বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ভীতি, বাস্তবতা ও কিছু পরামর্শ

মো. দেলোয়ার হোসেন
Published : 3 July 2020, 08:21 AM
Updated : 3 July 2020, 08:21 AM

বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্তের ১০০তম দিন পার হয়েছে গত ১৫ জুন, ২০২০। সেইসঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ১০০তম দিন পূর্ণ হয়েছে ২৫ জুন। উহানে অপরিচিত ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অস্বাভাবিক নিউমোনিয়ায় ভোগা কয়েকজন রোগী শনাক্তের প্রেক্ষিতে গত ৩১ ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক বার্তা দেয় চীন। ৭ জানুয়ারি চীন উক্ত ভাইরাসটি শনাক্তের ঘোষণা দেয় এবং নাম দেয় Novel Corona Virus (nCoV)। অল্প কিছুদিনের মাঝেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। হু হু করে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। ১১ মার্চ এটিকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেই থেকে ভাইরাসটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে নানা বিচার-বিশ্লেষণ ও আলোচনা। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রয়েছে নানা মত-দ্বিমত। মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে এক ধরনের ভীতি। তবে এই ভীতি কতটা বাস্তবসম্মত, তা ভেবে দেখার বিষয়। সেটি জানতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। কেননা, মহামারীর ভয়াবহতা বুঝতে আক্রান্তের চেয়ে মৃত্যুর হার বিবেচনায় নেয়াটাই যৌক্তিক।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ভয়াবহতার একটি তুলনামূলক ধারণা পেতে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিল এবং প্রায় সমহারে আক্রান্ত ভারতে প্রথম মৃত্যুর দিন হতে ১০০ দিনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা যতটা আতঙ্কগ্রস্থ, বাস্তবচিত্র তার চেয়ে অনেক কম ভীতিকর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে সংক্রমণও বেশি। তবে, শনাক্তের তুলনায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে। অন্যদিকে, নানা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে মূলত বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদান ব্যাহত হওয়ায় কোভিড, নন-কোভিড উভয় ধরনের রোগীই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। ফলে কোনো কোনো রোগী ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা না পেয়ে হয়তো খুব সামান্য কারণেই মারা যাচ্ছেন, যা মানুষের মাঝে ব্যাপক ভীতি ছড়িয়েছে। তবে, মহামারীর ভয়াবহতা পরিমাপের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় মৃত্যুর পরিসংখ্যানের দিক থেকে আমরা এখনো পর্যন্ত অত্যন্ত কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছি।

উল্লেখিত দেশগুলোতে ১০০ দিনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রথম মৃত্যু হতে ১০০তম দিনে এসে যুক্তরাজ্য ও স্পেনে প্রতি ১০০ জনে মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে ৬.১১ ও ৬.০৪ জনের। একই ভাবে, প্রতি ১০০ জনে ইতালিতে ৫.৫ জন, ফ্রান্সে ৪.৪৭ জন এবং আমেরিকায় ৩.৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রতি ১০,০০০ জনে ৯.৮৪ জন এবং ভারতে প্রতি ১০,০০০ জনে ৯.৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাজ্যে প্রায় ৬২ গুণ, স্পেনে প্রায় ৬১ গুণ, ইতালিতে প্রায় ৫৬ গুণ, ফ্রান্সে প্রায় ৪৫ গুণ এবং আমেরিকায় প্রায় ৩৫ গুণ মানুষ মারা গিয়েছে। এমনকি, ব্রাজিলে মারা গিয়েছে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ২৬ গুণ। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অতীতের যেকোনো সময়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২,০০০ মানুষ বিভিন্ন রোগে মারা যেত, যার মধ্যে গড়ে প্রায় ২০০ জন থাকে যক্ষার এবং এই রোগের উপসর্গও কোভিড-১৯ এর উপসর্গের মতো।

বাংলাদেশ ও ভারতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় অত্যন্ত কম। তবে, বাংলাদেশ ও ভারতে এই হার প্রায় একই রকম। কেন এই ভিন্নতা? আমেরিকার এমআইটি'র গবেষণা বলছে, পৃথিবীর শীতলতম অঞ্চলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়ার এলাকায় করোনাভাইরাস কম ছড়িয়েছে। বিশ্বে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রায় ৯০ ভাগ ঘটনা ঘটেছে ৩ থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং প্রতি কিউবিক সেন্টিমিটারে ৪ থেকে ৯ গ্রাম পরম আদ্রতাসম্পন্ন অঞ্চলে। এমআইটি'র গবেষণা সূত্রে আলোচ্য দেশগুলোর দৈনিক সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া বাকি দেশগুলোতে এ সময়ের তাপমাত্রা করোনাভাইরাস ব্যাপক বিস্তারের অনুকূলে ছিল। সে তুলনায় এই সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি ছিল। সে কারণেই হয়তো এই দুটি দেশে করোনাভাইরাস ততটা প্রণঘাতী হয়ে উঠতে পারেনি।

