মানুষ মারা করোনাভাইরাসে মানুষ বাঁচবার বার্তা এলো কি?

সেলিম রেজা নূর
Published : 27 May 2020, 11:39 AM
Updated : 27 May 2020, 11:39 AM

স্বাধীন মানুষ আর কত বন্দীত্ব মেনে নিতে পারে এই জীবনে! ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে কাঁটানো জীবনে ছন্দ ও সুর সবই কেমন যেন বেসুরো হয়ে যায়। জীবন ও জীবিকা যেখানে প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ সেখানে মুক্তির আস্বাদ পাবার জন্য মানুষ 'জেনে-শুনে বিষ পান' করবার মতো ঘরের বাইরে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে আজ! আমার ছোট ভাই জাহীদের স্ত্রী শুক্তি ও পুত্র সৌনক মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্কে এসে আটকা পড়ে গেল! ওদের দেশে ফিরে যাবার কথা ছিল মার্চের ২১ তারিখে, আর ঠিক তার আগের দিন ২০ মার্চ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সকল দেশের সাথে চলতে থাকা আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলি অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করে দিল – ফলে ওদের আর দেশে জাহীদের কাছে ফিরে যাওয়া হলো না। ওরা আমার বাসাতেই অনিচ্ছায় আটকা পড়ে আছে! ওর কন্যা সনোকা আমার কাছেই থাকে। এখন এই অভিনব লকডাউন পরিস্থিতিতে কেউই এই বন্দীত্ব কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না – দম বন্ধ অবস্থা ওদের! ফলে সতর্কতার সাথে ওদের দুই-তিনবার বাইরে থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্ত বায়ু সেবনের অনুমতি দিয়েছি। আমার কন্যাদ্বয় প্রবন্তী ও শ্রেয়ন্তী পাগলপারা হয়ে উঠলেও আমি তাদের এখনও বাইরে যেতে দেইনি কারণ এ রোগের অন্ধি-সন্ধি নিয়ে ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানীদের মধ্যে মনে হয় এখনো অনেক অজ্ঞতা রয়ে গেছে! ফলে একমাস আগে আমাদের যেসব কথা বলা হয়েছিল এ রোগ হবার এবং ছড়াবার ঝুঁকির কারণগুলি সেসবের অনেক কিছুই আজ আর টিকছে না! ফলে গতকালকের 'সত্য' আজ আর 'সত্য' থাকছে না! এ এক অদ্ভুত গোঁলক-ধাঁধাঁয় পড়ে গেছে মানব জাতি। সবাই বড় অসহায় বোধ করছে। জীবন না জীবিকা বাঁচাতে হবে এই নিয়ে রাজনীতিক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। এখানে-ওখানে, দেশে দেশে রাজনীতিকরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জীবনের উপর জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে 'সব কুছ্‌ ঠিক হ্যায়' বলে ব্যাবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক অবস্থাকালীন সময়ের মতো সবকিছু খুলে দিয়ে যেন মৃত্যুফাঁদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে! আবার বিজ্ঞান বলছে 'বাবা! আর ক'টা দিন সবুর করো, রসুন বুনেছি' – মানে এই ভ্যাক্সিন এলো বলে! তবে সে দিল্লী বহুত দুরস্ত! এখনো বছর খানেকের মামলা বলেই মনে হচ্ছে। ফলে মানুষ, বিজ্ঞানী, রাজনীতিক সকলেই যেন দিশেহারা আজ। এখন যে যার মতো ব্যাখ্যা করে পরিস্থিতি সামাল দেবার সুযোগ নিচ্ছে কিন্তু মানুষ বাঁচাবার উদ্যোগ-আয়োজনের আলোকরশ্মি তো দেখা যাচ্ছে না এখনো!

