সরকারের শিল্প দর্পণে পাটকল

এম আর খায়রুল উমামএম আর খায়রুল উমাম
Published : 8 July 2020, 11:27 AM
Updated : 8 July 2020, 11:27 AM

বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ সচেতন হওয়ার সাথে সাথে পলিথিনকে সরিয়ে পাটকে সামনে নিয়ে আসছে। বিশ্ব যখন পাটকে সমাদর করছে আমরা তখন পাটকে চরমভাবে অবহেলা করবার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেসরকারি পর্যায়ে পাটের অবস্থা সন্তোষজনক হলেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাটের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সরকারি পাটকলের জন্য আর কোনো শুভ উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ নাই। এক সময়ে দেশে ৮২টি সরকারি পাটকল থাকলেও বর্তমানে তার মাত্র ২৫টি অবশিষ্ট ছিল। বিপরীতে আশির দশকে গড়ে ওঠা বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা আজ ২২৫টি। ইতোপূর্বেও সরকারি পাটকলগুলো একের পর এক শুধু লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বা ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ২ জুলাই সর্বশেষ পাটকলগুলোও বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। পাটকল সরকারি হলেই লোকসান করে আর বেসরকারি হলেই লাভ করে, কি অদ্ভুত এক মজা তাই না? এবং এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে কৈফিয়তও দিতে হয় না, এটাও কম মজার বিষয় নয়। শুধু লোকসানের অজুহাতে পাট শিল্পকে বেহাল করার, বিলুপ্ত করার, গোষ্ঠী স্বার্থে নিবেদিত করার যেসব কার্যক্রম চলমান তার কতটা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর সে বিষয়টি বিবেচনা করা জাতীয় স্বার্থেই জরুরি।

বাংলাদেশের সবচাইতে অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট একসময় পর্যন্ত বিশ্বে সমাদৃত ছিল। পাটকে সোনালী আঁশ বলে আখ্যায়িত করা হতো। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে স্বীকৃত ছিল পাট। আমাদের আদমজী পাটকল বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল হিসেবে খ্যাত ছিল। সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের এত গুরুত্বপূর্ণ ফসল পাটের জীবনে বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা যায় একটা ঐতিহ্যের গলা টিপে মেরে ফেলা হয়েছে। বিশ্ববাজারে পাটের গুরুত্ব, ব্যবহার, সমাদর যখন বাড়ছে ঠিক তখনই পাটের গলা টিপে ধরা হলো। দেশে পাটকে গুরুত্বহীন করতে করতে শূন্যের কোটায় নিয়ে যাওয়া হলো। একের পর এক পাটকল বন্ধ করে দেয়া হলো। বিক্রি করে দেয়া হলো। বিশ্বে শ্রেষ্ঠ পাট উৎপাদনকারী দেশের মানুষকে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের কথা জানানো হলো না। পাট সংশ্লিষ্ট গবেষক, উন্নয়নকর্মী, উৎপাদক, ব্যবস্থাপক সবাই পাটের সুতো আর চট তৈরির মধ্যেই নিজেদের আটকে রাখলো। পরিবেশ সচেতন হয়ে ওঠা বিশ্ব যে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারের চাইতে পাট আর তুলোর ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সে খবর সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছাল না। স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মানুষ তাই কারো কোনো জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নেই। ফলে লোকসানের কারণ অনুসন্ধানের চাইতে লোকসান বড় হয়ে যাওয়ায় পাটের ভাগ্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ৬৭টি ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকল তদারকি, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে 'বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন' গড়ে তোলেন। মাত্র ১০ বছরে সরকার পাটকলগুলো পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিমালিকদের কাছে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার শিল্পকারখানা পরিচালনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সরকার বিশ্বাস করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করতে, শ্রমিকদের রক্ষা করতে এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পাটকলগুলো বেসরকারিকরণ করে ব্যক্তি মালিকদের হাতে ছেড়ে দেয়াই উত্তম। পরিতাপের বিষয় এই যে, সরকারের এই উত্তম বিশ্বাস যা দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় গৃহীত হয়েছিল তা কিন্তু সার্বিকভাবে প্রমাণিত হলো না। বরঞ্চ বলা যায়, ব্যক্তি স্বার্থ আর দুর্নীতির কালো মেঘ বাংলাদেশের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাই সেখানে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্টরা কেউ দেশ ও জাতিকে দেখতে পেল না। ফলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যে সিদ্ধান্ত এল তা জাতির ভাগ্যকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিল। ব্যক্তির ব্যর্থতার দায় পুরো জাতির কপালে অমানিশার কালো তিলক এঁকে দিল।

