা বিস্তৃতি। অনলাইনের বিভিন্ন ডোমেইনে মর্মান্তিক কিংবা অতিসংবেদনশীল বিষয়ে মন্তব্য দেখলে বুঝে নেওয়া যায় কত বড় সংকট নিয়ে আমরা শুধু ক্যালেন্ডারের হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ সময়ের বিবর্তনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তরুণদের আলোর পথে নেতৃত্ব দিতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভ্রূণ সৃষ্টি হয়েছিল যে!

রাজনীতির কল্যাণকামী দিক ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতা ও ডাক্তারদের মৃত্যু দেখিয়ে দিল দীর্ঘদিন ধরে আমরা আমাদের সেবাখাতকে কতটা অবহেলা করে এসেছি। দেশ ও দেশের বাইরে এসব নিয়ে প্রতি-যুক্তি যারা দিয়েছেন ও প্রতিবাদ যারা করেছেন, তাদেরকে অতি সংশয়বাদী বা "অ্যালারমিস্ট" তকমা দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক শক্তিগুলো। সুইডিশ পরিবেশ-বুদ্ধিজীবী ছোট্ট গ্রেটা থুনবার্গ জাতিসংঘ ও জলবায়ু সম্মেলনে এসব নিয়ে উচ্চকিত হয়ে বারবার বলেছে- আমরা সংকটের দ্বারপ্রান্তে।

করোনাভাইরাসের ছোবল ছোট্ট গ্রেটার কথাকে বাস্তব করে তুলেছে অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে। বয়স্ক দেশগুলোর বয়স্ক নেতাদের প্রকৃতিবিরোধী ও মানবমুখী বয়স্ক নীতির বলি হয়ে পৃথিবী আর কত ধুঁকবে?