ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ : কতটা যুক্তিযুক্ত

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 5 Sept 2012, 06:07 PM
Updated : 5 Sept 2012, 06:07 PM

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা — অনেক ঘটনা, রটনা, লেখালেখি, বাক্যালাপ, প্রেস ব্রিফিং, ধর পাকড়, আদলত, রিট, মন্ত্রী মহোদয়ের বানী আরও কত কি !! কিন্তু এসব কেন? কার জন্যই বা এত সব কিছু? কারা এতে লাভবান আর কারাই বা এত ভূক্তভোগী ?

'ভর্তি পরীক্ষা' এই পদ্ধতিটি-ই তো সকল বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দু, তাই না? বোধকরি পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যেখানে তথাকথিত এই 'ভর্তি পরীক্ষা' প্রথা প্রচলিত। পূর্ববর্তী পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেডের উপর নির্ভর করে কে কোথায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে তা নির্ধারিত হওয়া যৌক্তিক। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় আরও কিছু প্রেক্ষাপটকে নিঃসন্দেহে আমলে আনতে হবে, অন্যথায় বাস্তবতা বিবর্জিত প্রক্রিয়ার প্রয়োগ কখনোই যুক্তি সঙ্গত এবং ফলপ্রসু কিছু বয়ে আনবে না।

বাংলাদেশে কেন এই ভর্তি পরীক্ষা প্রচলিত! স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন দিন দিন জোড়ালোভাবে উঠে আসছে এবং যদি আমি ভুল না করে থাকি তবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা সম্পৃক্ত জটিলতা এবং এর সাথে মুনাফার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে দিন দিন অধিক মনোযোগী হয়ে উঠছে, যা কোনভাবেই নিন্দনীয় নয় বরং সময়ের সাথে উচ্চশিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে এক চি‎হ্নিত করা যেতে পারে ।

তবে হ্যাঁ , 'ভর্তি পরীক্ষা' কি রাতারাতি তুলে দেয়া উচিত হবে ? উত্তর কিন্তু সরাসরি 'না', কারন ভর্তি পরীক্ষা তখনই তুলে দেয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে, বা এ উদ্যোগ তখনই ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসবে যখন সরকার এর সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু শর্ত পূরণে সক্ষম হবে। প্রথমতঃ যে শর্তটি আলোচনায় আসে তা হলো, সরকার কি আদৌ সম-মানের তথা সমান সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ শিক্ষা দেশের সর্বত্র পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে? যদি বাস্তবতা তা না হয়ে থাকে তবে একই দেশের একেক জনের জন্য একেক রকম সুবিধা দিয়ে তার আলোকে কোন বাছাই সম্পন্ন করা কি আাদৌ সমীচিন হবে ? আমরা জানি দেশের রাজধানী এবং বড় শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান ও পরিবেশ কখনোই প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে তুলনীয় নয়। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই, আমাদের প্রথিতযশা শিক্ষকগন কি শহরের স্বনামধন্য স্কুল কলেজের ব্যাপক টিউশন বাণিজ্য ছেড়ে মফস্বলের বা গ্রামে বা কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নিজেদের ব্যাপ্তি বাড়াতে উদ্যোগী হবেন? বাস্তবতা আর নিয়মের বেড়াজালে আমরা সকলেই আবদ্ধ, শিক্ষকগনও এর বাইরে নন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর একাধিক তাগিদ এবং নির্দেশের পরও কি ডাক্তারদের আমরা শহর বিমূখী করতে পেরেছি? তাঁরা তো উপজেলা শহরেও থাকতে নারাজ। বলতে বাধা নেই শিক্ষক তথা অন্যান্য পেশাজীবিদের শহরকেন্দ্রিক হয়ে থাকবার পেছনে কাজ করে এক ধরনের বদলী বাণিজ্য যা কারোই অজানা নয় ।

আবার এটাও কিন্ত চলমান বাস্তবতা যে, পাবলিক পরীক্ষাগুলো মূল্যায়নের সময় নামী দামী স্কুল কলেজের খাতা যে ভাবে মূল্যায়িত হয়, অপেক্ষাকৃত আচেনা কম প্রভাশালী প্রতিষ্ঠানের খাতা মূল্যায়নে অবচেতনভাবেই ততটা সতর্কতা অবলম্বন করা হয় না, যা কিনা মেধা আনুযায়ী গ্রেডিং নির্ধারনে কখনও কখনও শিক্ষার্থীদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করে না। কলেজের নামের জোড়ে গ্রেডের জোড় বাড়ে বৈ কি !

