নিভৃত সাধক কামালউদ্দিন খান: চেতনার অহংকার

গৌতম রায়
Published : 11 May 2020, 03:40 PM
Updated : 11 May 2020, 03:40 PM

বাঙালি মণীষার এক বিরল আলোকবর্তিকাবাহী ব্যক্তিত্ব কামালউদ্দিন খান (১০ মে ১৯০৭- ৩ অক্টোবর, ১৯৭৭)। বাঙালির ইতিহাসের বিস্মৃতপ্রায় উত্তরাধিকারের যে প্রদীপটি কামালউদ্দিন খান জ্বেলেছিলেন আজও তা নির্জন রাতে বাঙালির ঘরে আলো জ্বালে। গত শতাব্দীর দুইয়ের দশকের শেষ প্রান্তে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' এবং তাদের মুখপত্র ' শিখা'-কে কেন্দ্র করে বাংলার নবজাগরণের যে দ্বিতীয় পর্যায় উন্মোচিত হয়েছিল, সেই কার্যক্রমের অন্যতম পুরোধা কামালউদ্দিন স্বীয় ব্যক্তিত্বেই নিভৃত সাধনাকেই তাঁর জীবনের ব্রত করেছিলেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সেনানী কামালউদ্দিনের জীবন এবং সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবজাগরণের ঋত্ত্বিক হিসেবে, রেঁনেসাঁসের সন্তান হিসেবে আলোর পিপাসু যে কোনো মানুষের কাছে আজও তিনি ভীষণভাবে জীবন্ত এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। সমাজ বিকাশের স্বার্থে ইতিহাসকে একটি গঠনমূলক ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবার ভাবনা বাঙালি সমাজে বিকশিত করবার ক্ষেত্রে ইতিহাস বিজ্ঞানের আধুনিক সজ্ঞাকার ই এইচ কারের বাঙালি রূপ হিসেবে তাকে খুব পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে হয়। ইতিহাসকে যেভাবে অতীত আর বর্তমানের চিরায়ত কথোপথনের আঙ্গিকে দেখবার দিকনির্দেশ ই এইচ কার করেছিলেন, পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র কামালউদ্দিন, কারের সেই সজ্ঞা নিরুপণেরও অনেক আগে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে (ইতিহাস দর্শনের ক্ষেত্রে তখন টয়েনবির দিকনির্দেশ-ই সবাই মেনে চলতেন) তিনি যেভাবে ভূবণানয়ন ঘটালেন, দুঃখের বিষয়, বাঙালি সমাজে তার সম্যক আলোচনাও সেভাবে হয়নি বলা যেতে পারে।

বাঙালির মেরুদণ্ডের একটা সার্বিক আদর্শ হলেন কামালউদ্দিন খান এবং তাঁর পত্নী বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল। এই সদাজাগ্রত দম্পতির যাপনচিত্রের মেরুদণ্ডের শক্ত বুনিয়াদ কখনো অন্যায়ের কাছে, চাপের কাছে, ঘুষ বা ঘুসির কাছে মুহূর্তের জন্যে আত্মসমর্পন করেনি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেন মূর্ত হয়েছিলেন কামালউদ্দিনের জীবনের সামগ্রিকতার ভিতরে।

কামালউদ্দিন দেখিয়ে গিয়েছেন- মানুষ ধ্বংসের ভিতর দিয়েও নিজের বিজয়বার্তার পরাজয় ঘোষণা করে না। মানুষের অপরাজেয়তার অদম্য বার্তা ঘোষণাই যেন ছিল কামালউদ্দিন খানের জীবনবেদ। নিভৃতসাধক কামালউদ্দিনের গোটা জীবনটাই ছিল মেরুদণ্ড সোজা রেখে একটি পরিক্রমা। এই মেরুদণ্ডের দৃঢ়তার ভিতর দিয়েই তিনি যেমন আত্মজনেদের জীবনের সৌন্দর্য বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই ভূমিকা নিজের কর্মের ভিতর দিয়ে ব্যপ্ত করে গিয়েছেন অচেনা- অজানা মানুষদের উদ্দেশেও। মানবপ্রেমের মূর্ত প্রতিচ্ছবি কামালউদ্দিন এতোটাই নিভৃত সাধক ছিলেন যে তার সমকালেও খুব কম মানুষই এই হিউম্যানিস্ট-কে সম্যক জানতে পেরেছিলেন। নিজেকে নিয়ে তার নিভৃতযাপনের অঙ্গ এমনটাই ছিল যে, তার আত্মজদের কাছেও তার পরিণত বয়সের ফটোগ্রাফ প্রায় নেই-ই বলা চলে। আজকের এই প্রচারকাঙাল প্রজন্মের কাছে তাই কামালউদ্দিনকে ঘিরে হয়তো জানার আগ্রহও তেমন নেই। তবু যারা তাকে জানতেও চান না, তাদের জন্যও একটি শোষণহীন, মুক্তচিন্তার পৃথিবীর ছবি কামালউদ্দিন আজন্ম দেখেছিলেন। মানবপ্রেমের অন্তহীন জাগর হিসেবে কামালউদ্দিন আর সুফিয়া কামাল ছিলেন যেন একে অপরের পরিপূরক।

