‘স্বাধীনতা’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রথম সার্থক রূপকার নজরুল

গৌতম রায়
Published : 24 May 2020, 04:52 PM
Updated : 24 May 2020, 04:52 PM

বিশ শতকের সূচনা লগ্নে জাতীয় আন্দোলনের পর্যায়ক্রমে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার ভিতর দিয়ে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থে ভারতবাসী তথা বাংলার মানুষদের কাছে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের পর্যায়ক্রম তখন শুরু হয়েছে মুসলিম সাহিত্য সমাজ এবং শিখা গোষ্ঠী-কে কেন্দ্র করে। এই পর্বেই নিজের পত্রিকা 'গণবাণী'-তে ১৯২৬ সালে নজরুল লিখছেন- "হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই-ই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়।" (হিন্দু মুসলমান- কাজী নজরুল ইসলাম, গণবাণী, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬)

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর (১৬ জুন, ১৯২৫) বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার আবর্তে নিমজ্জিত হতে শুরু করে। সেই সময়ে বাংলার আনাচেকানাচে দাঙ্গার অনুঘটক হিসেবে হিন্দুদের মসজিদের সামনে বাজনা আর মুসলমানেদের গরু কোরবানির ঘটনাক্রম একটা বড় রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে থাকে। এই দুটি বিষয়কেই কঠোরতম সমালোচনা করে নজরুল এবং তার বিশেষ সহযোগী মুজাফ্‌ফর আহমদ যে সতর্কতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তেমনভাবে সেই সময়ে মানুষকে খুব কম জনই সতর্ক করেছিলেন।

নজরুলের 'গণবাণী'-তে এইসময়ে মুজাফ্‌ফর আহমদ লিখছেন- "মি. আবদুর করিম গজনভী (১৮৭২-১৯৩৯, ইনি ছিলেন দেলদোয়ারের জমিদার। রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসার অন্যতম পুত্র) বাজনা বাজানোর বিরুদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। গত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে তাঁর পুত্রের সহিত খান বাহাদুর আবদুল মোমেনের কন্যার বিবাহ বর্দ্ধমান জিলার মাহ্তা গ্রামে হয়ে গেছে। গজনভী সাহেব কলকাতা শহর থেকে ব্যান্ডপার্টি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। মোমেন সাহেবের বাড়ির মসজিদের সম্মুখে এই ব্যান্ডপার্টি প্রাণখুলে বাদ্য বাজিয়েছিল।"

এই ঘটনার আবার এক বিপরীতমুখী ঘটনাও সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে মুজফ্‌ফর আহমদ উল্লেখ করে লিখছেন;

"এক মাড়োয়ারী আজীবন পল্টনে আজীবন গোমাংস সরবরাহ করে একবার গোহত্যা করবার জন্যে নরহত্যার (অর্থাৎ, মুসলমান হত্যার) ব্যবস্থা করেছিল।"

মুজফ্‌ফর আহমদের এই স্মরণবাণী যেন প্রায় একশো বছর পরে  আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক-

"ভারতের একটা অতি প্রাচীন সভ্যতা ছিল। বিশ্বের দরবারে এই সভ্যতার খুব একটা বড় জায়গাও আছে, আর এ সভ্যতাটি হিন্দুর শুধু একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, এটা ভারতের মুসলমানদেরও সম্পত্তি। মুসলিম সভ্যতার ভাণ্ডারে প্রাচীন ভারতের দান নিতান্ত অল্প নহে।" 

(আনিসুজ্জামান সম্পাদিত 'মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র ' নামক ১৯৬৯ সালে সঙ্কলিত গ্রন্থে 'খোলাচিঠি' নামক কাকাবাবুর এই নিবন্ধটি সঙ্কলিত হয়েছে। 'গণবাণী' তে ১৯২৬  সালের ১২ সেপ্টেম্বর এটি প্রকাশিত হয়। সংশ্লিষ্ট সঙ্কলনের পৃষ্ঠা-২৬৬।)

হিন্দু- মুসলমান সমস্যা নিরূপনে নজরুল এবং মুজফ্‌ফর আহমদের এই যে নির্মোহ মানসিকতা, পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি- এটি যেমন সেযুগেও বিরল ছিল, আজও তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া ভার। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় দ্যোতনার উর্ধ্বে  বহু মানুষ ই উঠতে পারেন নি। এমন কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও উঠতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে প্রায় সমসাময়িককালে (১৯২৬) রবীন্দ্রনাথের লেখা 'স্বামী শ্রদ্ধানন্দ' প্রবন্ধটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-

"আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম। মুসলমানেরা তখন তাতে যোগ দেয় নি, বিরুদ্ধ ছিল। জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা হোক। জানি, ওরা যোগ দেয় নি। কিন্তু কেন দেয় নি? তখন বাঙালি হিন্দুর মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য ! কিন্তু এতবড়ো আবেগ শুধু হিন্দু সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমান সমাজকে স্পর্শ করল না। সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয়নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি।"

এই প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- "অতএব যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই- তবে জানব এ সম্ভব করেছে আমাদের দুর্বলতা।"

পশ্চিম পাঞ্জাবের বণিক সম্প্রদায় 'লালা'-দের প্রতিনিধি মুন্সী রামবিজ, আর্যসমাজীদের ধর্মান্তরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় '২৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর আবদুল রশিদ নামক এক আততায়ীর হাতে নিহত হন। এর প্রেক্ষিতে 'স্বামী শ্রদ্ধানন্দ' নামক প্রবন্ধে 'আমরা', 'ওরা' সর্বনাম প্রয়োগ করেন রবীন্দ্রনাথ। তার পাশাপাশি ঠিক একই সময়ে নজরুল সম্পাদিত 'গণবাণী' তে মুজফ্‌ফর আহমদের নির্মোহ, নিরপেক্ষ মূল্যায়ন, কোথাও 'আমরা', 'ওরা' সর্বনাম প্রয়োগের ভিতর দিয়ে জাত্যাভিমান, ধর্মাভিমানের দম্ভোক্তি নেই। নেই এতোটুকু পরধর্মের প্রতি অসূয়া, যে অসূয়ার একটা চাপা অভিব্যক্তি থেকে মুক্ত হতে পারছেন না স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই সম্যক উপলব্ধির ভিতর দিয়ে নজরুল এবং মুজফ্‌ফর আহমদের মতো মানুষ ভারতের তথা বাংলার বুকে প্রথম প্রধান সার্থকতম ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব এবং চিন্তানায়ক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।

নিয়মতান্ত্রিক কোনও সংস্কার নয়, বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) সময় থেকে বাঙালির মনে ধীরে ধীরে যে স্বাধীনতার আকাঙক্ষা দুর্বার হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, সেই আকাঙক্ষাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে পরিপূর্ণ মুক্তির ভিতর দিয়ে একটা সুসংবদ্ধ রূপ নজরুলের আগে কেউ এতোটা সুস্পষ্টভাবে দেন নি। ধর্মের অনুকূল সামাজিক ব্যবস্থাকে বঙ্কিম 'স্বাধীনতা' বলে বর্ণনা করে গিয়েছেন। রাজ্য যদি অপরের দ্বারা শাসিত হয়, সেই শাসনকে একবাক্যে পরাধীনতা বলে মানতে চাননি বঙ্কিম। পরিস্থিতিটা ধর্মের জন্যে ইতিবাচক, না নেতিবাচক- সেইটা ছিল বঙ্কিমের কাছে স্বাধীনতার নির্ণায়ক পরিচয়। আধুনিক পরিবেশে প্রাচীন ভারতীয় জীবনযাত্রাতে ফিরে আসাকেই স্বাধীনতা হিসেবে ধরেছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। গান্ধীজির কাছে স্বাধীনতা মানে ছিল- "নিজের রিপুর উপর ব্যক্তির কর্তৃত্ব।" গান্ধীভক্তদের স্বাধীনতা মানে ছিল- ক্ষমতার হস্তান্তর।

নজরুল কিন্তু ১৯২২ সালে তাঁর 'ধূমকেতু'-তে লিখছেন 

কংগ্রেস বলছে- শান্তির সাথে আর বৈধ উপায়ে আমাদেরকে স্বরাজ পেতে হবে। কিন্তু স্বরাজের স্বরূপটা কী? অশ্বডিম্ব? সকল মানুষ সমান অধিকার না পেলে স্বাধীনতা-টাধীনতা কিছু হবে না। বিদেশী কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা যেমন আবশ্যক, তেমনি আবশ্যক আমাদের দেশীয় ডাকাতদের হাত হতেও দেশের প্রাণশক্তিকে উদ্ধার করা। আমাদের ঘরে বাইরে সংগ্রাম চালাতে হবে।" 

