গ্রামীণ ব্যাংক, অনিয়ম ও ড. ইউনূস

এ কে মনোওয়ারউদ্দিন আহমদ
Published : 11 Oct 2014, 07:40 AM
Updated : 11 Sept 2012, 11:35 AM

গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টি কীভাবে আলোচনায় এসেছিল সে স্মৃতি আমাদের কারও মনে ফিকে হয়ে যাওয়ার কথা নয়। ড. ইউনূস নোবেল শান্তি পাওয়ার আরও পরে, প্রায় বছর দুয়েক আগে নরওয়ের একজন সাংবাদিক একটি নরওয়েজিয়ান টিভি চ্যানেলের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। সে প্রতিবেদনটি প্রচারিত হলে তুমুল হৈচৈ শুরু হয়। কারণ প্রতিবেদনটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য অনিয়মের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণে ফান্ড ট্রান্সফারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। এ নিয়ে নরওয়ের দূতাবাস, এবং পরে নরওয়ের পার্লামেন্ট এবং মন্ত্রিপরিষদে বিষয়টি আলোচিত হতে থাকে। কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও হয়। নরওয়ের সরকারের আপত্তির মুখে একসময় গ্রামীণ কল্যাণ থেকে তহবিলটা গ্রামীণ ব্যাংকে ফেরত নেয়া হয়।

এটাই প্রমাণ করে যে এখানে কোনও না কোনও অনিয়ম হয়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ এখানেই। এরপর মিডিয়াতে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আরও লেখালেখি হতে থাকে। তাতে একটি বিষয় উঠে আসে- ড. ইউনুসের পৈতৃক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজেস কর্পোরেশনের সঙ্গেও গ্রামীণ ব্যাংকের একটি সম্পর্ক রয়েছে। অভিযোগ উঠে, ড. ইউনূস সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বা পারিবরিক স্বার্থে গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যবহার করেছেন।

এ ছাড়াও আরও দুটি বড় বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। একটি হল, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ইউনূস গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ ফান্ড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ দুটো প্রতিষ্ঠান পরে আরও কিছু লাভজনক ও অলাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গঠন করে যেগুলোর নামের আগে গ্রামীণ শব্দটি রয়েছে। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, এ সব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হচ্ছেন ড. ইউনূস। তাছাড়া ব্যাংকের ক'জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ওই সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে আছেন। সরকার এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সঙ্গত কারণেই জানতে চায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পর্ক কী। ফান্ড ট্রান্সফারের বিষয়টি কী বা গ্রামীণ ব্যাংকের যে উচ্চ সুদের হার সে ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে কিনা। দ্বিতীয় যে বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে তা হল, গ্রামীণ ব্যাংকের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর তখন পর্যন্ত কোনও রিভিউ হয়নি। তাই এ সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছিল।

এ জন্যই অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে। আমরা ২০১১ সালের প্রথমদিকে কাজ শুরু করি। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে আমি ছিলাম প্রধান। গ্রামীণ ব্যাংকের এই বিষয়গুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনাও চাওয়া হয় কমিটির কাছে। তাছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের নানা অনিয়ম নিয়ে এত দীর্ঘদিনেও কেন কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি সেটিও ছিল একটি প্রশ্ন।

আমরা যখন রিভিউ শুরু করলাম তখন সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ একটি বিষয় আমাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ল। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে আমাদের সবার ধারণা হচ্ছে এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অনেকের ধারণা এটা একটা এনজিও'র মতো। আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের সবগুলো মিটিংয়ের কার্যবিবরণী পড়ে দেখেছি। রিভিউ কমিটিকে কাজ করতে গিয়ে এটা করতে হয়েছে। আমরা দেখতে পেলাম, ব্যাংকের ৫২ তম পর্যালোচনা পর্ষদে সরকারের মনোনীত এক ডিরেক্টর বলে বসলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাই আমরা যতদিন চাইব ততদিনই ড. ইউনূস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন।' ওই পর্ষদে সভাপতিত্ব করেছিলেন ড. রেহমান সোবহান। তিনিও বললেন যে এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

