পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও নাগরিকের অধিকার

Published : 10 Sept 2012, 06:00 PM
Updated : 10 Sept 2012, 06:00 PM

পাকিস্তানে মানসিক প্রতিবন্ধি এক শিশুকে কোরান অবমাননার এক সাজানো অভিযোগে অভিযুক্ত করার ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবার পর দেশের প্রচলিত ব্লাসফেমি আইন নিয়ে আবারও আলোচনার ঝড় উঠেছে। ১৪ বছর বয়সী রিমশা মশিহ-কে ইসলামাবাদের শহরতলীতে স্থানীয় মসজিদের এক ইমাম কোরান পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করলে স্থানীয় লোকজন তাকে প্রায় হত্যার জন্য উদ্যত হয়। সে অবস্থায় পুলিশ তাকে আটক করে ব্লাসফেমি আইনের আওতায়। পরে সৌভাগ্যবশত মসজিদের একজন মুসল্লি সহ তিন জন প্রত্যক্ষদর্শী জানান যে পুরোটাই ছিল ইমামের উদ্দেশ্যপ্রনোদিত – সে স্থানীয় খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানির জন্য জেনে শুনেই এই শিশুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে। এখন ইমাম খালেদ চিশতী নিজে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে।

আদালত রিমশাকে জামিন দিয়েছে। কিন্ত কারাগার থেকে তাঁর মুক্তি আর দশজনের মত হয়নি। সেনাবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টারে করে তাকে নিয়ে যেতে হয়েছে নিরাপদ অবস্থানে। আদালত ও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের অনুমান যে রিমশা এবং তাঁর পরিবার এখন আর নিরাপদ নয়। কেননা তাঁরা যে কোন সময় 'উন্মত্ত জনতার' ক্রোধের শিকার হতে পারেন। পাকিস্তানি গণমাধ্যমে রিমশার আটকের খবর এবং পরে মুসল্লিদের বক্তব্য প্রকাশিত হবার পর দেশে এবং দেশের বাইরে সমালোচনার ঝড় ওঠে – খানিকটা জনমতের চাপে পড়েই আদালত এবং কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসে।

কিন্ত পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে অভিযুক্ত হওয়া এবং বিচারের মুখোমুখি হওয়া কোন নতুন ঘটনা নয়, অস্বাভাবিক ঘটনাও নয়। পাকিস্তানের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী কত লোক যে প্রতি বছর এই অভিযোগে অভিযুক্ত হন তাঁর কোনো নির্ভরযোগ্য হিসেব পর্যন্ত নেই। কেননা গ্রামাঞ্চলে এসব অভিযোগ আনা হয় সবচেয়ে বেশি। অনেকেই এগুলো মানবাধিকার সংগঠনের গোচরে পর্যন্ত আনেন না।

অনেকেরই হয়তো জানা আছে যে পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের ভিত্তিটি উপনিবেশিক সূত্রে পাওয়া। দন্ডবিধির ২৯৫ ধারা বৃটিশ আমলে তৈরি, ১৮৬০ সালের এই আইন উপমহাদেশের তিনটি দেশ-ই বহাল রেখেছে। মূল আইনের মর্মকথা হল যে কেউ যদি ইচ্ছে করে কোন উপাসনালয় বা কোনো ধর্মের পবিত্র বস্তুর ক্ষতি সাধন করে এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে সে কোন ধর্মকে অপমান করতে চায় তবে তাকে বিচার করা যাবে এবং দু'বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া যাবে। এর একটি উপধারায় (২৯৫-এ) এই আইনের আওতায় কোনো রকম লিখিত বা মৌখিক মন্তব্যকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে কোনো ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেও তাঁর বিচারের বিধান রাখা হয়েছে। ভারতে এ জন্য দন্ডের বিধান সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত। বাংলাদেশেও এই আইন বহাল আছে।

কিন্ত ভারত বা বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পার্থক্য হল এই যে পাকিস্তান এই আইনকে কেবল যে কোনো ধর্মের অবমাননার মধ্যে রাখেনি। পাকিস্তানে দু'দফায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটো উপধারা, এবং দণ্ডের মেয়াদ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। পাকিস্তানের সেনা শাসক জিয়াউল হকের আমলে ১৯৮২ সালে (২৯৫-বি) যুক্ত করে দেয়া হয়। যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয় যে কেউ পবিত্র কোরান বা তাঁর কোনো অংশের অবমাননা করলে, কিংবা অবমাননাসূচক ভাবে ব্যবহার করলে, বা আইন বহির্ভূতভাবে ব্যবহার করলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত দেয়া যাবে। ১৯৮৬ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় তৃতীয় উপধারা যেখানে বলা হয় যে হযরত মুহাম্মদের অবমাননাকারীকে সর্বোচ্চ প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দেয়া যাবে।

