জীবনানন্দ-র উত্তরসুর

omor_sams
Published : 17 Sept 2014, 09:22 AM
Updated : 17 Sept 2014, 09:22 AM

"রবীন্দ্রনাথের কাব্যভঙ্গি বাংলাভাষাকে যতোটা প্রকাশ ক্ষমতা দিয়েছিল, জীবনানন্দের কাব্যভঙ্গি তার চাইতে খানিকটা বেশি দিয়েছে", সঞ্জয় ভট্টাচার্য-র১ এই পরিলক্ষণ মেনে নিলে ভাবা যেতে পারে যে অনুজ কবিদের হাতে প্রকাশ-ক্ষমতার বিস্তার ঘটবে। কিন্তু কালের আবাদ দেখে, ভূমেন্দ্র গুহ২ আশঙ্কা করেছেন, "তাঁর (জীবনানন্দ-র) পূর্বসূরি ছিল না, উত্তরসূরি থাকবে এ-রকম বিশ্বাস করতে খুব আশাবাদ দরকার।" উত্তরসূরি ঠিক নেই, কিন্তু উত্তরসুর যে কোথাও একেবারে পাওয়া যায় না তা নয়। উত্তরসুর পাওয়া যায় বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর মধ্যে। আমার উদ্দেশ্য এই সুরগুলোকে বার করে একটু চিনিয়ে দেয়া। আগেই বলে নি, বিনয় মজুমদারকে জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত বলা যায়; শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর সনেট এবং দু-একটি কবিতায় জীবনানন্দ-র ব্যবহার আছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর অন্তত একটি কবিতায় জীবনানন্দ আছেন।
১. বিনয় মজুমদার :
বিনয় মজুমদার প্রায় সব কবিতাই অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন। অন্য ছন্দে তাঁর কবিতা ('গীতাবলী') কদাচিৎ। তাঁর অক্ষরবৃত্তের মাত্রার বাঁট ও চলন প্রায় জীবনানন্দীয়। কোথাও তৎসম শব্দের ব্যবহার কিছু বেশি, তাই কখনো সামান্য মাইকেলী শোনায় – তাও যদি ৮+৬ বাঁট থাকে। কিছু উদ্ধৃতি দিই 'ফিরে এসো চাকা' থেকে :
কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক ।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পরে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প'ড়ে আছে –
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক'রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে
[২৯ জুন, ১৯৬২, বিনয় মজুমদার// ফিরে এসো চাকা]

চিৎকার আহ্বান নয়, গান গেয়ে ঘুম ভাঙালেও
অনেকে বিরক্ত হয়; শঙ্খমালা, তুমি কি হয়েছো ?
আজ তাই মনে হয়; তবু তুমি পৃথিবীতে আছো ।
[২২ জুন, ১৯৬২, বিনয় মজুমদার// ফিরে এসো চাকা]

করুণ চিলের মতো সারাদিন, সারাদিন ঘুরি।
ব্যথিত সময় যায়, শরীরের আর্তনাদে, যায়
জ্যোৎস্নার অনুনয় ; হায়, এই আহার্যসন্ধান।
[৩০ মে, ১৯৬২, বিনয় মজুমদার// ফিরে এসো চাকা]

কাগজের কুসুমকলিকে
ফোটাতে পারিনি আমি, অথবা সে মৃতদেহ নাকি!
এই বেদনায় ফের শিশির, বাতাস সঙ্গে নিয়ে
খুঁজেছি সঙ্গত হ্রদ,
[১৫ মার্চ, ১৯৬২, বিনয় মজুমদার// ফিরে এসো চাকা]