সত্য হল বিপরীতটি। বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিকেল ৫২-তে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র বলতে আমরা বুঝি পার্লামেন্ট, সরকার এবং রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা (স্ট্যাটুটরি পাবলিক অথরিটি)। যে সব সংস্থা, সংগঠন বা কোম্পানির কার্যাবলি অথবা প্রধান কার্যাবলি রাষ্ট্র কর্তৃক তৈরি বিশেষ কোনও আইন, স্ট্যাটিউট বা অর্ডিন্যান্সের দ্বারা পরিচালিত হবে, সে সব প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্স জারি করেন। বাংলাদেশের সংবিধান মানলে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করলে- এটা সুস্পষ্টভাবে পরিষ্কার যে, সংবিধানের ৫২ ধারা অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক রাষ্ট্রের একটি অংশ। কারণ এটি একটি রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা। তার মানে, এটি একটি রাষ্ট্রীয় সংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিও অবশ্যই নয়।

তার মানে কী দাঁড়াল? বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এটিও একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে ১৯৭৩ সালের অর্ডিন্যান্স বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকও হয়েছে পৃথক অর্ডিন্যান্সের সাহায্যে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও বলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের সময়কার এক অর্ডিন্যান্সের বলে। এ ধরনের রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংগঠনের এমপ্লয়িরা কিন্তু পাবলিক সার্ভেন্ট। হ্যাঁ, অবশ্যই এরা প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করেন। তবে তাদের এই স্বাধীনতা দিয়েছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র চাইলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা কমাতে বা বাড়াতে পারে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক যে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এতে কোনও রকম বিতর্ক থাকার কোনও কারণ নেই। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট।

আমরা, রিভিউ কমিটি আরেকটি বিষয় জানতে পেরেছি। তা হল, আজ যে ঘটনাগুলো জনসমক্ষে আসছে, সে সব বিষয় প্রায় এক যুগ আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক তদানীন্তন সরকারের নজরে এনেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ইন্সপেকশন টিম গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যাবলী অডিট করে। এখন যে সব অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে তার বেশিরভাগই অডিট রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছিল। আমরা জানতে পেরেছি যে, অডিট রিপোর্টটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা হয়েছিল। সে আলোচনায় অর্থসচিব, ব্যাংকিং ডিভিশনের সচিবসহ দায়িদ্বশীল অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। কী কারণে তখন এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি সেটা একটা প্রশ্ন বটে। এটা খুব দু:খজনক।

১৯৮৩ সালের যে অর্ডিন্যান্সের বলে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে বেশ কয়েক জায়গায় লেখা আছে- সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। তারপরও সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ড. ইউনূসের বয়সসীমা অনেক আগেই পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনি এ পদে ছিলেন। তাই আমরা যখন রিভিউ করছিলাম তখন বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে জানিয়ে দেয় যে, ড. ইউনূস আর এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পারিচালক নেই।

ড. ইউনূস এই বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। হাইকোর্টে দীর্ঘ শুনানি হয়েছে। তবে রুল ইস্যু করা হয়নি। এর কারণ ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে শুধু তাঁর বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল- তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেয়া হয়নি। যেমন, ডিসমিসাল, টার্মিনেশন, ফোর্সড রিটায়ারমেন্ট, ডিমোশন টু আ লোয়ার পোস্ট ইত্যাদির মতো বড় কোনও শাস্তি। এমনকী মাইনর কোনও পদক্ষেপ, যেমন অ্যানুয়েল ইনক্রিমেন্ট বন্ধ বা নিন্দাজ্ঞাপনের মতো পদক্ষেপও নয়। স্বভাবতই রুলটি ডিসমিস হয়ে যায়।

ইউনূস সাহেব এরপর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেন। তারা আর্জিতে উল্লেখ করলেন যে, ইউনূস সাহেব গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এর ৯৭ ভাগ শেয়ারহোল্ডার দরিদ্র নারী। সুপ্রিম কোর্টের প্রায় ৬-৭ জন বিচারক এ বিষয়ে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ''ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রি-কারসর ছিলেন মাত্র। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা নন। তাছাড়া তিনি অবশ্যই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। কারণ গ্রামীণ ব্যাংক একটি বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যাংক নয়। এ প্রতিষ্ঠানের এমডি'র স্ট্যাটাস সোনালী বা জনতা ব্যাংকের এমডি'র সমতুল্য।'' সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হল যে গ্রামীণ ব্যাংক কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়।

