বাংলাদেশে শিল্পবিপ্লব কেন হবে না?

এম এম আকাশ
Published : 2 Sept 2012, 01:57 PM
Updated : 2 Sept 2012, 01:57 PM

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে ইদানিং যুক্তরাষ্ট্রকে খুব উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা সাহেব এমনভাবে কথা বলছেন যেন তিনি আমাদের দেশের কোনও ট্রেড ইউনিয়ন লিডার! আমাদের শ্রমিক-স্বার্থ নিয়ে কাজ করছেন। শ্রমিকদের খুন -গুম করে ফেলা হচ্ছে এ সব নিয়ে বলছেন। এ প্রেক্ষাপটে অনেকেই এ উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে, খুব শিগগির যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণত নানা ধরনের লিবারেজ থাকে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে ড্যান মজিনা চায়ের পেয়ালায় যে ঝড় তুলছেন তার পেছনে অর্থনৈতিক কারণের চেয়ে রাজনৈতিক কারণগুলোই বেশি শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা। অবশ্যই কিছু জিওপলিটিক্যাল মোটিভ আছে তাদের। আর এমন কোনও মোটিভ থাকলেই তারা লিবারেজগুলো ব্যবহার করে। এখন আমরা যাতে তাদের আর সুযোগ করে না দিই। মজুরি বাড়ানো বা আমিনুলের মতো কোনও শ্রমিকনেতা হত্যার যথাযথ তদন্ত করে ওদের কথা বলার সুযোগগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।

পাশাপাশি এটা ঠিক যে, আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে চিরকাল যদি মজুরি কম থাকে তবে সমস্যা হতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন বেকারত্বের হার গত অর্থনৈতিক মন্দার পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ৭ থেকে ৮ শতাংশ থাকছে সবসময়। তাই একটি জবও যাতে লস্ট না হয় সে চেষ্টা করছে ওরা। আর এ জন্যই আমাদের পণ্য উৎপাদনের আকারটাকে খুব বেশি বাড়তে দিতে চাইবে না ওরা। তাতে ওদের উৎপাদনের আকার ঠিক থাকবে। আর এ চিন্তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ওপর 'কমপ্লায়েন্ট কন্ডিশন' চাপিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। 'কমপ্লায়েন্ট কন্ডিশন' মানে আমাদের শ্রমিকদের মজুরি বা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য শর্ত দেওয়া। তবে আমার ধারণা যে যুক্তরাষ্ট্রের এ স্বার্থটা অত তীব্র কোনও স্বার্থ নয়।

কারণ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে আমরা খুব লো-এন্ডে কাজ করি। তার মানে, আমরা যে পণ্যগুলো গার্মেন্টসে উৎপাদন করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাঠাচ্ছি, সে পণ্য এত কম মজুরি দিয়ে ওরা কোনও দিনও ওখানে উৎপাদন করতে পারবে না। সুতরাং ওদের ধরেই নিতে হবে যে এ সব পণ্যের জোগান আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকেই আসবে।

একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমাদের কর্মশক্তি অন্যান্য দেশে যে ধরনের কাজ করছে বা আমরা যে ধরনের পণ্য বানাচ্ছি- সেগুলোর ক্রেতা এর চেয়ে সস্তা শ্রম-বিক্রেতা বা উৎপাদক পাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে দেখুন, ড্রেনেজ পরিষ্কারের কাজটা আমাদের শ্রমিকেরা করেন। এ কাজের জন্য যে মজুরি তারা দেয় তাতে অন্য দেশের লোক পাওয়া যাবে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের জন্য ওদের অভিবাসী জনগোষ্ঠীর ছেলেদের বেশি পাঠানো হয়। ওরাই যুদ্ধক্ষেত্রে ঝুঁকি নেয়, মারা যায়। কোনও মার্কিন তরুণের কফিন এলে তো সরকারের ভোট নষ্ট হবে।

তাই মার্কিন স্ট্র্যাটিজিও এটাই যে, যত ধরনের ইনফিরিয়র জব আছে তা তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের দিয়ে করানো। বা যত ধরনের ইনফিরিয়র পণ্য আছে তা তৃতীয় বিশ্বেই উৎপাদিত হোক। ইনফিরিয়র পণ্য বলতে আমরা বোঝাচ্ছি যে সব পণ্য উৎপাদনে পরিবেশগত ঝুঁকি বা হেলথ হ্যাজার্ড বেশি আছে। যেমন, জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে এ শিল্প বিকশিত হওয়ার পেছনের কারণ হল এ শিল্পের পরিবেশগত ঝুঁকি বেশি। তাই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশেই এটা বেশি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। একসময় চীন ও ভারত কিছু ইনফিরিয়র পণ্য উৎপাদন করত। এখন আর করছে না। গত দু'বছর ধরে তারা বরং বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস পণ্য আমদানি করছে।

