সোনালী আঁশের বাংলাদেশ

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 6 July 2020, 03:53 PM
Updated : 6 July 2020, 03:53 PM

যেহেতু শিক্ষকতা করি, তাই প্রজন্মের মানসিক পরিবর্তনটি সহজে বুঝতে পারি। পেশাগত কারণেই প্রতিবছর নতুন নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক তৈরি হয়। তাদের সঙ্গে পথ চলতে চলতে বুঝতে পারি, কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজকের প্রজন্মের কাছে প্রায় 'মিথ' হয়ে গেছে।

এ লেখার শিরোনামটিও তেমন। 'সোনালী আঁশের বাংলাদেশ' কথাটি শুনে, বুঝে, পড়ে আমরাসহ পরবর্তী অনেকগুলো প্রজন্ম বড় হয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই পাট, পাটকল বা পাটকলের শ্রমিক হল রাষ্ট্রের লোকসানি খবরের বিষয়বস্তু। যে পাট ছিল আমাদের গৌরব, অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি; আজ সেটা নিয়ে কেউ তেমন কথাও বলতে চান না। সম্প্রতি ২৫টি পাটকল বন্ধের সরকারি ঘোষণার সঙ্গেই বাংলাদেশে সরকারি পাটকল যুগের অবসান ঘটল। প্রশ্ন হল, পাট কি দিনে দিনে অলাভজনক পণ্যে পরিণত হয়েছে? নিশ্চয়ই না, কারণ বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার রিপোর্টে আমরা দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত, সিরিয়া, ইরান, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি হয়। তারপরও সরকারি পাটকল বন্ধ হবার একটি কারণ পাওয়া যায় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) জানানো তথ্য থেকে। দেশীয় চাহিদার মাত্র ২৪ শতাংশ পাটপণ্য সরকারি পাটকল পূরণ করতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে বাকি ৭৬ শতাংশ পূরণ করে বেসরকারি পাটকলগুলো। গত কয়েকদিন পাটকল বন্ধ সংক্রান্ত যতগুলো খবর পড়েছি, তা থেকে বোঝা যায়, বেসরকারি পাটকলগুলো বেশ ভালোই চলছে। কিন্তু যত লোকসান সব সরকারি পাটকলে। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) হিসাব মতে, গত জুলাই থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানী কমেছে ২০ শতাংশেরও বেশি। এ সময় ২ হাজার ৯৯২ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এর ২৮ শতাংশও পূরণ হয়নি।

অথচ বিজেএমসি প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়েছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ১৯৭২ সালের ১৯ জুন রাষ্ট্রপতির ৫৭ নং অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকার পাট রপ্তানী ব্যবসাকে জাতীয়করণ করে। সোনালী আঁশে সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্নেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালে এর আওতায় ৭০টিরও বেশি পাটকল ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থবছরে (১৯৭২-৭৩) রপ্তানী আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। কিন্তু ধারাবহিক লোকসানে গত ৪৮ বছরে সেটি ২৫-এ নেমে এল এবং স্বাধীনতার ৫০ বছরের আগেই সকল সরকারি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করল সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি এবং বর্তমানে এর পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। (বণিক বার্তা: ০৩ জুলাই ২০২০)।

দুই

লোকসানের হিসাব তো সরকার দিল, কিন্তু এই লোকসানের কারণ কী? সম্প্রতি সরকারি পাটকল বন্ধ হবার পর ২৫ হাজারেরও অধিক স্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারালেন। সরকার তাদের নানা ধরনের সুবিধা প্রদানের কথা বললেও এদের কর্মসংস্থানের তো সুযোগ তো শেষ হলো! সরকারি প্রজ্ঞাপনে অনেক কিছুই বলা হয়েছে কিন্তু সেখানে কৃষকদের কথা আছে কি? যে চাষীরা ইতোমধ্যে জমিতে পাটচাষ শুরু করে দিয়েছেন, তাদের ফসলের কী হবে? কোনো কোনো অঞ্চলে পাট কাটা ও জাগ দেওয়ার কাজও শুরু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞমহল বারবার কৃষি ব্যবস্থাপনার দিকে নজর ফেরাতে বলছেন, অথচ সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত নেবার আগে পাটচাষীদের কথা ভাবলেন না? সরকারি পাটকলগুলোর জন্য বিজেএমসি পাইকারদের কাছ থেকে পাট কিনত। গত মৌসুমে সারাদেশে ৫৭টি ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে পাট কিনেছিল তারা। আমরা মন্ত্রী আমলাদের মুখে শুনেছি, পাটের সুদিন আসছে। চাষীরাও সে কথায় আশ্বাস রেখেছিলেন, পাটের উৎপাদন বাড়িয়েছেন কিন্তু পাটকলই যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে পাট কিনবে কে? পাটকলের সঙ্গে শ্রমিকের মতো কৃষকের ভাগ্যও জড়িয়ে আছে। সরকার এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা কি কৃষকদের আগে জানিয়েছে? পাটচাষীরা যে খরচ করেন, তার সিংহভাগই ঋণের টাকা। পাট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। পাট বিক্রি না হলে এ ঋণ তাঁরা শোধ করবেন কীভাবে?

