আত্মস্মৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

চৌধুরী শহীদ কাদেরচৌধুরী শহীদ কাদের
Published : 23 Jan 2012, 01:21 PM
Updated : 1 July 2020, 03:42 PM

১৯২১ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট, কলা অনুষদের ডিন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়টুকুর বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় তার আত্মজীবনী 'জীবনের স্মৃতিদীপে'। 

এই স্মৃতিকথায় অধ্যাপক মজুমদার তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান, বিশ্ববিদ্যালয়টির কাঠামো কীভাবে গড়ে উঠেছিল সেই বিবরণ, বাংলার ইতিহাস রচনা, ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের আগমন, উপাচার্য হওয়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামাজিক জীবনের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হতো এবং একাডেমিক ক্ষেত্রে একাডেমিশিয়ানদের মূল্য দেওয়া হতো। এর পরীক্ষা পদ্ধতির প্রশংসা করে অধ্যাপক মজুমদার লিখছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা গ্রহণের প্রণালী ও আদর্শ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকটা ভিন্ন ধরনের হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধ পক্ষের লোকেরাও পরীক্ষা সম্পর্কে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সততা সম্বন্ধে বরাবরই উচ্চ প্রশংসা করেছেন। এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কীর্তি দুই খণ্ডে বাংলার ইতিহাস রচনা। রমেশচন্দ্র এই ইতিহাস রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।" 

তার ভাষ্য থেকে জানা যায়, ঢাকার হিন্দু নাগরিকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন পছন্দ করেন নি। প্রথম থেকেই তাদের মনে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে খুব বিদ্বেষভাব ছিল। মুসলমানেরা যে পরিমাণে খুশি হলেন হিন্দুরা সেই পরিমাণ অসন্তুষ্ট হলেন। তাদের অনেকেরই বিশ্বাস হল যে, আরেকভাবে বাংলাদেশকে দুই খণ্ড করা হল।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে তা প্রতিফলিত হতো এবং উপাচার্য বা শিক্ষকরা কীভাবে তার মোকাবেলা করতেন তার বিবরণও তিনি দিয়েছেন বিস্তৃতভাবে।

 শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপ্তি কতটা ছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী লেখক বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতে। 'আমার ছেলেবেলা'য় তিনি লিখেছেন, "ভিতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রেল-লাইন থেকে শহরের উত্তরতম প্রান্ত পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি। উত্তর অংশটি সরকারি কেষ্টবিষ্টুদের বাসভূমি, মধ্যিখানে আছে বিলেতি ব্যসন ঘোড়দৌড়ের মাঠ, গলফ খেলার মাঠ, আছে ঢাকার নাগরিকদের পক্ষে অপ্রবেশ্য ঢাকা ক্লাব, যেখানে মদ্যবিলাসী বল্-নৃত্যপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষ ও নারায়ণগঞ্জের পাটকল-চালক ফিরিঙ্গিরা নৈশ আসরে মিলিত হয়, আর আছে কাননবেষ্টিত উন্নতচূড়া একটি কালীমন্দির। কিন্তু দক্ষিণ অংশটি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারভুক্ত; সেখানে ছাত্র এবং অধ্যাপক ছাড়া ভিড় দেখা যায় শুধু শীতে বর্ষায় শনিবারগুলির অপরাহ্নে যখন জুয়াড়ি এবং বেশ্যায় বোঝাই খড়খড়ি তোলা ঘোড়ার গাড়ি ছোটে অনবরত রেসকোর্সের দিকে।"

রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখছেন, "বঙ্গভঙ্গ রহিতের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর আর রাজধানী রইল না। নতুন তৈরি সেক্রেটারিয়েট ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ও আর্টস বিভাগ স্থাপিত হয় এবং সরকারি কর্মচারীদের বাসভবনের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বসবাসের জন্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে দিলেন। রমনার বর্তমানে যে মন্ত্রীপাড়া সেটি দীর্ঘসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বাসস্থান ছিল।"

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের পিতা মিসবাহউদ্দিন খানের আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে এই বিত্ত-বৈভব দখল হওয়ার ইতিহাস। লিখেছেন, "পাকিস্তান হওয়ার পর পরই রমনা এলাকায় আমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য চলে গেল। নীলক্ষেতে কর্মচারীদের জন্য ব্যারাক নির্মাণ করা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রফেসর বাংলো মন্ত্রীদের দখলে চলে গেল।"

সৈয়দ মুজতবা আলীর বড় ভাই সৈয়দ মোস্তফা আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন ছাত্র ছিলেন। মূলত তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু হয়েছিল পূর্ববঙ্গের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। কলেজ দুইটিকে আইন করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তর করা হয়। ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাওয়ার সেই গল্প ওঠে এসেছে মোস্তফা আলীর আত্মকথায়। লিখেছেন, "১৯২০ সালের জুলাই মাসে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। চার-পাঁচ মাস পরেই শুনলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি চালু হবে। কোন রকমে কলেজ চালিয়ে ১৯২১ ইং  এপ্রিল মাসেই গ্রীষ্ম অবকাশের জন্য বন্ধ হলো। জুলাই মাসে কলেজ খুললে দেখা গেলো আমাদের সেই পরিচিত ঢাকা কলেজ আর নেই- সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়ে গিয়েছে। গ্র্যাজুয়েট ক্লাস, ল ক্লাস ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হয়ে গেল। পুরনো জগন্নাথ কলেজের ছাত্র এসে আমাদের ক্লাসে যোগ দিলেন।"