সরকারের উত্তম বিশ্বাস পুরো পাটশিল্পের ক্ষেত্রে বুমেরাং হয়ে গেল। জনগণের অর্থের মিল ব্যক্তিমালিকানার হলো। সরকার এই মালিকদের হাতে মিলগুলো হস্তান্তরের সময় সকল বকেয়া পরিশোধের নির্দেশনা দিয়েছিল কিন্তু সে নির্দেশনা পূরণ করার কোনো দায় গ্রহণ করল না। বরং মিলের জমি, মিলের সম্পদ থেকে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিল। এই ঋণের সামান্য অংশ মিলে প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ হলো ঠিকই তাতে মিল পরিচালনা করে লোকসানই থেকে গেল। শ্রমিকরা মজুরী পেল না, ছাঁটাই হয়ে গেল, মিল লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হলো বা হস্তান্তর করে দেয়া হলো। অন্যদিকে মিল মালিকরা এই ব্যাংক ঋণের অর্থে অন্যখাতে শিল্পপতি হয়ে গেল। আরো ব্যাংক ঋণ পেল, ব্যাংকের মালিকানা পেল, সমাজে বিত্তবান মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি অভিজাত শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করল। পুরো পাটশিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হলো, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হলো, কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হলো আর পাটকলের শ্রমিকরা নিঃস্ব হলো।

দেশে প্রতিটা শিল্প কারখানা বন্ধের প্রধান কারণ লোকসান। এই লোকসানের কথা বলে শুধু পাটকল নয়, একে একে বন্ধ করা হয়েছে ইস্পাত মিল, নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, বস্ত্র মিল, সুগার মিল, কেমিক্যাল মিলসহ আরো কত মিল। মোটামুটিভাবে দেশের বৃহৎ শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ করতে লোকসানকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে রেখে জনগণকে ভূগোল পড়ানো হলো। লোকসান কেন, কিভাবে, কোথায় এবং কখন হচ্ছে সে বিচার করার সময়ই পাওয়া গেল না। মূল অন্যায়কারীরা বিচারের ভার পেয়ে দায়ের স্বরূপ পরিবর্তন করে নিলো। যে কোনো বৃহৎ শিল্প-কারখানা লোকসানের পাশাপাশি কত শ্রমিক পরিবারকে জীবন সংগ্রামের রসদ যুগিয়েছে, কত টাকা রাজস্ব দিয়েছে, কত টাকা বিদ্যুৎ-পানি-টেলিফোন বিল দিয়েছে, কত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে বা ব্যয় বন্ধ করেছে, কত শিক্ষার্থীকে শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে, কত ক্ষুদ্র ও বড় ব্যবসায়ী পরিবারের রসদ সরবরাহ করেছে, কত কৃষক ও শ্রমিক এ কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ করে জীবন যুদ্ধ করেছে- সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর আছে কিনা জানি না। উত্তর কেউ খুঁজলও না। শুধু জাতি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করল বিশ্বের বৃহত্তম জুটমিল আদমজী লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হলো। এখানে ইপিজেট করা হলো। মহামারীর এই ক্রান্তিকালে জাতি আবার অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করল ক্ষমতার বলয়ের মানুষগুলো অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করল না। বরং আধুনিকায়নের নামে কর্মচ্যূতির সিদ্ধান্ত হলো ২৫টি মিলের শ্রমিকদের। সোনালী আশেঁর সোনালী দিন সোনার বাংলায় বুঝি হারিয়েই গের। সবচেয়ে মজা হলো সরকারের এই জুটমিল বন্ধে রাজনীতি, প্রশাসন থেকে শুরু করে অধিকাংশ শ্রমিক নেতারা এখনো পর্যন্ত নিরবতা পালন করছেন। তারা শুধু বহু ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষীর মতো আর একটা ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী হবার অপেক্ষায় রইল।

