পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে যা করণীয়

সাইফুল হোসেন
Published : 31 May 2020, 05:01 PM
Updated : 31 May 2020, 05:01 PM

দেশের পুঁজিবাজারের সাথে সম্পৃক্ত কয়েক লক্ষ বিনিয়োগকারী বর্তমান স্থবিরতার মধ্যে খুব চিন্তাযুক্ত হয়ে হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কবে শেষ হবে এই লকডাউন, কবে দেশের অর্থনীতি ফিরবে তার চিরচেনা রূপে, নাকি পূর্বের অবস্থায় কখনো ফিরবে না দেশ- এইসব প্রশ্ন আচ্ছন্ন করছে সবাইকে। কিন্তু উত্তর কারো জানা নেই, কারণ কোভিড-১৯ সারা পৃথিবীকে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে গেছে। 

আমাদের দেশের পুঁজিবাজার সেই অর্থে পরিপক্ক বাজার নয়, এই বাজারের গভীরতাও পৃথিবীর উন্নত দেশের মত নয়। এখানে সম্পৃক্ত অধিকাংশের মধ্যে শিক্ষা, বাজার সম্পর্কে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্বের যেমন অভাব আছে তেমনি বাজারে আছে সততা ও জবাবদিহিতার অভাব। আবার একটা শ্রেণি এখানে আছে যারা অন্য একটা শ্রেণিকে অন্যায় ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ঠকিয়ে নিজেরা লাভবান হবার চেষ্টায় সর্বদা সচেষ্ট। রাষ্ট্র জেনেও অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, শাস্তির প্রশ্ন আসলেও কোন অজ্ঞাত কারণে শাস্তি ও জবাবদিহিতা থমকে দাঁড়ায়, বাজার আস্থায় ফিরতে পারেনা। 

যদিও এই বাজারের নিবন্ধিত অধিকাংশ শেয়ার অবমূল্যায়িত তবুও বাজার থাকে নিম্নমুখী ধারায় বিনিয়োগকারীরা দিশা পায়না কোন দিকে যাবে, কোন পথে হাঁটবে, কিভাবে তাঁরা বেঁচে থাকবে। করোনার অভিঘাত মরার উপর খাঁড়ার ঘা'য়ের মত হাজির হয়েছে। এখন দশা এমন যে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি কিন্তু তবুও ছাড়া সম্ভব নয়, ছেড়ে যাবার জায়গা নেই।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে সরকার অনেকবার চেষ্টা করেছে বাজারকে টেনে তুলতে। কিন্তু সেই চেষ্টা বিশেষ কোন ফল দেয়নি। এই ১০ পয়েন্ট বাড়ে তো পরের দিন ১০০ পয়েন্ট কমেকমতে কমতে এমন অবস্থা যে যার বিনিয়োগ ২০ লাখ তার পুঁজি অল্পদিনেই কমে ৫ লাখে নেমেছে। যদিও বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেট বলেছেন যে- 'কোনওভাবে পুঁজি হারানো যাবেনা'- কিন্তু আমাদের বিনিয়োগকারীরা পুঁজিই শুধু হারান, কোনভাবেই এই হারানো রোধ করা যাচ্ছে না, এমনকি খুব ভাল মৌল ভিত্তির শেয়ার কিনেও পুঁজি থাকছে না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে যে লকডাউন চলছে তাতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন যারা শুধু শেয়ার বাজারের উপর নির্ভরশীল তারা। সাথে পুঁজি হারিয়ে পথে বসার জোগাড় হয়েছে কিছু বিনিয়োগকারীর যারা ব্রোকারেজ হাউজগুলো থেকে উচ্চ সুদে মার্জিন ঋণ নিয়েছেন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ বিপদে পড়েন মার্জিন ঋণ নিয়ে। মার্জিন ঋণ নিয়ে খুব অল্প বিনিয়োগকারী পয়সা বের করে নিতে পারেন। যখন বাজার পড়তে থাকে তখন ক্ষতির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে যারা মার্জিন ঋণ নিয়েছেন তাদেরএকদিকে শেয়ারের ভ্যালু কমে যায়, অন্যদিকে সুদ বাড়তে থাকে। বিনিয়োগকারী শেয়ার বেঁচতে পারেন না, একপর্যায়ে মূল্য এমন জায়গায় এসে পড়ে যে পুঁজি পুরোটাই হারিয়ে যায় এবং শেয়ার বাধ্যতামূলক বিক্রির কবলে পড়ে। 

বর্তমানে যারা মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছেন তারা খুব বেশি বিপদের মধ্যে পড়েছেনদুই মাস লকডাউনে মার্কেটে কোন ট্রেড হয়নি, কিন্তু মার্জিন ঋণের উপর সুদ তো আর বসে থাকেনি। বর্তমানে বাজারে ঋণাত্মক ইকুইটির পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত কয়েকমাসে এটা আরও বেড়েছে। তাছাড়া ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের দেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা যার আনুমানিক ৬০ ভাগ হচ্ছে ব্রোকারেজ হাউজগুলার। যেসব বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্বপ্রায় তারা এই আরোপিত সুদ পেমেন্ট করতে গিয়ে খুব বিপদে পড়ে যাবে। এখন মার্জিন ঋণের অনুপাত হচ্ছে  দশমিক ৫০ অর্থাৎ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ ১ লাখ টাকা বিও হিসাবে থাকলে তিনি ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিতে পারেন। লকডাউনের পূর্বে যারা মার্জিন ঋণ নিয়েছেন তাঁদের অনেকেকেই পুঁজিবাজার ছেড়ে বের হয়ে যেতে হবে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হবার কারণে। 

আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের গভীরতা কম। বড় বিনিয়োগকারীর যেমন অভাব আছে, তেমনি আছে ভাল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির। দেশে অনেক ভাল সরকারী, বেসরকারি ও বিদেশী কোম্পানি আছে কিন্তু তাদের অনেকেই শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হতে চায়না। সরকার চেষ্টা করেও আনতে পারছে না। বর্তমান অর্থমন্ত্রীও চেষ্টা করছেন, অনেক কোম্পানিকে মার্কেটে নিয়ে আসার কথা বলেছেন। কিন্তু এখনো সেটা বাস্তবায়ন হয়নি, কবে হবে সেটাও বলা যাচ্ছে না। কারণ, এই প্রক্রিয়া একটু জটিল ও সময়সাপেক্ষ। 

শেয়ার বাজারকে টিকিয়ে রাখার জন্য এখনি যা করণীয় 

১। বিএসইসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা অনেকদিন ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁদের সময়ে অনেক দুর্বল ভিত্তির কোম্পানি বাজারে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়ে।  বিনিয়োগকারীদের আজকের শেয়ার বাজারের প্রতি যে অনাস্থা তাঁর অনেক বড় কারণ উনাদের কাজকর্ম। বিদায়ী চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সময়ে পরিচালিত সমস্ত কার্যক্রমের একটা বিশদ তদন্ত হওয়া দরকার এবং তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া বেশি জরুরী। তাহলে নতুন কমিশন শুরু থেকেই তাঁদের কাজের ব্যাপারে সতর্ক হবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গাটা শক্ত হবে। 

২। এই মহা দুর্যোগে যদি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাঁচিয়ে রাখা না যায় তাহলে শেয়ার বাজার তার গতি ফিরে পাবে না। প্রথমত তাদের মার্জিন ঋণের সুদ মাফ করতে হবে। বিশেষত লকডাউনের সময়কসহ আগামী অক্টোবর পর্যন্ত এবং শুন্য সুদে বা ২ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাঁরা এবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া চলতি বছরের বিও একাউন্টের চার্জ মওকুফ করলে ভাল হয়। সাথে তাঁদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।    

৩। আমাদের দেশের বাজেট প্রণয়নে বারবার কালো টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকে কিন্তু বিনিয়োগ নামমাত্র হয়। মহামারী করোনাভাইরাসজনিত ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য নূন্যতম আগামী পাঁচ বছরের জন্য আসন্ন জাতীয় বাজেটে নিঃস্বার্থভাবে কালো টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করা জরুরী৷

৪. নূন্যতম ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সকল প্রকার ডিভিডেন্ড আয়ের উপর সকল ধরনের ভ্যাট, ট্যাক্স মওকুফের ব্যবস্থা করা দরকারতাছাড়া দ্রুত বাইব্যাক কোম্পানি আইন পাশ ও বাস্তবায়ন এবং ফিনাপ্টিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট দ্রুত বাস্তবায়ন করলে শেয়ারমার্কেট গতিশীলতা পাবে। কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালককে নূন্যতম ২% শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, তাতে জবাবদিহিতা বাড়বে৷ 

৫। আসন্ন বাজেটে পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়ানোর জন্য সরকারিভাবে শেয়ার ক্রয়ের জন্য ন্যূনতম ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্রদান পুঁজিবাজার উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। কারণ পুঁজিবাজারে সরকারিভাবে শেয়ার ক্রয় করলে, তখন সর্বস্তরের বেসরকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান,বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরো অধিক আস্থাশীল হয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে যা বাজারকে গতিশীল করবে বলে আশা করা যায়। 

ইতোমধ্যে সরকার ঘোষিত প্রত্যেক ব্যাংককে পুঁজিবাজারে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ সীমা বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ৪০০ কোটি টাকা করা গেলে বাজারে তারল্য বাড়বে। তবে সুফল পেতে হলে প্রত্যেক ব্যাংককে এই টাকা বিনিয়োগ দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে হবে। 

৭। পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য ভালো কর্পোরেট, দেশীয় ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে নিবন্ধিত করতে হবে। পুঁজিবাজারকে পুঁজি সংগ্রহের মূল জায়গাতে পরিণত করতে হবে; তাহলে ব্যাংকের উপর চাপ কমে যাবে এবং ঋণ খেলাপি হবার সম্ভাবনাও কম থাকবে। এই মার্কেট শক্তিশালী হলে মেগা প্রজেক্টগুলোর জন্য পুঁজিবাজার হবে পুঁজি সংগ্রহের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা। 

৮। খুব হিসেব করে ভাল কোম্পনির আইপিও আনতে হবে। দুর্বল ভিত সম্পন্ন কোম্পানি নিবন্ধিত যেন না হয় সেজন্য সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজটি করতে হবে। আর বিনিয়োগকারীরা যখন নতুন কোন কোম্পানির আইপিও তে আবেদন করবেন তখন দেখে শুনে করবেন। আইপিও মানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ার ব্যাপার নয়- এটি বুঝতে হবে। 

পুঁজিবাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই আশা করতে চায় যে করোনা থেকে একদিন এই দেশ মুক্তও হবে, এই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এবং একদিন বিশ্বমানের বাজার হবে এটি। 

পুঁজি সংগ্রহের বড় জায়গা হবে আমাদের পুঁজিবাজার।