জীবনানন্দীয় শব্দ, শব্দবন্ধ আছে [ 'আকাশের পরে অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ' // 'শঙ্খমালা, তুমি কি হয়েছো ? আজ তাই মনে হয়' // 'তবু তুমি পৃথিবীতে আছো' // 'করুণ চিলের মতো' // 'অথবা সে মৃতদেহ নাকি' // 'একটি মোটরকার পরিচ্ছন্নভাবে চ'লে গেলো' // ], তবু মাত্রার বিন্যাস, ৩+৩+২, ২+২+২… , ৪+৬ , এইসব চলনেই সুর চেনা লাগে। বিনয়-এর প্রায় প্রত্যেক কবিতার শুরুই ৮ মাত্রায়, ৩+৩+২ অথবা ৪+৪ হোক। উদাহরণ [ কবিতার প্রথম ৮ মাত্রা ] : [ একটি উজ্জ্বল মাছ ] ; [ শিশুকালে শুনেছি যে] ; [ স্রোতপৃষ্ঠে চূর্ণ চূর্ণ ] ; [কাগজ কলম নিয়ে ] ; [ মাংশল চিত্রের কাছে ] ; [ নাকি স্পষ্ট অবহেলা ] ; [আর যদি নাই আসো ] ; [ সুগভীর মুকুরের প্রতি ] ; [ সন্তপ্ত কুসুম ফুটে ]… যাতে জীবনানন্দীয় ধাঁচ আসে শ্রুতিতে। আরো উদাহরণ দেয়া যেতো, কিন্তু প্রয়োজন নেই কেননা বিনয়ের কবিতার ধরণ মোটামুটি একটিই।
কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা আছে, 'বিশাল দুপুরবেলা// [বিশাল দুপুরবেলা চারিদিকে ফুটে আছে আকাশে আকাশে], 'কেমন মোহনা'// [কেমন মোহনা চুপে মোহনারই মতো হয়ে চারপাশে এলিয়ে রয়েছে], 'সকল বকুল ফুল'// [সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে, ফোটে শীতাতুর রাতে] – এগুলোর চলনও একই কিন্তু এসব আরও ঢিলে, অহেতুক লম্বা এবং ক্লান্তিকর।
৩ মার্চ, ১৯৬২ [ ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে কতিপয় চিল শুধু বলেছিলো ], ১৮ মে, ১৯৬২ [ ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম ], ৮ মার্চ, ১৯৬২ [ একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে ] – এ-কটিই বিনয়ের অধিক পঠিত কবিতা। 'গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ দর্শনে বিফল ব'ল্র ভেবেছিলো, অক্ষমের গান', 'প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে', 'পিপীলিকাশ্রেণী একাকী কীটের মতোন অনেক হেঁটেছি অন্ধকারে' – এ-জাতীয় উপমা নিয়ে এই কবিতাগুলোয় বিনয় যতোখানি নিজস্ব হওয়া সম্ভব ততোখানি। তাঁর বেশির ভাগ কবিতাই ভালোবাসা ফিরে পাবার আকূতি, দীর্ঘশ্বাস ও আর্তনাদ।

২. শক্তি চট্টোপাধ্যায় :
'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' গ্রন্থের সনেটগুলোয় শক্তি জীবনানন্দীয় ধাচঁ ব্যবহার করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। প্রায় সব কবিতাই ৮+৪+৬ মাত্রা প্রতি অক্ষরবৃত্তের পঙক্তিতে। জীবনানন্দ-র সুর পাওয়া যায় এই কারণে যে
• মাত্রার বাঁটে ৩+৩+২, ২+২+… , ৩+৩ চলন
• কম যুক্তাক্ষর ব্যবহার
• সাধু ক্রিয়াপদ ব্যবহার
উদাহরণ : যথাক্রমে এবং নম্বর সনেট। উদ্ধৃত করি :
অনেক শেফালি আমি দেখিয়াছি, এ-জীবনে আর
দেখিতে চাহি না কোনো শেফালিরে, শেফালি দেখুক
ঝরিতে-ঝরিতে পারে দেখে নিক অপাঙ্গে আমার
আমি কোনোদিন কিছু দেখিব না, ডুবিয়া মরিব।
অনেক জেব্রার খেলা দেখিয়াছি – ম্যুজিয়ম-লুণ্ঠিত জেব্রার
খেলা দেখি নাই, তার অলৌকিক গায়ের বুরুশ
ঝরে গিয়েছিল জানি; মৃত্যু ও স্মৃতির অবধেয়
রূপ ও মুখশ্রী নাই। জীবিতেরই কায়ক্লেশ আছে।
তাই আমি শেফালির, কিছুতেই বকুলের নয়,
শেফালি ঘড়িতে ঝরে গত মুহূর্তের স্তব্ধ কাঁটা
হলুদ বোঁটার জোরে করে দেয় চলচ্ছক্তিময় –
তাই আমি শেফালির, সৌজন্যের, অতিরিক্ততার …
তাই আমি শেফালীরই, আপাদমস্তক শেফালীরই
চাহি, কোনোদিকে কিছু দেখিব না, ডুবিয়া মরিব।
[সনেট ৩১, শক্তি চট্টোপাধ্যায়// চতুর্দশপদী কবিতাবলী]