দেশের বৃহত্তম পেশাজীবী সংগঠন আইডিইবি আশির দশকে দেশব্যাপী সভা করে 'প্রযুক্তি চিন্তাহীন রাজনীতি শোষণের হাতিয়ার' বলে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছিল। এখনও আমাদের রাজনীতি প্রযুক্তি চিন্তাহীন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিদিনকার বিশ্বে যে রকেটের গতিতে এগিয়ে চলেছে তা আমাদের রাজনীতি ভাবতে চায় না। তার সাথে তাল মিলিয়ে চলার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করে না। সে অনুভবহীনতা থেকেই ৫০'র দশক, ৬০'র দশকে স্থাপিত পাটকলগুলো আধুনিকায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের খোঁজ করা হলো না। প্রয়োজনের মুহূর্তে অর্থ সরবরাহ করা হলো না। কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হলো। সবরকমের প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতাকে ছিঁকেয় তুলে রাখা হলো। আর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ সে তো আমাদের ভাবনার মধ্যেই নেই। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিবেচনায় যে জুটমিলগুলো আধুনিকায়নের ছোঁয়া পেল না বিপরীতে অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি বাঁধাহীন হলো সেখান থেকে লোকসান ভিন্ন অন্য কিছু আশা করা যায় কীভাবে?

দেশের উচ্চমহল তাদের সকল অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অব্যবস্থাপনার দায়ভার শ্রমিকদের ঘড়ে চাপিয়ে নিজেরা ধোয়া তুলসিপাতা থাকতে চায়। আমাদের শ্রমিকদের নিম্ন মূল্য সংযোজনের কারণে শিল্পখাত জিডিপিতে যথাযথ অবদান রাখতে পারে না। বহুবিধ কারণে শ্রমিকদের এ নিম্নমূল্য সংযোজন, যার দায় শ্রমিকদের চাইতে উচ্চমহলের বেশি। তবে আমাদের দেশে অন্যসব সংগঠনের মতো শ্রমিকরাও শুধু নিজেদের অধিকার নিয়েই তাদের সব কার্যক্রম পরিচালনা করে। কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের সুবিধাও যে এক ধরনের অধিকার তা কেউ বিশ্বাস করে না। ফলে কর্মক্ষেত্রে উন্নয়ন ও উৎপাদনের ভাবনা দেখা যায় না। সংশ্লিষ্টরা এই সুযোগটাই গ্রহণ করে শ্রমিকদের উপর দায় চাপায় এবং তাদের ন্যূনতম প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে। এখনো এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা চলমান। শ্রমিকদের মজুরীর জন্য সংগ্রাম করতে হয়, জীবন দিতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতেও স্বাধীন দেশে এবছর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে দিনাজপুরে বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল একজন শ্রমিককে। উন্নয়নের বাংলাদেশে শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। বরং শ্রমিকদের উপর দায় চাপানোর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা চলমান রইল।

স্বাধীনতার পরপর পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রপ্তানি আয়ে ৮৭ শতাংশ আসত যা আজ সিঙ্গল ডিজিটে রুপান্তরিত হয়েছে। পক্ষান্তরে গার্মেন্টেস খাত মোট রপ্তানি খাতের তিন-চতুর্থাংশের মালিক। সরকার এই খাতের প্রসারে খুশী হয়ে একে শিল্পের মর্যাদা দিয়েছে। দেশে সব চাইতে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত এবং নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির সোপান হিসেবে সরকারিভাবে শিল্পের মর্যাদা পেলেও প্রকৃতপক্ষে শিল্প হিসেবে এ খাতকে মূল্যায়ন করা কষ্টকর। নারী শ্রমিকদের শ্রমনির্ভর লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই শিল্পকে নিয়ে গর্ব করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এখানেও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে শ্রমিক বঞ্চনা বিদ্যমান। বৃহৎশিল্পের তুলনা গার্মেন্টেসের সাথে হতে পারে না। বৃহৎ শিল্প দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় রক্ষা করা জরুরি। বৃহৎ শিল্পের জন্য অর্থ, প্রযুক্তি এবং শ্রমিকদের সুষম সমন্বয় দরকার। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় দেশের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। বিশ্বাস করতে চাই সরকার দেশের জন্য আত্মঘাতী এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। দেশের আপামর মানুষের কল্যাণে মহামারী উত্তর দেশে পাটশিল্প নিয়ে সরকার নতুন ভাবনা নিয়ে আন্তরিক ভাবে উদ্যোগী হবে। ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি জনকল্যাণে বৃহৎ শিল্পগুলো রক্ষায় সরকারের পাশে থাকবে। দেশের ঐতিহ্যের হাতে হাত রেখে পরিবেশবান্ধব এ বৃহৎশিল্পের দিকে নতুনভাবে নজর দেবে। বাংলাদেশের সোনালী আঁশ আবার বিশ্বখ্যাত হবে।