(নজরুলের এই প্রবন্ধটির নাম 'দ্বৈপায়নের পথে'। ধূমকেতুর ষোড়শ সংখ্যা, ১৩২৯, কার্তিকে প্রকাশ)।

স্বাধীনতার অর্থ যে বিদেশিদের বিতাড়িত করে দেশিয় ডাকাতদের সুবিধা করে দেওয়া নয়- এই চরম সত্যটি প্রদম স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। এই অর্থে ক্ষমতা হস্তান্তরের এতোকাল পরেও নয়া উদার অর্থনীতির নামে ভারতের অর্থনেতিক স্বাধীনতাকে খর্ব করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নজরুলই হলেন লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান শক্তি। স্বাধীনতার জন্য ঘরে বাইরে লড়াইয়ের মন্ত্রে নজরুল আমাদের সঞ্জীবিত করে গিয়েছেন। শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবি'-তে সব্যসাচীর বিপ্লবী দুনিয়াতে কিন্তু কৃষকের কোনো ঠাঁই ছিল না। নজরুল তার পত্রিকারই নাম রেখেছিলেন- 'লাঙল'। তার ও আগে বঙ্কিম তার কমলাকান্তের মুখ দিয়ে খুব পরিষ্কার করেই বলেছিলেন: 'আমরা সমাজবিপ্লবের অনুমোদক নহি।'

দেশপ্রেমের জঠরে যে জাতীয়তাবাদ জন্ম নিয়েছিল তা অচিরেই সাম্প্রদায়িকতার কোটরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এই রূপান্তরের প্রশ্নে 'শ্রেণি' বিষয়টির কী ভূমিকা ছিল তা নজরুল, মুজফ্ফর আহমদের মতো সামান্য কিছু মানুষ ছাড়া অন্যেরা সম্যকভাবে ধারণাই করতে পারেননি। অন্যদের কথা না হয় বাদই দেওয়া হল, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-ই তা বুঝে ছিলেন কি? বুঝে থাকলে নিশ্চয়ই বলশেভিকবাদের এভাবে বিরুদ্ধতা করতেন না।

'ছোলতান' পত্রিকাকে আমরা এককথায় প্রতিক্রিয়াশীলতার তকমা দিয়ে থাকি। অথচ এই পত্রিকাটি লেনিনের মৃত্যুর পর তার প্রতি সপ্রশংস উল্লেখে বলছে- "মানবের যাহা প্রকৃত মনুষ্যত্ব, ধর্ম্মের যাহা সার, তাহা লেনিনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণেই বিদ্যমান ছিল, বস্তুত তিনি সর্ব্বতোভাবেই একজন নিষ্ঠাবান সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করিয়া গিয়াছেন।" ( ছোলতান। ৮ ম বর্ষ । ৩৮ সংখ্যা। ১৩৩০ বঙ্গাব্দ, ২৫ শে মাঘ) ।

এই পর্যায়েই ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: "ইদানীং পশ্চিমে বলশেভিজম ফ্যাসিজিম প্রভৃতি যেসব উদ্ যোগ দেখা দিয়েছে, আমরা যে তার কার্যকারণ তার আকার- প্রকার সুস্পষ্ট বুঝি তা নয়; কেবল মোটের উপর বুঝেছি যে, গুণ্ডাতন্ত্রের আখড়া জমল। এমনি আমাদের নকলনিপুণ মন গুণ্ডামিটাকেই সবচেয়ে বড় করে দেখতে বসেছে। রাশিয়ার জারতন্ত্র ও বলশেভিকতন্ত্র একই দানবের পাশ মোড়া দেওয়া।" ( রায়তের কথা) ।

এই পর্যায়ের অনেক আগেই (১৯২২ সালে) সোচ্চারে 'ধূমকেতু'-তে নজরুল লিখেছেন: "সেদিন স্বরাজপার্কের এক সভায় এক নামজাদা অসহযোগপন্থী একটা জীবন্ত সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তাঁর মতে বলশেভিজমের ধূমকেতুটা আজ বিষবাষ্পের মতো সমগ্র রুশ মুল্লুকটাকে ছারখার করে দিয়েছে। ভাগ্যে সময় থাকতে আমরা এই অহিংস অসহযোগের সুদৃঢ় কেল্লায় আশ্রয় নিয়েছিলুম- নয়ত এর ল্যাজের আগুনে গোটা আর্য্যাবর্ত্তটাই এতদিনে জ্বলে পুড়ে ভষ্মপিণ্ড হয়ে যেত।" 

