যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও কিছু চ্যালেঞ্জ

শাহরিয়ার কবীরশাহরিয়ার কবীর
Published : 26 Sept 2012, 05:58 PM
Updated : 26 Sept 2012, 05:58 PM

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য আমরা ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি দু'দশক ধরেই আন্দোলন করছি। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন। এখন এ বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। প্রথমদিকে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এ আইনে এই প্রথমবার বাংলাদেশে কোনও বিচারকাজ শুরু হয়েছে। বিচারকদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। তদন্ত সংস্থাগুলোরও কাজটা বুঝতে সময় লেগেছে। কী ধরনের তথ্যপ্রমাণ লাগবে তারা প্রথমে বুঝতে পারেননি। কারণ এটা তো প্রচলিত ফৌজদারি আদালতের মতো নয়। তবে এখন এই সমস্যাগুলোর বেশিরভাগই কেটে গেছে। খুব ভালোভাবেই ট্রাইব্যুনালের কাজ চলছে।

এখন যে সমস্যাটি রয়ে গেছে তা হল, আমাদের ট্রাইব্যুনালের লোকবলের অভাব। আমরা শুরু থেকেই সরকারকে বলে এসেছি- এত বড় একটি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কমপক্ষে আট-দশজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে হলে আমাদের অন্তত পঁচিশজন আইনজীবীর সাহায্য দরকার। তাদের সঙ্গে আরও সমসংখ্যক তদন্ত কর্মকর্তা ও গবেষণা সহকারী থাকতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজের জন্য প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে বেশকিছু আর্কাইভ এবং লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছি আমরা। অন্যান্য উপকরণগুলোরও জোগান দিতে হবে।

সবচেয়ে জরুরি যে প্রয়োজনটি ছিল তা হল, বিচারকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, তদন্ত কর্মকর্তা এবং সাক্ষীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। আমরা চেয়েছিলাম সরকার সাক্ষীদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক। এ জন্য সাক্ষ্য নিরাপত্তা আইন গঠনের দাবি ছিল আমাদের। কিন্তু এ সব বিষয়ে সরকার এখনও কোনও পদক্ষেপ নেননি। কেন নেননি সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। তবে এর ফলে আমাদের এই ট্রাইব্যুনালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে আমরা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য পাচ্ছি না। নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে তারা ট্রাইব্যুনালে আসছেন না। তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের এ জন্য অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

আমি বরাবরই বলে এসেছি, সমস্যাটা হল, সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই, উপলব্ধির ঘাটতি আছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের পদ্ধতি ও জটিলতা সম্পর্কে তাদের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা নেই। সরকার ভাবছে, কেন এ বিচারের জন্য এত এত আইনজীবী লাগবে, এত রসদ লাগবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা কোনও ফৌজদারি মামলার বিচার করছি না। একজন বা দুজন খুনির বিচার এখানে হচ্ছে না। আমরা একচল্লিশ বছর আগে সংঘটিত একটি গণহত্যার বিচার করছি। এটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সংঘটিত পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সরকারের প্রস্তুতিটা হতে হবে ব্যাপক।

পৃথিবীর যে কোনও দেশে গণহত্যার বিচার খুব জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। কারণ এখানে প্রচুর তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কাজ থাকে। আমাদের দেশে দীর্ঘ চার দশকে গণহত্যার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী মারা গেছেন। তাই ট্রাইব্যুনালকে আরও রসদের জোগান ঠিকঠাকভাবে দিতে হবে। এটা করতে পারলে আমরা আশা করি, ২০১৩ সালের মধ্যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শেষ করা যাবে।

অনেকেই অভিযোগ করেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার কেন আওয়ামী লীগ সরকার আরও আগেই শুরু করেননি। আমি এর কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে চাই। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির ব্যাপারে সরকার আমাদের কথা দিয়েছিলেন যে, তারা এই বিচার শুরু করতে চান। তবে একসঙ্গে সবগুলো হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা কঠিন ছিল। প্রথমত, ওই টার্মে সরকারের এত সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না যতটা এবার হয়েছে। তাই আগে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে চেয়েছিলেন। তাদের কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শেষ করে তারা এ বিচার শুরু করবেন।

দ্বিতীয়ত, আমাদের আরও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন, এ দেশে দক্ষ আইনজীবীর অভাব রয়েছে। আবার আইনজীবীদের শুধু দক্ষ হলেই চলবে না, তাদের সততারও একটি ব্যাপার আছে। পাশাপাশি, তাদের অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে হবে। এ সব কারণে তখন এই বিচারকাজ শুরু করা যায়নি যা এবার করা যাচ্ছে।

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সরকারকে সহযোগিতার সর্বাত্মক চেষ্টা আছে। আমাদের কাছে যে সব তথ্য-প্রমাণ ছিল সব আমরা ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় সরকারকে দিয়েছি। এছাড়া অতীতের অনেক ট্রাইব্যুনালের নথিপত্র, মামলার রায়, সওয়াল-জবাব, অপিনিয়ন স্পিচ সবই সংগ্রহ করে সরকারকে সরবরাহ করেছি। তবে আরও কাগজপত্র লাগবে। অন্যান্য দেশের আর্কাইভে একাত্তরের গণহত্যার অনেক দলিলপত্র রয়ে গেছে। সেগুলো সংগ্রহ করা দরকার। এটাও খুব জটিল একটি কাজ। পাশাপাশি, অতীতের ট্রাইব্যুনালগুলো কী কী সমসার মুখোমুখি হয়েছে, সে সব সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করেছে, তাদের কী কী সীমাবদ্ধতা ছিল ইত্যাদি নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি।