তিন

পাটকল বন্ধের এই সিদ্ধান্তে কৃষক শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকার লোকসানের খতিয়ান জানিয়েছে কিন্তু কারণ অনুসন্ধান করেছে কি? দীঘদিন ধরে যাদের ষড়যন্ত্রে একের পর এক পাটকল বন্ধ হয়েছে, তারা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল। বেসরকারি পাটকলগুলো ভালো মতো চলছে, তাহলে সরকারি পাটকল বন্ধ করতে হচ্ছে কেন? তবে কি দীর্ঘদিনের পুরোনো সেই আমলাতান্ত্রিক প্রবাদ 'সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল'– এর বাস্তব রূপটাই আমরা দেখছি? পাট হত্যার নেপথ্য কুশীলবদের বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি। তাদের শাস্তি তো পরের কথা, চিহ্নিতই করা হয়নি। ১৯৭২ সালের শুরু থেকেই আমাদের পাটকলগুলোতে আগুন লাগানো হয়েছে। আজও উদঘাটিত হয়নি নারায়নগঞ্জ, দৌলতপুর ও সরিষাবাড়ীসহ আমাদের অসংখ্য পাটকল পুড়ে যাবার কারণ। বঙ্গবন্ধু বিজেএমসি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেন পাটের রাপ্তানীতে জাতীয় সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রে নিম্নমানের ও ভেজা পাট রপ্তানী করা হয়েছে। ফলে একের পর এক বাজার হারিয়েছি আমরা। সরকারি পাটকল বন্ধে সরকার যতগুলো কারণই দেখাক না কেন, এ কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, দুর্নীতিই হলো এর প্রধান কারণ। পাটের সঙ্গে পাটচাষী ও পাটকল শ্রমিকরা বছরের পর বছর জড়িত কিন্তু এই খাতের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করেছে কতিপয় সরকারি আমলা আর রাজনীতিবিদ। তারা মেয়াদ ফুরালে চলে গেছে কিন্তু ধ্বংস করে গেছে পাটের ভবিষ্যত। এদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণেই চাষী ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কল-কারখানা উন্নয়নের জন্য গত কয়েক দশকে কোনো ধরনের কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি? অথচ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি পাটকলগুলোকে সচল করা যেত। তবে কি বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার জন্যেই সরকারি পাটকল বন্ধের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া হলো?

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালের শেষদিকে রাষ্ট্রপতির ৫৭ নং অধ্যাদেশে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এর মাধ্যমেই পাট রপ্তানি ও ব্যবসায় বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু এতে পাটচাষী বা পাটকল শ্রমিকদের কোনো উন্নতি হয়নি। উল্টো বছরের পর বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সোপান পাট বিশ্বরাজনীতির শিকার হয়। গণমাধ্যমে দেখলাম, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জনাব গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছেন, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চালুর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই ১৯৯৩ সালের কথা। পাটখাত সংস্কার কর্মসূচীর কথা বলে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে দুটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেশের দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ আর মধ্যসত্বভোগীদের কারসাজিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত পাটখাত উদ্ধারের জন্য উড়ে এসেছিল বিশ্বব্যাংক। তৎকালীন বিএনপি সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে একের পর এক পাটকল বন্ধ করে দেয়। এই ধারাবাহিকতা পরবর্তী সরকারেও চলতে থাকে। ২০০২ সালের ৩০ জুন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার বন্ধ করে দেয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল। সুতরাং আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার দায় পাশ কাটিয়ে বেসরকারি মালিকানাকে উৎসাহিত করার ফলাফল সব সময় ভালো হয় না।

পাটকল বন্ধ হলে পাটচাষীর ও শ্রমিকদের জীবন টানাপোড়েনের মুখে পড়ে। এরাই প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু যেসব দুর্নীতিবাজদের জন্য সরকারি পাটকলগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে, সরকার সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কি? সদিচ্ছা আর রাজনৈতিক মেরুদণ্ড থাকলে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ না করেও রাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সেটাই হবে বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর।