প্রসঙ্গ কোভিড-১৯: ভিআইপিরাও নিরাপদ নন

কাজী আহমদ পারভেজ
Published : 27 May 2020, 02:30 PM
Updated : 27 May 2020, 02:30 PM

লকডাউনের মধ্যে ধীরে ধীরে হলেও করোনাভাইরাস কিন্তু আমাদের উপর জাঁকিয়ে বসছে। ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী পাবার পর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক কিছুই আমরা ভালোভাবে করেছি। আবার অনেক কিছু তেমন ভালোভাবে করতে পারিনি। যত খারাপভাবেই করি না কেন, এখন পর্যন্ত আমাদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা, সেটা আমাদের কাছাকাছি অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যার দেশগুলো থেকে এখনো খুব একটা খারাপ বলা যাবে না। তারপরেও, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি, কবে নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। আর তাই ভাবনা চিন্তা করতেই হচ্ছে। এরকম একটা ভাবনার জায়গা হলো, সাম্প্রতিক আলোচিত বিষয়- ভিআইপিদের মৃত্যু!

মনে রাখতে হবে, ভিআইপিদের আক্রান্ত হবার সংবাদ কিন্তু এতদিন সেভাবে জানা ছিল না। যেকোনো কারণেই হোক, তা মূলধারায় উঠেও আসেনি। তাই তাদের মৃত্যু সংবাদগুলো একধরনের বিস্ময় নিয়ে উঠে আসছে আমাদের কানে। এতদিন অন্যান্য আক্রান্ত হবার সংবাদগুলো বরাবরই এক একটা নম্বর হিসাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং সেগুলার তুলনায় মৃত্যুহার এতটাই কম ছিল যে, অনেকেই সেগুলো শুনে "এ আর এমন কী? এ থেকে বেশি মানুষ তো রোজ অপঘাতেও মারা যায়…"- জাতীয় মন্তব্য করতে বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে ছাড়ছিল না। কিন্তু ভিআইপিদের মৃত্যু সংবাদগুলো আসা শুরুর পর আর তা করা যাচ্ছে না।

কারণটাও বোধগাম্য। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার আমজনতা হয় প্রায়ই, কিন্তু ভিআইপিরা হন কদাচিৎ। পাশাপাশি আরেকটা আশঙ্কাও ভাবাচ্ছে; তারা এত নিরাপত্তায় থেকেও এভাবে আক্রান্ত হলে, অন্যদের কী অবস্থা হতে পারে?

এত অনিশ্চিত যখন পরিস্থিতি, এটা বুঝতে একটু অনুসন্ধান করাই দরকার যে, কী এমন ভিন্নতা ভিআইপিদের মধ্যে যা তাদেরকে অন্যদের চেয়ে বেশি ঝুকিপূর্ণ করে ফেলছে? অন্যদেরও তা থেকে কোনও শিক্ষা নেবার আছে কিনা? একটা ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত যে, তাদের আক্রান্ত হবার খবর না জানলেও সেটা যে উচ্চ হারেই ঘটেছিল, তা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু সে কথা তো বলে বেড়াবার মতো কিছু না, তাই আমরা জানতাম না। আক্রান্ত হবার ব্যাপারটা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত হলেও মৃত্যু কিন্তু তা না। এটা তাই জানাজানি হয়েই যায়। কারণ এটা জানতে বা জানাতেও হয়। এখন আমরা তাই সেটা জেনে যাচ্ছি। জেনে আতঙ্কিত হচ্ছি। অসহায়ও বোধ করছি।

আর তা এজন্য যে, অনেক রকমের নিরাপত্তায় থাকার পরেও তারা এরকম ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছেন কিভাবে? তারাই যদি এই হারে আক্রান্ত হন, মারা যান, আমাদের অবস্থা কী হতে যাচ্ছে?

আমার ধারণা, এই যে আক্রান্ত ভিআইপিরা, এদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সহায়ক কর্মচারী (সাপোর্ট স্টাফ) দ্বারা পরিচালিত ও পরিবেষ্টিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সমস্যা এখানেই, তারা এমন সব অবস্থানে আছেন যে, ঐসব সাপোর্ট স্টাফ ছাড়া, তাদের পক্ষে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড চালানো কঠিন। হতে পারে, তারা কিছু পূর্ণকালীন সাপোর্ট স্টাফসহ-ই কোয়ারেন্টিনে আছেন, কিন্তু সব সাপোর্ট স্টাফ পূর্ণকালীনভাবে পাওয়া কঠিন।

পাশাপাশি একটা মিথ্যা ভরসাস্থল তৈরি হয়েছে স্যানিটাজার, মাস্ক, গ্লাভস, প্রোটেকটিভ বডিস্যুট নিয়ে। মিথ্যা বলছি এজন্য যে এগুলার "সঠিক ব্যবহার" ও "নির্দিষ্ট সময়" পর্যন্ত নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে আমরা সচেতন না, ঠিকমতো জানিও না। দেখা যাবে, ভুল ভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যবহার করার জন্য এগুলো প্রোটেকশন দেবার বদলে হয়তো ঝুঁকি আরো বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি, এগুলার ব্যবহার যতই হোক না কেন, এগুলা আসলে ফুলপ্রুফ কোনো প্রোটেকশন না।

আমার ধারণা, ভিআইপিরা সাপোর্ট স্টাফদেরকে পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস, ইত্যাদি দিয়েই সার্ভিস নিতেন। কিন্তু তারপরেও সেগুলা ব্যবহারের কিছু একটা সমস্যা হয়ে কোনো না কোনো ভাবে তা ফেইল করেছে। আর এটা আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ফুল প্রুফ প্রোটেকশন দিতে পারে, এরকম কোনো প্রোটেকটিভ গিয়ার আসলেই নেই। করোনাভাইরাসের বিপক্ষে এক্সপোজার না হওয়া পর্যন্ত একমাত্র ফুলপ্রুফ সমাধান যেটা আছে, তা হলো অন্যদের থেকে দূরে থাকা। তবে হ্যাঁ, একান্তই যদি কোনো এক্সপোজার হয়ে যায়, তখন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা।

শুধু ভিআইপিরাই নন, সবারই এখন মনোযোগ দেয়া দরকার, কিভাবে সাপোর্ট স্টাফ ছাড়া আরো কিছুদিন টিকে থাকা যায়, সেদিকে। আর সেজন্য আশা করছি, ভিআইপিদের এই নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হবার ব্যাপারটি নিয়ে তারা আরও সতর্ক হবেন। শুধু তারা না, অন্যরাও এই ব্যাপারগুলো আরও যত্নের সাথে ভেবে দেখবেন। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের কথা আলাদা, তাদের জন্য এক্সপোজড হবার বিকল্প নাই। আবার তারা প্রোটেকটিভ গিয়ারের ব্যবহার ও হাইজিন ইস্যুগুলা জানেনও। বাদবাকি সবারই উচিৎ হবে মূলত কন্টাক্ট এড়ানো ও হাত ধোয়ায় মনযোগী হওয়া। এবং এজন্য সব ধরনের সাপোর্ট স্টাফের ব্যবহার থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা।

কন্টাক্টে থেকে যতই প্রোটেকটিভ গিয়ার ব্যবহার করা হোক না কেন তার ভুল ব্যবহার শুধু ভিআইপিদের নয়, সবার আক্রান্ত হবার ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়াবার জন্য ভূমিকা রাখবে। এটা আমরা যত দ্রুত বুঝব, ততই মঙ্গল!