করোনা কালের ঈদ, তবু আনন্দ জাগে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 26 May 2020, 09:49 AM
Updated : 26 May 2020, 09:49 AM

এমন ঈদ কখনো আসেনি আগে। কখনো না। আমরা নয় নয় করে ষাট পেরিয়ে যাওয়া মানুষ। জীবনে তো কম দেখিনি। গরমকালে, শীতকালে, বর্ষাকালে নানা ঋতুতে ঈদ দেখেছি আমরা। সবসময় না হলেও কখনো কখনো সমস্যা ছিল। একসময় আমাদের মানুষজনের হাতে টাকা ছিল না। দুয়েক বাটি সেমাই আর বাড়িতে বানানো পিঠা দিয়েই ঈদ সেরেছে মানুষ। কিন্তু কি তৃপ্তি, আর কি আনন্দ। মাঝে মাঝে রাজনীতিও আমাদের বুকে আঘাত হানতো বৈকি। কত সময় গেছে যখন দেশের অবস্থা কী হবে ভেবে ঈদের আনন্দ কিছুটা হলেও কমতো। কিন্তু কখনো এমন হবে আমরা কেউ ভাবিনি। ভাবেনি বিশ্বের মানুষ।

আমরা সবাই জানি ঈদের এক অপার আনন্দ আর আকর্ষণ হচ্ছে কোলাকুলি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী না। কিন্তু তা বলে কোলাকুলি বা আলিঙ্গন করব না? ঈদের নামাজটা শেষ হবার জন্য বসে থাকতাম আমরা। যে পাঞ্জাবিটা নতুন সেটা গলিয়ে বেরিয়ে পড়তাম পাড়ায়। প্রথম কাজ কোলাকুলি করা। বড়দের পায়ে ধরে সালাম করার পর তারাও আমাদের বুকে টেনে নিতেন। এই আনন্দের যে ঐশ্বরিক অনুভূতি এবার তা হবে না। শুধু হবে না বললে ভুল বলা হবে, হতে পারবে না। তা ছাড়া আলিঙ্গন শুধু না কেউ কারো সাথে হাত মেলাতেও পারবে না। আমাদের সিডনিতে দফায় দফায় অল্প অল্প করে যেতে পারলেও দেশে সম্ভব হবে না কারো বাড়িতে যাওয়া। কারণ সংখ্যা বাড়ছে। আজ খবরে দেখলাম প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি চলে গেছে সংক্রমণের সংখ্যা। এটা রেড এলার্ট। না মানলে জাতির ভাগ্যে কি আছে স্বয়ং বিধাতাও বলতে ভয় পাবেন।

এবারের ঈদ এসেছে কোভিড-১৯ এর কঠিন কালে। আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। এখন থেকে দুনিয়া চলবে সাবধানতা আর সতর্কতার সাথে। সবাই জানি এখনো এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। কবে হবে কেউ জানে না। মানবজাতি বিশ্বযুদ্ধের চাইতেও গভীর এক সংকটকালে আজ অসহায়। করোনাভাইরাস আক্রান্ত ঈদে যারা দোকানপাটে যাচ্ছেন বা জোর করে আনন্দ উৎসবের জন্য জামা-জুতা কিনছেন আমি তাদের যতটা দোষারোপ করব তারচেয়ে বেশি চাইব তারা যেন এই পোশাক, জুতা বা প্রসাধনী ব্যবহার করার সুযোগ লাভ করেন। ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি এই রোগ আমেরিকা, চীন, রাশিয়া থেকে ছোট ছোট দেশ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। আজ না হোক কাল সে টুঁটি চেপে ধরবেই। আর তাতেই কাবু সভ্যতা। এটাও প্রমাণ হয়েছে মানুষ যতটা এগিয়ে যাক না কেন এখনো সে প্রকৃতির কাছে অসহায়। অসহায় দানবের কাছে।

ঈদের বড় আনন্দ বাড়ি বাড়ি যাওয়া, সেটা হবে না। হবে না লাইভ অনুষ্ঠান। পাঁচ-সাতদিন ব্যাপী এসব আয়োজন এবার বন্ধ। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্য অনলাইনভিত্তিক বিনোদন বা অনলাইনে করা অনুষ্ঠান দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমি মনে করি অযাচিত অনভিপ্রেত হলেও এই রোগ আমাদের সতর্ক করে দিয়েছে জানিয়ে দিয়েছে নানা বিষয়ে আমরা সীমা মানিনি। এটা মানুষের স্বভাব দোষ। দুনিয়ায় যে যত বাড়ে প্রকৃতি তাকে তত কঠিন ভাবে সাইজ করে। তাই আমাদের মানতে হবে উৎসবের আনন্দ ঢালাও না হলেও কম পড়ে না কিছু। বরং এবার পরিবারের সাথে নিবিড় ভাবে আনন্দ উদযাপনের সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশের ঈদ। যদি মনযোগ দিয়ে চিন্তা করেন আর পেছনে তাকান দেখবেন অনেক বছর আপনি এমন নিবিড় পারিবারিক ঈদ উদযাপনের সুযোগ পাননি। বাড়তি বিষয়গুলো বড় হয়ে গিলে নিয়েছিল পারিবারিক আনন্দ। সকালে এখানে বিকালে ওখানে রাতে আরেক বাড়ি। পরদিন পরেরদিন এমন করতে করতে পরিবারকে সময় দেয়ার সময় থাকত না আমাদের। করোনাভাইরাস সে কষ্ট লাঘব করেছে। শিখিয়েছে দিনশেষে পরিবার পরিজন ছাড়া আসলে কেউ নাই, কেউ থাকে না। এরাই সুখ এরাই দুঃখ। এদের আমরা নানাভাবে নানা প্রলোভনে দূরে রাখতাম। এবার হয়তো তার লাঘব হবে কিছুটা।

