আমরা যারা প্রায়ই পাবলিক বাসে চড়ার ও মাঝে মধ্যে সিএনজি অটোরিকশায় চাপার দিনক্ষণ পাই, আমরা জানি কী দুদ্দাড় ওভারটেকিংয়ের রক্ত হিম করে দেয়া মাহেন্দ্রক্ষণ নিয়ে আসেন ড্রাইভারগণ সর্বক্ষণই! আরে, প্যাসেঞ্জার ডরায় নাকি! হুদা কামে ডরায়! আল্লায় কপালে যেমন মউত লেখছে, মরণ সেমনে আসবই! নাইলে, কেডায় মারে কারে! কপালে যুদি মরণ থাকে যাইতে হইবই!
এই উচ্চ মারফতি কথা প্রতিটা বেলায় শুনি সকল চালকের মুখে, শুনি আশেপাশের সকল জনার মুখে। শুনি, শুনি, কিন্তু ওই শোনাই সার! আমার পরাণ এতোই মোহনিদ্রানিমগ্ন যে, সে ওই মহাবাণী শুনতেও পায় না, মহাবাণী আত্মস্থ করা তো বহু দূর! উল্টো আমার জানার অংশটা বরং মনে করে চলছিলো–কী ওই মারফতি কথাসকল, কপালে যুদি মরণ থাকে এই অগাধ বিশ্বাসের ব্যাপারটা বুঝি এমনিই এক কথার কথা!
কিন্তু এই গত তিনচারদিনের দুই দুইখানা বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত দেখে শুনে, তার দিকে নজর রেখে, একটু বিশদ মনোযোগ দিয়ে ভাবনাচিন্তা করে ও খতিয়ে দেখে আমি এক মহা বোধোদয়গ্রস্ত হয়ে গেছি! ওহ্! মূঢ় আমি! মূঢ় মূঢ়! কী করছিলি এতোদিন! এই সমাজ সংসারে কোন গভীর দর্শন, কোন মহাতত্ত্ব চালু আছে, অনুশীলিত হয়ে আসছে, চালাচ্ছে সকলজনাকে। ওরে নিদ্রাগ্রস্ত মূঢ়, তুই তার কিছুই জানলি না এখনও! অজ্ঞানতার গ্লানি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রথম বৃত্তান্তটি আবার মনে করতে চাই।
ঘটনাটি ঘটেছে ১লা জুন রোজ মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রি আনুমানিক পৌনে এগারোটার দিকে। অকুস্থল রাজধানীর ১৮/বি মধ্য বেগুনবাড়ি। সংবাদে প্রকাশ, ওই হোল্ডিং নম্বরের পাঁচতলা বাড়িটি মাটির নিচের পিলার উপড়ে নিয়ে পড়ে গেছে। ওই পাঁচতলাটিকে খাড়া করা হয়েছিলো ঝিলের একেবারে কিনারা ঘেঁষে। খালি চার চারটা ক্রংক্রিট পিলার মাটির ওপর কোনোমতে বসানো হয়, তার ওপর বসানো হয় একের পর এক তলা। এক কাঠারও কম সেখানে জায়গা, সেখানে ওপরের দিকে উঠে না গিয়ে মালিকের উপায় কী! পাকাবাড়ি কি কেউ খালি নিজে নিজে হাওয়া খাওয়ার জন্য বানায়! বানায় দুইটা হক্কের পয়সা ঘরে আনার জন্য। যতো ঘর ততো ভাড়া, ততো ঘরে পয়সা আসা। এই সুবুদ্ধি ছিলো বলেই মালিক নিচের দিকের তলাগুলোতে রাখে দুটা করে ঘর, কিন্তু একদম উপরে উঠে করে ফেলে আট আটটা ঘর। তারপরে ছাদ। ছাদ কি ফেলে রাখার বস্তু নাকি! তাতেও কিছু করতে পারে সে-ই, যার বুদ্ধি আছে। শাস্ত্রে আছে বুদ্ধি যথা বল তথা। মালিক যে বুদ্ধিমান ও বলবান বোঝা যায় তার ছাদের উপরে করা কীর্তি দেখেই। ছাদের উপর সে করে দেয় দুখানা টিনশেড ঘর। ব্যস, ভাড়াকে ভাড়া আসতেই আছে, আসছেই। প্রশ্ন যদি ওঠে যে, চারতলায় আটখানা ঘর কেনো? নিচে যেখানে দুটো করে? ঢাকা শহরবাসী মালিকদের সকলেই এর উত্তর জানেন। উত্তর হচ্ছে, চারতলায় আলো হাওয়া বেশি খেলে বলে, ওই তলাতে ভাড়াটে পাওয়া যায় বেশি। তাই দু'টার জায়গায় সেখানে আটটা ঘর। তা, বাড়ির মালিক তার এক কাঠারও কম জায়গায় দুটো ঘর বানাক, নয় আটটা বানাক–অন্যের চোখ টাঁটায় কেনো তাতে! হিংসা হিংসা। সেই পাকা টংঘর যে সেদিন চার চারটা পিলার উপরে নিয়ে চিৎপাত হলো–সেটা কী কারণে?