আরেকটি তথ্য আমাদের জানা দরকার। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার সময় অর্ডিন্যান্সে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এই ব্যাংক গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণসুবিধা প্রদান করবে। ক্ষুদ্রঋণের কথা কিন্তু কোথাও ছিল না। এভাবে লেখা হয়েছিল, 'টু প্রোভাইড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটিজ অ্যান্ড আদার এনসিলারি সার্ভিসেস টু দ্য ল্যান্ডলেস পিপল ইন দ্য রুরাল এরিয়াস।' রুরাল এরিয়া কী হবে সেটাও নির্ধারণ করবেন সরকার, এটা অর্ডিন্যান্সে বলা হযেছিল। তবে ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি সোশ্যাল ডিসকোর্সে পরে এসেছে– এটাও দোষের কিছু নয়।

আমি বরং এখানে অন্যান্য দিক থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টিকে দেখব। ১৯৮৩ সালের অর্ডিন্যান্সে গ্রামীণ ব্যাংকের পেইড-আপ ক্যাপিটাল কত আর অথরাইজড ক্যাপিটাল কত তা নির্ধারণ করা ছিল। ১৯৮৬ সালে অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে এর পরিমাণ বাড়ানো হয়। ১৯৯০ সালের জুন মাসে আরেকবার অর্ডিন্যান্স সংশোধন করা হয়, ক্যাপিটালের পরিমাণ বাড়ানোর জন্যই। এরপর আর ক্যাপিটালের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য অর্ডিন্যান্সে কোনও সংশোধনী আনা হয়নি। ব্যবস্থাপনা পারিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে শুধু আরেকবার সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ কার্যদিবসে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্যাপিটালের পরিমাণ বাড়ানো হয় প্রশাসনিক আদেশের ভিত্তিতে। একটি মূলধন ৪০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা, আরেকটি মূলধনের পরিমাণ ৫০ কোটি থেকে ৩৫০ কোটি হয়ে যায়।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বাড়াতে পারেন। তবে এ জন্য অর্ডিন্যান্সের ধারা সংশোধন করতে হবে। কোনও প্রকার প্রশাসনিক আদেশে- অর্থমন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই মূলধনের পরিমাণ বাড়াতে পারবেন না। অবশ্যই এ জন্য পার্লামেন্টের মাধ্যমে অর্ডিন্যান্স সংশোধন করতে হবে। সেটা যে করা হয়নি তা-ও একটি অনিয়ম।

দ্বিতীয়ত, ড. ইউনূসের পক্ষে অনেকেই বলছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক দরিদ্র নারীরা। তাদের মধ্য থেকে পরিচালক নির্বাচিত হন ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমি একমত- এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্যাপিটাল স্ট্রাকচার যা-ই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। এমনকী বরোয়ারদের শতভাগ মালিক হলেও। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ শতাংশ অর্থের জোগানদাতা সরকার, বাকি ১০ শতাংশ বিশ্বদ্যিালয় নিজে জোগার করে। উল্টোটা যদি হত, তাহলে? সে ক্ষেত্রেও এটি রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা থাকবে, এর মালিকানা থাকবে রাষ্ট্রের হাতে।

কারণ মালিকানা একটি আইনি ধারণা। আমার মৃত্যু হলে আমার সম্পত্তির মালিক হবেন আমার সন্তানরা। গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারা কি এভাবে মালিকানার দাবি করতে পারবেন? আসলে গ্রামীণ নারীদের জন্য এটা একটা সান্ত্বনা। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের মালিক যেমন আমরা সবাই। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংগঠনের মালিক কিন্তু রাষ্ট্র। সরকার বদলাতে পারে, গণতান্ত্রিক থেকে আধা-সামরিক সরকার বা বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগ এভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে লোক বদলাতে পারে; গ্রামীণ ব্যাংকের অবস্থান বদলাবে না।

তাই যারা আজ বলছেন যে, সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করতে চাচ্ছেন- তাদের উদ্দেশে আমি বলব, কোন দুঃখে সরকার এটা করতে যাবেন? প্রতিষ্ঠানটির মালিক তো রাষ্ট্র। তাই সেই অর্থে সরকারেরই প্রতিষ্ঠান এটি। আমি বিশ্বাস করি যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া– কেউ চাইবেন না এই প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হোক। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, 'যত মত তত পথ।' ইসলাম ধর্মেও একই ধরনের কথা রয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন সরকারের, বিভিন্ন দলের মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। তেমনভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বা বিএনপি সরকারের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে। তাই বলে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করতে চাইবেন না কেউ-ই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক কেউ ধ্বংস করতে চাইবেন? গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশ্নে সবচেয়ে বড় বোঝার বিষয় হল সেটাই। এটি একটি স্ট্যাটুটরি পাবলিক অথরিটি বা রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা, ঠিক যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এগুলো। এই কথাটি না মানলে আমাদের রাষ্ট্র ও সংবিধানকে পুনর্ব্যাখ্যা করতে হবে। ১৯৮৩ সালে দেশের প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল' এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে এইচ এম এরশাদ একটি অর্ডিন্যান্সের বলে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তখনকার অর্থমন্ত্রী ছিলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত। তিনিই প্রফেসর ইউনূসকে অর্ডিন্যান্স পাশ করাতে সাহায্য করেছেন। কারণ তখন কৃষি ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল।

এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে, এতদিন কেন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে এ সব আইনগত বিষয় নিয়ে কোনও প্রশ্ন আসেনি? কেন প্রফেসর ইউনূসকে নির্বি্ঘ্নে অনিয়মগুলো করে যেতে দেওয়া হয়েছে? রাষ্ট্রীয় সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও এতদিন ধরে এটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিও'র মতো কাজ করেছে- এটা আমার কাছে একটা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন। রিভিউ কমিটির রিপোর্টে আমরা এই প্রশ্নটি করেছি। এ নিয়ে পলিটিক্যাল ও সোশ্যাল রিসার্চ হতে পারে।

সমস্যাটা হচ্ছে এখানেই যে, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকার মনোনীত সদস্যরা পর্যন্ত বলছেন এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা বলছেন, পর্ষদই ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে। আসল ঘটনা হল, এই পর্ষদ নমিনেশন, সুপারিশ সবই করতে পারত। আগে এই মনোনয়কে অনুমোদন দিত অর্থ মন্ত্রণালয়। এখন এর ধারা বদলে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এদের অনুমোদন ছাড়া হবে না। আদালতও কিন্তু তাই বলেছেন, 'ইট ইজ দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ হুইচ ইজ দ্য আলটিমেট রেগুলেটর অব গ্রামীণ ব্যাংক।' সম্প্রতি সরকার ধারাটা বদলে ফেলেছেন। সরকার চাইলে সুদের হারও কমাতে পারেন। যা-ই করুন না কেন, আমি মনে করি এই মুহুর্তে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ব্যাংককে আরও গতিশীল, কার্যকর ও সত্যিকারের জনকল্যাণমুখী করা। আর সে জন্য দ্রুত একজন যোগ্য, দেশপ্রেমিক, প্রতিশ্রুতিশীল ও ডায়নামিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে।

বলা হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাচিত ৮০ লাখ দরিদ্র নারী শেয়ারহোল্ডার তাদের ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেবেন। আসলে এরা কি নির্বাচিত? এরা তো তেমন শিক্ষিতও নন যে একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। তাই এখন যেহেতু সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে এর রেগুলেশনের দায়িত্ব দিয়েছেন, এখন তারা যা করবেন সবই গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত ১৯৮৩ সালের অর্ডিন্যান্সের ধারা মেনেই করবেন। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবেন একজন সরকারি এমপ্লয়ি, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

মজার ব্যাপার হল, বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় হল, এর কারণ কী? হিলারি ক্লিনটন এ দেশে এসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভাটি করেছেন ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে। তার মানে কী? একসময় গ্রামের মহাজনরা যে ব্যবসা করতেন সেটা এখন এরা করছেন। ক্ষুদ্রঋণও একটি ব্যবসা। ওরা ওয়েস্টার্ন ফাইন্যান্স ক্যাপিটালের প্রতিনিধি। আর এটা একটা মার্কেট ইকোনমি। তাহলে এখানে কোনও স্বার্থ কি নেই?