এ জন্য আমরা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল ইত্যাদির বিচারকাজের কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি। এ সব ট্রায়ালে যে সীমাবদ্ধতাগুলো ছিল তা যাতে আমাদের ট্রাইব্যুনালে না থাকে সে চেষ্টা করেছি। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে যখন এ আইনটি পেশ করা হল তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, 'আমরা অতীদের ট্রায়ালগুলোর আলোকে এ ট্রায়াল তৈরি করেছি। তবে এতে অতীতের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটানোর চেষ্টা করেছি।' যেমন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন হল, টোকিও ট্রায়াল ও ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে আসামীদের আপিলের কোনও সুযোগ ছিল না। আমাদের ট্রাইব্যুনালে সে সুযোগ রাখা হয়েছে। এই বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিতও হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সরকারগুলো ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও প্রমাণ নষ্ট করে ফেলেছিল। কারণ তারা জানত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে একদিন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি উঠবে। এই চ্যালেঞ্জটিকেও মোকাবেলা করেও আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেছিলেন। জিয়া এসে সেটা বন্ধ করেছিলেন। ওদিকে খালেদা জিয়া বলেছেন, এ সরকার যা কিছু করছে সব আমরা বাতিল করব। এই যে একটি অপসংস্কৃতি- এটা তো আমাদের দেশে রয়ে গেছে। বিএনপি যতবার ক্ষমতায় গেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব কিছু বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বাহাত্তরের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেললেন। রাষ্ট্রের চার মূলনীতি বদলে ফেলে যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করলেন- এগুলো করে রাষ্ট্রকে তামসিকতার দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এগুলো কখনও-ই কাম্য নয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এক দীর্ঘ সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে বিশাল একটি প্রজন্মকে জানতে দেওয়া হয়নি। তারা বুঝতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কী কী ঘটেছিল। রাজাকার-আলবদর কারা গঠন করেছিল বা কীভাবে তারা পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। এখানে যে নৃশংসতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তা নিয়েও তাদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করতে পারেনি। আমরা তাই গত দু'দশকে একটি প্রজন্মকে তৈরি করেছি যারা যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে সচেতন। তারা জানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, কারা এই যুদ্ধে আমাদের শত্রু বা মিত্র ছিল। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মাধ্যমে এত বছরে আমরা এই জায়গায় এগুতে পেরেছি। আমাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্ম নেয়া প্রজন্মগুলো এখন সচেতন হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য যুদ্ধাপরাধীরা দেশে-বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে- এটাও আমাদের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বিচার সম্পর্কে বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করতে এরা সবসময়ই সক্রিয়। ওরা দেশের বাইরে প্রচুর টাকা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। দেশেও তারা নানাভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। টক শো ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারের সুশাসনের অভাবের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টিকে এক করে তুলে ধরছে। ফলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরির আশঙ্কা ছিল।

তাই আমরা যখনই সুযোগ পাচ্ছি এই বিচারের যৌক্তিকতার কথা সবাইকে জানাচ্ছি। গত তিন বছরে আমাদের প্রচুর প্রকাশনা তৈরি করতে হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে আমরা ইউরোপয়ীয় পার্লামেন্টে এই বিষয়ে একটি শুনানিতে অংশ নিয়েছি। আমাদের আইনজীবীরা সেখানে ছিলেন। ছিলেন জামায়াতের আইনজীবীরাও। যখনই সুযোগ পেয়েছি আমরা বিভিন্ন দেশের আইনপ্রণেতা, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। সবার কাছে এই বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি। তাতে দেখেছি, অনেকেই জামায়াতের মিথ্যাচার-অপপ্রচারের শিকার হয়েছিলেন। আমাদের কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য জানতে পেরে তাঁরা অবস্থাটা বুঝতে পেরেছেন। বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়েছেন।

তবে আমরা মনে করি, সরকারকে এ ব্যাপারে আরও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। জামায়াত বিশেষ করে যে সব লবিস্ট নিয়োগ করেছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি, বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোরও আরও কার্যকর ভূমিকা দরকার। তবে আমরা কিন্তু সতর্ক রয়েছি এবং সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

আমরা আশাবাদী। সরকারও এই ট্রাইব্যুনাল চালাতে গিয়ে শিখছেন, আমাদের আইনজীবীদের বিরাট একটা অভিজ্ঞতা হচ্ছে- তাই বিচারকাজ সুসম্পন্ন করা যাবে বলে আমরা মনে করি।

হ্যাঁ, এই সরকার কাজটি শেষ করতে না পারলে যদি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের দল ক্ষমতায় আসে তাহলে কী হবে সে প্রশ্ন থাকতে পারে। ট্রাইব্যুনাল তো বন্ধ হয়ে যাবে না যেহেতু এটা একটি কোর্ট। তবে তারা চেষ্টা করবেন নানাভাবে। বিচার বিলম্বিত করবেন, রসদের জোগান দেবেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্রেও তারা এটা করেছেন। তবে এখন যেভাবে বিচারকাজ এগুচ্ছে তাতে ২০১৩ সালের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায় পাওয়া যাবে। এরপর আসামীরা আপিল করতে পারবেন। আমরা চাই আপিলে কী রায় আসে সেটা দেখতে। যদি আপিলে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে তাহলে আমরা চাইব যেন শাস্তিটা কার্যকর করা হয়।

শহীদ পরিবার, গোটা জাতি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সচেতন মানুষ অপেক্ষা করছেন এই বিচারের রায়ের জন্য। আমরাও তাই গণজাগরণের ওপর আস্থা রাখছি। মানুষ এখন জানেন এই বিচারটা কেন জরুরি। এটাই অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ জয় করার জন্য সবচেয়ে জরুরি।

শাহরিয়ার কবীর: লেখক, সাংবাদিক, চিত্রনির্মাতা ও মানবধিকারকর্মী।