আগামী বাজেট, তারপরের বাজেট ও বাজেটের আচিলিস হিল: সম্পদ আহরণ ও বণ্টনে অগ্রাধিকার এবং মানব-প্রেমের অন্বেষায়

মোহাম্মদ তারেক
Published : 29 May 2020, 04:34 PM
Updated : 29 May 2020, 04:34 PM

কেউ বলে হারিকিরি। কেউ বলে সাতসুগাই। আমি বলি, সুকি সুকি, ধোকিধোকি, ভালবাসি ভালবাসি।  'সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার পরে নাই'। বাংলাদেশের উন্নয়ন এ দেশের ১৮ কোটি মানুষের উদ্যোম ও উদ্যোগের ফল। মুক্তিযুদ্ধে তারা জিতেছে। এ যুদ্ধেও তারা জিতবে। তাদের অদম্য কর্মোদ্যম ও অফুরাণ প্রাণশক্তির জোরে। আমরা যে যেখানে আছি, আমাদের ন্যূনতম দায়িত্ব ও কর্তব্যটুকু যদি করে যাই। 

রাজস্ব নীতি যে কোনো দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম হাতিয়ার। এই নীতির বাস্তবায়ন হয় জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে। তাই, বাজেট শুধু আয়ব্যয়ের হিসাব নয়। বাজেট অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দলিল। এমন কি বাজেট সামষ্টিক সুব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিতা ও  স্বচ্ছতার দলিল। দলিল স্থিতিশীলতার, উন্নয়নের।

এই করোনাকালে আমরা শুধু উন্নয়নের বাজেট খুঁজছি না। আমরা দেখতে চাচ্ছি স্বাস্থ্য-বান্ধব বাজেট। মানব-বান্ধব। পরিবেশ-বান্ধব, দরিদ্র-বান্ধব বাজেট। সে লক্ষ্যে প্রধান অন্তরায় কোথায়?

বাজেট কাজ করে প্রধানত পাঁচটি পরষ্পর সম্পর্কিত নীতি-সাধনীর (policy tools) উপর– করনীতি, ব্যয়নীতি, বাজেট ঘাটতি, ঘাটতি অর্থায়ন ও ঋণ-জিডিপি অনুপাত। এই পাঁচটি নীতি-সাধনীর মধ্যে দুর্বলতম সাধনীটি হচ্ছে কর নীতি। এর পরিচায়ক আমাদের রাজস্ব-জিডিপি ও কর-জিডিপি অনুপাত। বাংলাদেশে কর-জিডিপি রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ। একমাত্র আফ্রিকার কয়েকটি দেশ বাদ দিলে আমাদের এই অনুপাতটি সর্বনিম্ন।

উপরের সারণিটির দিকে তাকালেই দেখতে পাব– আমাদের রাজস্ব আয় যেখানে জিডিপির ৯.৬ শতাংশ, সেখানে ভিয়েতনামে ২৭.৩ শতাংশ, ভারতে ১৯.৯ শতাংশ। এমন কি পাকিস্তানে ১৫.২ শতাংশ। এত কম রাজস্ব আয় নিয়ে তো আর ব্যয় বাড়ানো যাবে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে– আমাদের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত কি বাড়ানো সম্ভব? আমি মনে করি, অবশ্যই বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা ও প্রকৃত রাজস্ব আয়ের পার্থক্য প্রায় জিডিপির  ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এবং এই সম্ভাবনা কর হার বা এর ব্যাপ্তি বাড়িয়ে অর্জন করা সম্ভব হবে না। এ জন্যে করনীতি ও কর প্রশাসনের সংস্কার জরুরী। একান্ত জরুরী।

অর্থ বিভাগের বিভিন্ন প্রকাশনা ব্যবহার করে সারণি ২ ও সারণি ৩ প্রস্তুত করেছি। সারণি ২ থেকে দেখা যায়- 

সারণি ২: গত তিন দশকে বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের পরিবর্তন

(১) গত তিন দশকে রাজস্ব আয় বেড়েছে মাত্র জিডিপির ২ শতাংশ, অথচ এ সময়ে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ১৩,৭৬৮.৫ টাকা থেকে ১,২২,১৫২, প্রায় নয় গুণ, 

(২) এনবিআর-বহির্ভূত কর রাজস্ব (স্ট্যাম্প বিক্রয়, মটরযান, লিকর ও ভূমি কর) কমেছে,

(৩) একইভাবে করবহির্ভূত আয়ও (বাংলাদেশ ব্যাংক, বিটিসিআরের আয়, অন্যান্য সকল ধরনের ফিস, লেভিস, জরিমানা ইত্যাদি) জিডিপির শতাংশ হিসেবে কমেছে। 