পাকিস্তানী সমাজ ও রাজনীতির ইসলামিকরণে জিয়াউল হক সরকারে আরো অনেক পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই কেবল এসব সংশোধনী আনা হয়নি, আনা হয়েছে সমাজের কোনো কোনো অংশকে আইনানুগভাবেই অধিকার বঞ্চিত করার জন্য। লক্ষনীয় মূল আইন যেখানে সব ধর্মের অবমাননাকেই সমান ভাবে বিবেচনা করেছে যেখানে পাকিস্তানী সংশোধনীগুলো ইসলাম ধর্মকে দিয়েছে প্রাধান্য। তদুপরি, সর্বশেষ উপধারা সংযোজনের লক্ষ হচ্ছে আহমদিয়া গোষ্ঠিকে কোণঠাসা করা। পাকিস্তানের সংবিধানে ১৯৭৩ সালে আহমদিয়াদের অমুসলিম বলে চিহ্নিত করার পর এই আইনের মাধ্যমে তাঁদেরকে সব সময়ই এক ধরণের ভীতি ও শংকার মধ্যে নিপতিত করা হয়েছে। সেটা মোটেই কাকতালীয় নয়, পাকিস্তানী শাসক এবং উগ্র ধর্মপন্থীরা জেনে শুনেই তা করেছেন, কেননা সেটাই তাঁরা করতে চান।

এ ধরণের আইন তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যখন সাধারন মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় তখন তা বিভিন্ন রকম কারণে ও উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে এটা মোটেই বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। অবিভক্ত ভারত ও পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের এসব পরিবর্তনের আগে ৬০ বছরে (১৯২৭-১৯৮৬) মাত্র সাতটি মামলা হয়েছিলো ধর্মীয় অবমাননা বিষয়ক। আর এর পরের চিত্রটি বোঝা যায় যে অসম্পূর্ন চিত্র আমরা পাই তাতেই। ন্যাশনাল কমিশন ফর জাস্টিস এন্ড পিস নামের এক সংগঠন বলছে, গত ২৫ বছরে ১০৫৮টি মামলা হয়েছে। ২০১০ সালে ফ্রিডম হাউসের এক পলিসি ব্রিফিং-এ দেয়া হিসেবে বলা হয় যে, ১৯৮৬ থেকে এপ্রিল ২০০৬ পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৯৫ (ছয়শো পচানব্বই) জন লোক এই আইনে অভিযুক্ত হয়েছে। ইংরেজি দৈনিক ডনের হিসেব অনুযায়ী ১৯৮৪ থাকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ৯৬৪ (নয়শো চৌষট্টি)। পত্রিকাটি বলছে যে প্রায় ৫০০০ (পাঁচ হাজার) মামলা হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে এই মামলার যেগুলো আদালতে গড়িয়েছে তাঁর কিছু আন্তর্জাতিক ভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করেছে তাঁর হিসেবেই বলা যায় পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াচ্ছে।

১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সালে মাত্র ১২টি মামলা উচ্চ আদালতে হাজির হয়, ১৯৯০-৯৯ সালে তাঁর সংখ্যা ছিলো ৩৭। ২০০০-২০০৯ সালে এ ধরণের মামলার সংখ্যা হয় ৫৬। ২০১০ সালের প্রথম দু'মাসেই ৪টা মামলা হয়েছিলো। এ সব মামলায় কারা অভিযুক্ত হন? সে প্রশ্নের উত্তর এক অর্থে রিমশা মশিহ-এর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। রিমশা মশিহ – খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই এর শিকার বেশি। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন বলছে অধিকাংশ অভিযুক্ত আহমদিয়া সম্প্রদায়ের। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যে সব মামলা হয়েছে সে বিষয়ে গবেষণা করেছেন ওসমা সিদ্দিকী এবং জারা হায়াত। তাঁরা দেখান যে যতগুলো মামলা হয়েছে তাঁর মধ্যে ৪১টি মামলা হয়েছে ২৯৫ আইনের 'সি' উপধারায়। তাঁর মধ্যে ১৫টিতে আহমদিয়া, ৫টিতে খৃষ্টান, ২০ টিতে অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা অভিযুক্ত। ন্যাশনাল কমিশন ফর জাস্টিস এন্ড পিস – এর হিসেব অনুযায়ী মোট ১০৫৮ টি অভিযোগের ৪৫৬টি আহমাদিয়ার বিরুদ্ধে, অন্য মুসলিমদের বিরদ্ধে ৪৪৯ টি, খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে ১৩২ টি এবং ২১টি হিন্দুদের বিরদ্ধে। হিন্দু, আহমদিয়া এবং খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার আকার বিবেচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হয়না কতটা অসমভাবে এরা অভিযুক্ত হচ্ছেন।