এরকম একটা বিশ্বময় সঙ্কটকালীন সময়ে প্রয়োজন ছিল সকল জাতির সমন্বয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়ে যাবার! কিন্তু আমরা এক গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড তৈরি করে এমনই নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের জন্ম দিলাম যে এখন কেউ আর অন্যের দায় নিজের কাঁধে নিতে রাজি নয়! সেই আশির দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান সেই যে রিগ্যানোমিক্সের বিষবাষ্প মার্কিন রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়ে দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন আর তার পোঁ ধরলেন ইংল্যান্ডে মার্গারেট থ্যাচার, তার এক ধ্বংসাত্মক রুপের গুঁতায় মানুষ যেন আজ দিশেহারা! এই মার্কিন মুল্লুকে আবার ফিরে আসা এই রিপাবলিকান দুষ্ট প্রশাসনের হাতে পড়ে সেই ব্যবস্থা ফুলে-ফলে বিকশিত হয়ে আজ যেন মুখ ব্যাদান করে সাধারণ মানুষের প্রতি ভ্যাংচী কাঁটছে। মানুষের লোভ কত সর্বনাশা হতে পারে – মানুষের জীবন ও জীবিকার চাইতে আর্থিক লাভালাভ কত মুখ্য হয়ে শ্রমিককে পিষ্ট করে মালিকের সর্বৈব উত্থান নিশ্চিত করতে এই মানুষেরই সৃষ্ট শৃংখলিত ব্যবস্থা তো নির্দয় হতে পারে তারই বহিঃপ্রকাশ আজকের এই বিদ্যমান অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে এই রিপাবলিকান পার্টিই বহু উদ্যোগ-আয়োজন করেই বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘকে নির্বীর্য করেছে আজ বহুদিন কারণ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় না বলে যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্ব সংস্থাকে দুর্বল ও অকার্যকর করতে চাঁদা দেওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে! এবার তার সুরে তবলা সঙ্গত করেনি বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা "হু"কেও এক হাত নেবার হুমকি ছুঁড়ে দিয়েছে 'আর চাঁদা দেব না" বলে! এটাই বুঝি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের অন্তঃসার শূন্যতা!

এই রিগানোমিক্স মুলতঃ নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা যেগুলি নাগরিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য এতকাল ধরে নাগরিকেরা অর্জন করেছিল ও রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ কল্যাণমূলক বিষয়গুলির দেখ-ভাল করতো সেগুলিকে এক কথায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়। নাগরিকদের এই মৌলিক চাহিদাগুলি থেকে বঞ্চিত করে যে অর্থনীতি চালু করে তার মোদ্দা কথা হলো বড় লোকদের বড় লোক বানানো – তেলা মাথায় তেল দেওয়া!! প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য থেকে বিতাড়ন করে বড়লোকদের ওপর হাওলা করে দেয়া হয় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্মচারী তথা সেবাদাস হয়ে সেসবের দেখাশোনা করবে বলে– আর মালিক চরিত্রের যে প্রকৃতি তার প্রকাশ ঘটবে অবলীলায় সে তো জানা কথাই, শ্রমিক/কর্মচারীর কাছ থেকে যতটা বেশি কাজ আদায় করা সম্ভব সেটি করে নিয়ে কম পারিশ্রমিক দিয়ে কর্মনিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে বরাবরের মতোই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী করে বেঁধে রাখা – আর এভাবেই তেলা মাথায় তেল ঢেলে চলা। রিগ্যান মুলতঃ ট্যাক্স ব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন এনে দেয়ায় বড়লোক তথা ধনীদের আয়কর থেকে চরম রেয়াত তথা মুক্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ায় এতদিনকার গড়ে ওঠা চলমান ব্যবস্থা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে পড়ে গেল টান – ফলে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আদায়ে বিশাল ঘাটতি থাকায় রাষ্ট্রের পক্ষে আর সুযোগই রইল না নিম্নবিত্ত তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা-জাল দিয়ে ভাল ভাবে বেঁচে-বর্তে থাকবার নিশ্চয়তাটি দেবার! ফলে রাষ্ট্র প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্রগুলিকে একে একে বিদায় করা হলো! ধনীদের আয়কর কম দেবার সুযোগ করা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে ধনীরা যদি বেশি অর্থ বাঁচাতে পারে আয়কর কম দিয়ে তবে আঁখেরে সেই ধনীলোকেরা তাদের বাড়তি অর্থ দিয়ে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলবে – ফলে এভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে সারা দেশ জুড়ে, তাতে করে পরিণতিতে সেখানে শ্রমিক-কর্মচারী হ'য়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাজের সুযোগ উন্মুক্ত ও অবারিত হবে! আসলে সেটি ছিল ধনীকে ধনী করবার কুট-কৌশল আর পুঁজিবাদের সেই মতলববাজী নীতিমালাকে সিনেটর কেনেডি ও অন্যরা 'তেলা মাথায় তেল ঢালবার' অর্থনীতি বিলে চিহ্নিত করেছিলেন তখন। রিগ্যানের এই ব্যবস্থাপত্রকে আরো চিহ্নিত করা হয় "চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতি" হিসেবে। কারণ ধনীদের অর্জিত সম্পদ যত বাড়বে সেগুলি তারা পুনরায় লগ্নী করবে আর আঁখেরে তাদের সেই লগ্নীকৃত টাকায় গড়ে ওঠা ব্যবসা-বাণিজ্যের সুফল নিম্নবিত্তের কাছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়বে এবং তারা এর সুফল পেতে থাকবে! মুলতঃ স্বল্প সংখ্যক ধনীরা হলো একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী জনসংখ্যার ১০% কিন্তু তাদের হাতে জমা আছে ৯০% সম্পদের ভাণ্ডার! এরা একে অপরের আপনজন – ধনী ক্লাবের সদস্য হয়ে নিজেদের দিকে সমুদয় ঝোল টেনে নিয়ে অর্থনীতিকে পরিচালনা করছে ধনীদের দ্বারা 'ধনীদের স্বার্থে-ধনীদের পক্ষে-ধনীদের জন্য' আর এটাই হলো আজকের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের তথা গোষ্ঠী অর্থনীতির স্বরুপ! এই কার্যক্রম এই রিপাবলিকান পার্টির বহুদিনের চর্চিত রাজনীতি ও নীতিমালা'র (কু)ফল! আজ রাষ্ট্রীয় আর্থিক বুনিয়াদ এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যা তেলা মাথায় তেল দিয়ে ধনীকে আরো ধনী করবার সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে!

