ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আলমা ম্যাটারের প্রতি নিবেদন

Published : 2 July 2020, 08:04 AM
Updated : 2 July 2020, 08:04 AM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার আলমা ম্যাটার। আমার বিদ্যাদায়িনী, খাদ্যদায়িনী মা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার প্রাণের নিবিড় সম্পর্ক। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কেটেছে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সোনালি তারুণ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এ বিশ্ববিদ্যালয় যেন বাংলাদেশের ইতিহাসকে বক্ষে ধারণ করে আছে। যে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয় সেই মহান ভাষা আন্দোলনের জন্মস্থান হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান দার্শনিক, নেতা, কর্মীরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক ও ছাত্র। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক আবুল কাশেম ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক যারা জাতিকে দিয়েছিলেন দিকনির্দেশনা। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র এবং ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা ছিলেন। ভাষাশহীদ আবুল বরকত ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন ছাত্রের ছাত্রত্ব চলে যায়।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অংশ নিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন। পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষক কর্মচারীদের বাসভবনে চালিয়েছিল ভয়ংকর গণহত্যা। শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য ছাত্র। শহীদ হয়েছিলেন শিক্ষকরা। শহীদ হযেছিলেন কর্মচারী, কর্মকর্তারা। মহান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি বিরাট অংশ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বীরত্বের ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরা এদেশের প্রতিটি মুক্তি আন্দোলনে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। সয়েছেন নির্যাতন। পঁচিশে মার্চে রোকেয়া হলের ছাত্রীদের অনেককে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে ভয়ংকর নির্যাতন সয়েছেন তারা। শহীদও হয়েছেন অনেকে।

এই ইতিহাস আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার সজীব হয়ে ওঠে।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম প্রতিবাদ মিছিল করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই।

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও প্রথম থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা উৎসবের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেরও সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। স্বৈরাচারী তত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেও আন্দোলন দানা বেঁধেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমনকি রাজাকারের ফাঁসি চেয়ে শাহবাগ আন্দোলনও হয়েছে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের পবিত্র ভূমিতেই।

প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যলয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পাওয়া হয়নি অসংখ্য শিক্ষার্থীর। ১৯৮৫ সালে জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির কারণে শহীদ হন অনেক ছাত্র। তাদেরও বিশ্বদ্যিালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি আর পাওয়া হয়নি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়ার মতো শহীদ হয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র। সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজু। এই শিক্ষার্থীরা আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন এই সবুজ চত্বরে। অথচ অকালে তাদের চলে যেতে হয়েছে জীবন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাসে এখনও মিশে আছে তাদের তরুণ প্রাণের সজীবতা।

২০২১ সালে শতবর্ষ পূর্ণ হতে যাচ্ছে প্রাণপ্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই পবিত্র লগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিনীত আবেদন, রাজনৈতিক কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাদের ছাত্রত্ব গিয়েছিল (১৯২১-১৯৯০), যারা ছাত্র অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ও শহীদ হয়েছেন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে সম্মানসূচক এম এ ডিগ্রি দেয়া হোক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার পরিবারের নিবিড় সম্পর্ক। ১৯২১ সালে আমার দাদা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিক্ষক হয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

বড় চাচা মুহম্মদ সফিয়ূল্লাহ দীর্ঘদিন ছিলেন সিনেট সদস্য। বাবা কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও কর্মী। আমার একমাত্র ভাই ইয়ূসুফ আব্বাস এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। আমিও ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থী এবং নব্বইয়ের গণআন্দোলনের একজন কর্মী ছিলাম।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধকে, দেখতে পাই ভাষা আন্দোলনকে। চোখে ভেসে ওঠে শহীদ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মুখ। এই শহীদ শিক্ষার্থীদের, আন্দোলনের কর্মীদের কি দাবি নেই তাদের আলমা ম্যাটারের কাছে? তারা কি সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার স্বপ্ন নিয়ে এই মাতৃ প্রতিষ্ঠানে আসেননি? ২০২১ সালে শতবর্ষের আনন্দ লগ্নে মিশে আছে তাদেরও স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সফল করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সম্মানসূচক মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করবেন এই প্রত্যাশা আমার একার নয়, অসংখ্য শিক্ষার্থীর, যারা এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের গর্বিত সদস্য। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত, আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূরণের পথে যাত্রাকে অভিনন্দন জানাই।