এ ধরণের আইনের অপব্যবহার যতটা উদ্বেগজনক পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ততটাই উদ্বেগজনক হল সমাজের ভেতরে তাঁর প্রভাব। ভয়াবহ তথ্য হলো এই যে ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৩৫ জন অভিযুক্ত হওয়ার পরপরই খুন হয়েছেন। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের সমাজে এই আইন কেবল যে সমর্থনপুষ্ট তাই নয় এর যে কোনো ধরণের বিরোধিতা করলে তাকেও বড় ধরণের মাশুল গুনতে হয়। ২০০৯ সালে আসিয়া বিবি পাঞ্জাবের একটি গ্রামে কয়েক জন লোক দ্বারা ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। আদালতে হাজির করা সাক্ষ্য-প্রমান মোটেই সংশয়ের উর্ধে ছিল না, নারীদের বিরুদ্ধে আদালতের এক ধরণের প্রেজুডিসও স্পষ্ট ছিলো। আসিয়া বিবি খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী। আদালত তাকে প্রাণদণ্ডে দন্ডিত করে। দেড় বছর ধরে মামলা চলার সময় দেশে এবং দেশের বাইরে এই নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়। কিন্ত তাতে কোনো ফলোদয় হয় নি। মামলা এবং দন্ডের সব চেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির। তিনি দণ্ড মওকুফ এবং প্রেসিডেন্টের অনুকম্পার জন্য আবেদন করেন আসিফ জারদারির কাছে। সালমান তাসিরের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রচারনা, তাঁর পদত্যাগ দাবি করা হয়। বলা হয় যে আসিয়া বিবিকে সমর্থন করে তাসির নিজেও ধর্মের অবমাননা করেছেন এবং তারও বিচার হওয়া দরকার। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি তাঁর দেহরক্ষী মুমতাজ কাদরি তাকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর মুমতাজ কাদরি এই নিয়ে কোন রকম অনুশোচনা দেখায় নি। যখন তাকে আদালতে হাজির করা হয় তখন হাজার হাজার মানুষ ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলো। তাকে পাকিস্তানের ধর্মীয় নেতারা বীর বলে বর্ননা করেছিলো। তাঁর সমর্থনে করাচীতে যে সমাবেশ হয় তাতে পঞ্চাশ হাজার মানুষ যোগ দিয়েছিলো। সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ড দেশে কোনো পরিবর্তন আনেনি – ২ মাস পরে নিহত হন এই আইনের আরেক সমালোচক দেশের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি। ধর্ম বিশ্বাসে খৃষ্টান ভাট্টির মৃত্যু প্রমাণ করে যে সমাজের যে অবস্থানেই থাকুন না কেন সংখ্যালঘুরা, আইনের সমালোচকরা মোটেই নিরাপদ না। তারপরে লক্ষ বস্ততে পরিণত হন শেরি রাহমান। তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের দূত হিসেবে পাঠানোর পেছনে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও একটা কারণ বলে পাকিস্তানে কারো কারো ধারণা। এ ধরনের রায় দেওয়ার জন্য বিচারকেরাও বড় রকমের মাশুল গুনেছেন। ১৯৯৭ সালে লাহোরে আরিফ ইকবাল হোসেন ভাট্টি নামের একজন বিচারক ব্লাসফেমির অভিযোগ থেকে দুজনকে খালাস দেওয়ার পর তাঁর অফিস কক্ষে নিহত হন।