এই রিগানোমিক্স তিন যুগ আগে এসেছিল ঠিক এর বিপরীতমুখী আরেক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিবাদ হিসেবে। সেই ব্যবস্থা ছিল মুলতঃ কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ব্লু-প্রিন্ট! এই পুঁজিবাদের মধ্যেই গড়ে ওঠা সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা নাগরিকদের প্রতি সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি দায়বদ্ধতা বোধ করেছিল বিধায় এই পশ্চিমা বিশ্বে পুঁজিবাদই 'জনগণের জন্য-জনগণের দ্বারা-জনগণের প্রতি' উদ্দিষ্ট নীতিমালা ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডকে নির্ধারণ করে দিয়েছিল; ফলে এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুঁজিবাদী বিশ্বে সামাজিক নিরাপত্তা-জালের আওতায় নাগরিকদের এনে মানুষের মৌলিক-অধিকারগুলি লাভের পথ উন্মুক্ত করেছিল। কিন্তু এতে করে ধনীদের বুঝি একটু অসুবিধাই হয়ে যায়, কারণ এই সুবিধাদানে 'সুনাগরিক' হিসেবে ধনীকে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য অধিক আয়কর দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তহবিল গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়! সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে পরিচিত এই নীতিমালায় বিশ্বাসী রাজনীতিকেরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় সকল নাগরিকের জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাপত্র প্রদান করার জন্য দেশে দেশে। তারা গণ-মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের যে নির্মল নির্বিঘ্ন নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বহু আন্তর্জাতিক সনদ-চুক্তি স্বাক্ষর করে, আইএলও থেকে শুরু করে বহু আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে গণ-মানুষের স্বার্থে যে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিল কালে কালে পুঁজিবাদের সেই সাম্যতার সোশ্যাল ডেমোক্রেসিয় নীতিমালা ও ব্যবস্থাপত্রকে অস্বীকার করে এক বীভৎস ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের, মানে গোষ্ঠী অর্থনীতির সূচনা করে! যার মোদ্দা কথাই হলো, উদগ্র লোভ আর সৃষ্টি ছাড়া লাভালাভের ব্যবস্থাপত্র!

রিগ্যানের একই সময়কালে যুক্তরাজ্যে ক্ষমতায় তিন তিনবারের জন্য এলেন 'আইরন লেডি' মার্গারেট থ্যাচার, যিনি 'আইরন' হয়েই বৃটিশ জনগোষ্ঠীকে এমনই ডলা দিয়ে গেলেন যে ষাটের দশকে প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনসহ প্রমুখ নেতাদের উদ্যোগে পরিচালিত লেবার পার্টির সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাবিধি একে একে গুঁটিয়ে আনা হলো; ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী একইভাবে মালিকের কর্মচারী হয়ে শুধু বেতন নির্ভর জীবন ও জীবিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে সময় ও যুগের সাথে বংশপরম্পরায় পাল্লা দিয়ে চলবার সুযোগ হারাল! 'নুন আনতে পান্তা ফুরাবার' জীবন হয়ে উঠলো তাদের বিধিলিপি – মালিকের "হায়ার" আর "ফায়ার" এই দুই শব্দে জীবন ও জীবিকা হলো ওষ্ঠাগত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার পরিপূর্ণভাবেই ইংল্যান্ডে রিগানোমিক্স বাস্তবায়ন করে সমস্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাপত্রকে ঝঁটিয়ে বিদায় করায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য গড়ে তোলা এতদিনকার সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেল! এই ধনী ক্লাব দ্বারা পরিচালিত ধনীকে আরো ধনী করবার যে অর্থনৈতিক সংস্কৃতিটি চালু হয়েছে সেটাই হলো আজকের কর্পোরেট কালচার মানে ফুঁলে-ফেঁপে দৈত্যাকৃতির মতো বড় হয়ে ওঠা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির চলমান সংস্কৃতি!