'শেফালী'-কে প্রতীক ধরে 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর', এই মর্মকেই কিম্বা বিশিষ্ট কোনো নারীকে ইঙ্গিত করেই কবিতাটির রচনা। "অনেক জেব্রার খেলা দেখিয়াছি – ম্যুজিয়ম-লুণ্ঠিত জেব্রার খেলা দেখি নাই, তার অলৌকিক গায়ের বুরুশ ঝরে গিয়েছিল জানি" … "তাই আমি শেফালীরই … কোনোদিকে কিছু দেখিব না, ডুবিয়া মরিব", এই উচ্চারণকে 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি'-র পাশে রাখুন 'বোধ', 'সারবত্তা', 'ভালোবাসা', – আকাশ পাতাল দূরত্ব। শব্দ-ব্যবহার, মাত্রার লয়, শ্রুতিকল্প, সাধু ক্রিয়াপদ এগুলোর জন্য জীবনানন্দীয় আস্তর পাওয়া যায় কিন্তু হৃদয় ও মর্ম নেই। পরের কবিতায়ও একই দশা : "মহীনের ঘোড়াগুলি"-র পাশে জেব্রা, "ভৌত সামুদ্রিক জ্যোৎস্নার ভিতরে" "অলৌকিকতা" – জীবনানন্দীয় ইতিহাসের প্রবাহমানতার মতো কোনো গভীরতা পাওয়া যায় না। "অলৌকিকতা" জাতীয় একটা কিছু হচ্ছে, কিন্তু তার ইঙ্গিত এবং তার থেকে ভাবনার জন্য গন্তব্য আমি ঠিক পাই না। শব্দের খেলার চেষ্টা লক্ষ্য করি, কিন্তু সূক্ষ্মতা নেই – "বামনের বিষণ্ণতা বহে নেয় ও কি নারিকেল ও কি চলচ্ছবিগুলি লাফায়ে-লাফায়ে যাবে চলে" – ছবি, শ্রুতি দুটোই বেখাপ্পা।
মহীনের ঘোড়াগুলি মহীনের ঘরে ফেরে নাই
উহারা জেব্রার পাশে চরিতেছে। বাইশ জেব্রায়,
ঘোড়াগুলি অন্ধকার উতরোল সমুদ্রে দুলিছে
কালের কাঁটার মতো, ওই ঘোড়াগুলি জেব্রাগুলি
অনন্ত জ্যোৎস্নার মাঝে বশবর্তী ভূতের মতন
চরিয়া বেড়ায় ওরা – কথা কয় – কী কথা কে জানে!
মানুষের কাছে আর ফিরিবে না এ তো মনে হয়
আরো বহু কথা মনে হয়, শুধু বলিতে পারি না।
বাইশটি জেব্রা কি তবে জেব্রা নয় ? ময়ূরপঙ্খীও
হতে পারে এই ভৌত সামুদ্রিক জ্যোৎস্নার ভিতরে ?
বামনের বিষণ্ণতা বহে নেয় ও কি নারিকেল
ও কি চলচ্ছবিগুলি লাফায়ে-লাফায়ে যাবে চলে ?
ও কি মহীনের ঘোড়া ? ও কি জেব্রা নয় আমাদের ?
অলৌকিকতার কাছে সবার আকৃতি ঝরে যায়।
[সনেট ৩৭, শক্তি চট্টোপাধ্যায়// চতুর্দশপদী কবিতাবলী]
শক্তির নিজের ধরণের সনেটও আছে, তবে সংখ্যায় কম। নিচে একটি উদাহরণ। এতে কবির 'ইডিয়োসিনক্রেসি' পাই, কিন্তু কবিতার উৎকর্ষ?
ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো ।
যেদিকে দুচোখ যায় – যেতে তার খুশী লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন আর পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরীবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড়-ঝাঁপ করবো কড়া রোদে
'উল্লুক' আমায় বলবে – প্রসন্নতাপিয়াসী ভিখারী –
চেয়ালে থাপ্পড় যদি কম হয়, লাথি মারবে পোঁদে ।
[সনেট ৬৩, শক্তি চট্টোপাধ্যায়// চতুর্দশপদী কবিতাবলী]