"
দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা গ্যাসের চুলা বিনা কারণেই জ্বলতে থাকে বাংলার ঘরে ঘরে। কেউ চুলা নেভানোর গরজ বোধ করে না।… ধ্বংস করছি নদী, অপচয় করছি দ্বিধাহীনভাবে সুপেয় জল, নিংড়ে নিয়ে আসছি মাটির তলা থেকে পানি, খাদ্য মুড়িয়ে দিচ্ছি বিষে।… এইসব রোধ করার জন্য প্রতিষ্ঠান লাগবে খালি? সবটা সামলাতে পারবে, সবটাই দূর করতে পারবে শুধু প্রতিষ্ঠান?
"
দেশে বাস্তুবিদগণ আছেন। রাজউক আছে, দালানকোঠা বানানোর বিধি নিয়ম আছে, বিধি নিয়ম মান্য করাও আছে, অমান্য করাও আছে। বিধি হচ্ছে দালান যেখানেই বানাতে যাও, আগে মাটি পরীক্ষা করে নাও। মাটিকে পোক্তমতো পাইলিং করো। তারপর আসল লোক দিয়ে বাড়ির নকশা ডিজাইন করাও। তারপর দালানকোঠা বানাতে যাও। ওই পাঁচতলা পাকা টংঘর থুবড়ে পড়ার পর হইহাট্টা চিল্লাচিৎকার হল্লা থেকে ক্রমে জানা যায়, দালানটি ইমারত বিধি মোতাবেক নির্মিত হয় নি। তার অতি দুর্বল ভিত ও ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোই তাকে ধূলিশায়িত করেছে। তবে এই পাকা টংঘরের এমনই পোড়াকপাল যে সে পড়ার জন্য এক চিলতে ফাঁকা ঝিল ও জায়গাও পায়নি। সে যখন দুমদাম তলার পর তলা নিয়ে ওপরের দিকে চলে যাচ্ছিল তখন আশপাশ দিয়ে তাকে ঘিরে, ঝিলে খুঁটি গেঁড়ে গেঁড়েই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো তিন তলা তিন তলা সব টিনের টং। পাকা টংঘরকে পড়তে হয়েছে ওইসব টিনের টংঘরদের ওপর। রাত্রিবেলা কিনা, তাই টিনের টংঘরের প্রায় সকল লোক ঘরেই ছিলো, ছিলো ঘুমানোর উদ্যোগ আয়োজন নিয়ে। কেউ কেউ ছিলো ঘুমন্ত। পাকা টংঘর তাদের কাউকে জ্যান্ত থাকতে দেয়নি। ওই মানুষেরা মরে যাবার আগে বুঝে উঠতেও পারেনি যে, তাদের কপালে মরণ এইভাবে লেখা ছিলো।
এবার দ্বিতীয় বৃত্তান্তটিতে আসা যাক। ওটি ঘটেছে গেলো বৃহস্পতিবার সন্ধ্যারাতে, তারিখ ৩রা জুন। পুরোনো ঢাকার নিমতলীতে দুর্ধর্ষ রকম আগুন লেগে ছটি বাড়িই শুধু পোড়া আঙড়া হয়ে যায়নি, জ্যান্ত পুড়ে শেষ হয়ে গেছে পরিবারের পর পরিবার। লাশের পরে লাশের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে আমাদের শহর। যে আগে কোনোদিন এতো মৃত্যুকে একসঙ্গে বরণ করার অভিজ্ঞতাশূন্য ছিলো। সেও নির্ঘাত কেঁপে উঠেছে মৃত্যুর পরাক্রম দেখে। শোকের মাতমে শুধু মৃতদের স্বজনেরাই নেই, পুরো দেশ বেদনাস্তব্ধ। ওই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কোথায়, কীভাবে? প্রথমদিকে, সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়ে, আগুন ধরে যায় ওই দালানগুলোর নিচতলার গুদামে গুদামে রাখা কাগজ ও কেমিক্যাল-এ। তারপর হুড়মুড় আগুন উঠে যায় ওপরতলাগুলোর দিকে। পুড়িয়ে মারে প্রতিটি বহুতল ভবনের