গত ১৫ বছরের আবহাওয়ার রেকর্ড অনুযায়ী আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির মধ্যে থাকার কথা, যা করোনাভাইরাস বিস্তারের অনূকুল তাপমাত্রার চেয়ে অনেকটাই বেশি। এমনকি, নভেম্বর মাসের তাপমাত্রাও করোনাভাইরাস বিস্তারের অনূকুল তাপমাত্রা থেকে বেশি থাকবে। করোনাভাইরাসে তাপমাত্রার প্রভাব সত্য হলে এই সময়ে বাংলাদেশে সংক্রমণের ধারা অব্যাহত থাকলেও মৃত্যুর হার খুব একটা বাড়ার সম্ভাবনা নাই। আর ততদিনে আমরা হয়তো হার্ড ইমিউনিটি বা তার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারব। আবহাওয়ার প্রভাব ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভাস এবং বিসিজি টিকা অপেক্ষাকৃত কম মৃত্যুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ।

যদিও আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত অনেক কম, তারপরও আগামীতে মৃত্যুহার বাড়বে না সেটি এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। হয়তো অনেকটা প্রাকৃতিক কারণেই আগামীতেও বাংলাদেশে করোনায় ভয়ানক হারে মৃত্যুর সম্ভাবনা কম। অন্তত ইউরোপ-আমেরিকার মতো ভয়াবহ অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে, যেহেতু বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাস নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি, তাই এই মুহূর্তেই এর সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়। আবার, যেহেতু আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত ঝুঁকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম, তাই আতঙ্কিত না হয়ে যথাযথ সচেতনতা অবলম্বন করাই ভালো।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংক্রমণের হার ও পরিমাণ জানতে টেস্ট বাড়ানোর বিকল্প নাই। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও কন্টাক্ট ট্রেসিং না হওয়ায় আমরা এখন সংক্রমণের ঠিক কোন স্তরে আছি তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তেমনি জনসংখ্যার কত ভাগ মানুষ ইতোমধ্যে সংক্রমিত হয়েছে বা হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছাতে আর কতদিন লাগতে পারে তাও সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। উল্লেখ্য যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১ জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট ৭,৮৭,৩৩৫ জনের করোনাভাইরাস পরীক্ষা হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.৪৮ শতাংশ মাত্র। গত কদিন যাবত দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এই হারে পরীক্ষা চলতে থাকলে, দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগের টেস্ট করতেই সময় লাগবে প্রায় ৪৮০ দিন বা এক বছরের বেশি।

সম্প্রতি অনেকে কোনো প্রকার উপসর্গ ছাড়াই করোনাভাইরাস পজিটিভ হচ্ছেন। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরই কোনো প্রকার উপসর্গ থাকে না। বাকি ২০ ভাগের মধ্যে ১৫ ভাগের ক্ষেত্রে খুব সামান্য উপসর্গ দেখা দেয়। আর বাকি মাত্র ৫ ভাগের ক্ষেত্রে উপসর্গ প্রকটভাবে দেখা দেয়। পরিলক্ষিত হয়েছে যে, এই ৫ ভাগের অনেকেই উপসর্গ দেখা দেয়ার পরও প্রথম দিকে এটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেননি। পরবর্তিতে অবস্থা যখন সংকটাপন্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন হাসপাতালে ছুটছেন। অথচ, প্রথম থেকেই যথাযথ চিকিৎসা এবং ঘরোয়া পদ্ধতি গ্রহণ করলে হয়তো তাদের মধ্যে অনেকে বাড়িতেই সুস্থ হয়ে যেতেন।

যেহেতু মহামারী আর কতদিন চলবে তা বলা যাচ্ছে না, তাই করোনাভাইরাস নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে না থেকে চলমান সংকট থেকে কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের ভাবা দরকার। তার জন্য সর্বপ্রথম করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের অযৌক্তিক ভীতি দূর করতে হবে। একইসঙ্গে যুক্তিসঙ্গত আশঙ্কার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সে লক্ষ্যে জনগণকে এ ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া ও করণীয় সম্পর্কে জানানোর মাধ্যমে তাদের ভীতি দূর করা, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সকল রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান, হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং চলমান মহামারী কার্যকরভাবে মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করা সবচেয়ে জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস।

পাশাপাশি আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করতে পারি-

(ক) করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত বা বিভ্রান্ত না হয়ে এ সম্পর্কে সত্য ও সঠিক তথ্য ভালো করে জানা;

(খ) লকডাউন থাকুক আর না-ই থাকুক, পরিস্থিতি যা-ই হোক, যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা;

(গ) কৌতুহল বা সন্দেহবশত বা সামান্য উপসর্গ দেখা দিলেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ভিড় না করা। এতে সংকটাপন্ন রোগীরা যথাসময়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন;

(ঘ) উপসর্গ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত কোভিড হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইন বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করার পাশাপাশি বাড়িতে ভেষজ পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা। জেনে রাখা ভালো, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রোগী সামান্য নিয়ম মেনে বাড়িতে থেকেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠছেন;

(ঙ) প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার গ্রহণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ভিটামিন-সি ও বিশুদ্ধ পানি পান করা। পাশাপাশি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রচলিত ঘরোয়া টোটকাগুলো পালনের চেষ্টা করা এবং প্রতিদিন অন্তত ১৫/২০ মিনিট গায়ে সূর্যের আলো লাগানো।

করোনাভাইরাসের কোনো চিকিৎসা বা প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে, আপনার শরীরের সুস্থতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও প্রয়োজনীয় সচেতনতাই আপনাকে করোনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখতে যথেষ্ট। তাই লকডাউন থাকুক আর নাই থাকুক, করোনার প্রভাব পুরোপুরি কেটে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সবাইকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কারণ, করোনাভাইরাস সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কোনো কথাই শেষ কথা নয়।