বজলুভাই-মতিয়া আপার বাসায় ঈদ নিমন্ত্রণের স্মৃতি!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 18 Jan 2012, 02:21 AM
Updated : 25 May 2020, 04:48 AM

১৯৯৯ সালের শেষ দিকে আমি সংবাদে যোগ দিই। তখন সংবাদের সম্পাদকীয় বিভাগের রুমটি ছিল 'নক্ষত্রখচিত'। একই রূমে বসতেন সংবাদ সম্পাদক ও খেলাঘরের 'ভাইয়া' খ্যাত বজলুর রহমান। ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের প্রবাদপুরুষ সবার প্রিয় 'দাদা' সন্তোষ গুপ্ত। ছিলেন সব বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী মকবুলার রহমান। আরও ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত (কবি মাহমুদ আল জামান হিসেবে খ্যাত), তুখোড় কলামিস্ট ও কবি সোহরাব হাসান (বর্তমানে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক), বিশিষ্ট সাংবাদিক মুনীরুজ্জামান (বর্তমানে সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)। সেখানে সারাক্ষণ গল্প-আড্ডা হতো। সে আড্ডায় আমি ছিলাম নীরব শ্রোতা। বজলুভাই মাঝে মাঝে আমাকে কথা বলার জন্য উস্কানি দিতেন। বলতেন, তুমি সারাক্ষণ এত চুপচাপ কেন? আমি কেবল হাসতাম। কারণ এমন বড় মানুষদের সমাবেশে বলার মতো কথা আসলে আমার ঘটে ছিল না!

আমি সংবাদে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যে সংবাদ কার্যালয় নতুন আঙ্গিকে সাজানো হয়। তখন সাহিত্য সম্পাদক হাসনাত ভাইয়ের জন্য আলাদা রুম বরাদ্দ করা হয়। বজলুভাইও আলাদা রুমে চলে যান। বজলুভাই আলাদা রুমে যাবার পর প্রতিদিনই ইন্টারকমে আমাকে তার রুমে ডেকে নিতেন। তারপর নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতেন। আমিও বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইতাম। বজলুভাই অত্যন্ত সাবলিলভাবে সে সব প্রশ্নের জবাব দিতেন। কখনও বিরক্ত হতেন না। আমাকে চা খাওয়াতেন। চা ছিল তার খুব প্রিয়। নানা ধরনের চা খেতে পছন্দ করতেন। অনেক সময় কী লিখতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিতেন। এভাবে বজলুভাইয়ের সঙ্গে আমার একটা অন্তরঙ্গ স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

সে সময় ঈদের দিন দুপুরে (বিশেষত ঈদুল ফিতরে) বজলুভাই বাসায় নিমন্ত্রণ করতেন। সিদ্ধেশ্বরীর রমনা অ্যাপার্টমেন্টে আমি কয়েকবার নিমন্ত্রণ খেয়েছি। এই নিমন্ত্রণ প্রসঙ্গে বজলুভাই একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, এটা হচ্ছে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ আয়োজন! কলামিস্ট ও ব্যাংকার রমণীমোহন দেবনাথ, তোলারাম কলেজের অধ্যাপক হারাধন গাঙ্গুলি, সাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তসহ কয়েকজন থাকতেন এই তালিকায়। খুবই সাদামাটা আয়োজন। ছোট্ট একটা ডাইনিং টেবিলে বসে আমরা খেতাম। মতিয়া আপা (মতিয়া চৌধুরী) নিজে খাবার তুলে দিতেন। খাওয়ার পর বসতো আড্ডা। এই আড্ডায় মতিয়া আপাও যোগ দিতেন। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হতো। রসালো সব গল্প। নানা অভিজ্ঞতা। নানা কাাহিনি। বজলুভাইয়ের সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠভাবে না মিশেছেন, তারা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না যে, তিনি কত বড় একজন রসের ভাণ্ডার ছিলেন!

২০০৩ সালে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রথম যে ঈদ আসে, সেবার বজলুভাই আমাকে ডেকে বলেন, এখন তো তুমি একইসঙ্গে নাবালক থেকে সাবালক এবং সিঙ্গেল থেকে ডাবল হয়ে গেছ। তো ঈদের দিন দুপুরে বউসহ বাসায় চলে এসো।

ঘরে ফিরে এসে বজলুভাইয়ের নিমন্ত্রণের কথা আমার বউ ববিকে বলি। বজলুভাই ও মতিয়া আপার বাসায় নিমন্ত্রণের কথা শুনেই সে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। তার মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য লক্ষ করি। ববির কাছে সেরা আকর্ষণ অবশ্যই মতিয়া আপা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে সেও মতিয়া আপা সম্পর্কে বিস্তারিত জানে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মতিয়া আপার মতো বড় মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কয়জন আছে? সেই আইয়ূববিরোধী গণঅভ্যূত্থানে যিনি 'অগ্নিকন্যা' খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, এরপর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের পর প্রতিটি আন্দোলনে, জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি প্রথম সারির নেতা, তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার অনুভূতিই আলাদা!