আমরা যে সুপারিশগুলো করেছি তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটির কথা উল্লেখ করছি। আমরা একটি কমিশন বা কমিটি করার কথা বলেছিলাম। কমিশন গঠিত হয়েছে এবং সেটি কাজ করছে। আমাদের সুপারিশ ছিল অবশ্য কোনও স্বাধীন রেগুলেটরের হাতে গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংককে মনিটারি পলিসি নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই অন্য কোনও রেগুলেটর এ দায়িত্বটা পালন করলে বেশি ভালো হত।

গ্রামীণ নামের যত প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর সমন্বয়ের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের আইনি কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। সেটা যত দ্রুত করা যায় তত ভালো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেষ করে দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারণ এগুলো তো সমাজের কোনও না কোনও চাহিদা পূরণ করছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্পষ্ট নই যে, এ সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আসলে কীভাবে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের উপকার করছে। তাছাড়া বলা হয়েছিল, 'রুরাল এরিয়া' কী হবে তা নির্ধারণ করবেন সরকার। কিন্তু এ সব প্রতিষ্ঠান রুরাল এরিয়াতে সবসময় কাজ করছে তা বলা যাবে না।

তাছাড়া সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণকে সমন্বয় করে একটি জাতীয় নীতি করতে হবে। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমরা সুপারিশে লিখেছি, পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসাকে সমন্বয় করে বৈধতা দেওয়া দরকার।

সমস্যা হল, গ্রামীণ টেলিকম তো গ্রামীণ ফোনের ৩৫ শতাংশের মালিক। এরা হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফা করছে। এখন কথা হল, দুস্থ মহিলারাই যদি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হন, তারা কি এই লাভের টাকার অংশীদার হচ্ছেন? হওয়া সম্ভব নয়, কারণ কোনওটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা কিন্তু নেই।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আজ যদি ক্ষুদ্রঋণ না থাকত তাহলে কী হত? গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের অবদান বেশি, নাকি গার্মেন্টস শিল্প বা অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্য কিছুটা দূর হয়েছে? যারা ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে বলছেন তারাও স্বীকার করছেন দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এটা কোনও 'মহৌষধ' নয়, এটা একটা সোশ্যাল সেফটি নেট বা সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা মাত্র। একজন নারী গার্মেন্টসে কাজ করলে সেটা তার জীবনেই মৌলিক পরিবর্তন এনে দেবে। আবার ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে নারী কিছু করছেন সেটাও একটা পরিবর্তন আনছে তার জীবনে। আরেকটি বিষয় হল মহাজনরা একসময় অনেক-অনেক বেশি উচ্চহারে সুদ ধার্য করত। সে তুলনায় গ্রামীণ ব্যাংকের ৩০ শতাংশ সুদের হার তেমন বেশি নয় কিন্তু। তাই ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার জন্য এনজিওগুলো এগিয়ে না এলে ওই মহাজনদের দাপটে দরিদ্রদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না।

আসলে আমাদের মতো দেশগুলোতে রাষ্ট্র দুর্বল। সরকারও তাই। এখন সরকারি চ্যানেলে ফান্ড বণ্টন করতে গেলে দুর্নীতির কারণে দরিদ্রদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হতে পারে। দুর্বল রাষ্ট্র বা সরকার কাঠামো দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হবে না বলেই পশ্চিমা দেশগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান বা ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে এ ধরনের এনজিওগুলোকে একভাবে মূল্যায়ন করে।

তাই আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হল, ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। কারণ গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্র এলাকাগুলোতে কাজ শুরু করার পর থেকে মহাজনরা বিদায় নিয়েছে। এরা একসময় উচ্চসুদে টাকা ধার দিয়ে বিশাল ব্যবসা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ। এটা অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে খুব বেশি নয়। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক প্রফেসন লামিয়া করিম জানিয়েছেন, নানাভাবে জোর-জবরদস্তি করে, হীন সব উপায় প্রয়োগ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের কিস্তি আদায় করা হচ্ছে। নানা সমালোচনা আছে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

আমার বিবেক তবুও বলছে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যাংকের অবদানের কথা অস্বীকার করা যাবে না। সুস্পষ্টভাবেই আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে নই। কারণ এটা তো আমাদেরই প্রতিষ্ঠান। এখন কীভাবে এই প্রতিষ্ঠান এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃঙ্খলায় এনে এগুলোকে সত্যিকারের জনকল্যাণমুখী করা যায় এটাই হল আগামীর চ্যালেঞ্জ।