এই ব্যবস্থাপত্রে তাই বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের মালিক আর যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট ব্যবসায়ীর চরিত্র আর উদ্দেশ্য একই সুঁতার টানে বাঁধা। এরা এতই ধনী যে নিজেরা চিকিৎসা করাতে ছুঁটে যায় বিশ্বের উন্নত দেশের সেরা সেরা প্রতিষ্ঠানে সেরা সেরা ডাক্তারদের সেবা লাভের জন্য, আর নিজেদের শ্রমিক-কর্মচারী-আমজনতার জন্য একটা মানসম্পন্ন হাসপাতাল অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে না – এমনকি সুষ্ঠু চিকিৎসার কোনো সুযোগও দেয় না! আর মজুরী? সে তো গরীবের পেটে লাথি মারা! এইসব কোম্পানীর মালিক, সিইও'রা কাজ করে না কিছুই – শুধু ওপরের কানেকশনটি 'ফিট' করে কন্ট্রাক্ট বাগিয়ে আনা মধ্যস্বত্বভোগী, কিন্তু একেকজন অবকাশকালীন ভাতা-বোনাস নিয়ে থাকে বিশাল অংকের অর্থ মুল্যে, বেতনের বাইরেই!

এদিকে এই গণতান্ত্রিক তথা মুক্ত ব্যবস্থাপনার মধ্যে আরেক দলের উৎপত্তি হয়েছে, যদিও তাদের অবস্থান এখনও ততটা বড়সড় কিছু নয়, তবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভোটের বাক্সের রাজনীতিতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের কোণঠাসা করে দিতে পারে এরা। এরা ব্রাকেট-বন্দী হয়েছে 'নিও-লিবারেলিজম' বলে! এরা হলো চলমান উদারনীতির প্রবক্তাদেরই আরেকটি নতুন ও কিছুটা পরিবর্তিত ধারার লোকজন, যারা মুলতঃ মুক্ত-বাজার পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবক্তা! এরা সরকারকে-রাষ্ট্রকে অর্থনীতি ও সমুদয় ব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, কোনোভাবেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ-বিধিবিধান তাদের কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকতে দিতে নারাজ! কারণ 'মানুষ জন্ম স্বাধীন' ফলে কারো নিয়ন্ত্রণে সে যাবে না – রাষ্ট্রের তো নয়ই! মুক্ত-অর্থনীতির প্রবক্তা হয়ে এর ওপরে কোনো সরকারি বাধ্য-বাধকতার বিরোধী। ভাবখানা এমন যে জন্ম স্বাধীন মানুষ তার ব্যবসা-বাণিজ্য নিজেদের ইচ্ছা মতো পরিচালনা করবে, তার উৎপাদিত পণ্যে লাভালাভের মাত্রা সে-ই নির্ধারণ করবে, কারণ তারা বিশ্বাস করে "আমাদের ভাগ্যের আমরাই ঈশ্বর" – ফলে সরকার 'তফাত যাও'! তারা ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রতার পক্ষে এবং সামগ্রিক জীবন-যাপনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরকারি কোনো কল্যাণমূলক ব্যবস্থাপত্র দানের ঘোর বিরোধী! ভাবখানা এমন যে 'আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে এভাবে ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছি – তুমি হও না কেন? সরকারে উপর নির্ভর করো কেন?' খুবই খোঁড়া যুক্তি! শ্রেণি-বিভক্ত এই সমাজ কাঠামো ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় সবারই জন্ম হয় না একই রকমের রাজতিলক মাথায় ধারণ করে। জীবনের এই টিকে থাকবার এই দৌড় প্রতিযোগিতায় ট্রাম্প-রকফেলারদের 'মুক্ত-স্বাধীন' মানব সন্তানেরা বাই ডিফল্ট দৌড় শুরুর লাইনের অনেকদূর সামনে দাঁড়িয়েই প্রতিযোগিতাটি শুরু করে, আর টম-জন-স্মিথ-হরিদাসদের দৌড়টা শুরু করতে হয় অনেক পিছন থেকে – এককথায় 'লেভেল প্লেইং ফিল্ড' না হলে অসম প্রতিযোগিতা হয় – সেটাই এক্ষেত্রে হয়ে চলেছে! যাইহোক, ইংল্যান্ড থেকে রাজতন্ত্রের গুঁতা খেয়ে মার্কিন মুল্লুকে যেসব পূর্ব-পুরুষেরা নতুন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিত্তি-প্রস্তর রচনা করেছিলেন নতুন দেশ ও ব্যবস্থাপনা হিসেবে, তারা অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ঠিক করেছিলেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সরকারকে যত কম নাক গলাতে দেয়া যায় ততই ভাল, আর তাই সেই ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অদৃশ্যমান সরকার। যদিও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকালীন পিতৃদেবদের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ কর্ম, ক্ষেত্র বিরাট তবে আজ স্বার্থসর্বস্ব রাজনীতির যুপকাষ্ঠে এই ব্যবস্থাপত্র যেন হিতে-বিপরীত হয়ে উঠছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপরে কারণ সেই 'ব্যক্তি স্বাধীনতা'র বুলি এখন যেন 'গুলি' হয়েই তাদের বুকে গিয়ে বিঁধছে! সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সীমিত ও অথর্ব করে দিয়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতার উর্ধোত্থান কোনো কাজের কথা হতে পারে না, এর মধ্যে একটি সুসমন্বয় থাকার দরকার আছে সে কথা বলাই বাহুল্য!

এই করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের মাঝে কেন ট্রাম্প সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত খুলে দেবার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছে তার একমাত্র কারণই হলো এই গোষ্ঠী অর্থনীতির প্রতিভু হিসেবে বসে বসে তার প্রভুদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব মার খাবে – লাভের টাকা গুনতে তারা ব্যর্থ হবে সেটি মেনে নিতে প্রস্তুত নয় এরা। ফলে মিথ্যা করে হলেও 'স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান' বলে মানুষজনকে ঘরের বাইরে আনতে পারলে ট্রাম্পের 'প্রভু' মালিক-ব্যবসায়ীরা হাফ ছেড়ে বাঁচবে। তাছাড়া, ট্রাম্পের বিশ্বাস সামনের নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে মার্কিন অর্থনীতির চাকা সচল থাকতে হবে। গতানুগতিক জ্ঞান বলে যে দেশের অর্থনীতির দশা কাহিল হলে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট পুনঃনির্বাচিত হয় না – মানুষের আস্থার জায়গাটি সংকুচিত হয়ে আসে। ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসের গুঁতায় মার্কিন অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছে সেটি সামলানো এখন কয়েক বছরের মামলা হয়ে দাঁড়িয়েছে! চার কোটি লোকের উপরে মানুষ হয়েছে কর্মহীন! বহু প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। অনেক ব্যবসা অচিরেই ফিরে আসবে না। বহু কর্মজীবী মানুষ পরিণতিতে কাজে ফিরে যেতে পারবে না খুব সহজেই। এরকম একটি অনিশ্চিত অবস্থায় ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের আশা দিন দিন দূর থেকে দূরেই ছিঁটকে পড়ছে বিধায় সে এতই নার্ভাস হয়ে গেছে যে মরিয়া হয়ে উঠেছে 'স্বাভাবিক অবস্থা' ঘোষণা দিয়ে মানুষজনকে বাইরে টেনে এনে এই অর্থনৈতিক ধস থামিয়ে দিয়ে পুনঃনির্বাচনের বৈতরণী পার হয়ে যাবার। তবে সে আশা দূরাশা, কারণ অর্থনীতি কারো খেয়াল-খুশি, মর্জি মাফিক চলে না! ফলে ট্রাম্প যেভাবে চাইছে সেভাবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটা সুদূর পরাহত! সেটাই হলো নির্বাচনের সহজ হিসাব!

এরই বিপরীতে আশার একটি দিক দেখা যাচ্ছে! এই সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের প্রতিনিধি হিসেবে এবার মঞ্চ দখল করেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তবে বিগত তিন যুগের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের দৌর্দন্ড প্রতাপ মানুষের মস্তিষ্ক ধোঁলাই করে দিয়েছে এবং পুঁজিবাদের রক্ষক হয়ে মালিকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে মালিক হলো প্রায় 'ভগবানতুল্য' কিছু একটা, তাই তার রাজী-খুশির ওপরেই যেন তাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল! মানুষের অধিকারবোধ ভোঁতা হয়ে গেছে। এদিকে সামগ্রিকভাবে দেশে দেশে পুঁজিবাদের চরম বিকাশ রাজনীতিতে ব্যবসায়ী তথা অর্থবিত্তের চরম অনুপ্রবেশ রাজনীতির চেহারা-চরিত্র, গতি প্রকৃতি সবই দিয়েছে বদলে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় এখন! ফলে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তথা কর্পোরেট বিজনেস অর্থ লগ্নী করে থাকে তাদের পছন্দসই 'গণ-প্রতিনিধি' আসনে প্রার্থীদের নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে। এইসব 'গণ-প্রতিনিধি'রা জন ও গণ কারোই প্রতিনিধি হয় না, তারা সব গোষ্ঠীস্বার্থ তথা বিশাল অর্থের চালিকা শক্তির প্রতিনিধি তথা উপপত্নী হয়ে বসে আছে! সরকারি পদে থেকে বা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে সমস্ত আইন-কানুন, সুযোগ-সুবিধা টেনে আনে তাদের প্রভু সেই গোষ্ঠী অর্থনীতি তথা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ঝোলার মধ্যে! এই চলমান প্রবনতা ও রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এই বার্তা বক্ষে ধারণ করে, রাজনীতি-অর্থনীতি হোক মানবের কল্যাণে – মানবের স্বার্থের চালিকা শক্তি। তাই স্যান্ডার্স অবলীলায় দাবি তুলতে পেরেছেন সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার – গণমুখী বেতনমুক্ত উচ্চ-শিক্ষার নিশ্চয়তার। যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাটি হলো ব্যবসার একটি বিরাট ক্ষেত্র! স্যান্ডার্স মুলতঃ সেই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের তলপেটে এমন কষে লাথি দিয়েছেন যে এই গোষ্ঠীস্বার্থ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে একজোট হয়েছে আজ স্যান্ডার্সকে থামিয়ে দিতে। তাই 'কম্যুনিস্ট'-'সমাজতন্ত্রী' এইসব অপপ্রচারের ঘেরাটোপে বেঁধে রাখতে চাইছে তাকে! তাই আজ গোষ্ঠীস্বার্থ হয়েছে একাট্টা স্যান্ডার্স' বিনাশে! এদিকে স্বীয় দল ডেমোক্রেট নেতৃত্ব মনে করছে স্যান্ডার্সের নীতি-কর্মসূচি সময়ের অনেক আগে আগে চলছে, ফলে সেই পালে হাওয়া লাগবার সম্ভাবনা কম বিধায় স্যান্ডার্সের পক্ষাবলম্বন করলে বিজয়ী হবার সম্ভাবনা থাকবে কম বিধায় তারা স্যান্ডার্সকে সমর্থন তো করছেই না বরং তার থেকে 'বিপদ মুক্ত দূরত্ব'ই বজায় রেখে চলেছে। তাদের মধ্যকার অনেকেই এই কর্পোরেট ব্যবসার পয়সায় প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েই ঐসব আসনে আজ জেকে বসায় সেই কর্পোরেট অর্থ স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবার সৎ সাহস তাদের অনেকেরই নেই আজ!

স্যান্ডার্স মনে করেন গণজোয়ার সৃষ্টি করে, গণমানুষকে আন্দোলিত করে গণমানুষের বিজয় অর্জন করা সম্ভব। স্যান্ডার্স অবশ্যই সফল হয়ছেন তারুণ্যকে আন্দোলিত ও উদ্বেলিত করতে। কলেজে-কলেজে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা স্যান্ডার্সের পালে শুধু হাওয়া নয় বরং ঝড়ো হাওয়াই তুলে দিয়েছে! আমার যে কন্যাদ্বয় প্রবন্তী-শ্রেয়ন্তী যারা স্বভাবে মুখচোরা গোছের আর সবেমাত্র হাইস্কুলের ছাত্রী, তারাও স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আমার সাথেই স্যান্ডার্স ও তার কর্মসূচি নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ওদের সাথে কথা বলে বুঝি ওরা আমার চাইতে বেশি খবর রাখে, আমার চাইতে ভাল জানে!

তবে মূল রাজনৈতিক স্রোতধারায় স্যান্ডার্স নিজ দলে বা জাতীয় পর্যায়ে ঝড়ো হাওয়া যে তুলতে পারেননি তার একটি কারণ আছে। মার্কিন রাজনীতির, রাষ্ট্রব্যবস্থার ও চিন্তা-চেতনার গভীরে এর মূল আছে প্রথিত! সেই শিকড় উপড়ে বেরিয়ে আসা – বিজয় ছিনিয়ে আনা এখনও সহজসাধ্য ব্যাপার নয় বলেই ডেমোক্রেট দলীয় প্রগতীশীলরাও কিছুটা ব্যাক গিয়ারে চলতে চাইছে বলে স্যান্ডার্সের গাড়িতে উঠছে না এখনো! মুলতঃ কম্যুনিন্ট তথা লাল জুজুর ভয় সেই যে কোল্ড ওয়ার তথা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মুক্তবিশ্বের লোকদের দেখানো হয়েছিল সেই জুজু'র ভয় দেখিয়ে এখনও মার্কিন মুল্লুকে চরম পুঁজিবাদের স্বার্থ হাসিল করা যায়! রিপাবলিকান পার্টি এ বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করায় ভীষণ পটু! ষাটের দশকে এই এই রিপাবলিকানরাই কুখ্যাত 'ম্যাকার্থিসিজমে'র জন্ম দিয়ে 'উইচ-হান্ট' করে প্রশাসন ও সারা দেশ থেকে 'কম্যুনিস্ট শয়তানদের' বিতাড়নে এক রাজ যজ্ঞ বসিয়ে ছিল; যার উদ্দেশ্যই ছিল ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে স্বদেশী ভিন্ন মতাবলম্বী সুস্থ রাজনীতির প্রবক্তা দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার – যা ট্রাম্প এখন করে চলেছে! এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশের মানুষেরা ভাল রকমেরই রক্ষণশীল মানসিকতার ফলে তাদের কাছে রিপাবলিকানদের জনস্বার্থ বিরোধী হুজুগে বড়ি বেঁচার খুব সুবিধা হয়। 'ডেমোক্রেটরা মানসিকতায় নরম-ধরম, প্রতিরক্ষায় দুর্বল' – এভাবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে কারণ ডেমোক্রেটরা পারতঃপক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায় না – বরং তার বিপক্ষেই কথা বলে! একা যুদ্ধে যাবার চাইতে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন নিয়ে যুদ্ধ করতে চায় ফলে মার্কিনীদের "মাচো ম্যানশীপ" – তথা 'মুই কি হনু'রে ভাবটিকে জলাঞ্জলি দিতে হয় ফলে তাদেরকে চিত্রিত করা হয় "ভীষণ দুর্বল" বলে। বার্নি স্যান্ডার্স যেভাবে নাগরিকদের সেবাদানে রাষ্ট্রকে জড়িত করতে চাইছেন সেটাকে চিত্রিত করা হচ্ছে "লাল কম্যুনিস্ট"দের ব্যবস্থা বলে ফলে এই "ব্যক্তির অধিকারের দেশে রাষ্ট্রকে নাক গলাতে দেওয়া হবে না" বলে পুঁজিবাদের করাতে শান দিয়ে হাতে গোনা নামমাত্র কিছু ব্যক্তির ব্যবসার হাতে গণমানুষের স্বার্থগুলিকে তুলে দেয়া হচ্ছে যাতে ঐসব ব্যবসায়ীরা গণমানুষের পকেট কেটে মজাসে বাণিজ্য করে যেতে পারে! ঐ ব্যবসায়ী দলটি মূলতঃ হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসায়ী ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ফলে এই নিজস্ব লোকেদের একটিই স্বার্থ 'লাভ – লাভ আর লাভ" এই 'মহান মন্ত্রে' উজ্জীবিত হয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ হয় – নিজেদের মধ্যে সবকিছু ভাগাভাগি করে নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে পরিচালিত করে ক্রোনি ইকনমির জন্ম দিয়েছে। এখানে সেবাদান করাটি মুখ্য উদ্দেশ্য নয় বরং ব্যবসা করা, বাণিজ্য করে যাওয়া এবং লাভের মাত্রা অক্ষুন্ন রাখা ও বাড়িয়ে যাওয়াটি উদ্দেশ্য! স্যান্ডার্সের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকে জড়িয়ে দিলে রাষ্ট্র আর ব্যবসা ও লাভের কথা চিন্তা করবে না বরং সেবাভিত্তিক কাজ করবে – জনগণ কম পয়সায় সেবা পাবে!

স্যান্ডার্স যদিও নির্বাচনে আর প্রার্থী হয়ে থাকছেন না তার অর্থ এই নয় যে তার মঞ্চ থেকে ওঠানো আওয়াজগুলো বাতাসে মিলিয়ে গেছে! না, সেটা হবে না। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী মানে জো বাইডেনকে স্যান্ডার্সের ভোটারদের কাছে টানতেই হবে নির্বাচনের বিজয়মাল্য ছিনিয়ে আনতে; ফলে সারাদেশে তারুণ্যের মধ্যে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাদের ভোট নিজের দিকে টেনে আনতে স্যান্ডার্সের অনেক কর্মসূচিকে নিজ কর্মসূচিভুক্ত করতে হবে। স্যান্ডার্স অদৃশ্যে থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে চালিকাশক্তি হয়ে বিরাজ করছেন এবং করে যাবেন সে কথা বলাই বাহুল্য!

