মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ : সামান্য কথা

হাসান শফি
Published : 6 Nov 2014, 07:27 PM
Updated : 17 Sept 2012, 02:04 PM

গেল বৃহস্পতিবার দেশে যে বড় ঘটনাটি ঘটল তাকে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে, রদবদল নয়। মত্রিসভার শপথগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকার বা মন্ত্রিসভার সার্বিক সাফল্য দাবি করেছেন। তাঁর মতে, মন্ত্রিসভার সদস্যদের সবাই দক্ষতার সঙ্গেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন। এ অবস্থায় কিছুদিন আগে পদ্মাসেতুর দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে, শুধু বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ করতে বা তাঁর নিজের ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় 'দেশপ্রেমে'র পরিচয় দিতে, যে সৈয়দ আবুল হুসেন পদত্যাগ করলেন, তিনিও দক্ষ। দক্ষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও, রাতের আঁধারে গাড়িতে টাকা নিয়ে ব্যক্তিগত সহকারীর মন্ত্রীর বাসায় যাওয়ার পথে ধরা পড়ার অভিযোগের মুখে পদত্যাগ করেও যিনি অচিরেই আবার দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর মর্যাদায় মন্ত্রিসভায় পুনরাভিষিক্ত হয়েছেন।

মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পর সুরঞ্জিত বাবু বড় গলায় দাবি করেছিলেন, ঘটনায় তাঁর সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও, ঘটনার নৈতিক দায়দায়িত্ব নিয়ে তিনি পদত্যাগ করছেন। আর এভাবে পদত্যাগের মাধ্যমে এ দেশের ইতিহাসে তিনি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। আমরা অনেকেই সেদিন তাঁকে, তাঁর সে বক্তব্যকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও অতঃপর অভিযোগের মুখে সরকার, মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের দুর্র্নীতি, ব্যর্থতা বা অব্যবস্থাপনার অন্তত নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগের এই দৃষ্টান্তটি অনুসৃত হবে। কিন্তু এরপর কী ঘটল, কেন বা কোন পরিস্থিতিতে তিনি আবার গাড়িতে পতাকা ওড়াবার সুযোগ ফিরে পেলেন, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। তিনি নিজেও খোলাসা করে এ ব্যাপারে কোনও কথা বলেননি। যদিও বরাবরের মতো টিভি টকশোতে ও সাংবাদিকদের কাছে রোজদিনই তিনি নানা বিষয়ে সমানে মত-মন্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তদন্তে তাঁর এপিএস, অভিযুক্ত রেল কর্মকর্তা এঁরা কি নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছেন? সেই গাড়িচালকই বা কোথায়? তাঁর সন্ধান কি পাওয়া গেছে?

দেশবাসী এ ব্যাপারে আজও অন্ধকারে। ঘটনায় মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা ছিল না এ কথা কি নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হযেছে? একজন সামান্য সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতি বা অসদাচারণের অভিযোগ উঠলে, তিনি প্রকৃতই দোষী বা নির্দোষ তা প্রমাণিত হওয়ার আগেই, তদন্ত চলাকালীন তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর একটি কারণ অভিযুক্ত যেন তাঁর পদ বা ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে তদন্তকে প্রভাবিত করতে না পারেন। মন্ত্রী, এমনকী তিনি যদি দপ্তরহীনও হন, তাঁর ক্ষমতা কি একজন সরকারি কর্মচারীর চেয়েও কম? তবে তাঁর বেলায় এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে কেন? আমাদের প্রতিবেশী ভারত বা অন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আমরা সাধারণত কী দেখি? মাঝখান থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এই পদত্যাগ করে আবার কদিন পরই দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসা, এটা জনমনে নানা প্রশ্ন ও জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। তিনি কি নিজেই চেষ্টা-তদ্বির করে ফিরে এসেছেন? নাকি কারও ইচ্ছা বা চাপ এর পেছনে কাজ করেছে?