রমেশচন্দ্র মজুমদারের আত্মজীবনীতে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের সমন্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনের ভালো বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে এই দুই কলেজের শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত নানা ঝামেলা, অসন্তোষের বিবরণ চোখে পড়ে। 

কবি ও রাজনীতিবিদ কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রায় পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনের স্মৃতি উঠে এসেছে তার আত্মজীবনীতে। সেইসময়কার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মোহিতলাল মজুমদার, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, হরিদাস ভট্টাচার্য, কালিকারঞ্জন কানুনগোসহ অনেক শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ তার স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়। কিরণ শঙ্করের শিক্ষা জীবনের সাথে মিশে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি। 

লিখেছেন, "হিটলার যখন রাশিয়া আক্রমণ করলো তখন আমাদের এম. এ ক্লাস চলছে। আমাদের বিভাগীয় প্রধান হাসান সাহেব (মাহমুদ হাসান) ১৯৪১ সালের ২৩ জুন সকালের ক্লাসে এসে এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির কথা ক্লাসে জানান।"

জাপানের পার্ল হারবারে আক্রমণ, দেশ জুড়ে ব্ল্যাক আউটের মহড়া, স্বদেশী আন্দোলনের টেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা পরিবেশকে অন্য রকম মনে হচ্ছিল। লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই সময়ে প্রবলভাবে রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়েছিলেন। 

শিল্পী মুর্তাজা বশিরের বাবা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর চাকরিসূত্রে এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তার আত্মজীবনী 'আমার জীবন ও অন্যান্য'তে এই সময়কার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণনা পাওয়া যায়।

আচ্ছা কিরণ শঙ্কররা কি আমাদের মতো আড্ডা দিতেন? কোথায় বসত সেই আড্ডার আসর? কিংবা এখন যে লাইব্রেরি বিসিএস প্রস্তুতির মূল কারখানা- কেমন ছিল চল্লিশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির পরিবেশ। 

লিখেছেন কিরণ শঙ্কর, "রেস্তোরাঁ বা গাছতলায় আড্ডা জমতো ছাত্রদের। আমার নিজের আশ্রয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, সেখানে নিবিড় এক মর্মব্যাপ্ত স্তব্ধতার মাঝে ছাত্রছাত্রীরা নোট টুকছেন। টেবিলের ওপর ছড়ানো বহু পত্র-পত্রিকার অধিকাংশই ইংরেজি ও বাংলা, ঝকঝকে তকতকে। কোনো কোনোটি বিদেশ থেকে সদ্য প্রেরিত। সাহিত্য ভালোবাসতুম বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিবিড় পরিবেশে আমি মগ্ন হয়ে যেতাম, ডুবে যেতাম এক সময়। মনে পড়ছে টি এস এলিয়ট তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত হয়নি; এই লাইব্রেরিতে এসেই তাঁর জটিল কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটেছিল।"

চট্টগ্রামের পটিয়ার মেয়ে নিবেদিতা নাগ ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। তার বাবা সঞ্জীব কুমার চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক। নিবেদিতার বর্ণনায় চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়।

লিখেছেন, "মেয়েদের রোলকলের জন্য অধ্যাপকরা রোল খাতা হাতে নিয়ে মেয়েদের কমনরুমের সামনে এসে দাঁড়াতেন- আমরা ছাত্রীরা তার পিছনে পিছনে লাইন দিয়ে ক্লাসে ঢুকতাম। আমরা বসতাম অধ্যাপকদের বাঁ দিকের চেয়ারের সারিতে। আর ছেলেরা বসত সামনের সারিতে। অধ্যাপকদের সঙ্গে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে দেখে ছেলেরা ব্যঙ্গ করে বলতো 'রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে', স্যারেরা হাসতেন, আমরাও।

সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র-ছাত্রীরা কথা বলতেন না, কথা বলা বারণ ছিল। ইউনিয়নের নির্বাচনের সময় এই নিয়ম মানা হতো না। নিবেদিতা নাগ লিখেছেন, "এটি প্রেমের ফাঁদ পাতার একটি বড় উপলক্ষ ছিল।"

কিন্তু তার মানে এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের কোন স্বাধীনতা ছিল না বললে ভুল হবে। সেই চল্লিশের দশকেও অনেক নারী শিক্ষার্থী সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। নিবেদিতা লিখেছেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা (অধ্যাপকদের) রমনা এলাকায় থাকতেন, তারা অনেকেই সাইকেলে আসতেন।"