অর্থনীতির ভাষায় 'ফ্লাইং গিজ মডেল' বলতে একটি মডেল আছে। শীতের সময় সাইবেরিয়া থেকে যে অতিথি পাখিরা আসে ওরা একটা নিয়ম মেনে ওড়ে। সবচেয়ে প্রথম সারিতে থাকে একটি পাখি। তার পরের সারিতে দুটি। মাঝের সারিগুলোতে পাখিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়- সবচেয়ে ওপরের সারিতে রয়েছে ইউরোপ, তারপরের সারিগুলোতে উন্নত দেশগুলো- এভাবে মাঝের সারিগুলোতে মধ্য আয়ের কিছু দেশ এবং সবশেষে আমরা, উন্নয়নশীল দেশগুলো। এখন যদি আমাদের ঠিক ওপরের সারির একটি দেশ তার ওপরের সারিতে চলে যায়, তাহলে আমাদের সুযোগ আছে ওপরের সারিতে যাওয়ার। এভাবেই উড়ন্ত পাখিদের মতো বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির মধ্যে গতিশীলতা থাকে। গ্লোবাল ইকোনমি এ নিয়মে চলছে। আমরা যেহেতু একদম শেষ সারিতে রয়েছি- আরও অনেকদিন 'উড়তে' পারব আমরা।

তাই আমার মনে হয়. আমাদের গার্মেন্টস-বাজার সহজে নষ্ট হবে না, বরং আগামীতে সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা। আজ যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বন্ধ হয়, তবে আমরা ইউরোপে যাব। ভারত-চীনের মতো দেশের বাজারও তো আমাদের জন্য তৈরি হয়েছে। গ্লোবাল ইকোনমির আসলে কত পার্সেন্ট আর যুক্তরাষ্ট্র নিচ্ছে? অন্য দেশও তো আছে।

সমস্যা সেখানে নয়। অন্যদিকে। এখন আমাদের গার্মেন্টসে প্রতিবছর ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এই যে বিশাল একটা প্রবৃদ্ধি- তার একটা অংশ শ্রমিকদের সঙ্গে শেয়ার করছেন না গার্মেন্টস মালিকরা। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শ্রমিকরা কম মজুরিতে কাজ করে আসছেন। ওদিকে শিল্পের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় মালিকদের কাছে বিশাল অংকের অর্থ আসছে। এখন মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে এই প্রবৃদ্ধির অর্থ শুধু শেয়ার করছেন না তা নয়- শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের প্রকৃত মজুরিকে কনস্ট্যান্ট লেভেলে রাখার চেষ্টাও করছেন না। এটা করতে হলে শ্রমিকদের আর্থিক মজুরিকে মুদ্রাস্ফীতির হার অনুযায়ী অ্যাডজাস্ট করে নিতে হয়।

এটা তো এখানে হচ্ছে না। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করুন। আমরা আয় করছি ডলারে। ডলারের দাম এখন বেড়েছে। ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকার ওপরে গেছে ডলারের দাম। ডলারের যদি ২০ শতাংশ ডেপ্রিসিয়েশন হয়, তাহলে সবকিছুর দাম ২০ শতাংশ হারে বাড়বে। তাতেও কিন্তু মুনাফার হার ঠিকই থাকবে। মালিকরা এর সুযোগ নিয়ে মুনাফার পরিমাণ বাড়িয়ে নিচ্ছেন কিন্তু এই বাড়তি মুনাফাটা শ্রমিকদের সঙ্গে শেয়ার করছে না।

তাতে ক্ষতি হচ্ছে যেটা তা হল, শ্রমিকদের পেটে টান পড়ছে। তারা নানা সময়ে বিক্ষোভ করছেন। এ সুযোগে ঝুট মাস্তানরা গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে আগুন দিচ্ছে। এখন কথা হল, পুরো পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? আমি বলব, শ্রমিকরা অবশ্যই দায়ী নন, দায়ী মালিকদের লোভ। তারা শ্রমিকদের বৈধভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দিচ্ছেন না। তাই আমি মনে করি, মজিনা সাহেবের ধমক বা ইত্যাদির কারণে গার্মেন্টস শিল্পের কোনও ক্ষতি হবে না। বরং এই ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দেওয়ার কারণেই সমস্যাগুলো গভীর হচ্ছে।

সরকারের নিয়ম হচ্ছে- মোট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে দিতে হবে। মালিকরা বলছেন, তারা ৩ শতাংশ হারে নিট মুনাফা করছেন। তাদের হিসেবটা যদি মেনে নিই তাহলেও, আমি হিসেব করে দেখেছি- ১০০ ডলারের একটি পণ্য থেকে ৩ ডলার লাভ করলে, এই ৩ ডলারের ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে দিতে হবে। সে হিসেবে ৩ ডলারে মোট ১৫ সেন্ট হিসেবে এই অংকটা হবে বছরে ৩৭০ কোটি টাকা। এই টাকাটা ৩০ লাখ শ্রমিককে দিলে প্রত্যেকের বেতন অন্তত ৫০০ টাকা করে বাড়বে।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বাড়লে লাভ কিন্তু দু'দিক থেকেই। পুরো শিল্প সুস্থিরতা ফিরে পাবে। শ্রমিক আন্দোলন কম হলে কারখানাগুলো নিয়মিত চলবে। এই সেক্টরের মর্যাদাও অনেক বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র আজ আমাদের যে 'কমপ্লায়েন্ট কন্ডিশন' দিচ্ছে তার মূল সুরও তো এটাই- মজুরি বাড়াও, এই শিল্পকে স্ট্যান্ডার্ড করো, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন ওরা বলাবলির আগে আমরা নিজেরাই যদি সমস্যাগুলো ঠিক করে নিতে পারি, তাহলে এই পয়েন্টে ওরা আর আমাদের ধরতে পারবে না।

পাশাপাশি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিতে হবে। দুনিয়াজুড়ে শ্রমিকদের এ অধিকার স্বীকৃত। আমাদের গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যে এ নিয়ে অহেতুক ভীতি আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে গুণ্ডামি হয় কিন্তু আমাদের দেশেই খুব ভালো ইউনিয়নেরও উদাহরণ আছে। যেমন, ট্যানারি শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী। ওখানে তো কোনও সমস্যা হচ্ছে না। বরং নিয়মতান্ত্রিকবাবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায় হচ্ছে। গার্মেন্টসে এটা না থাকায় সমস্যা যেটা হচ্ছে তা হল, শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন কিন্তু তাদের দাবির কথা মালিকপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যথাযথ অথরিটি নেই। মালিকপক্ষও বুঝতে পারছেন না শ্রমিকদের দাবি কী বা কার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন শক্তিশালী হলে গার্মেন্টস শিল্পে একটা সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে।

আমাদের দেশেই একটি গার্মেন্টসে মালিক-শ্রমিক সুস্থ সম্পর্কের একটি চমৎকার উদাহরণ আছে। ওপেক্স নামের একটি গার্মেন্টসে একসময় সুপাভাইজারের কারণে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। মালিক পরে শ্রমিকদের আস্থায় নিয়ে তাদের হাতেই কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। মালিক শুধু মাস-শেষে এসে বেতন দেন আর মুনাফাটা নিয়ে যান। তার মানে, শ্রমিকদের আস্থায় নিলে কতদূর হতে পারে তার একটা বড় উদাহরণ এটি।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের সম্ভাবনা আসলে কতটুকু? মাঝে মাঝে যে অনেক নেতিবাচক কথা শোনা যায়, তার সত্যতা কী? আমাদের দেশে শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নই বা কতটা সম্ভব?

আমার মনে পড়ে বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি পারভেজ আলম চৌধুরীর সঙ্গে একটি গবেষণা নিয়ে আমার প্রচুর মতবিনিময় হয়েছে। তিনি আমাদের শিল্পের উন্নয়নের ব্যাপারে কিছু সাজেশন দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ একাটি শিল্প-বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। আর সামান্য কিছু কাজ করলেই একে এগিয়ে দেওয়া যাবে। বিশেষ করে আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। উন্নত দেশগুলোতে টেক্সটাইল শিল্পকে কেন্দ্র করেই শিল্প-বিপ্লব হয়েছে। শিল্পের বিকাশ সাধারণত এভাবে হয়- প্রথমে সুতা, তারপর গেঞ্জি, পোশাক এবং সবশেষে টেক্সটাইল। আমাদের দেশেও এটাই হচ্ছে।

দরকার দুটো কাজ। প্রথমত, এই শিল্পের শ্রমিকদের ব্যাপক ট্রেনিং দিতে হবে। এখন যেভাবে চলছে সেভাবে চলবে না। শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিও লাগবে। আর এ সব আধুনিক যন্ত্র চালাতে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে ট্রেনিংটা খুব জরুরি। ৪৬০ উপজেলার প্রতিটিতে যদি ট্রেনিং সেন্টার করে দেওয়া যায়, তবে সেখান থেকেই আধুনিক মেশিন চালানোর উপযোগী দক্ষ শ্রমশক্তি বেরিয়ে আসবে। আর দরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। ব্যস, এ দুটো হলেই আমাদের দেশে একটি শিল্প-বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া সম্ভব।

পারভেজ আলম চৌধুরীর এই সম্ভাবনাময় ভবিষতের চিন্তা কোনও অলীক কল্পনা নয়। আসলেই এটা সম্ভব। আমার গবেষণায় সেটা উল্লেখ করেছি আমি।

কেন এ দেশে শিল্প-বিপ্লব সম্ভব নয়? আমাদের একটা বিশাল শ্রমশক্তি রয়েছে। পূর্ব এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম কিন্তু শ্রম-ঘন শিল্পপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে উন্নতি করেছে। আমরা আমাদের শ্রমশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে শ্রম-ঘন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারি। শ্রম-ঘন শিল্পের বিকাশ হলে কিন্তু পশ্চিমের মতো বেকারত্ব-কেন্দ্রিক পুঁজিবাদের বিকাশ হবে না। ওখানে বিশাল পুঁিজ, শ্রমিক কম। আর আমরা করব কম পুঁজিতে বিশাল শ্রমশক্তি নিয়ে শ্রম-ঘন শিল্পের বিকাশ।

তবে শুধুমাত্র শ্রম-ঘন শিল্পপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমেও উন্নতি সম্ভব নয়। এ জন্য মজুরি-খরচ কম রাখতে হয়। আর মজুরি-খরচ কম রাখতে গেলে দেশের প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম কম রাখতে হয়। এ জন্য আবার দরকার কৃষি-বিপ্লব। তাতে খাদ্যের দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা যায়। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে আগে কৃষিতে একটা বিপ্লব হয়েছে। পাশাপাশি ভূমি-সংস্কার করে কৃষিতে একটা ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটিয়েছে তারা।

বাংলাদেশেও কিন্ত এখন কৃষিতে এই রকম একটা উল্লম্ফন হচ্ছে। কৃষিতে যে বিরাট বিকাশ ঘটেছে তা এখন না মেনে উপায় নেই। এই বিকাশের প্রথম শর্ত, প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে। আমাদের এখানে চাল প্রধান খাদ্যপণ্য। সরকার নানাভাবে এর দাম স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে এর দাম আর বাড়ছে না। কিন্তু এই সাফল্যগুলো পরিপূর্ণ করে শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে চাইলে ভূমি-সংস্কার দরকার। এই সংস্কারের মাধ্যমে আমরা বিরাট অনুৎপাদনশীল বা অনুপস্থিত মালিক শ্রেণীকে কৃষি থেকে সরিয়ে সমবায়ের মাধ্যমে মধ্য বা ক্ষুদ্র কৃষকদের হাতে জমিগুলো তুলে দিতে পারি। এটা করলে কৃষি উৎপাদন গুণগত ও পরিমাণগত দু'দিক থেকেই বাড়বে। কারণ আমরা তো শুধু বাইরের বাজার দিয়েই এ দেশে শিল্প-বিপ্লব ঘটাতে পারব না। দরকার দেশের বাজারেরও বিকাশ। এ জন্য কৃষকের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে হবে। তার মানে, কৃষি-বিপ্লব এবং শিল্প-বিপ্লব, দুটোর মেলবন্ধনের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

আমাদের দ্বিতীয় শর্ত হল, শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষা নয়, কাজ বা চাকরির জন্য নির্দিষ্ট ট্রেনিং বা শিক্ষা। ব্যস, এগুলোই হল 'কি টু দ্য মিরাকল।'

আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশটা গত কয়েক বছরে আমাদের দেশকে দু'ভাবে এগিয়ে দিয়েছে। প্রথমত, বস্তুগত উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে এটা সাংস্কৃতিক জগতেও একটা বিপ্লব ঘটিয়েছে। কে আগে ভেবেছিল যে গ্রামের সহজ-সরল মেয়েটি হয়তো বড়জোর কারও বাসায় কাজ নিতে পারত- সে একটা শিল্পের শ্রমিক হয়ে যাবে এভাবে? গ্রাম থেকে দলে দলে মেয়েরা শহরে আসছে। একা থাকতে শিখছে। কাজ করছে। এটা আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক বলয়ে বড় একটা নাড়া দিয়েছে।

সুতরাং আমি আশাবাদী। সামান্য কিছু কাজ করে দেশে একটা শিল্প বিপ্লব ঘটানোর অবস্থা আমাদের আছে। শুধু সুযোগটা নিয়ে নিতে হবে।

এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।