নিভৃতচারী অনন্য বিজ্ঞানীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 May 2020, 03:30 PM
Updated : 9 May 2020, 03:30 PM

বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির ঢাকা শহর রক্তে ভাসানোর বছর ১৯৫২ সালের শেষ দিকে রংপুর শহর থেকে জেলখানার দিকে এক যুবককে হাতকড়া পরিয়ে হাঁটিয়ে নিচ্ছিল পুলিশ। যুবকটি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ঘটনাটি ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে এক বালককে। স্বাধীন দেশের মানুষের কেন এ অপমান- সপ্তম শ্রেণির ছাত্র এম এ ওয়াজেদ মিয়ার মন আলোড়িত হয়। গ্রেপ্তারকৃত যুবকের নাম ছিল কাজী আবদুল হালিম, ওয়াজেদ মিয়ার নিজের এলাকা পীরগঞ্জের অধিবাসী। ভাষা আন্দোলনের কথা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ রাজনীতিকের কথা তার কাছেই প্রথম শোনেন। স্কুল বা কলেজ জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেননি তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হবার পরও পড়াশোনার বাইরে কেবল বিতর্ক অনুষ্ঠান এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডেই কেবল তাকে যুক্ত দেখা গেছে। অথচ ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের পরিবেশের মধ্যেই ফজলুল হক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়ে যান সহসভাপতি পদে। সামরিক শাসনের মধ্যেই গোপনে ছাত্রলীগের যে কেন্দ্রিয় নেতৃত্ব গঠিত হয়, তার সদস্য হিসেবে তিনি মনোনীত হন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি এবং সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে প্রবল আন্দোলন শুরু হয় তাতে তিনিসহ ওই সময়ের আরও অনেক ছাত্রনেতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৬১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তারের পর শেখ মুজিবুর রহমানই তার মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন শুরুর জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে অনুরোধ করেন। সে সময়ে আরেকটি প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নও এ আন্দোলনে সক্রিয় ছিল।

এ আন্দোলন শুরুর তৃতীয় দিনেই ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে ছোট একটি বসার ঘরে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এম এ ওয়াজেদ মিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। বাড়িটি যে এলাকায়, সেই ধানমণ্ডি প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- 'বিশেষ কোনো বাড়িঘর ছিল না, সন্ধ্যায় শেয়াল ডাকত।' এ বাড়ির সঙ্গে, সেখানে বসবাসরত পরিবারটির সঙ্গে তার জীবন যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাবে, সেটা হয়ত তিনিও ভাবেননি। মাত্র এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এ বাড়িটিই পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে বিকল্প প্রশাসন পরিচালনা করা হচ্ছিল, তার কেন্দ্রে। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনার স্বামী হিসেবে তখন এ কেন্দ্রের বাসিন্দা, সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কেবল সাক্ষী নন, সরাসরি অংশগ্রহণকারীও।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ গ্রন্থে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনা উল্লেখ করেছেন এভাবে- ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের নেতা হওয়ার 'অপরাধে' আরও অনেক ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে তিনি কারাগারে। কারাগারের ভিজিটরস রুমে যেদিন তার পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন, একই সময়ে সাক্ষাৎ ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের, তার পরিবারের সঙ্গে। তিনিই ফজলুল হক হলের সহসভাপতিকে পরিচয় করিয়ে স্ত্রী-পুত্রকন্যাদের সঙ্গে। শেখ হাসিনাও ছিলেন সেখানে।

১৯৬৭ সালের নভেম্বরে শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে। কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করার যাবতীয় প্রক্রিয়া তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। তার ফাঁসির দণ্ড হবে, এটাই সর্বসাধারণের ধারণা। আইয়ুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানে তার দোসর মোনায়েম খান প্রকাশ্যেই তাকে পাকিস্তানের দুশমন হিসেবে অভিহিত করে চলেছেন। সন্দেহ নেই, বিয়ের পর থেকেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ওপর নেমে আসা অবর্ণনীয় হয়রানি-ভোগান্তি-নিপীড়ন। অথচ তিনি নির্ভীক। নববধূকে তিনি নিয়ে তিনি ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে একের পর বৈঠক করছেন, তাদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন ক্যান্টনমেন্টে বন্দি, বিচারের নামে চলছে প্রহসন- তিনি পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখা করার প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতি পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয় জানতে চেয়ে ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদ এবং ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ ক্যান্টনমেন্টে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে যে চিঠি দিয়েছিলেন সেটা প্রহরায় থাকা আর্মির নজর এড়িয়ে শেখ হাসিনা জড়িয়ে কান্নার সময় বাবার গেঞ্জির ভেতরে গুজে দেন। পরদিন ফের দেখা করার সুযোগে ছাত্রনেতাদের জন্য শেখ মুজিবের বার্তা নিয়ে আসেন।

আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান যেন প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুুব খান আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণে সম্মত হন- সে জন্য একটি মহল তৎপর হয়। মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন এমন সর্বনাশা প্রস্তাবের ঘোরতর বিরুদ্ধে। ছাত্র নেতৃবৃন্দও ছিলেন বিরুদ্ধে। এ অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে মুক্ত করে আনে। তিনি বাঙালির প্রকৃত কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন।

ওই আন্দোলনের প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ফাঁসির দণ্ডের হুমকি তুচ্ছ করে, পায়ে দলে বাঙালির স্বার্থ আদায়ে অবিচল কীভাবে থাকা যায়- সেটা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে নিভৃতচারী, বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত ড. ওয়াজেদ মিয়ার অবদান খুব একটা আলোচনায় আসেনি। পত্রিকায় তাকে নিয়ে সংবাদ হতো না। কারণ তিনি বা তার স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যরা সেটা চাইতেন না।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পরের কয়েকটি মাসও তাকে আমরা দেখি একই অসম সাহসী ভূমিকায়। পাকিস্তানের বর্বর আর্মির হাতে যে কোনো সময়ে হত্যার শিকার হওয়ার হুমকি। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল পালিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল আর্মির কঠোর নজরদারি এড়িয়ে উধাও- যোগ দিয়েছে মুজিবনগর সরকার গঠিত মুক্তি বাহিনীতে। ড. ওয়াজেদ মিয়া বিচক্ষণতার সঙ্গে তাদের শুধু বিভ্রান্ত করেননি- শেখ জামালকে তারাই গায়েব করে দিয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করেন।

ড. ওয়াজেদ মিয়া, তার স্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধু নিজে সর্বদা ড. ওয়াজেদ মিয়াকে বিজ্ঞানের জন্য নিবেদিত হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার ধারেকাছেও তিনি ছিলেন না। লোভ-মোহ তাকে বিন্দুমাত্র আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু দেশের রাষ্ট্রপতি, বাকশালের চেয়ারম্যান। কিন্তু তার জামাতা দেশের বাইরে, গবেষণায় নিজেকে উজার করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সৌভাগ্য, তার এ অনন্য গুণের কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পান। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব অর্পিত হয় শেখ হাসিনার ওপর। তিনি পিতার মতোই মৃত্যুভয়ে ভীত নন। ১৭ মে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ বিকেলে পা রাখেন বাংলাদেশের মাটিতে। ড. ওয়াজেদ মিয়া পরম মমতায় আগলে রাখেন শিশু পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে। শেখ রেহানাও তার সঙ্গে। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এ অধ্যায়ে তার ভূমিকাও অনালোচিত। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। সে সময়ে ড. ওয়াজেদ মিয়া পরমাণু শক্তি কমিশনে কর্মরত। এ প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্প নিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে আলোচনার সময় তিনি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এ বৈঠক প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, পুরো সময়টি তিনি প্রশাসনিক অনুশাসন মেনে চলেছেন।

বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া Fundamentals of Thermodynamics এবং Fundamentals of Electromagnatics
নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ছাত্রছাত্রীদের জন্য। 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ' গ্রন্থটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনন্য দলিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে শুধু নয়, 'বাংলাদেশ অধ্যয়নে' এর তুল্য গ্রন্থ কমই আছে। তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও অনেক কিছু ভবিষ্যতে হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। তার ছাত্রছাত্রী ও এক সময়ের সহকর্মীরাও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে পারেন।

প্রয়াণ দিবসে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।