‘আমাদেরকে উদ্ধার করুন, বাঁচান’

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
Published : 24 May 2020, 03:50 PM
Updated : 24 May 2020, 03:50 PM

শুধু সাম্প্রতিককালে নয়, যখনই বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, সুন্দরবন প্রাকৃতিক রক্ষাব্যুহ হিসেবে তার পুরো হিন্টারল্যান্ড ( পশিচমবঙ্গের ২টি জেলা এবং বাংলাদেশের ৩ জেলা- সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট)-কে নিজে বুক পেতে দিয়ে রক্ষা করে। সিডরের সময় থেকেই সুন্দরবনের ভূমিকা অকৃতজ্ঞ দেশ ও সমাজ এর কাছে মিডিয়াই প্রথম তুলে আনে।

২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডর এবং ২০০৯ সালের  মে মাসে আইলা সরাসরি সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদ এর ব্যাপক প্রাণহানিসহ সুন্দরবন অভ্যন্তরে সুপেয় পানির আধার ( প্রায় ৩৪০টি) পুকুরগুলো লোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ায় খাবার পানির তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয় বনে বেঁচে যাওয়া প্রাণীরা। খাদ্যাভাবে প্রাণীকূলের মধ্যে অন্তর্কলহ ও ডোমেইন বা অধিকৃত এলাকায় থাকতে হিংস্র সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। সিডরের পরে জনপদে বাঘ চলে আসা, লিভার সিরোসিস হয়ে বাঘের মৃত্যুর ঘটনাও রিপোর্ট হয়েছিল তখন। দীর্ঘদিন পড়ে ছিল বনের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাছপালা।

সুন্দরবন ভেতরে পানির আধার সংস্কারসহ মৃত গাছপালা সংস্কারের জন্য দেরিতে হলেও বৈদেশিক সহায়তা নিয়েছিল, পেয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকেও ফান্ড পাওয়ার জন্য কম চেষ্টা করেনি সুন্দরবনের দেশ ভারত ও বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গ সুন্দরবন অভ্যন্তরে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণী সম্পদসহ অন্যান্য সম্পদ সংরক্ষণকল্পে বড় বড় প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় পশ্চিমমবঙ্গে খোদ সুন্দরবনকে রক্ষার উদ্যোগ প্রকল্পে কাজ হলেও, বাংলাদেশে সুন্দরবন এর বাইরে লোকালয়ে ক্ষেত-বেড়িবাঁধের উদ্ধার উন্নয়নে কিছু কাজ হলেও ( সেগুলোও যে দুনীর্তিগ্রস্ততায় যথাযথ বাস্তবায়িত হয়নি, তা বোঝা যায় এবার সেবার বাঁধগুলোর ঠুনকো কার্যকারিতা দেখে) খোদ সুন্দরবন এর জীববৈচিত্র্য, প্রানীসম্পদ সুরক্ষার কিছুই হয়নি। বরং স্বয়ং সুন্দরবনের প্রাকৃতিক শক্তি বিনাসের আয়োজনই চলেছে, চলছে।

সুন্দরবনের প্রকৃতি বিধ্বংসী প্রকল্প বা স্বার্থবাদী কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে বুলবুল এর আক্রমণ থেকেও সুন্দরবন যেভাবে লোকালয়কে রক্ষা করেছে তা শুধু ছিটেফোটা উল্লেখেই সীমাবদ্ধ ছিল, সুন্দরবন অভ্যন্তরের ক্ষয়ক্ষতির কোনও দুশ্চিন্তা মাথাব্যথার কারণ হয়নি, মাথায় আসেইনি। সবাই বেমালুম ভুলে যাওয়া শুরু করতেই গত ২০ মে আম্পানের আস্ফালন ও আক্রোশ সুন্দরবনই আবার ঠেকিয়ে দিল।

আজ চার দিন হলো কেন্দ্রিয় ও স্থানীয় প্রশাসন লোকালয়ে কতটা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, কতজনের মাছের ঘের নষ্ট হয়েছে, কতটা বাঁধ ভেঙেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের কতটাকা নগদ সাহায্য দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি নিয়ে বড় জোর সংবাদ সম্মেলনেই আম্পানের তাণ্ডব উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু আম্পানে সুন্দরবনের ভেতরে যে ব্যাপক হতাহত হয়েছে প্রাণিসম্পদের এবং এবারও তাদের সুপেয় পানির আধার বিনষ্ট হয়ে যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য সমূহ সর্বনাশ সামনে অপেক্ষা করছে সে ব্যাপারে কোন রিপোর্ট বা কার্যক্রমের খবর বন বিভাগের কাছ থেকে নেয়া হয়নি, যারা প্রকৃত রক্ষক সুন্দরবনের সেই প্রাণিসম্পদের হাহাকার কেউ যেন শুনতে পাচ্ছেন না।

অবিলম্বে সুপেয় পানির আধার উদ্ধার, প্রাণীকূল কোথাও ট্রাপড হয়ে আটকে থাকলে তাদের উদ্ধার, এমনকি প্রযোজ্যমত তাদের খোরাকী সরবরাহের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহনের অনিবার্যতাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে রীতিমত অন্যায়। বনবিভাগ এর তরফ থেকে অবিলম্বে সকলকে সত্য তথ্য জানানো উচিৎ। ঈদের ছুটি উদযাপনের অবকাশের বিলম্বে সুন্দরবনের প্রাণীকূলের জন্য আরো মর্মান্তিক পরিণতি কেন রোখা হবে না? সুন্দরবনের ভেতরে মৃত্যুপথযাত্রী, রক্তক্ষরণে ভোগা প্রাণিসম্পদ এর আকুল চিৎকার "আমাদেরকে উদ্ধার করুন, বাঁচান"- এটা সকলকে শুনতেই হবে।