নজরুল এবং ধূমকেতু আর তার লেখকেরা- সবাই কিন্তু ছিলেন পরিবর্তনকামীর মৌলিক মুখপাত্র। পূর্ণ স্বাধীনতার তারা ছিলেন সমর্থক। এদের অনেকেরই গভীর বিশ্বাস ছিল সামাজিক বিপ্লবে। এখানে বলতে হয় মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের 'সওগাত'-ও কিন্তু বলশেভিক ভয়ে কখনোই ভীত ছিল না। বলশেভিকদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা সওগাত সম্পাদক ১৯২৮ সালেই তার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছিল।

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শিথিলতা এলে কিভাবে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পায়, নিজের বাস্তব রাজনৈতিক বীক্ষণ দিয়ে সেটি উপলব্ধি করেছিলেন নজরুল। 

তাঁর সেই বীক্ষণ আজও ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। অসহযোগ আন্দোলনজনিত হতাশা, গান্ধীজীর দেওয়া এক বছরের প্রতিশ্রুতির সময় শেষ হয়ে যাওয়া- এইরকম একটা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে 'ধূমকেতু'-তে ১৯২২ সালে লেখা নজরুলের লেখা 'আনন্দময়ীর আগমনে" কেবল সেই সময়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ভিতর দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখবার প্রশ্নে প্রাসঙ্গিক ছিল, তাই-ই নয়। আজও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা যে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতাকে রুখবার প্রশ্নে একটি সুবৃহৎ হাতিয়ার, তাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়।

ছয় বছরের বন্দিকারায় গান্ধী, পাঁচ হাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে 'দানব রাজা'-কে মন্ত্রণা দিচ্ছেন সুরেন্দ্রনাথ, সংগ্রাম ভুলে যোগাসনে ধ্যানমগ্ন অরবিন্দ, বিপ্লবীরা সবাই-ই দীপান্তরে- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে আপসকামিতা-কে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের কালে এ হেন কষাঘাত, খুব কম মানু ই করেছেন। এই কবিতার দায়ে 'ধূমকেতু' র ওই সংখ্যাটি ব্রিটিশ বাজেয়াপ্ত করে। নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

বস্তুত সমসাময়িকতার নিরিখে নজরুলের সমতুল্য ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী প্রায় দেখাই যায় না। ধর্মকে কখনোই রাজনীতির সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে দেননি নজরুল। এজন্যে মুসলমান সমাজের একটা অংশের ভয়ংকর ক্রোধের মুখোমুখি নজরুলকে হতে হয়েছিল। তবুও তিনি আপস করেননি। 'ধূমকেতু'র সম্পাদক হিসেবে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তিনি যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তা গোটা বিশ্বের রাজদ্রোহীদের সেরা দশটি জবানবন্দির ভেতর একটি। এই দৃঢ়তা, নির্ভীকতা এবং আদর্শবাদিতা- সমসাময়িককালে খুব অল্প মানুষের ভেতরেই পাওয়া যায়।

মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল অংশ নজরুলকে অভিহিত করেছেন 'নাস্তিক' হিসেবে। আবার অনেক 'নিরপেক্ষ' সমালোচক এই চর্চাতেই মগ্ন থেকেছেন যে, নজরুল কি আদৌ সাহিত্যিক? কেউ কেউ নজরুলকে সাম্প্রদায়িক বলতেও ছাড়েন নি। সুকুমার সেনের মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাড়ে আট পাতা মোহিতলাল মজুমদারকে নিয়ে লিখলেও, মাত্র তিন পাতা বরাদ্দ করেছেন নজরুলের জন্যে। সেখানেও তিনি, 'নজরুলের কবিতা দারুণ সত্য অর্থে সাময়িক কবিতা' বলে স্পর্ধোক্তি করেছেন। সুকুমার সেন নজরুলকে কার্যত চৌর্যবৃত্তির অপবাদ দিয়ে 'অগ্নিবীণা' নামটিও রবীন্দ্রনাথের থেকে নেওয়া বলে উল্লেখ করেছেন (সংশ্লিষ্ট গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ড)। নজরুল যে গল্প , উপন্যাস ও পুরোমাত্রায় লিখেছেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি।