করোনাভাইরাস-ডেঙ্গু: সহ-সংক্রমণে নতুন সর্তকবার্তা

মো. আসাদুজ্জামান মিয়া
Published : 3 June 2020, 12:42 PM
Updated : 3 June 2020, 12:42 PM

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে ফলে একই ব্যক্তি একইসাথে করোনা ও ডেঙ্গু উভয় ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে যেমন- সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভারতে আগেই এই ধরনের সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের দেশেও এই ধরনের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি চট্রগ্রামে একজন বয়স্ক লোক (৫৮ বছর) একইসাথে করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছে। এটাকে অবশ্য মিডিয়াতে দেশের প্রথম ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু বলা হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে চট্রগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল এবং তিনি একইসাথে করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গু উভয় ট্রিটমেন্টই নিয়েছিলেন। এরকমই আরেকটি ঘটনা ঘটেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার ক্ষেত্রে। প্রথমে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকেন এবং পরে কোভিড-১৯ পরীক্ষায় তার পজেটিভ ফলাফল আসে। বর্তমানে তিনি করোনা এবং ডেঙ্গু উভয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এরকম অনেক কেস বা ঘটনা হয়তো দেশে ঘটে থাকতে পারে যা আমাদের অজানা তবে আশংকা করা যায়, দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে এরকম রোগীর সংখ্যা আরো বাড়বে। যদি আসন্ন মৌসুমে ডেঙ্গুর মহামারী হয় তাহলে করোনা ও ডেঙ্গু উভয় ভাইরাসের যুগপৎ সংক্রমণ আমাদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। তাই এখন থেকেই সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের এ বিষয়ে অধিকতর সর্তকতার পাশাপাশি এটা ভাইরাসদ্বয়ের সহ-সংক্রমণ (কো-ইনফেকশন) কিনা তা নির্ভুল পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। কারণ কোভিড-১৯-এর মহামারী অবস্থায় করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গুর সহ-সংক্রমণ সত্যিই দুশ্চিন্তার বিষয়।

একই দেহে করোনা ও ডেঙ্গু উভয় ভাইরাসের সংক্রমণ বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র আর্ন্তজাতিক মেডিকেল জার্নাল 'দ্য ল্যানসেট'-এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাপত্রটিতে বিজ্ঞানীরা সিঙ্গাপুরের এমন দু'জন (৫৭ বছর বয়সী একজন পুরুষ ও একজন মহিলা) রোগীর বর্ণনা করেছেন যাদের শরীরে ডেঙ্গু টেস্টে (র‍্যাপিড সেরোলজিকাল টেস্ট) পজেটিভ ফলাফল এসেছে এবং পরবর্তীতে যাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্তে দেখা গেছে, আক্রান্ত একজন রোগী তিন দিনের জ্বর ও কাশি নিয়ে প্রথমে হাসপাতালে ভর্তি হন। ডেঙ্গুর রেজাল্ট পজেটিভ হওয়ায় ডাক্তাররা রোগীকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়। কিন্ত চিকিৎসার পরও এই রোগীর জ্বর অব্যাহত থাকে এবং পাশাপাশি কাশি, শ্বাসকষ্ট ক্রমশ বাড়তে থাকে যা পরবর্তীতে কোভিড-১৯ পরীক্ষায় পজেটিভ ফলাফল পাওয়া যায়। আসলে উক্ত রোগীর শরীরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছিল না যদিও র‍্যাপিড সেরোলজিকাল টেস্টে তার ডেঙ্গু পজেটিভ হয়েছিল। কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর এরকম ফলাফলকে ফলস পজেটিভ বলা হয়েছে উক্ত গবেষণায় যা চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এভাবে একজন কোভিড-১৯ রোগীকে প্রথমে ডেঙ্গুরোগী বিবেচনা করে চিকিৎসা প্রদানকে একধরনের ব্যর্থতাই মনে করা হয়েছে উক্ত গবেষণাপত্রটিতে এবং যা জনসাধারণ, রোগী এবং জনস্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যদিও হাসপাতাল, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবার কাছে এই ধরনের ঘটনা অনেকটা নতুন। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ এর নতুন কিছু লক্ষণ আবিষ্কার করেছেন, যেখানে রোগীরা ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এবং লক্ষণ দেখে (বিশেষ কিছু লক্ষণ ছাড়া) কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গু রোগের পার্থক্য বুঝা যাচ্ছে না। তাছাড়া কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গু রোগের ক্লিনিকাল এবং ল্যাবরেটরি বৈশিষ্ট্যগুলি অনেকটা একইরকমের হওয়ায় এদের পার্থক্য করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

করোনা ও ডেঙ্গু দুই ধরনের ভাইরাস হলেও প্রাথমিক অবস্থায় এদের কিছু উপসর্গ বা লক্ষণ একই ধরনের। রোগ বাড়লে এদের লক্ষণের প্রার্থ্যক্য বুঝা যায়। করোনা খুবই সংক্রমিত একটি ভাইরাস যা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। মানুষের কফ, থুতু, নাকের সর্দি বা সংক্রমিত কোনো কিছু স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। আর ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত মশার মাধম্যেই ছড়ায়। কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গু উভয় রোগের লক্ষণ সাধারণত জ্বর দিয়ে শুরু হয়। তাছাড়া শরীর ব্যথা, বমিভাব, মুখে বিস্বাদ বা রুচি কমে যাওয়া, ক্লান্ত অনুভব ইত্যাদি উভয় রোগেরই সাধারণ লক্ষণ। কোভিড-১৯ এর নির্দিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে কাশি, গলা ব্যথা ইত্যাদি আর ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে গুরুতর মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা এবং দেহের ফুসকুড়ি ইত্যাদি। তবে ডেঙ্গুতে কাশির লক্ষণও এখন অস্বাভাবিক নয় কারণ প্রতিবছরই ডেঙ্গুর লক্ষণ কিছুটা বদলে যাচ্ছে। তাছাড়া ডেঙ্গুতে বমি এবং ডায়রিয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষসহ পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীদেরও লক্ষণ দেখে কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুর মধ্যে পার্থক্য করা জটিল হয়ে পড়েছে। সুতরাং কোভিড-১৯ বা ডেঙ্গুর চিকিৎসায় লক্ষণ নয় বরং সঠিক রোগ নির্ণয়পূর্বক (ডায়াগনোসিস) চিকিৎসাপ্রদানই বাঞ্ছনীয়।

আমাদের দেশে করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গুর সহ-সংক্রমণের বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক এবং দুশ্চিন্তার কারণও বটে। জনসাধারণ থেকে স্বাস্থ্যকর্মী সকলের জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি সর্তকবার্তা। এমনিতেই আমাদের হাসপাতালগুলো এখন করোনাভাইরাস রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে আর এর সাথে যদি ডেঙ্গুসমেত করোনাভাইরাস রোগী যোগ হয় তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। জনমনে বাড়বে আতঙ্ক। সুতরাং আমাদের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের এই ধরনের সংক্রমণের ব্যাপারে এখনই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই ধরনের রোগীর চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন হবে এবং রোগীরা কিভাবে তা মোকাবিলা করবে এজন্য সুর্নিদিষ্ট গাইডলাইন দেয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুর জন্য র‍্যাপিড, সংবেদনশীল এবং সঠিক ডায়গনস্টিক পরীক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক চিকিৎসার জন্য কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুর নির্ভুল ফলাফল হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

(তথ্য সূত্র: দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন দৈনিক ও রির্সাচ জার্নাল)