গণতন্ত্রের প্রথম পাঠে আমরা পড়েছি-শুনেছি সকল কিছুর মতোই এর সুফল-কুফল, সুবিধা-অসুবিধা আছে। গণতন্ত্র তথা মুক্ত এই ব্যবস্থায় মানুষকে অবারিত স্বাধীনতা দেওয়া হয় বিধায় কোনো কোনো সময় সেই স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হতে পারে। এই ব্যবস্থায় মানুষের অর্থ উপার্জনের পথ এতই উন্মুক্ত থাকে যে অপর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করে সেই অর্থ রাজনীতিকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত তো করেই এমনকি এক পর্যায়ে গিয়ে গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরে – নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারে সেই অর্থের জোরে! এটা হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, কুফল, অসুবিধা! রাজনীতিতে এই অপর্যাপ্ত টাকার অনুপ্রবেশ বন্ধ করার প্রক্রিয়া সহজ নয়! কারণ এতে করে এই মুক্ত ব্যবস্থা প্রদত্ত মানুষের অধিকারকে সংকুচিত করা হয়, যা গণতন্ত্র অনুমোদন করে না। এই যে টাকার ছড়াছড়ি হয় সেটি নিশ্চিতভাবেই সাধারণ মানুষের পছন্দ-অপছন্দকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে একটি আপসাইড ডাউন পরিবেশের সৃষ্টি করে মন্দকে ভাল ও ভালকে মন্দ হিসেবে ফুঁটিয়ে তুলে জনগণের মতামতের বারোটা বাঁজিয়ে দেয়! আশির দশক উত্তর মার্কিনী নির্বাচনে এই অশুভ প্রবণতা প্রকটভাবেই ধরা পড়েছে। পরিণতিতে আজকের এই পাগলা রাজা হোয়াইট হাউজ দখল করে নিতে পেরেছে মূলতঃ টাকার জোরে! ফলে এই অর্থের অবারিত চলাচল আর শেষ পর্যন্ত জন ও গণের গণতন্ত্র থাকে না! ধনীগোষ্ঠীর পছন্দ-অপছন্দই গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে! এই অপর্যাপ্ত অর্থের মালিকানা পুঁজিবাদের পথকে প্রশস্ত করার মাধ্যমে জন ও গণ শাসিত গণতন্ত্র নয়, বরং পুঁজি শাসিত গণতন্ত্রের নামে এক স্বেচ্ছাতন্ত্র নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দেয়। দেশে দেশে আজ এই জাতীয় গণতন্ত্রের চর্চা চলছে বিধায় গণমানুষের মুক্তি আসেনি একদিকে, অপর দিকে মানুষের অধিকারও প্রতিষ্ঠা হয়নি, যা কি-না গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সত্য!

অর্থনীতি পাঠে জেনেছিলাম ম্যালথাসের প্রান্তিক জনসংখ্যা নীতি। যার মূল তত্ব ছিল, বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়ে গেলে রাষ্ট্র,সরকার, মানুষ কিছু না করলে প্রকৃতিই রোগ-মহামারী-বানভাসি-ঝঞ্ঝা আকারে এসে এসে জনসংখ্যা কমিয়ে দিয়ে যাবে। আবার অনেক নীতি কথায়, বিদ্যজনের বক্তব্যে জেনেছি- অন্যায়, অসাম্য 'সৃষ্টিছাড়া' হয়ে উঠলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে আসে! আমার কাছে এই করোনাভাইরাস হলো পৃথিবীর সেই অন্যায়-অসাম্যকে আরো মানবিক করে তুলবার বার্তা বহনকারী! বিগত দশকগুলিতে গোষ্ঠী অর্থনীতি তথা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের শৃংখল ভেঙে দেশে দেশে রাজনীতিক ও চিন্তা নায়কেরা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সুর তুলে পুঁজিবাদের যে সহনীয় রূপের উত্থান ঘটিয়ে মানব বন্দনার সূচনা করেছিল এই করোনা-উত্তর বিশ্বে আজ আবার সেই বাতাবরণ সৃষ্টি করতে এসেছে এই করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতি-রাজনীতি আর আগের মতো একইরকম থাকবে না কিছুতেই! ক্রোনি ক্যাপিটালিজম তথা গোষ্ঠী অর্থনীতি তথা মালিকের রাহুগ্রস্ত অর্থনীতি আর চলবে না। দিন বদলের পালা এবার বুঝি শুরু হবে! মনে হয় এই করোনাভাইরাস বিদ্রোহী কবি নজরুলের এই বাণীরই বন্দনা করতে এসেছে "ধ্বংসের মাঝে হাসুক মা তোর সৃষ্টির নব পূর্ণিমা" আর কবি গুরুর কথায় বলতে এসেছে "তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা!" জয় হোক বিপন্ন মানুষের! জয় হোক মানবতার!! জয় হোক বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের! আমার কথাটি ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল!!