প্যানডেমিক প্রভাবে গণমাধ্যম

মোহাম্মাদ আক্তার হোসেন
Published : 26 May 2020, 11:28 AM
Updated : 26 May 2020, 11:28 AM

১৯৬৪ সাল টেলিভিশনের যাত্রা শুরু থেকে কালক্রমে নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ বাংলাদেশে সংবাদ ও বিনোদনভিত্তিক সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চ্যানেল সংখ্যা প্রায় ৩৫টি। একইসাথে আরো কিছু নতুন চ্যানেলের অপেক্ষায় বাংলাদেশিরা, আর হবেই না কেন? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জনে গর্বিত বাংলাদেশীরা বিশ্বের সপ্তম বহুল প্রচলিত ভাষায় কথা বলে, যদিও বাংলাদেশ আয়তনে ছোট কিন্তু মনোবল ও সাহসিকতার দিক থেকে আমরা অনেক বড় তাই হয়তো আমাদের চ্যানেলের সংখ্যাও একটু বেশি।

বিশ্বায়নের দ্রুতরথে তাল মিলাতে গিয়ে বাংলাদেশ টিভি চ্যানেলগুলো কিছুদিন থেকে এমনিতেই একটি বড় ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল যা বিভিন্ন সংগঠনগুলোর সমন্বয় ও মালিকদের সহযোগিতায় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও চলছিল। কিন্তু এরই মধ্যে বৈশ্বিক মহামারীর ছোবলে ২০২০ সাল "'কোভিড- ১৯'' বিষে জর্জরিত করায় মিডিয়ার টানাপোড়ন আবার শুরু হলো।

এমনিতেই চ্যানেলগুলোর দিন আনি দিন খাই অবস্থা তার ওপর আবার এই মহামারী শুধু যে আমাদের বিজ্ঞাপনের উপর প্রভাব ফেলছে তাই না, এটি আমাদের মনোবলও ভেঙ্গে দিচ্ছে। চাকরির অনিশ্চয়তা মিডিয়ায় কর্মরতদের ঘিরে রাখছে সবসময়।

এই মহামারীতে আমরা কিন্তু থেমে নেই, থেমে নেই আমাদের পথ চলা। বাংলাদেশের ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, ব্যাংকার পরিচ্ছন্ন কর্মী ও কিছু জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের পাশপাশি মিডিয়া কর্মীরাও কাজ করে যাচ্ছি দিনরাত।

যদিও এত কিছুর মধ্যে ভয় রয়েই যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে আমাদের পরিবার আগের মতো হাসবে তো? পাশে পাবে তো? জানি না কি হতে যাচ্ছে! এরই মধ্যে ১৩৮ জন গণমাধ্যমকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, ৩ জনকে চিরতরে হারিয়েছি।

চ্যানেলগুলোতে সকল বিভাগ মিলিয়ে কমবেশি ৮৭০০ কর্মী হবে, আর একই সাথে তাদের পরিবার ভাবতেই আমার ভয় হয় যতটা না হয় এই 'করোনাভাইরাস'কে। এই চ্যানেলগুলোতে বেতন না দেওয়া আর কর্মী ছাটাই আগে থেকেই ছিল। তার উপর এখন এই অবস্থা। এর মধ্যে চ্যানেলগুলোর একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন কমতে শুরু করেছে। মিডিয়াকর্মীরা পড়ছে অনিশ্চয়তায়।

Kantar-এর একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৯% শতাংশ বিজ্ঞাপন আয় কমে গেছে (COVID-19 Impact on TV viewing)। এক্ষেত্রে সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলো কিছুটা ব্যতিক্রম। যেখানে বিগত বছরগুলোতে মিডিয়া বাজেট থাকত ৯০০-১১০০ কোটি টাকার মধ্যে, সেখানে এই বছর মাত্র ৫০০-৬০০ কোটি টাকা হবে। দেশীয় চ্যানেলগুলো ফ্রি টু এয়ার বলে বিজ্ঞাপনই আমাদের একমাত্র চালিকা শক্তি।

যেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষ অনলাইনে বেশি সময় ব্যয় করে থাকে, তাই বিজ্ঞাপন দাতারাদের ডিজিটাল সেক্টরে বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রবনতাটাও বেশি, আর তারপরই বেছে নেয়া হয় সংবাদভিত্তিক চ্যানেল, তাই সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলোতে উপচে পড়ে বিজ্ঞাপন।

এক্ষেত্রে বিনোদনভিত্তিক চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। করোনাভাইরাসে ছোয়াছুয়ি, বাছ-বিচারে সচেতনার কারণে কমেছে বাড়িতে খবরের কাগজের ব্যবহার, এরই মধ্যে দুটি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো বেশকিছু পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পথে। এক্ষেত্রে অনলাইন নিউজের কাটতি কিন্তু ভাল, মানুষ যেহেতু গৃহবন্দী থাকছে এই অস্থির অবস্থায় তারা টেলিভিশনের চেয়ে ডিজিটাল মিডিয়াতে বেশি সময় দিচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে ৬৩% শতাংশ টিভি, ৭৭% শতাংশ সোশ্যাল মিডিয়া, ৫৮% শতাংশ ইনস্ট্যান্ট মেসেজ, ৭০% শতাংশ অনলাইন ভিত্তিক স্ট্রিমিং, আর ২৭% শতাংশ ব্যয় করছে প্রত্রিকায়। (তথ্য সূত্র: KANTAR COVID-19 Barometer Bangladesh)

বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু বিজ্ঞাপন তুলনামূলক বেড়েছে যেমন মানি ট্রান্সফার, স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, লিকুইড সাবান, বার সাবান, ডিস ওয়াস, ফ্লোর ক্লিনার, ওয়াশিং পাউডার, ভোজ্য তেল, লবন, আটা, গুড়ো দুধ, খাদ্য দ্রব্য ইত্যাদি। তেমনি মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় এদের ব্যবহারও বেড়েছে আগের তুলনায় ১০% শতাংশ। (তথ্য সূত্র: COVID-19 Impact on TV viewing)

কিন্তু অপরদিকে বাকি সকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন এবং পণ্যের ব্যবহার কমে এসেছে যেমন রূপচর্চা সামগ্রী, বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাবার, চিপস, সফট ড্রিংকস, সুপ, তরল দুধ ইত্যাদি। (তথ্য সূত্র: COVID-19 Barometer Bangladesh)

চলমান মহামারীর ফলে থমকে গেছে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ভ্রমণ, হেয়ারড্রেসিং, বিউটি পার্লার, ফিটনেস ক্লাব, পোশাক, বিলাস দ্রব্য, রূপচর্চা সামগ্রী, আবাসন, শেয়ার বাজার, ইলেক্ট্রনিক বাজার ইত্যাদি। এই সকল ক্ষেত্রে মানুষের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে এই মহামারী মানুষের অন্ন ও স্বাস্থ্যজনিত নিয়ামককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রভাবিত করেছে। ফলে কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে যেমন মৌলিক মহামারী প্রতিরোধের পণ্য, বাসস্থান পরিষ্কারের পণ্য, খাদ্য ও পানীয়, ঔষুধ, চিকিৎসা, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য, ইন্টারনেট, অনলাইন বিনোদন ইত্যাদি।

তবে আমরা যদি একটু খেয়াল করি, বাংলাদেশে বিদেশী চ্যানেলগুলোর যে দাপট ছিল তা কিন্তু অনেকাংশেই কমে গেছে। বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে এখন দেশীয় চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। এখন দর্শক বিদেশী চ্যানেলের চেয়ে ১৬৩% শতাংশ বেশি দেশীয় চ্যানেল দেখছে।

দেশী চ্যানেলগুলিও ইফতার ও সেহেরীর সময় অনুসরণ করে প্রোগ্রাম সাজিয়েছে। এক উপাত্তে উঠে এসেছে টিভির রিমোট এখন দীর্ঘমেয়াদে পুরুষদের দখলে যা করোনাকালীন ক্রমবর্ধমান ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সজনিত নারী নির্যাতনবৃদ্ধির বৈশ্বিক চিত্রের সাথে অদৃশ্যভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এখন সরকারের উদার প্রণোদনাই পারে টেলিভিশন মিডিয়াকে বাঁচাতে, তাহলেই হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে এই শিল্প আর আমরা নিজেরাও যদি এখন থেকেই কোনো পদক্ষেপ না নেই তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। এখনই আমাদের মিডিয়া শিল্পকে বাঁচাতে নিতে হবে সম্মিলিত উদ্যোগ এক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন অনুষ্ঠানের মানোন্নয়নে, না হলে আবার টিভি দর্শককে ঘিরে ধরবে বিদেশি চ্যানেল, জনপ্রিয়তা হারাবে দেশীয় চ্যানেল।

তাই বন্ধ করতে হবে বিজ্ঞাপন দাতা ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা আধিকর্তার মতানুসারে চলা। উদ্যোগ নিতে হবে সরকারি নিতিমালা বাস্তবায়নের, বিজ্ঞাপনের মুল্য নির্ধারণ, অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, বিজ্ঞাপনের টাকা সময়মতো পরিশোধ করা আর বাংলাদেশ এর চ্যানেলগুলোকে পে চ্যানেলে উন্নীত করার জন্য। আমাদের টেলিভিশনের পাশাপাশি ডিজিটাল মিডিয়াতেও বেশিমাত্রায় ফোকাস করতে হবে।

বেতন ভাতা ও টেলিভিশন পরিচালনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন নির্ভর না হয়ে, পে চ্যানেলের মাধ্যমে কেবল অপারেটরের দর্শক প্রদেয় মাসিক ফী নির্ধারণ করতে হবে।

সময়মতো বিজ্ঞাপনের বকেয়া টাকা উত্তোলন নিশ্চিত করে মিডিয়া কর্মীদের বকেয়া বেতন ও বোনাস পরিশোধের উদ্যোগ নিতে হবে। জানি না এই মহামারী আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে! কিন্তু এটা বুঝতে পারছি এখনই যদি আমারা পদক্ষেপ না নেই আমাদের মিডিয়াগুলো ধুকে ধুকে মরবে। আর এর প্রভাব পড়বে এই ৮৭০০ কর্মী ও তাদের পরিবারের ওপর।

২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ এর পর (২য় বিশ্বযুদ্ধ) থেকে আজ মে, ২০২০ পর্যন্ত জীবন জীবিকা এবং অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে করোনাভাইরাস। ইতোমধ্যে সমাজে মানুষের আচরণে, কাজে এর প্রভাব পরিদৃষ্ট হচ্ছে। গত এপ্রিল বৈশ্বিক এক তৃতীয়াংশ চলাচল স্থবির হয়ে গেছে। মানুষ আজ মহামারীর জন্য গৃহবন্দী। সংকট অতীতেও এসেছে, ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু মানবসভ্যতা বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আমারা করোনাভাইরাস করব জয় একদিন, বিশ্বাস হারাব না। আমারা আমাদের পাশে থাকব।