সারণি ৩ থেকে দেখা যায়- গত পাঁচ দশকে আমাদের করকাঠামোর বিবর্তন ঘটেছে। কর-আয়ের বাণিজ্য নির্ভরশীলতা কমছে, ইনকাম ও ভ্যাট থেকে ক্রমান্বয়ে অধিক রাজস্ব আয় আসছে। এটা ইতিবাচক বিবর্তন। আমাদের ভবিষ্যত  কর আয় আহরণের মূলভিত্তি হতে হবে– আয়কর ও ভ্যাট। 

সারণি ৩: গত পাঁচবছরে বাংলাদেশের রাজস্ব অবকাঠামোর বিবর্তন

এখন কোথায় কোথায় সংস্কার জরুরী-

১. সকল ধরনের করনীতি প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন পৃথক হতে হবে, এতে করদাতাদের অযথা হয়রানি বন্ধ হবে, কর ফাঁকিও রোধ হবে, 

২. কর মূল্যায়ন, কর আদায় ও নিরীক্ষা আলাদা আলাদা ব্যক্তি কর্তৃক সম্পন্ন করতে হবে, 

৩. বর্তমানে এনবিআর আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস – এই তিনটি ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তি কৃত্রিম। আমদানি বা উৎপাদনের শেষ পর্যায়ের লাভ থেকে আসে আয়কর। কাজেই, এই কৃত্রিম বিভাজন তুলে দিলে, একজন এনবিআর কর্মকর্তা সম্পূর্ণভাবে সেবা ও পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবে। 

৪. শুধু কর প্রদান নয়, কর প্রদান প্রক্রিয়াকরণ এবং করপ্রদান প্রক্রিয়ান্তে করদাতার সার্টিফিকেট প্রদানও অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে, তা হলেই মাত্র কর-আদায়কারি ও করদাতার মধ্যেকার অশুভ আঁতাত রোধ করা সম্ভব হবে। 

৫. করমেলা বছরে তিনবার করা উচিত, ১ম মেলায় যিনি কর দিচ্ছেন। পরবর্তী মেলায় তাকে কর প্রদানের সার্টিফিকেট প্রদান করা যায়।

৬. এনবিআরের চেয়ারম্যান নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও নেতৃত্বের গুণাবলীর ভিত্তিতে, এজন্যে এবং অন্যান্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্যে আনেক দেশের মত আইন প্রণয়ন করা উচিত। করনীতি ব্যক্তিখাত বান্ধব হবে, ব্যক্তিখাত দ্বারা পরিচালিত নয়।  

এখন দেখি সামনের বছরগুলিতে বাজেটের সম্পদ বরাদ্দ কেমন হওয়া উচিত করোনাভাইরাস উত্তর বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা, জনকল্যাণ ও মানব-বান্ধব দেখার অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে। 

সারণি ৪: বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকে বাজেট অগ্রাধিকারের বিবর্তন

সারণি ৪-এ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের (সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী) অগ্রাধিকারের বিবর্তন দেখানো হয়েছে। আর সারণি ৫-এ প্রধান তিনটি খাতের ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের একটা তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। এই দুটি সারণি থেকে প্রতীয়মান

 ১. সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ সমাজকল্যাণমুখী ও উন্নয়ন্নমুখী হয়েছে, তবে, স্বাস্থ্য খাত কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ পায়নি,

সারণি ৫: ২০১৮ অর্থবছরে চারটি দেশে প্রধান তিনটি খাতে খরচ

২. স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত বরাদ্দ মোট ব্যয়ের ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। এবং সেটা জনসেবা খাতের বরাদ্দ কমিয়ে করা সম্ভব, করা একান্ত জরুরি। তবে, স্বাস্থ্য খাতে সম্পদ সুষ্ঠূ ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

৩. সেটা জিডিপির কত শতাংশ হবে, সেটা নির্ভর করবে – রাজস্ব আয় কত বাড়বে এবং বাজেটের আকার জিডিপির শতাংশ হিসেবে কতটা বড় হবে তার উপর।

৪. বৃহত্তর কৃষি খাতে (কৃষি, পল্লী-উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা) ও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ যথাযথ আছে বলে মনে হয়।

অতএব, আগামী বাজেট ও পরবর্তী বাজেটসমূহের মূল অগ্রাধিকার হওয়া উচিত- রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা। এটা করার জন্য দরকার শক্তিশালী পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা প্রবর্তন, ফলাফল মূল্যায়ন ও ফলাবর্ত ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে। তৃতীয় অগ্রাধিকার হতে হবে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানো এবং যথাযথ ব্যবহার।

করোনাকাল আমাদের শিখিয়েছে– উন্নয়নের প্যারাডাইম (paradigm) বদলে গেছে। উন্নয়নের কেন্দ্রে মানব কল্যাণ, মানুষের ক্ষুধা, তার পরিবেশ, তার শিক্ষা ও তার স্বাস্থ্য। তারপর, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়। আগামি বছর না হলেও, পরবর্তী বাজেটগুলোতে তার প্রতিফলন হতে হবে।