বাঙালি মুসলমানের সম্যক আধুনিকতার দিশারি কামালউদ্দিন কিন্তু নাস্তিক ছিলেন না। আবার তার ধর্মবোধকে তিনি বিজ্ঞানমনষ্কতার বাইরে কখনো উপস্থাপিত করেননি। জড়বাদ আর ভাববাদের দ্বন্দ্বের কেতাবি চর্চার ভিতরে নিমজ্জিত থেকে বাঙালির জীবনবোধের মৌলিক সূত্রকে তিনি একটি বারের জন্য ও এড়িয়ে যাননি, অস্বীকার করা তো দূরের কথা। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তার নাম কুদরত-ই-খুদা, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কাজী মোতাহার হোসেনের সাথেই একই বন্ধনীতে উচ্চারিত হওয়ার স্পর্ধা রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের এইখানেই যে, নিভৃতসাধককে ঘিরে কখনোই বাঙালি কোনোরকম উৎসাহ দেখায়নি। মানুষের ঈশ্বরকে কামালউদ্দিন যেভাবে নিজের সার্বিক বোধের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তার সম্যকচর্চার ভিতর দিয়ে, সেই বোধ যদি আমাদের জীবনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলে, আজকের এই চরম সংকটকালে মানবজাতির সার্বিক যাপনচিত্রই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

প্রকৃত ধার্মিক যে কখনো ধর্মমোহের শিকার হন না, কামালউদ্দিন খান- সুফিয়া কামালের গোটা জীবন দিয়ে তা আমাদের দেখিয়ে গিয়েছেন। প্রকৃত ধর্মপ্রাণতার সঙ্গে যে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিন্দুমাত্র সংযোগ থাকতে পারে না- এটাও কামালউদ্দিন-সুফিয়া তাদের গোটা জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। আত্মনিবেদিত মানবপ্রেমি অথচ মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণার ক্ষেত্রেও আন্তরিকতার কমতি নেই- এটাই ছিল এদের যাপনচিত্রের সব থেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য। মনুষ্যত্ব আর মানবতার মুক্তির দিশারি হিসেবে বাংলা-বাঙালির গণ্ডিকে অতিক্রম করে এরা সর্বকালের এক আন্তর্জাতিক প্রতিভু হয়ে উঠেছিলেন। সততা, সার্বিক আদর্শবোধ আর সর্বাঙ্গীন মূল্যবোধের উপর জীবন প্রতিষ্ঠিত করলে কিভাবে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে হাসিমুখে অতিক্রম করা যায় কামালউদ্দিন তার গোটা জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন। ঝড়কে সাথী করেই কী করে সংকটের মোকাবিলা করা যায়, সঙ্কোচের বিহ্বলতাকে অতিক্রম করা যায় তার জীবন্ত পাঠ হল কামালুদ্দিনের জীবন।

চট্টগ্রামের 'চুনতি'-বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা একটি নাম। বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বাংলার তথা ভারতের সমাজ জীবনে প্রোথিত করবার ক্ষেত্রে চট্গ্রামের লোহাগড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের চুনতি গ্রাম তাঁর স্বমহিমায় আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে স্থান করে নিয়েছে। এই গ্রামটির দক্ষিণপূবের পাহাড় আর উত্তর পশ্চিমের কোল বরাবর চলে গেছে আরাকান সড়ক। হালের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন এই অঞ্চলটি ছিল বাংলাতে মরমীয়া সুফী সাধকদের অন্যতম প্রাচীন আবাসভূমি। গোটা অঞ্চলটিকে সমন্বয়ী সংস্কৃতির এক তীর্থভূমি হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এই চুনতির ডেপুটি বাড়ির সন্তান ছিলেন কামালউদ্দিন। চুনতি এবং সেখানকার ডেপুটি বাড়ির একশ শতাংশ শিক্ষার অগ্রগতি বিংশ শতাব্দীর বাংলায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ছিল।