প্রায় সকলকে। কিন্তু দু'একটি সংবাদ সূত্র এবং দু'একজন প্রত্যক্ষদর্শী সন্ধান দেন অগ্নিকাণ্ডের অন্য কারণের। তারা জানান যে, আগুনটা প্রথমে যে বাড়িতে লাগে ওই বাড়িতে সেদিন ছিলো বিয়ের পানচিনি অনুষ্ঠান। নিচতলা থেকে পাঁচতলার ছাদ পর্যন্ত জায়গা জুড়ে চলছিলো আনন্দ-হুল্লোড়, খুশি, হইচই। কনে ছিলো বিউটি পার্লারে, নিচের একচিলতে জায়গায় বাবুর্চি চুলা বসিয়ে রান্না করে চলছিলো নানা পদ, তার চুলার কাছ ঘেঁষেই দাঁড় করানো ছিলো মোটর সাইকেল, চুলা থেকে একটু দূরেই অন্য বাড়ির একতলার গুদাম। সেটা বোঝাই কেমিক্যালে। অতি উত্তম যোগ। প্রথমে বিস্ফোরিত হয় মোটর সাইকেলটা, অগ্নিকাণ্ড গিয়ে ছোঁয় গুদামটাকে। অগ্নিকে মুহূর্তে লুফে নেয় কেমিক্যাল, গ্রাস করে আশপাশকে, চক্ষের পলকে।
আচ্ছা, মোটর সাইকেলটা ওইখানে, ওই জ্বলন্ত চুলার পাশে কেনো রেখেছিলেন চালক? আর জায়গা ছিলো না বলে? না, সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। চিপায় চাপায়, আরো দূরে ঢের জায়গা ছিলো। তাহলে ওই দাউ দাউ চুলার পাশেই কেনো! কেনো? কারণ, চালক এবং বাবুর্চি–দুজনই কঠিন রকম ধ্রুবসত্য বলে জেনে গেছিলো যে, রাখলে কী হয়! কিচ্ছু হয় না! গুদাম বানানেঅলারাও জেনে গেছিলো যে, বসবাসের মহল্লায় কেমিক্যাল গুদাম বানালেও কিছু হয় না। আর যদি নসীবে মুসিবিত থাকে, তা কে রোধ করবে! মুসিবত যে কোনো ছুতায়ই তো আসতে পারে, নাকি! ওই রকম মারফতি বোধ, ওই চরম বিবেচনাহীনতা অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে এই মহাপ্রলয়কে। ঘনিয়ে এনেছে অতো অতো মানুষের দগ্ধ হওয়া, বিভীষিকা ও মৃত্যুকে। কপালে যদি মরণ থাকে, তারে ঠেকাবে কে! সেই জন্যই সাবধানতার ধার ধারেনি কেউ; না চুলাঅলা না মোটর সাইকেলঅলা। দরকার নেই তো! কিসমতে যা আছে তা হবেই। বিবেচনা, ভালোমন্দ বোধ, সতর্কতা ও অন্যের কথা ভাবার কোনো দরকার নেই। কপালে যা আছে তা হবেই। হবেই হবে। তাই যেমনে খুশি সেমনে চলেন। যা আছে নসিবে, আপনাআপনি আসিবেই আসিবে। এসেছে সেটা নিমতলীতে। এসেছে বেগুনবাড়িতে, আসছে আমাদের সকলের দিকে, আসছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে।
আমাদের, এই বঙ্গবাসীগণের একটি অতি তীব্র প্রবণতা আছে, যাকে বুঝে ওঠা যায় না। কিন্তু আপৎকালে তার সন্ধান পাওয়া যায় খুব। সেটি হচ্ছে, কোনো একটা বিপর্যয় বা সঙ্কট সমস্যার সময় আমরা শুধু উদ্বেগ, চিন্তা বা যন্ত্রণায় ছটফট করি না, একটা কিছু বা কোনো একজনকে বা কোনো গোত্রকে আমাদের দরকার পড়ে অভিযুক্ত করার জন্য। খুব দরকার পড়ে একটা স্কেপ গোট-এর। যার ঘাড়ে আমাদের পাপতাপ, অপরাধ চাপিয়ে দিয়ে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি। শান্ত ও ঘুমন্ত করে নিতে পারি আমাদের