পাকিস্তানে প্রচলিত ব্লাসফেমি আইনে যে মানবাধিকার বিরোধী, এমন কি মানবিকতা বিরোধী সেটা বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্ট। উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যায়। রিমশা মশিহ শিশু এবং মানসিক প্রতিবন্ধি হওয়া স্বত্বেও অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির মামলাই এনেছিলো। এটা নতুন নয়। ২০০৩ সালে আনোয়ার মাসিহকে আটক করা হয় এই একই অভিযোগে, ছয় বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। কিন্ত আনোয়ার ড্রাগ আসক্ত এবং মানসিকভাবে অসুস্থ্য। ১৯৯৬ সালে জয়বুননেসাকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। কিন্ত গ্রেফতারের পর-ই একটি মেডিক্যাল বোর্ড বলেছিল যে সে মানসিকভাবে সুস্থ্য নয়। ২০১১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ সামিউল্লাহ-র বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে এক পরীক্ষার খাতায় সে হযরত মুহাম্মদকে অবমাননা করেছে। এখনও সামিউল্লাহ-র বিচার হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে আসা কয়েকটি মামলায়ও উঠে এসেছে যে অন্যান্য আইনে অভিযুক্তদের শাস্তি বিধানের জন্য যে ধরণের উঁচু মাত্রার সাক্ষ্য প্রমাণ চাওয়া হয় এই আইনের ক্ষেত্রে তা হয়না । পাকিস্তানের এই আইনটি যে পাকিস্তানের প্রচলিত অন্য আইনের সাথেও অসংগতিপূর্ন সেটাও বহুভাবে প্রমানিত।

জিয়াউল হকের আমলেই এই আইনের বিরুদ্ধে দেশের সিভিল সোসাইটি বা জন সমাজ, রাজনৈতিক দলসমূহ, মানবাধিকারকর্মী ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক সমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানালেও আজও এই আইন বহাল রয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে বহুবার বেসামরিক নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছেন সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফ, যিনি বিভিন্ন রকম সংস্কারের দাবিও করেছেন। পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় এ নিয়ে মৃদু আপত্তি করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তারা কখনোই কোনো রকম পদক্ষেপ নেয়নি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা এবং দলগুলো এই নিয়ে কথা বলার সাহসও সম্ভবত এখন আর রাখেন না। উপরন্ত সমালোচনার মুখে তাঁরা বরঞ্চ এই আইনের পক্ষেই দাঁড়ান। চলমান বিতর্কে দেশের উঠতি রাজনৈতিক নেতা ইমরান খানের বক্তব্যই তাঁর প্রমাণ। তিনি মনে করেন যে পাকিস্তানের এই আইন দেশে শান্তি রক্ষা করছে। আদালতে রুজু করা মামলা তা মোটেই বলে না। তবু রাজনীতিবিদরা সে রকম ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন তাতে করে জনপ্রিয়তার সহজ রাস্তাটি খোলা থাকে।

আশু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জন এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার লোভ থেকে পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা এই ধরণের একটি অমানবিক ও মানবতা বিরোধী আইনকে বহাল রেখে চলেছেন। তাঁর পরিণতি যে দেশের জন্য, দেশের সাধারণ মানুষের জন্য শুভ হয়নি তা সকলেই অনুমান করতে পারেন। কিন্ত ধর্মের এক ধরণের সীমিত ব্যাখ্যা এবং বৈষম্যমূলক আইন নাগরিকের অধিকারকে যেভাবে সীমিত করে দিয়েছে তা কেবল সংখ্যালঘুদের জন্যেই উদ্বেগজনক তা নয় পাকিস্তানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথেও বড় বাধা। পাকিস্তানে গণতন্ত্র যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি, বারবার সংকটের মুখে পড়ছে তার পেছনে এটাও অন্যতম কারণ। ব্লাসফেমি আইন কেবল একটি আইনের ব্যাপার নয়, এটির উপস্থিতি এবং নির্বিচার ব্যবহার প্রমাণ করে যে দেশটিতে নাগরিকের অধিকার এবং আইনের শাসন সুদূরপরাহত।

এই প্রক্রিয়াটি পাকিস্তানে এক দিনে শুরু হয়নি। রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা, আহমাদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা, উগ্রপন্থীদের প্রতি রাষ্ট্র এবং সমাজের পৃষ্ঠপোষকতার পথ ধরেই তা বিকশিত হয়েছে। রিমশা মাশিহ-র মত নাগরিকরা যখন অধিকার বঞ্চিত হয়, তখন তা কেবল আইনি বিষয় থাকেনা। তা হয়ে ওঠে নাগরিকের অধিকারের প্রশ্ন। পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা থেকে কেবল এই শিক্ষাই যথেষ্ট নয় যে ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে; এটাও বোঝা দরকার যে, আইনের চোখে সকলের সমতা নিশ্চিত না করে গণতন্ত্রের আশা কল্পনা মাত্র। এটাও বোঝা দরকার যে, দল বা গোষ্ঠির প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যত তৈরি করে।

পাকিস্তানে ব্লাসফেমি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হলেও তা থেকে কোনো রকম আশু পরিবর্তন আশা করার কারণ নেই। অতীতের মতো আবারও রাজনীতিবিদরা সহজ পথটিই বেছে নেবেন বলে অনুমান করতে পারি।
ইলিনয়, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।