এরপর আসা যাক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত বাংলাদেশের কথায়। এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষাগুলো কতটা নিরাপদ প্রাকৃতিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় তা ভেবে দেখবার অবকাশ কিন্তু রয়েই যায়। প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায় কোন একটি বিশেষ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা হয়তো গ্রেডে পিছিয়ে গেল, তবে কি প্রকৃতির কাছে পরাজিত হয়ে উচ্চশিক্ষার সকল আকাংখার যবনিকা তাদেরকে এখানেই টানতে হবে ? রাজনৈতিক সামাজিক অসহিষ্ণুতার কথা বিস্তারিত আর না ই বা বললাম । প্রসঙ্গতঃ একটা ঘটনা বলি, আমার এক নিকটাত্মীয়র এইচ এস সি পরীক্ষার সিট পরেছিল ঢাকার মিরপুর এলাকায়, প্রায় ৫/৬ বছর আগের কথা, ফিজিক্স পরীক্ষার দিন ঐ এলাকায় পোষাক শ্রমিকদের ভয়াবহ গোলযোগ শুরু হয় এবং সে এক ঘন্টারও বেশী সময় পরে অনেক কষ্টে সৃষ্টে জীবন বাজি রেখে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে বটে, কিন্তু ফিজিক্স এ কম নম্বর পাওয়ার কারনে সে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক স্থানে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া থেকে বঞ্চিত হয়। যারা ভুক্তভোগী তারা বলতে পারবেন সে দিনের ঘটনা। সরকার কিন্তু খোদ রাজধানীতেই পরীক্ষা চলাকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল !

এখন 'ভর্তি পরীক্ষা' সংশ্লিষ্ট অন্য একটি প্রাসঙ্গিকতায় আসি, যা সরকারের তথা শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত কিছু মহলের বিতর্কে ইদানিং কালে জোড়ালোভাবে উঠে এসেছে । প্রসঙ্গটি হচ্ছে 'ভর্তি পরীক্ষা' এর সাথে কোচিং ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। এ ব্যপারে প্রথমেই যা স্পষ্ট করে নেয়া উচিত তা হলো , তথাকথিত 'কোচিং ব্যবসা' বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে 'ভর্তি পরীক্ষা' তুলে নেয়া কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে না। সরকার উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন তথা একে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ধীরে ধীরে 'ভর্তি পরীক্ষা' তুলে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে বৈকি এবং তা উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু 'কোচিং ব্যবসা' বন্ধের জন্য সরকার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। সমাজ থেকে চোর বাটপার মুনাফাখোর চোরাচালানকারী হঠানো যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি কোচিং ব্যবসার নামে মানুষকে ধোকা দিয়ে যারা হাতিয়ে নিচ্ছে অগনিত টাকা তাদেরকে সরকারের হঠাতে হবে দেশের প্রচলিত আইন আদালত নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে। এজন্য কেন আমার আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎকে সরকার রাতারাতি জিম্মি করবে ! কোচিং ব্যবসার নামে চাঁদাবাজি আর মুনাফাবাজি তো আর রাতের অন্ধকারে হয় না, কোচিং ব্যবসা চলে দিনের আলোতে বড় বড় সাইনবোর্ড বিলবোর্ড লাগিয়ে মহাসমারোহে। কি হাস্যকর, তবুও সরকার এদের আটকাতে পারে না—এ কি সরকারের ব্যর্থতা নাকি রসিতকতা তা বুঝা দায়। সত্যি স্যেলুকাস বড় বিচিত্র এই দেশ !

সর্বোপরি বলতে হয় 'ভর্তি পরীক্ষা' রাতারাতি তুলে নেয়া হবে অর্বাচীনের মত কাজ। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে অপেক্ষাকৃত সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষার সাথে কিছুটা গ্রেডের সংমিশ্রন পরীক্ষামূলকভাবে ভালো ফলাফল দিতে পারে এবং ভর্তি পরীক্ষাকে অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ও বিশ্লেষণধর্মী করতে পারলে তা মেধা যাচাই কার্যকরী অধিক ফলাফল এনে দিতে পারবে বলে আশা করা যায় এবং সেই সাথে কোচিং বাণিজ্যকে কোনঠাসা করবে বলে আমি মনে করি। আর একটা কথা কিন্তু না বললেই নয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে আমরা বয়োজ্যেষ্ঠরা যে তামাশা করে যাচ্ছি, তাতে আমরা লজ্জিত হচ্ছি না। কর্তা ব্যক্তি নীতি নির্ধারকগন এতে মোটেই লজ্জিত বা বিচলিত হন না কি এই জন্য যে, তাদের ছেলে মেয়েরা এ সবের উর্দ্ধে? এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের সন্তানদের ধরতে পারে নি—টাকার ওজনে তারা উতরে গেছে।

আরেকটা কথা না বললেই নয়—আমাদের সমাজে এখনও অনেক নামী দামী বিজ্ঞ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র আমলা উকিল খুঁজে পাওয়া যায় যাঁদের পিতারা কৃষক কিংবা দিন মজুর ছিলেন, হালের বলদ বা ধানী জমি বিক্রি করে তাঁরা তাঁদের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, এখনও মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব প্রতিভাবানদের মাঝপথে সমূলে উৎপাটনের জন্য কোন মহল যেন কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে না পারে বা কোন আপাতঃ উজ্জ্বল আলোকচ্ছ্বটা আমাদেরকে যেন অন্ধ না করে দেয়। নিয়ম-নীতি-পদ্ধতি পাল্টে ফেলার আগে ভাবতে হবে গভীরভাবে, দূরদর্শীতার সাথে। গা ভাসিয়ে দিলে ভেসে যাবে প্রজন্ম, পঙ্গু হবে জাতি, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে ভবিষ্যৎ ।

মাসুমা বিল্লাহ্ : গবেষক, বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এন এফ পি রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অফ গ্রোনিনগেন, দি নেদারল্যান্ডস্।