ব্যক্তি জীবনে কামালউদ্দিন ছিলেন এই চুনতির ডেপুটি বাড়ির ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন খানের দৌহিত্র তৈয়বউদ্দিন খান এবং মোছলেমা খাতুনের সন্তান। প্রখ্যাত রাজনীতিক হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সঙ্গে কামালউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার কথা অনেকে বলেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো তাদের ভেতরে কোনো আত্মীয়তা ছিল না, ছিল আত্মীয়প্রতিম বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্বের সুবাদেই হাবিবুল্লাহ বাহারের সহদোরা সেলিনা বাহার, সুফিয়া কামাল-কে আজীবন 'বৌমা' বলে সম্বোধন করেছেন। এই শতাব্দীর (একুশ শতক) সূচনাপর্বে হাবিবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত 'বুলবুলে'-র একটি নির্বাচিত সঙ্কলন বর্তমান নিবন্ধকার তুলে দেন জ্যোতি বসুর হাতে। 

তখন অবিভক্ত বাংলার আইনসভাতে হাবিবুল্লাহ বাহারের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করবার স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে তার আত্মীয় কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে পরিচয়ের প্রসঙ্গের অবতারণা জ্যোতি বাবু করেছিলেন। ৪৬-এর দাঙ্গা প্রশমনে কামালউদ্দিন এবং সুফিয়া কামালের ভূমিকার সশ্রদ্ধ উল্লেখ জ্যোতিবাবু করেছিলেন।

বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল এই নিবন্ধকারকে ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বলেছিলেন- "আমি ঘর ভাঙার নারীবাদে বিশ্বাস করি না। এই ঐতিহাসিক অভিমত সংগঠনে কামালউদ্দিন খানের চিরজাগ্রত ভূমিকার কথা না বললে, ইতিহাসের পাঠক্রমের যথার্থতা রক্ষিত হয় না। বাঙালির ভিতু বদনাম যে শুভনামের কাছে স্তব্ধ হয়ে যায়, সেই সুফিয়া কামালের 'জননী সাহসিকা' হয়ে ওঠার অবিশ্রান্ত উৎসমুখ ছিলেন কামালউদ্দিন। নিটোল দাম্পত্যজীবনের ভিতর দিয়ে নারীকে একটি উন্মুক্ত আকাশে ধ্রুবতারা স্বরূপ কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত হলেন কামালউদ্দিন। তাই গৃহের নিভৃত কোণেও কিভাবে দ্রোহের আগুন জ্বালতে পারা যায় সেই সমাজের বিরুদ্ধে যে সমাজ ঈদের বাজারে হাজার টাকার লেহেঙ্গা কেনবার ভিতর প্রগতি দেখতে পায়, আর উৎসবে দূরের কথা, অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে একমুঠো ভাত পায় না খিদের মুখে- তাদের জন্যে আজীবন লড়াই করে বুঝিয়ে গেছেন সুফিয়া কামাল। 

সুফিয়া কামাল নামক একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সর্বাঙ্গীন বিকাশে কামালউদ্দিন খান যে ঐতিহাসিক অবদান রেখে গিয়েছেন, তা কেবল ঢাকার বত্রিশ নম্বরে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক দপ্তরের কার্যালয়টির পিছনের বাড়িতেই আবদ্ধ থাকা কোনো বিষয় নয়। গোটা কার্যক্রমটিই আজ দেশ-কাল-সময়-ভাষা- লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তির বার্তার বিকাশে একটি বীজমন্ত্র হয়ে উঠেছে।

মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত (১৯২৬) হওয়ার ঠিক এক বছরের মাথাতেই কামালউদ্দিনের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল- "আমরা যে যুগে বাস করছি, এ হচ্ছে মানবতার যুগ। সাম্প্রদায়িক আন্দোলনের মুখে একবিন্দু সত্য নাই।"

(গণদাবি, 'পলিটিক্সের দুর্দশা', ১৯২৭, ৪ অগাস্ট)। কেবল উচ্চারণই নয়, হাতেকলমে এই বিশ্বাসের প্রয়োগে কামালউদ্দিন এবং সুফিয়ার ছিচল্লিশের দাঙ্গারকালে নিজের কন্যা আমেনা খাতুন (দুলু), বেগম মরিয়ম মনসুরের কন্যা জাকিয়া মনসুরকে নিয়ে পার্ক সার্কাসের লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে মেয়েদের জন্যে আশ্রয় কেন্দ্রের ঐতিহাসিক অবদানের কথা জ্যোতি বসু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। দাঙ্গায় নি:স্ব মেয়ের অর্থনেতিক পুনর্বাসনের উদ্দেশে পার্ক সার্কাসেরই কংগ্রেস এক্সজিবিশন রোডে 'রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুল' নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল সুফিয়া কামাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্কুলটি তৈরিতে এবং সেখানে শিল্পী কামরুল হাসান, তার ভাই হাসান জান আর মুকুলফৌজের কর্মীদের যুক্ত করার ক্ষেত্রেও কামালউদ্দিন খান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ সময়ে নিয়মিত তাদের বাড়িতে আসার পথে ট্রামের টিকিটের সাদা অংশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একের পর এক স্কেচ এঁকেছিলেন কামালউদ্দিন খানের। সেই স্কেচগুলি হয়তো কামালউদ্দিনের পরিবারে এখন আর সংরক্ষিত নেই। সেই স্কেচগুলির কথা বর্তমান নিবন্ধকার শুনেছিলেন কলিম শরাফির কাছে। কলিম শরাফির মতে, স্কেচগুলি জয়নুল ভাইয়ের 'দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা'-র সমতুল্য শিল্পগুণের পরিচয়বাহী ছিল।