যা হোক, ঈদের দিন দুপুরে বজলুভাই ও মতিয়া আপার বাসায় গিয়ে ববি খুবই অবাক হয়। এর আগে মতিয়া আপা (১৯৯৬-২০০০) ছিলেন কৃষিমন্ত্রী। একজন সাবেক মন্ত্রীর বাসা যেমন হবে বলে ববি ভেবেছিল, তেমনটি সে দেখতে পায়নি। ছোট ছোট তিনটে রুম। পাঁচ-ছয়জন বসার মতো একটা সাধারণ সোফা। ছোট্ট একটা টিভি। একটা টেপ-রেকর্ডার। বাসায় তেমন কোনো আসবাব নেই। প্রত্যেক ঘরেই ছড়ানো-ছিটানো বই, দেশবিদেশের পত্রপত্রিকা। কোনো চমক নেই, জৌলুস নেই! এটা কোনো মন্ত্রীর বাড়ি হতে পারে?

আমরা যাওয়ার পর দেখলাম মতিয়া আপা রান্না করছেন। বজলু ভাই মতিয়া আপার সঙ্গে ববিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মতিয়া আপা ববিকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।

বজলুভাইসহ অন্য অতিথিদের সঙ্গে আমি আড্ডায় যোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর খাবারের টেবিলে যাবার ডাক এলো। মতিয়া আপা নিজে প্লেট ধুয়ে খাবার তুলে দিলেন। ববি মতিয়া আপাকে সাহায্য করতে চাইলে মতিয়া আপা ধমক দিয়ে বললেন, তুমি নতুন বউ। চুপ করে বসে খাও।

লাল চালের ভাত, কয়েক রকম মাছ, মুরগির মাংস, ভাজি, চাটনি দিয়ে ভাত খেলাম। প্রতিটি আইটেম মতিয়া আপা নিজ হাতে তুলে দিলেন। অসাধারণ সেই রান্না। বজলুভাই মাঝে মাঝে এসে তত্ত্বাবধান করতে থাকলেন। তবে আমার কাছে মতিয়া আপার রান্না করা চিতল মাছের কোপ্তাটাই সবচেয়ে বেশি স্বাদের বলে মনে হয়েছে। কয়েকবার খেয়েছি, অসাধারণ! এটা মতিয়া আপার চেয়ে ভালো কেউ রাঁধতে পারবেন বলে মনে হয় না! এখনও কোথাও চিতল মাছ দেখলেই মতিয়া আপার রান্না করা কোপ্তার কথা মনে পড়ে যায়!

খাবারের পর এলো ভোলা থেকে আনানো মহিষের দুধের দই। সেটাও খুব অনন্য স্বাদের। মতিয়া আপার বাড়িতেই আমরা প্রথম আঙ্গুরের আচার খাই। ববি এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখালে মতিয়া আপা ববিকে আঙ্গুরের আচার বানানোর প্রক্রিয়া বলে দেন। এর পর থেকে অবশ্য বাসায় ববি নিয়মিত এই আচার বানায়। আমার ঘনিষ্ঠজনরা অনেকেই এই আচারের স্বাদ পেয়েছেন। এটা আসলে 'মতিয়া চৌধুরী স্পেশাল'!

সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর মতিয়া আপা খেতে বসলেন। আমি আর ববি ডাইনিংয়ে বসে মতিয়া আপার সঙ্গে গল্প শুরু করলাম। খেতে খেতে তিনি ববির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করলেন। কয় ভাইবোন, কোথায় লেখাপড়া করেছে-এসব সাধারণ প্রসঙ্গ। এক পর্যায়ে ববি মতিয়া আপাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি যে বিভিন্ন দেশ সফর করেন, সেসব দেশ থেকে সাধারণত কি কেনেন? মতিয়া আপা হেসে বললেন, আমি খুব বেশি বিদেশ সফর করিনি। যে অল্প কয়েকটা দেশে গিয়েছি, সেখানে কাজ আর মিটিং করতেই তো সময় শেষ হয়ে যায়। তবে একবার ভিয়েতনামে আমার থাকার হোটেলের পাশে একটা মাছের বাজারে গিয়েছিলাম, মাছ দেখতে। সেখানে দেখলাম মাছ বিক্রেতা একটা কাঁচি দিয়ে দ্রুত বড় বড় মাছ কাটছেন। কাঁচিটা আমার খুব পছন্দ হয়। তার কাছে জেনে নিয়েছিলাম এই কাঁচি কোথায় পাওয়া যায়। ভিয়েতনাম থেকে সেবার মাছ কাটার একটা কাঁচি এনেছিলাম। বিদেশ থেকে কেনা এটাই আমার একমাত্র জিনিস! কিন্তু দুঃখের বিষয় হলে, মন্ত্রীত্ব শেষ হওয়ার পর বাসা বদলের সময় আমার সেই সাধের কাঁচিটা হারিয়ে গেছে! খেয়াল করলাম একথা বলার সময় মতিয়া আপার চোখে-মুখে একটা বিষাদের আভা ফুটে উঠেছে!

আমরা অবাক হয়ে মতিয়া আপার কথা শুনছিলাম! এ এক আশ্চর্য ধাঁতে গড়া মানুষ! কোনো ঠাঁট নেই, বিলাস নেই, কৃত্রিমতা নেই। উচিত কথা বলার ক্ষেত্রে কোনো বাছ-বিচার নেই। তার কাছে দলীয় বিবেচনা বলে কিছু নেই। কেউ তার কাছে কোনো বাড়তি সুবিধা নিতে পারেননি। মন্ত্রণালয়ে কর্মীদের সাক্ষাৎ দিতেন না, বাড়িতেও না। কারও দরখাস্তে সুপারিশও করতেন না। আদর্শ আর নীতির বাইরে তিনি কখনও চলেননি। নিজে যে আদর্শকে সেরা মনে করেছেন, সেই আদর্শ থেকে এক চুল নড়েননি। জীবনে কোনো পর্যায়ে কখনও আপোষ করেননি। রাজনীতির মঞ্চে তীব্র বাক্যবাণে প্রতিপক্ষের 'ছাল-বাকল তুলে নেওয়া' এই মানুষটি যে এত নরম, এত কোমল সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না!

ববি মতিয়া আপাকে জিজ্ঞেস করেছিল, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে বাইরে আপনার সময় কীভাবে কাটে? মতিয়া আপা মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, তোমরা যেভাবে কাটাও, আমিও সেভাবেই কাটাই। বাজার করি, ঘরের কাজ করি, মাছ কাটি, রান্না করি, পত্রিকা পড়ি, বই পড়ি, গান শুনি।

এরপর তিনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে ববির পরনের শাড়ির আচলটা আঙ্গুলে ধরে জিজ্ঞেস করেন, এটা কোথা থেকে কিনেছ? খুব সুন্দর শাড়ি! মতিয়া আপার এ সহজ-সরল আচরণে আমরা দুজনেই মুগ্ধ, বিস্মিত! সেই ক্ষণটি আমার কাছে চির-ভাস্বর হয়ে আছে।

মতিয়া আপার মতো একজন বড় মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের মতো অতি সাধারণ অতিথিদের সঙ্গে গল্প করছেন, নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াচ্ছেন, জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে?

খাওয়ার পর রান্না, গান, সিনেমা, ছোটবেলার ঈদ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে আলোচনা হলো। মতিয়া আপা, বজলুভাইসহ উপস্থিত সবাই সে আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন। ওদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমরা ফিরে আসার প্রস্তুতি নিই। ফেরার সময় আমরা মতিয়া আপা ও বজলুভাইকে প্রণাম করি। মতিয়া আপা মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন। এ সময় তিনি ববির মাথাভর্তি দীর্ঘ চুলের খুব প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, চুলগুলোর যত্ন করো। খুবই সুন্দর চুল। এখন তো আবার চুল না রাখাটাই ফ্যাশন!

…….এর পর মহাকালের গর্ভে অনেকগুলো দিন হারিয়ে গেছে। মাঝখানে কয়েক বছরে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে আমি সংবাদ এবং সাংবাদিকতা ছেড়েছি। ২০০৮ সালে বজলুভাই প্রয়াত হয়েছেন। মতিয়া আপার সঙ্গেও আর যোগাযোগ নেই।

এর মধ্যেও ঈদ আসে, ঈদ যায়। ঈদের দিন দুপুরে বজলুভাই-মতিয়া আপার বাসার সেই আপ্যায়নের কথা মনে পড়ে! বজলুভাইয়ের কথা মনে পড়ে। মতিয়া আপার কথাও!