তো, সাম্প্রতিক মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের কথায় ফিরে আসি। সরকারের মেয়াদের মাঝে এক বা একাধিকবার মন্ত্রিসভার রদবদল, পুনর্গঠন বা সম্প্রসারণ একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। যাকে বলে 'রুটিন ওয়ার্ক'। কিন্তু এবার যেভাবে ব্যাপারটা ঘটল এ দেশের ইতিহাসে এক কথায় তা অভূতপূর্ব। মন্ত্রিসভার এই সম্প্রসারণে সরকার বা দেশ কার কী উপকারে হবে বা হতে পারে, এক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া বোধহয় কেউই তা জানেন না। আমাদের বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা গঠন, পুনর্গঠন বা সম্প্রসারণের এক্তিয়ার অবশ্য এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর। এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভার অন্য কোনও সদস্য, দলের বা জোটের নেতার সঙ্গে তিনি পরামর্শ বা আলোচনা করতে বাধ্য নন। এবারও নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের ব্যাপারে শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় তাঁর নিকটতম কোনও সহকর্মী বা উপদেষ্টা কিংবা দলের কারও সঙ্গে পরামর্শ বা মতবিনিময় করেছেন কিনা, অথবা এর বাইরে আর কারও সঙ্গে কথা বলেছেন, আমাদের জানা নেই। নতুন মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানাবেন এটাও বরাবরের নিয়ম। কিন্তু তাই বলে তোফায়েল আহমদের মতো দলের একজন সিনিয়র নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভায় মনোনয়ন লাভের বিষয়টি প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছ থেকেই জানতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আগে বা পরে কোনও আলাপই করবেন না, কিছুমাত্র ধারণা দেবেন না, এটা নিশ্চয় স্বাভাবিক বা প্রত্যাশিত নয়। তোফায়েল আহমদ কেন, কারও পক্ষেই বোধহয় ওভাবে শুধু ক্যাবিনেট সচিবের ফোন পেয়ে দ্রুত সাজগোজ করে শপথগ্রহণ করতে বঙ্গভবনে ছুটে যাওয়া আত্মসম্মানজনক নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্যও এটাকে শুভলক্ষণ বলা যাবে না।

সরকারের প্রায় শেষ বছরে মন্ত্রিসভায় যোগদান করে তোফায়েল আহমদ কতটা কী করতে পারতেন কিংবা সরকার যে গাড্ডায় পড়েছে তা থেকে তাকে উদ্ধার করতে আদৌ কোনও ভূমিকা রাখতে পারতেন কিনা, তার চেয়ে এ বিবেচনাটিই হয়তো মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁকে অধিক প্রভাবিত করেছে। তা দলের একজন অনুগত কর্মী হিসেবে প্রকাশ্যে তিনি এখন যা-ই বা যত কথাই বলুন না কেন। আর যত ছোট দলই হোক, জোটসঙ্গী হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিষয়টিও দলের অনুমোদন সাপেক্ষ। পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণটির সঙ্গে যে তিনি এক টুকরো মাংশ ছুঁড়ে দেওয়ার তুলনা করেছেন, তা অযথার্থ নয়। মেননের নিজের মনের ইচ্ছা কী ছিল জানি না, তবে দলের পলিটব্যুরো, অন্তত তার অধিকাংশ সদস্য, সরকারের এই শেষ পর্যায়ে তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে।

জাসদেরও নিশ্চয় একটি কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। হাসানুল হক ইনুর মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিষয়টি কি সেই ফোরামে আলোচিত হয়েছে? তাঁরা কি আগেই এ ব্যাপারে 'যখন যে-অবস্থায় … ডাকিবা মাত্র' জাতীয় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন? নাকি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ধরনে তারাও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক ক্ষমতা সভাপতিকে দিয়ে রেখেছিলেন?