এবার প্রতিযোগিতাও থাকবে না। কে কত দামে লেহেঙ্গা কিনলেন কার শাড়ি কত দামের বা কারটা খাঁটি পাকিস্তানি আর কার পোশাক বলিউডের লেটেস্ট সে কমপিটিশান এবার নাই। আপনি পারেননি হিল্লী-দিল্লী, কুয়ালালামপুর বা ব্যাংকক গিয়ে শপিং করতে। যেতে পারেননি কলকাতাও। ফলে অসুস্থ প্রতিযোগিতাও নাই। এটা আপনার মনোবেদনার কারণ হতে পারে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবাদের এবার আড়ালে চোখের পানি মুছতে হবে না। সন্তানকে সেরা কিছু কিনে দেবার নামে প্রতিযোগিতা এবার বন্ধ বলে তাদের মন ভাল থাকবে।

এটা ঠিক বাণিজ্য আর ব্যবসায় এবার যে মন্দা তার রেশ থাকবে অনেক বছর। হাজার হাজার কোটি টাকার ঈদ বাণিজ্য এবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। দোকানী-ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। মানুষের ঘরে ঘরে কষ্ট। খাবার থেকে ঔষধ সবকিছু আস্তে আস্তে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সংযম আর ত্যাগ কাকে বলে কীভাবে করতে হয় প্রকৃতি যেন চোখে আঙুল দিয়ে হাতে কলমে শিখিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। এই পাঠ এই শিক্ষা যেন ভুলে না যাই আমরা। জানি মানা কঠিন আরো কঠিন মেনে জীবন যাপন করা। কিন্তু এটা সত্য আমাদের লোভ লালসা হয়ে পড়েছিল। আমাদের ইচ্ছা হয়ে গিয়েছিল কামনা। আমরা ধর্মের মূল বিষয় ভুলে নেমে যেতাম নানা অসুস্হ প্রতিযোগিতায়। এবার তার ছেদ টেনেছে করোনাভাইরাস।

আর একটা কথা, ভালো করে ভাবুন তো, এই ঈদে আপনি যে নির্মল নীল আকাশ দেখবেন তা কি কখনো দেখেছেন? শেষ কবে দেখেছেন এমন থালার মত গোল চাঁদ ঝকঝক করতে নীল চাদরে? কবে এমন সুবাতাস আপনার বুক ভরিয়ে দিয়েছে? কবে আপনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনার মতো বড় বড় জনবহুল শহরে এমন বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছিলেন? কবে দেখেছেন এমন নির্জন রাস্তাঘাট? যে ভীড়কে আমরা এখন ভয় পাচ্ছি মানুষকে গালাগাল দিচ্ছি কেন তারা করোনাভাইরাসের ভয় তুচ্ছ করে ছুটছে এই ভীড় কি এমন থাকত? না এর একশগুণ বেশি মানুষ দৌড়াতেন? মারা পড়তেন শয়ে শয়ে মানুষ। ডুবে যেত যাত্রীভারে লঞ্চ, পড়ে থাকত হাহাকার। এবার এসব হবে না। এবার কেউ লাখ টাকার কাপড় পরে যাবেন আর কেউ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন তাও হবে না। এক ধরণের সাম্য আর সমতা এনেছে এই করোনাভাইরাস।

তবে এর সবচেয়ে মন্দ দিকটা মানুষকে মানুষের দুশমন করে তোলা। আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি একজন আরেকজনকে দেখলে পালাবে। দূর থেকে দেখে রাস্তা ছেড়ে অন্য দিকে চলে যাবে কিংবা সরে দাঁড়াবে। ঘরে ঘরে মানুষকে থাকতে হবে একা এবং নিঃসঙ্গ। এই কঠিন সময়ের ঈদে আবার আমাদের হিরো কিন্তু পর্দা কাঁপানো নায়ক নায়িকারা না। এবার আমদের জাতির এবং বিশ্বের হিরো ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা। এবার আমাদের শ্রদ্ধার আসন কেড়ে নিয়েছে বহুল সমালোচিত পুলিশ। সে জায়গাটা এখন তাদের। আর যারা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ঈদকে এখনো অম্লান রাখছেন তারাই আমাদের এবারের ভালোবাসার মানুষজন।

একটি ছোট ভাইরাস সবকিছু বদলে দিলেও একটা বিষয়ে ছাপ ফেলতে পারেনি, তার নাম ভালবাসা। তার নাম মায়া। এর ভেতরেই পূর্ণ হবে ঈদ উৎসব। করোনার ঈদ হবে আগামীর শক্তি। জয়তু ঈদ।