বিবেককে। পাকা টংঘর উপড়ে পড়ার ঘটনার মুখোমুখি হয়ে আমরা অস্থির ক্রুব্ধ হয়ে খালি বকর বকরই করি নি, আসল দোষী যে কে এবং এই টং ভেঙে পড়ার মূলে যে দায়ী–তাকেও খুঁজে বার করেছি। আঙুল তুলে তুলে বলেছি, ওইটাই নষ্টের গোঁড়া, ফাঁকিবাজ! ওর জন্যই লোকেরা আইন লঙ্ঘনের ফাঁকফোঁকড় পেয়ে যাচ্ছে, আর বিধি লঙ্ঘন করছে। ওইটা-টা কে? কে আবার রাজউক! রাজউক ফাঁপড়ে পড়ে শেষে স্বীকার করে যে, সব দোষ, সব তার। এরপর থেকে সে আরো সতর্ক ও খরনজরঅলা হবেই হবে। ব্যস, সব ঠাণ্ডা।
আমি প্রতিষ্ঠান, আইন, বিধি ও প্রয়োগ অতো কিছু খুব তুমুলরকম বুঝি না। সে কারণেই বোধহয় মাথায় প্রশ্ন আসার বিরাম নেই। প্রশ্ন খালি জাগছেই! আচ্ছা, সবই খালি প্রতিষ্ঠান দেখে দেবে? জীবনের প্রতিটা কদম? ব্যক্তির, পরিবারের বোধবুদ্ধি বিবেচনা, কল্যাণ ও মঙ্গল ধারণা, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান, ভালোমন্দ বোধ–এইগুলি থাকবে না আর? অইগুলো থাকার দরকার তবে নেই আর? পাকা টংঘরের মালিক হিত ও অহিত বিবেচনা করার বোধশূন্য এক দ্বিপদ শুধু? তাই সে পোক্ত ভিত্তি ছাড়াই দাঁড় করিয়ে দেয় পাঁচতলা? নাকি অন্য আরেকটা বোধ ছিলো তার ভেতর! ওই যে, ওই বোধটা–আরে, কীসের পাইলিং! ওইসব আইন খালি টাকা খাওয়ার হাউকাউ, আর কিছু না! আর, নসিবে মরণ থাকলে পাইলিং থাকলেও মরণ আসবে, এমনে চার খাম্বার ওপরে দালান করলেও মরণ আসবে। তাহলে আর কীসের ভয়, কীসের পিছুটান, যমের ভাবনা! জীবন মৃত্যু যেখানে পায়ের ভৃত্য, সেখানে চিত্ত ভাবনা শূন্য তো হবেই হবে। পাকা টংঘর মালিক একা এক বিচ্ছিন্ন উদাহরণ মাত্র নয় কিন্তু! যারা ওই পাকাটার পাশে টিনের টংগুলো দাঁড় করিয়ে নিয়েছে তারা বিবেচনাটা রেখেছিলো কি যে ওই পাকাটা হুমড়ি খেলে টিনের গুলার কী হবে? কেউ কিছু বিবেচনায় রাখে নি। দুইটা পয়সা আসার বন্দোবস্তুটা করার কথা মাথায় আছে শুধু, আর কিছু নেই। শুধু এই এক্ষণ, আমার বুঝটুকু বুঝে নেয়ার টনটনে জ্ঞানটা আছে আমাদের সকলের। দয়া, বিবেচনা, মঙ্গলবোধ–সব, সব লুপ্ত। সব উধাও। সেই কারণেই দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা গ্যাসের চুলা বিনা কারণেই জ্বলতে থাকে বাংলার ঘরে ঘরে। কেউ চুলা নেভানোর গরজ বোধ করে না। তারপরে আসবে অন্য প্রজন্মের যে মানুষ এইখানে তারটুকুও যে আমরাই ধ্বংস করে যাচ্ছি তা একটা মুহূর্তের জন্যও বিবেচনায় আসে না। ধ্বংস করছি নদী, অপচয় করছি দ্বিধাহীনভাবে সুপেয় জল, নিংড়ে নিয়ে আসছি মাটির তলা থেকে পানি, খাদ্য মুড়িয়ে দিচ্ছি বিষে। বাহ্! এইসব রোধ করার জন্য প্রতিষ্ঠান লাগবে খালি? সবটা সামলাতে পারবে, সবটাই দূর করতে পারবে শুধু প্রতিষ্ঠান? প্রতিষ্ঠান কতোক্ষণ সামলাবে? যদি মানুষের শুভবোধ ও বিবেক ও দায়বোধ না জাগে?