যাই হোক, মন্ত্রিত্ব করার সৌভাগ্য তোফায়েলের আগে হয়েছে। মেনন যে সুযোগটা হারালেন জীবনে তিনি আর দ্বিতীয়বার এ সুযোগ পাবেন কি না, বলা মুশকিল! তারপরও তোফায়েল ও মেননের এই মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি দেখা গেল দলমত নির্বিশেষে অনেকের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি দেশবাসীর বিলীয়মান আস্থা ও শ্রদ্ধার মনোভাব পুনরুদ্ধারে তাঁদের এ ভূমিকা যদি যৎসামান্য প্রভাব ফেলে সেটাও এ-সময়ে কম কথা নয়! যে-দুজন ডাক পেয়েও মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন না, তাঁরা উভয়েই রাজনীতির লোক। তাঁদের অন্য সীমাবদ্ধতা বা তাঁদের সম্পর্কে অভিযোগ-সমালোচনা যাই থাক, মাঠের রাজনীতি, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁরা উঠে এসেছেন। ক্ষমতার জন্য রাজনীতিতে যোগ দেওয়া কোনও সাবেক আমলা বা ব্যবসায়ী তাঁরা নন। অন্তত এই তফাতটি তাঁরা স্পষ্ট করতে পেরেছেন। সে জন্য তাঁদের অভিনন্দন।

পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ও তাঁর পদত্যাগের দাবির মুখে সৈয়দ আবুল হোসেন কেবল নিজেকে বারবার নির্দোষই দাবি করেননি। একাধিকবার বলেছেন, যে-দোষ তিনি করেননি তার দায় মাথায় নিয়ে তিনি কেন পদত্যাগ করবেন? বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মন্ত্রী পদে বসিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই কেবল তিনি ওই পদ ছাড়তে পারেন, অন্য কারও কথায় নয়। খুবই সঙ্গত কথা। অবশেষে তিনি পদটি ছেড়েছেন, 'দেশের স্বার্থে' এবং নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই। রীতিমতো সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছেপে আবুল হুসেন দেশবাসীকে সেটা জানিয়েছেন।

একইভাবে সাম্প্রতিককালে শেয়ারমার্কেট, ডেসটিনি ও হলমার্কের মতো দেশের অর্থনীতি খাতের কয়েকটি বড় কেলেঙ্কারি এবং সে ব্যাপারে যথোচিত পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে অর্থমন্ত্রীর একের পর এক দায়িত্বহীন, উল্টোপাল্টা বা বেসামাল উক্তি নিয়ে সংসদে এমনকী সরকার-দলীয় সদস্যদেরও তীব্র সমালোচনার মুখে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছেন, এবং পরিহাস করেই কিনা জানি না (আশা করব, পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর মতো একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি পরিহাস করেননি), এমনও বলেছেন, 'এই মুহূর্তে আমিই মনে হয় দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি'। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে এ-ও জানিয়েছেন নয় মাস ধরে নাকি তিনি 'পালাতে চেষ্টা করছেন'। পালাতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না, কেন? প্রধানমন্ত্রী ছাড়ছেন না বলে? নাকি দেশের স্বার্থের কথা ভেবে? অথচ তিনিই আবার পদ্মাসেতু চুক্তির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অবশিষ্ট শর্তটি পূরণ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানের পদত্যাগ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, 'উনি পদত্যাগ করছেন না কেন?'

বর্তমান সরকারের আমলে আমরা দেখলাম প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগের পরও মাসের পর মাস তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হল না; সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী হিসেবে তাঁর 'দৃষ্টান্তস্থাপনকারী' পদত্যাগের কদিন পরই আবার, কার অদৃশ্য অঙুলি হেলনে জানি না, দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হয়ে ফেরত এলেন; দুর্নীতির অভিযোগের মুখে সৈয়দ আবুল হুসেন আরও আগেই পদত্যাগ করে তাঁর 'দেশপ্রেমের' পরিচয় দিতে পারতেন, অথচ তিনি তা করলেন না; অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব 'পালাতে চেয়েও' পালাতে পারছেন না, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান দেশের স্বার্থে একবার নয় 'দশবার পদত্যাগ' করতে রাজি আছেন বলার পরও দুদিন ভারত থেকে ঘুরে এসে আবার উল্টো সুরে গাইতে শুরু করেছেন : তিনি দুর্নীতিবাজ এটা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি পদ ছাড়বেন না; অন্যদিকে মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেয়েও তোফায়েল আহমদের মতো আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন না।

সরকারের শীর্ষস্তরে ঘটে যাওয়া এই ব্যাপারগুলো দেশবাসীর কাছে কোনও ইতিবাচক বার্তা কি পৌঁছে দিচ্ছে?

হাসান শফি : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।