মলচত্বরে বাহারী নামের এখন যে সারি সারি বাস তার প্রচলনও শুরু হয়েছিল এই সময়। ১৯৩৯ সালে নারী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার জন্য প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় শাটলের ব্যবহার শুরু হয়। নিবেদিতা লিখেছেন, "ঢাকা শহরে তখন ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া অন্য কোন যানবাহন ছিল না। মধ্যবিত্ত বা ধনী ঘরের মেয়েরা হেঁটে পথ চলত না, একমাত্র ভরসা ছিল খড়খড়ি দেওয়া ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু রোজ রোজ ঘোড়র গাড়িতে যাতায়াত প্রচুর খরচ সাপেক্ষ ছিল। ভর্তি হয়েও এই অসুবিধার জন্য অনেক ছাত্রী কলকাতায় পড়তে চলে এলেন। অনেকের পড়াই বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে  অভিভাবকরে আবেদনে সাড়া দিয়ে আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাসটি সমস্ত ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে মেয়েদের তুলে নিত। প্রচুর সময় নষ্ট হতো আমাদের।"

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগের ছাত্র ছিলেন মিসবাহউদ্দিন খান (প্রাক্তন সংসদ সদস্য ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের পিতা)। তার স্মৃতিচারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে শাস্তি দেওয়া হত তার বিবরণ পাওয়া যায়। লিখেছেন, "অনার্সে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়াতেন ড. শশীভূষণ চৌধুরী। তিনি খুব সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করে পড়াতেন। প্রথম টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমরা তার দেওয়া এসাইনমেন্ট করে যাইনি। তিনি আমাদের শাস্তি দিলেন বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে। মেয়ে সহপাঠিনীকেও দাঁড়িয়ে থাকতে আদেশ দিলেন।" 

মুহাম্মদ এলতাসউদ্দিন ষাটের দশকের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তার আত্মস্মৃতি 'দাদীর আমলের কথায়' সেকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, পাঠদান পদ্ধতি, সামাজিক অবস্থাসহ বিধি বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বিশেষ করে ১৯৫২-৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছিলেন সেইসবের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

শিশু সাহিত্যিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের বর্ণনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন স্থানান্তরের বিবরণ পাওয়া যায়। 

লিখেছেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের এক পাশে। দোতলা ভবনে ক্লাস হতো। ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষকরা ছাত্রীদের কমনরুম থেকে ডেকে ক্লাসে নিয়ে যেতেন। ছাত্রীদের একমাত্র হল ছিল চামেলী হাউস (বর্তমান সিরডাপ ভবন)। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধের সময় পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় ভবন থেকে কলাভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ স্থানান্তরিত হয়।"

অবসরপ্রাপ্ত সচিব সুলতান-উজ-জামান তার আত্মজীবনী 'স্মৃতির সাতকাহনে' এই সময়টার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। লিখেছেন, "কয়েকজন তথাকথিত আধুুনিক ছাত্রীর আগমন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে কিছুটা চমক লাগিয়েছিল। কেবল বাহ্যিক চাকচিক্যের দিক থেকে যে তাঁরা স্মাট ছিলেন তা নয়, লেখাপড়ায়ও তাদের কৃতিত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য।" 

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ্ এম এস কিবরিয়ার আত্মজীবনী 'পেছন ফিরে দেখা'-তে ভাষা আন্দোলনের সময়কার ছাত্র আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

অ্যান জেরাল্ডাইন স্টক ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনের অস্থির উত্তাল সময়ে শিক্ষক হিসেবে তিনি এই আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই আন্দোলনের সাথে যারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত তাদের দেখার সুযোগ হয়েছিল। এর পর স্টক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান। ছেড়ে চলে যাবার পর দীর্ঘদিন স্টকের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন যোগাযোগ ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্টক আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর তার যে পর্যবেক্ষণ আমার কাছে মনে হয়েছে সেটিই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। লিখেছেন, "বিশ বছর পর ফিরে এসে আমার মনে হলো, ছাত্ররা খুব বেশি বদলায়নি, যদিও আমি বর্তমানের চাইতে অতীতকে বেশি জানি। মিছিল ও শ্লোগানে তাদের উৎসাহ দেখে মনে হয় তারা এখনও বিশ্বাস করে যে তারা যদি মিছিল না করে, শ্লোগান না দেয়- সরকার জানতেই পারে না জনগণ কী চায়, কী ভাবে।"

পাঁচ দশক পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঐতিহ্য, সেই মিছিলের আগুন বহাল তবিয়তে আছে। এটাই শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের জায়গা।

 পূর্ববঙ্গে একটি শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তোলার জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন হয়েছিল গত একশ বছরে সেই বিশ্ববিদ্যালয় পাল্টে দিয়েছে পূর্ববঙ্গের মানচিত্র। পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেটি একটি জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। অনেকেই মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়টি আস্তে আস্তে তার আবেদন হারাচ্ছে। কিন্তু এখনও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে- এই রাষ্ট্রের শেষ ভরসা। সামরিকতন্ত্র, আমলাতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র এগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। শতবর্ষে একটাই প্রার্থনা,  অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কণ্ঠস্বর যেন ক্ষীণ হয়ে না আসে।