সত্য তথ্য পেলে মানুষ ভয়কে জাদুর মতো জয় করে

দিদার মালেকী
Published : 5 July 2020, 10:42 AM
Updated : 5 July 2020, 10:42 AM

২০০৯ সাল। বাবা অসুস্থ বিধায় আমাকে বাড়িতে থাকতে হচ্ছিল। সময় কাটাতে কিছু বই গোগ্রাসে আর কিছু পাতা উল্টে শেষ করছিলাম। একটা বই 'দ্য বিট্রোথড' সোজা বাংলায় 'বাগদত্তা'। প্লেগের সংক্রমণ নিয়ে ইতালীয় লেখক আলেজান্দ্রো মানজোনির উপন্যাস। সেই যাত্রায় পড়ার সুযোগ হয়েছিল। খুব একটা মনোযোগের পঠন নয়, হাতের কাছে ছিলো বলে পৃষ্ঠা উল্টোনোর মতো।

এখন যে করোনাভাইরাস মহামারী চলছে, বিশেষ করে ইতালি যে মৃত্যু দেখল, প্রায় একইরকম অবস্থা মানজোনি সেই উপন্যাসেও দেখিয়েছেন। ১৮২৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটিতে মানজোনি ১৬৩০ সালের প্লেগের সময় মিলানের কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।

এই করোনা-দুর্যোগে প্রায় দুইশ বছর আগের সেই উপন্যাসের কথা কেন? আপদে-বিপদে এমন কোনও ঘটনার কথা মনে এলে আপাত যোগসূত্রহীন মনে হতেই পারে। কিন্তু আসলেই কি তাই? কোনও না কোনও যোগ রয়েছে বলেই মস্তিষ্কের জমা থেকে তা উঠে এলো। একটু মাথা ঘামালে সেই যোগসূত্রের হদিশও মেলে বইকি।

যেটা দেখলাম─ একটা চরিত্র 'রিকোবোনো', তার মুখ দিয়ে একটা কথা বলিয়েছেন লেখক। সেকথাটি ভাবতে ভাবতে ওইসময়ের ইতালিতে মহামারীর বাস্তবচিত্রবহুল মানজোনির সেই উপন্যাস সম্প্রতি আবার পড়া শেষ করলাম। এবার অবশ্য মনোযোগের সঙ্গেই এবং খানিকটা বীক্ষণ রেখেই।

দ্যা বিট্রোথডে দেখা যাচ্ছে মহামারীর শুরুতে মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল 'অস্বীকৃতি'। আর সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী সব সময়েই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে তথ্য বিকৃত করেছে। রোগাক্রান্তের এবং মৃত্যু হওয়া মানুষের প্রকৃত সংখ্যাও কৌশলে বদলে দিয়েছে। এমনকি মহামারীর অস্তিত্বই অস্বীকার করেছে। ওই মহামারীর সময়ে সরকারের ভূমিকা আর তার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হওয়া জনরোষ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তাও দেখতে পাই উপন্যাসে।

মানজোনি দেখিয়েছেন, মহামারী চলছে তার মধ্যেও মিলানের গভর্নর রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করেছেন। একদিকে মানুষ মরছে তার মধ্যেই স্থানীয় এক রাজপুত্রের জন্মদিনের অনুষ্ঠান পর্যন্ত জনাকীর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো। অর্থাৎ লেখক ঘটনা থেকে ঘটনায় যেতে যেতে দেখালেন─ মহামারী ঠেকাতে যথেষ্ট বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ ছিল শিথিল। ফলে মানুষ সেগুলো অতটা আমলে নেয়নি। আর একারণে মহামারী ছড়িয়েছে আকছার। নির্বিচারে মরেছে মানুষ। সতেরো শতকের ওই মহামারীতে ১০ মিলিয়ন ইতালীয়র মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

যে কোনও মহামারীর সঙ্গে আরেকটা জিনিসও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে─ গুজব। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আন্তর্জালে করোনা সংক্রান্ত তথ্যের আড়ালে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে রয়েছে গুজবের সুপ্ত বীজানু। কিছু মানুষের মর্মর মন থেকে যা প্রাণ পেয়ে রঙ-রূপ বদলে অন্য আদল নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আরও দুর্বার গতিতে।

মানজোনি গুজবের একটি অবয়বের বর্ণনা দিয়েছেন উপন্যাসে। মধ্যযুগে প্লেগের সময় মানুষের কল্পনায় একটি চরিত্র ফিরে ফিরে এসেছে। মানুষের কল্পনা থেকে জন্ম নিয়ে ছড়িয়ে পড়ত বিচিত্র আর আতঙ্ক জাগানো সব গুজব। একটি গুজব ছিলো এমন─ পিশাচরূপী এক আকৃতিকে কোথাও না কোথাও দেখা যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে ওই দুষ্টু আকৃতি বাড়ির দরজার হাতলে, ঝর্ণার পানিতে প্লেগের জীবাণু ভরা তরল ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

আরও মর্মান্তিক ঘটনা রয়েছে, যেমন─ গির্জার মেঝেতে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসেছেন কোনও এক বৃদ্ধ। পাশ দিয়ে যাওয়া এক নারী অদ্ভুত অভিযোগ করে বসলেন। যেমন ওই বৃদ্ধ নাকি গির্জার মেঝেতে নিজের কোট ঘষে জীবাণু ছড়িয়েছেন। আর উপস্থিত লোকজন বৃদ্ধকে প্রহারে উদ্যত। এমন সব ঘটনায় ক্ষেত্রবিশেষে মারধরে হতো প্রাণহানিও।

এই যুগে মানজোনি বর্ণিত গুজবের এমন চিত্র আমরা দেখছি না বটে। তার মানে গুজব যে আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে এমনও নয়। বরং করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহতার মধ্যেও নানাভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। আর অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব গুজব জনান্তরে ছড়িয়েও পড়ছে দ্রুত।

এসব গুজবের বশবর্তী হয়ে অনেকসময় সরকারগুলোও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোও তথ্যকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করতে গিয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

আমি শুরুতেই বলেছিলাম মানজোনির উপন্যাস নিয়ে আলোচনা লিখতে বসিনি। কেবল একটি বাক্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে এই লেখার চলন। এবার সেই কথায় আসি। উপন্যাসটির একটি চরিত্র রিকোবোনো বলছেন─ "At the root of it, there's our fear, and when fear is depicted in such an authentic way, we can exorcise it."।

আক্ষরিকে না গিয়ে বাক্যটির ভাবার্থ এমন হতে পারে─ যেকোনও কিছুর মূলে আমাদের একটা ভয় কাজ করে এবং সেই ভয়কে যথার্থ একটা পন্থার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করা হলে তখনই সেটা আমরা জাদুর মতো আয়ত্ত করতে পারি।

অর্থাৎ আমরা বলতে পারি─ যেকোনও দুর্যোগে মানুষের কাছে ভয়ের বার্তাটাও নির্ভুলভাবে পৌঁছুনো উচিত। কারণ প্রবৃত্তিগতভাবেই মানুষ সত্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে পাড়ি দিতে পারে যে কোনও দুর্যোগের মহীসোপান। আর তথ্য বিকৃতি কিংবা লুকোনোর চেষ্টা যেকোনও মহামারী কিংবা দুর্যোগকে বাড়িয়ে নেওয়ার রাস্তাকেই কেবল সুপ্রশস্ত করে।