সন্দীপের মানুষ ছিলেন মুজাফফর আহমদ। চট্টগ্রামের সাথে ভৌগলিক নৈকট্য এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐক্যের কারণে তার সঙ্গে কামালউদ্দিনের বিশেষ সখ্যতা ছিল। এ সখ্যতার কথা ব্যক্তিগত আলাপচারিতাতে জ্যোতি বসু ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছিলেন। এই সংযোগের ক্ষেত্রে কামালউদ্দিনের আত্মীয় হাবিবুল্লাহ বাহারের ভূমিকার কথাও জ্যোতিবাবু বলেছিলেন। আজ যারা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি সাংস্কৃতিক বিকাশ নিয়ে গবেষণা করেছেন, সন্দর্ভ রচনা করেছেন, তারা কেউই উল্লেখ করেননি মুজাফফর আহমদ, কামালউদ্দিন খান, হাবিবুল্লাহ বাহার এবং দিদারুল আলমের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের কথা। 

১৯২৬, '২৯ এবং '৩২ সালে নজরুল তিনবার চট্টগ্রামে এসেছিলেন। এই পর্বে কামালউদ্দিনের সাথে নজরুলের বন্ধুত্ব বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। আজকের বাঙালির কাছে প্রায় অপরিচিতই ব্যক্তিত্ব মাহবুব আলম চৌধুরী। তার লেখা, 'কাঁদাতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' একদিন বাঙালির মুখে মুখে ফিরত। এই বিস্মৃত কবিকেও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে কামালউদ্দিন খানের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কামালউদ্দিনের কাজী মোতাহার হোসেনের প্রতি ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। নিজের 'কথায় কথায়' বইটি তিনি তার 'গুরু' কাজী মোতাহার হোসেনকে উৎসর্গ করেছিলেন।

কামালউদ্দিন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, "জ্ঞান সাধনার ভিতরেই মানুষের জন্য অনন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে।" তাই আত্মমগ্ন নিভৃত সাধনাই ছিল তার সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য। তার এই নিভৃত এবং সর্বাঙ্গীন সাদাসিধে জীবনের একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে নিবন্ধের ইতি টানব।

এতোটাই নিভৃতচারী ছিলেন তিনি যে, পরিবারের মানুষদের সামান্য বিলাসিতাতেও হতবাক হয়ে পড়তেন। ঘটনাটির বিষয়বস্তু আজকের প্রজন্ম হয়তো উপলব্ধি করতে পারবেন। হয়তো পারবেন না। আজকে দরিদ্র পরিবারগুলিতেও পরিধেয়জনিত সমস্যা দেশভাগ, দাঙ্গা, সত্তরের প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা ইত্যাদি কালের মতো নেই। তাই জানি না, প্রসঙ্গটির উল্লেখ আজকের প্রজন্মের কাছে কতোখানি হৃদয়গ্রাহী হবে। তবুও কামালউদ্দিন খানকে বুঝতে এই ঘটনাটির উল্লেখ করতেই হয়।

কামালউদ্দিনের জ্যেষ্ঠা কন্যা সুলতানা তখন পড়াশুনা শেষ করেছেন। ছাত্রী থাকাকালীন স্কলারশিপের টাকাতে একটু আধটু শখ করে শাড়ি কেনেন। এমন সময়ে চোরে আলমারি ভেঙে বেশ কিছু শাড়ি চুরি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনাটি শুনবার পর কামালউদ্দিন চোরেদের কাজে বিস্মিত হননি, অবাক হয়েছিলেন, দেশের এই ভয়াবহ সঙ্কটের লগ্নে তাঁর মেয়ের স্কলারশিপের  উপার্জনে বেশ কিছু শাড়ি কিনে সেগুলি নিজের ব্যবহারের জন্যে সংরক্ষিত রাখার ঘটনা শুনে!

ক্ষণজন্মা কামালউদ্দিন-কে নিয়ে সম্যক চর্চা আজও আমাদের অন্ধকার অতিক্রমের দিশা জাগায়। দেশ-কাল-ভাষার সীমারেখা অতিক্রম করে মনীষী কামালউদ্ধিনকে অন্তরের শ্রদ্ধা, প্রণাম।