অন্য এ কটি কবিতা, 'বহুদিন বেদনায় বহুদিন অন্ধকারে'-র অংশ :
শেষবার সেই লোক কাহাদের বিড়ালেরই সাথে
করিয়াছে মুখোমুখি দেখা !
অবহেলা তোমাদের, অবহেলা তাহার তো নয়
অমর নারীর মতো তোমরা করিতে পারো খেলা,
তাহাদের সে সময় আছে ?
এই তো সেদিন আমরা আমাদেরই জন্মদিনে করেছি গ্রহণ –
বয়সের পরচুলা।
[বহুদিন বেদনায় বহুদিন অন্ধকারে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় // হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান]

আরেকটি কবিতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কবিতাটির নাম, 'কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুচ্চমকে জাগিয়ে রেখেছিলো আমার পুরানো চাঁদ'। 'হাওয়ার রাত', অবলীলাক্রমে মনে পড়ে। জীবনানন্দের 'হাওয়ার রাত'-এ মনে হচ্ছিলো 'স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে' 'মশারিটা ফুলে'-ওঠা বিছানা; 'মৃত নক্ষত্ররা কাল জেগে উঠেছিলো … পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রর ভিতর' দেখেছেন তিনি। 'কালরাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেনঃ আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল ; আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেমে নেমে আমার জানালার ভিতর দিয়ে সাঁই-সাঁই ক'রে সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মত। হৃদয় ভ'রে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে, মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়।' শক্তি-র কবিতায় তাঁকে 'কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুচ্চমকে জাগিয়ে রেখেছিলো আমার পুরানো চাঁদ', 'পাল্লাদাস ক্ষণে ক্ষণে আমার সেই স্বপ্নছায়াময় ঘুম থেকে জাগিয়ে বলেছিলো এই তো গ্রীসদেশ, এখানে কেউ ঘুমায় না'। তিনি পাল্লাদাসের সঙ্গে 'বিদ্যুচ্চমকে' 'পুরানো চাঁদ'-এর রাতে 'গ্রীস থেকে বেড়িয়ে' ফিরলেন; 'সারারাত অকুণ্ঠ নতুন মৌসুমির মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম আমি মেঘের খাঁজে খাঁজে ছিলো আলো আর আঁধার রূপসীর বগলের কনিফেরাসের মতো'; 'যারা … নিমন্ত্রণ ক'রে নিয়ে গিয়েছিল তাদের সকলের সমাধি আমি অন্ধকারে এসেছি দেখে এপিটাফ এপিটাফ এপিটাফে ভরে গিয়েছি আমি'।
কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুচ্চমকে জাগিয়ে রেখেছিলো
আমার পুরানো চাঁদ
পাল্লাদাস ক্ষণে ক্ষণে আমার সেই স্বপ্নছায়াময় ঘুম থেকে জাগিয়ে বলেছিলো
এই তো গ্রীসদেশ, এখানে কেউ ঘুমায় না –
তখনই চাঁদ অস্পষ্ট কালো এক ঝিনুকের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো
আমার আর গ্রীসদেশ দেখা হলো না –
দেখা হল না পাল্লাদাশের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে
অসরাচর গ্রীসের হাজার হাজার বছরের শৌখিন সমাধিস্তবক
বাগানের ফুল
সারারাত অকুণ্ঠ নতুন মৌসুমির মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম আমি
