ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ: নেই জবাবদিহিতা, নেই সমন্বয়

মানোয়ার হোসেন
Published : 27 May 2020, 12:54 PM
Updated : 27 May 2020, 12:54 PM

করোনাভাইরাসের এই সময়ে যেকোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই চোখে পড়বে এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট। নানা শঙ্কা ভয় ভীতির কথা যেমন আছে, তেমনি আছে আশার কথাও।

অনেকেই করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে অসহায়দের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। নানাভাবে খাবার বা আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছেন। এই সহযোগিতা দেয়ার ছবি কেউ কেউ বিভিন্ন পোস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ নিজ উদ্যোগে সহযোগিতা দিলেও পরিচয় লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করেন। এই দু'পক্ষকেই আন্তরিক ধন্যবাদ।

শিরোনাম দেখে প্রথম দুই প্যারা পড়ার পর আপনার মনে হতে পারে সবই যখন ঠিক আছে তাহলে কেন এমন শিরোনাম। আসছি সে বিষয়ে। বেসরকারি ত্রাণ নিয়ে আমাদের দেশে মোটা দাগে তিন ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এক, ত্রাণ সংগ্রহ করার পর সঠিকভাবে গ্রহীতাদের কাছে পৌঁছানো হয়। দুই, ত্রাণ সংগ্রহের পর কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেলেও তা বিতরণ করা হয় না। যেমন বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করা হলো কিন্তু তা পৌঁছানো পর্যন্ত দেখা গেলো বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তিন, ত্রাণ হিসেবে যা সংগ্রহ করা হচ্ছে তার বড় একটা অংশ যিনি বা যারা সংগ্রহ করেছেন তারা আত্মসাৎ করেন।

আমার মূল আলোচনার বিষয় দুই ও তিন নম্বর নিয়ে। বেসরকারিভাবে যারা ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণ করেন তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে নেই কোনো আইন। এখানে বিবেক বা নৈতিকতাই সবচেয়ে বড় আইন। তবে যার কাছ থেকে ত্রাণ দেয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হলো তিনি যদি কখনো হিসেব চান সেক্ষেত্রে অডিট করার বিধান আছে।

আমি আমার জানা তিনটি ঘটনা ছোট করে উল্লেখ করতে চাই। ২০০৯ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার পর খুলনার কয়রা উপজেলায় আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ত্রাণ হিসেবে শিক্ষা উপকরণ নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো আমরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করি। তখন কয়রার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন আরিফ পাশা। যদি এই লেখা তার চোখে পড়ে হয়তো তিনি মনে করতে পারবেন। তখন তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ দেয়ার কারণে তিনি একটি ভিন্ন রকমের সমস্যায় পড়েছেন। সবার কাছে তখন ত্রাণের এ পরিমাণ খাবার মজুদ হয়েছে যে এখন কাজ করার কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তাঘাট পরিষ্কার থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থাপনা পুনর্নির্মাণে কোনো মজুর পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোনো কোনো এলাকায় কেউই ত্রাণ পায়নি। এ ধরনের সমন্বয়হীনতা তাকে বিড়ম্বনায় ফেলেছে।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষা জীবনের শুরুর দিকে কিছুদিন একটি সংগঠনে নিয়মিত যেতাম। বেশ কিছুদিন সেখানে সময়ও দিয়েছি। সেখানে কাজ করতে করতে জানতে পারলাম এই সংগঠনটি তিন বছর আগে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য একটি ফিল্ম শো করেছিল। কিন্তু সেই টাকাটা এখনো তাদের কাছে রয়ে গেছে।

আর তিন নম্বর বিষয়টি যদিও স্পর্শকাতর তারপরও বলতে হয়, আমাদের দেশে মোবাইল ব্যাংকিংকে কেন্দ্র করে যেহারে প্রতারক চক্র রয়েছে সেক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতারণার কথা আমরা কোনোভাবেই উড়িয়ে দিতে পারি না। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের সময় এ ধরনের ঘটনা আমরা অনেক দেখেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের সাহায্য চাইলেই কি ধরনের সাড়া পাওয়া যায় তার একটা উদাহরণ দেই। রোহিঙ্গা সংকটের সময় বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টি ফোরের প্রতিবেদক রামিম হাসান (বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত) পরিবার হারানো একটি রোহিঙ্গা শিশুকে নিয়ে রিপোর্ট করেন। এরপর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঐ প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঐ শিশুকে বিভিন্ন সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেই অঙ্ক প্রায় অর্ধ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এত বড় অঙ্কের টাকা ঐ প্রতিবেদক তার মাধ্যমে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এটি একটি ভালো উদাহরণ। কিন্তু কিছু খারাপ খবরও আপনারা নিশ্চয় জানেন। ঐসময় অনেক ইউটিউব চ্যানেল গড়ে উঠেছিল শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ দেয়ার উপর নির্ভর করে। যার মাধ্যমে দুয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারকে সহায়তা করে ইউটিউবে ভিডিও আপলোড দিয়ে অর্থ সহায়তা চাওয়া হতো। পরে প্রশাসন এই অপতৎপরতা বন্ধ করতে সক্ষম হয়।

যারা সঠিকভাবে ত্রাণ বিতরণ করছেন, তারা অবশ্যই একটি মহৎ কাজ করছেন এ নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই, থাকার কথাও না। কিন্তু কিছু কিছু বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরুতে কিছুটা হিমশিম খেতে হয়। এই সময়টা কাজে লাগায় সুযোগ সন্ধানীরা। এখন করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে তা যে অনেকেই করছে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? তার ওপর এখন অনেকেই বলছে, খাদ্য সহায়তা দিয়ে এই দুর্যোগে বিপন্নদের উদ্ধার করা যাবে না, দরকার নগদ সহায়তা।

এবার আসি সমন্বয়হীনতার দিকে। একটু আগেই কয়রার উদাহরণ দিয়ে আসলাম। এমন ঘটনা এখনো ঘটছে। যেখানে ত্রাণ যাচ্ছে সেখানে অনেক। আবার অনেক জায়গায় তা পৌঁছায়নি। সরকারি ত্রাণ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু বেসরকারি ত্রাণের এ ধরনের সুযোগ নেই। একটি সিস্টেম দাঁড়াতে সময় লাগে কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় এমন ঘটনা। এক্ষেত্রে গবেষকরা সবসময় একটি ডাটাবেজ করার কথা বলে আসছেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক যদিও এরই মধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। আশা করি সরকারের পক্ষ থেকেও শিগগিরই এমন উদ্যোগ চোখে পড়বে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে হয়তো প্রতারক ধরতে আইনও হবে। একই সঙ্গে সচেতন হবেন সাধারণ মানুষও।