মেঘের খাঁজে খাঁজে ছিলো আলো আর আঁধার
রূপসীর বগলের কনিফেরাসের মতো
কংকালের পাঁজরের মতো, নতুন ভয়েলের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল মেঘ
আমার মাথার উপর
আমার করুগেট ছাদের উপর গোলাপায়রা ছুটি- হওয়া ইস্কুলের মতন
বসেছিলো
এতো আলো, মেঘ এতো, শেফালিতলা ভরে মখমলের মতো এতো
সনির্বন্ধ গাঁদাফুল।
………………………………
কিছুক্ষণ আগে গ্রীস থেকে বেড়িয়ে ফিরলাম আমি
যারা, যারা আমায় নিমন্ত্রণ ক'রে নিয়ে গিয়েছিলো
তাদের সকলের সমাধি আমি অন্ধকারে এসেছি দেখে
এপিটাফ এপিটাফ এপিটাফে ভরে গিয়েছি আমি
চৌরঙ্গীর দশফুট উঁচু দেয়ালের মতো পোস্টারে ভরে গিয়েছি আমি
তোমায় লেখা চিঠি আমার দেড় বছর পরে ফিরেছে কাল –
এপিটাফ এপিটাফ এপিটাফে ভরে গিয়েছি আমি
কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুচ্চমকে জাগিয়ে রেখেছিলো
আমার পুরানো চাঁদ
(কাল রাতে জাগিয়ে রেখেছিলো আমায় পুরানো চাঁদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় // হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান )
শক্তির এসব কবিতায় 'ইডিয়সিনক্রেসি' আছে, কিন্তু সারবত্তা, কোনো উদ্ভাসন? জীবনানন্দ-র গদ্য কবিতার উপস্থাপন, প্রকৃতি-অতিপ্রকৃতি-র দৃশ্য বিবরণ, অসাধারণ চিত্রকল্প, চিত্র থেকে চিত্রে কল্পনা থেকে কল্পনায় ক্রমাগত বিস্তার, প্রতিটি শব্দের, ধ্বনির নিখুঁত নির্বাচন, সর্বোপরি এক খোয়াব-বাস্তবের বিচরণে মনের এই উদ্দীপনা শক্তির কবিতায় খোঁজা বৃথা। শক্তির কবিতার ধ্বনি এবং উপমা উভয়ই এবড়ো-থেবড়ো উৎকট। কবিতায় কিঞ্চিৎ জীবনানন্দীয় পলেস্তরা আছে, মর্ম ও গভীরতা নেই।

৩. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় :
'যদি নির্বাসন দাও', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় কবিতা, আবৃতিকারদের প্রিয় কবিতা। 'বাংলার মুখ আমি', 'এই ডাঙা ছেড়ে হায়' –এগুলোর থিম যা এই কবিতাটিরও তাই । প্রথম লাইনটিই কবিতার উৎসারক, যার উৎস 'পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর'। কবিতার মাঝপথে 'নেইনি কি', 'শুনিনি কি দুপুরে চিলের তীক্ষ্ণ স্বর' – এ-সব জীবনানন্দীয় শ্রুতি আছে। কিন্তু জীবনানন্দর আবহর বিস্তৃতি, দূরত্ব, গহীনতা এখানে খোঁজা বৃথা। "রূপসী বাংলা"-র কবিতা না থাকলে এখানে এই ধাঁচ আসতো কি ? কিন্তু আমাকে বলতে হবে, কবিতাটি জীবনানন্দ-র তরল সংস্করণ।

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো !
বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ –
এ আমারই সাড়ে-তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো !
…………………………………
কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি তুমি এত প্রতারক ?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলী ফুলের মতো বালিকারা হাসে
নেইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ্ণ স্বর ?

বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ
এ আমারই সাড়ে-তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো !
৪. আবুল হাসান :
আরেকজন কবিকে স্মরণ করছি, আবুল হাসান। তাঁর সঙ্গে জীবনানন্দ-র যে জায়গায় সবচেয়ে মিল সেটা শব্দ, উচ্চারণ, উপমা, টেকনিক এসব নয় বরং একটি বিশেষ বোধে – মানুষের প্রতি সহানুভূতি, মমত্ববোধে সঙ্গে-সঙ্গে বাঙলা ও বাঙালিত্বের অনুরাগে। মৃত্যুচিন্তার কবিতা হাসান লিখেছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্ব অনুভূতি ও উচ্চারণে। হ্যাঁ, একটি কবিতায় জীবনানন্দ-র লাইন স্পষ্ট :
আমরা সবাই নষ্ট ডিমের খোলস
ভেঙ্গে গেলে ভিতরে কেবল কালিমার ধারাস্রোত। লোলজিভ
শুয়োরের
অমানব অবৈধ সংক্রাম!
আমাদের গলগণ্ডে মাংশ নয় আমাদেরই অনাচারী দেশ ফলিয়াছে।
[নষ্ট ডিমের খোলস, আবুল হাসান // অগ্রন্থিত কবিতা]
এই কবিতায় হাসান সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও ব্যবহার করেছেন – উভয়কেই খুব সচেতনভাবে। একটি কবিতা 'আলেখ্য', এক তরুণের আত্মহত্যার কবিতা – আট বছর আগে-র বিষয় নিয়েও ওই কবিতার থেকে অনেক পৃথক :
মনে হলো,
দেশ-বনিতার এই উলঙ্গ অর্ধেক জিহ্বা
ঢেকে দিতে বন্দুকের খাদ্য দরকার।

যেন এও বিপন্ন বিস্ময়,
মিজে মুখোমুখি মুগ্ধ নিজের রক্তের কাছে
নতজানু হয়ে বললো, দেশ।
মনে মনে বললো বোন তুই
নকশীকাঁথার মতো সুশিক্ষিতা
হে আমার লোকায়ত পারুল বকুল
এর বেশি, কিছু না, কিচ্ছু না।
[ আলেখ্য, আবুল হাসান // অগ্রন্থিত কবিতা ]

মানুষের প্রতি মমত্ব এবং দেশ-সমাজের অবক্ষয় এই বোধ, অবলোকনের মধ্যেই দুই কবির আত্মীয়তা। কিন্তু হাসান পৃথক এবং স্ব-সত্ত্বায় প্রকাশমান। জীবনানন্দ-র 'অনন্দা' থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
একটি মৃত্যু, একটি ভূমিকা, একটি শুধু আইন
বলছে মেশিন। মেশিনপ্রতিম অধিনায়ক বলে :
সকল ভূগোল নিতে হবে নতুন ক'রে গ'ড়ে
আমার হাতে গড়া ইতিহাসের ভেতরে
নতুন সময় সীমাবলয় তো আজ আমি ;
ওদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আমার স্বত্বাধিকারকামী ;
আমি সংঘ জাতি রীতি রক্ত হলুদ নীল ;
সবুজ শাদা মেরুণ অশ্লীল
নিয়মগুলো বাতিল করি ; কালো কোর্তা দিয়ে
ওদের ধূসর পাটকিলে বফ্ কোর্তা তাড়িয়ে
আমার অনুচরের বৃন্দ অন্ধকারের বার
আলোক ক'রে কী অবিনাশ দ্বৈপ-পরিবার।
[ অনন্দা (অংশ) , জীবনানন্দ দাশ // শ্রেষ্ঠ কবিতা ]

এবং আবুল হাসানের একটি কবিতা, ১৯৭৪ এর দিককার বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে :

নকল কাগজ দিয়ে তৈরী করেছিলাম একটি মানুষ
তার সবকিছু নকল কাগজে তৈরী, তার
চোখ নকল, মুখ নকল, ভাষা নকল
তার সবকিছু নকল এলাকা।
সে মানুষ সিংহাসনে বসে এখন পা দোলায়
সে মানুষ প্লাবন প্লাবন বলে ফারাক্কার বাঁধ দিতে
প্রবল আপত্তি তোলে সেই মানুষ
হরিণ কমে যাচ্ছে সুন্দরবনে ক্রমশ, সুন্দরী কাঠের তৈরী
কোমল কার্পেট থেকে বেরিয়ে আসছে একটা খাদ্যবাহী জাহাজ। তাতে তার
আপত্তি দোলায় । বলে না এসব হবে না।
আমি প্রসব করবো নতুন স্বদেশ ।
নতুন বনভূমি। বাঘ হরিণ
চিতা ও চিলের সাম্রাজ্য ভরা আকাশ,
আমার হাঁটুর ভিতর থেকে আমি জন্ম দেবো
আমার নদী – আমার গঙ্গা কপোতাক্ষ বাঁধের শস্যক্ষেত –
[ জন্ম, আবুল হাসান // অগ্রন্থিত কবিতা ]
হাসান কি পড়েছিলেন, 'অনন্দা'? জানি না। পুরো কবিতাটি পড়া দরকার। যদি তিনি জীবনানন্দকে ব্যবহার করে থাকেন, তিনি সম্পূর্ণ আত্মস্থ করেই অন্য কবিকে গ্রহণ করেছেন। হাসানের 'জন্ম' অত্যন্ত শক্তিশালী কবিতা – প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কবিতা, চমৎকার চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে বাঁধানো – যেখানে কোনো তরলতা আদৌ নেই।
উপরে যা বলেছি, তার সারমর্ম হচ্ছে এই :
• বিনয় মজুমদারকে জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত বলা যায়, এই অর্থে যে জীবনানন্দ-র শব্দ ও ধ্বনি, লয়ের চলন তিনি অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর বিষয় প্রধানত প্রেম এবং জীবনানন্দ-র প্রেমের থেকে আলাদা। জীবনানন্দ-র কবিতার বিচিত্র বিষয়, বিস্তার, শ্রুতি-চিত্রকল্পের সূক্ষ্মতা বিনয়-এ পাওয়া যাবে না।
• শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর সনেট এবং দু-একটি কবিতায় জীবনানন্দ-র ব্যবহার আছে, কিন্তু গভীরতা নেই। বাহিরে জীবনানন্দীয় পলেস্তরা, সেটা খসালেই শক্তির মুদ্রাদোষ বেরিয়ে পড়ে।
• সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর একটি কবিতায় জীবনানন্দ-র ছায়া উল্লেখ করেছি। তবে সেটা ছায়াই, জীবনানন্দ-র মাহাত্ম্য নাগালের বাইরে ।
• আবুল হাসান-এর সঙ্গে জীবনানন্দ-র আত্মীয়তা বোধে – মানুষের প্রতি সহানুভূতি, মমত্ববোধে সঙ্গে-সঙ্গে বাঙলা ও বাঙালিত্বের অনুরাগে। ভাষা, শব্দ, চিন্তা ও চিত্রকল্পের বিস্তার – এসব যদি হাসান নিয়ে থাকেন তবে তা সম্পূর্ণ আত্মস্থ করে নিয়েছেন। শুধু একটি কবিতায় যেখানে তাঁরা কাছাকাছি, 'অনন্দা' এবং 'জন্ম'-র মধ্যে সঙ্গতি থেকেও, হাসান পৃথক।
জীবনানন্দকে পূর্বসূরী গ্রহণ করতে গেলে নিজের সুর রাখা অসাধ্য অথবা তাঁকে শুধু খোলসে জড়ানো যায় কিন্তু জীবনানন্দীয় মর্ম-সারবত্তা-অন্তরর্দীপ্তি আগলে আনা অসম্ভব।

টিকা ও গ্রন্থপঞ্জী :
১. জীবনানন্দ দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য // ভারবি
২. অস্পষ্ট রহস্যময় বড়ো পৃথিবী, তার অধিবাসী, ভূমেন্দ্র গুহ // শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে