Published : 18 Apr 2020, 02:41 AM
মার্কস: 'দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!'
পথিক: 'দাঁড়ানোর সময় যে নাই। ওই ভয় জাগে মনে, যাই ভক্তি আহরণে।'
মার্কস: 'আপনি পথ হারাইয়াছেন!'
পথিক: 'পথ পথিকের সৃষ্টি করেনা, পথিকই পথ সৃষ্টি করে।'
মার্কস: 'কেমন আছেন'?
পথিক: 'করোনাক্রান্তি চলিতেছে দেশে। লকডাউন সোসাইটি। সঙ্গঃনিরোধ বিচ্ছিন্নতায় আছি।'
মার্কস: 'সে তো বহু আগেই বলিয়া গিয়াছিলাম, বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব?'
পথিক: 'আরে জনাব, রাখুন আপনার তত্ত্বালাপ, আমার নামাজের সময় গড়িয়ে যায়।'
মার্কস: 'তথাস্তু'!
প্রিয় পাঠক, মহামতি কার্ল মার্কস বাংলাদেশে এসেছিলেন করোনাক্রান্তিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে সেঁটেছিলেন। খবর পেয়েছেন? এই লেখার সাথে সংযুক্ত ছবিটি দেখুন। আাজিজুল ইসলাম নামের একজন নিরাপত্তাকর্মী ফুটপাতে নামাজ পড়ছেন। উপরের কাল্পনিক কথোপকোথনটি ভাবুন, দেয়ালের গ্রাফিতির মার্কসের সাথে আজিজুল ইসলামের। ঢাকায় করোনাভাইরাস সঙ্কটে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তিনি হেঁটেই যান অফিসে। গত ৯ই এপ্রিল, ২০২০ তারিখ বাসা হতে কাজে যাওয়ার মাঝে মাগরিবের সময় হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটপাতেই নামাজে বসে যান তিনি (ছবি ও তথ্য সূত্র: মাহমুদ জামান অভি/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)।
এই লেখাটি কার্ল মার্কসের প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ নয়। ত্রাতা হিসেবে তাকে তুলে আনা নয়। এটি শুধু একটি স্থিরচিত্রকে নিয়ে সামান্য দু-চারটি 'কথাবার্তা' মাত্র। তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করার ক্ষমতা বা অধিকার কোনওটাই আমার নেই। কিংবা তার সম্মন্ধে নিন্দা, পরচর্চা করাও আমার অভীপ্সা নয়। আসুন কাল্পনিক সংলাপটি চিহ্নবিদ্যার ভাবনার দরবার অব্দি এগিয়ে নিই। এই দেশের ঢাকা শহরে 'তোমার আমার ঠিকানা- পল্টন, মুক্তাঙ্গন, তোপখানা' বলে তো বহু তর্ক, বিতর্ক, পাঠচক্র, দল ভাঙা-গড়া, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব হলো। মার্কসবাদ, মার্কসীয় দর্শন, জীবনের সর্বক্ষেত্রকে ব্যপ্ত করে রাজনীতি, দলই জীবন-বিপ্লবই জীবন, শ্রেণিশত্রু খতম, মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা, জাতীয়মুক্তি বনাম জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, বিপ্লবের প্রধান দ্বন্দ্ব বনাম দ্বন্দ্বের প্রধান দিক… এইরকম কত বাহাস, বিতর্ক, আলোচনা.. কত কিছু হলো। সব দেখে-শুনে-বুঝে-না বুঝে দেয়ালের ওই মার্কস মহাশয়ের মুখটির দিকে তাকিয়ে দেখুন, কেমন মুখ ফিরিয়ে অভিমান করে আছেন। দেখুন ছবিটি!
রসিকতা বাদ দিই। আসল ঘটনাটি যথেষ্ঠ চাঞ্চল্যকর! এই ছবি বাংলাদেশের প্রথাগত বাম আন্দোলন, সংকট, ধর্ম, বিশ্বাস, রাজপথ, গ্রাফিতির ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ছবি। বাংলার শহুরে মধ্যবিত্ত জীবন থেকে যখন কমিউনিস্টদের শক্তি কার্যত নেই হতে চলেছে, ঠিক সেই সময় প্রাচ্যের রাজধানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্রসংগঠনের ঐতিহ্যবাহী এক গ্রাফিতিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত দ্যোতনা সত্যিই মুগ্ধকর। তাও, বিশ্বব্যাপী চরম সংকট- এই করোনাক্রান্তির মুখে মার্কস এর দেখা পাওয়া; এও কি কম কথা? কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ধর্ম জনগণের আফিম। বলেছিলেন, ধর্ম হলো নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস। তার অনুসারী, আশেকান, ভক্ত, মুরীদানগণ তাকে অন্ধ অনুকরণ করতেন। কমরেডগণ মার্কসকে দেখতেন বিপ্লবী হিসেবে। মার্কস ধর্মকে দেখতেন সমাজ থেকে 'পলায়নবাদী প্রবৃত্তি' হিসেবে। প্রকৃতির দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে তিনি তুলে ধরেছিলেন, মানবজাতির গন্তব্য হিসেবে। যা ইতিহাসের বুকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। যোগাযোগবিদ্যার আলোকে আসুন, ছবিটি ব্যাখ্যা করি।
তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, আধুনিক চিহ্নবিদ্যার অগ্রজ পথিক ধরা হয় সুইসভাষা বিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুরকে। তিনিই প্রথম ভাষাতত্ত্বে নিয়ে আসেন সাইন, সিগনিফায়ার ও সিগনিফাইড এর ধারণা। এগুলোর অর্থ হলো কোন 'চিহ্ন' আমাদেরকে কী ধারণা দেয়; অর্থাৎ আমাদের মনে কোন বস্তুকে দেখে অর্থবোধক ভাবনা তৈরি। এটি একটি ''ত্রিভুজ মডেল''। যেমন: আমরা 'কলম' বলে একটি শব্দ উচ্চারণ করলে, তা যদি হয় কলমরূপ বস্তুর 'চিহ্ন', তা হলে এর মনোজগতে ভাবনা হবে 'সিগনিফায়ার' আর বাস্তবের কলমটি হলো 'সিগনিফাইড'। যদিও কোন কোন চিহ্ন তার সমাজ সংস্কৃতি ভেদেও নতুন অর্থ তৈরি করে। যেমন কালো বিড়াল আমাদের দেশ অশুভ হলেও জাপানে এটি শুভ চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তা হলে দেখা যাচ্ছে, অর্থ বা মিনিং তৈরিতে চিহ্ন একটি সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে। আমরা আসলেই একটি চিহ্ন-বিশ্বে বসবাস করছি। আমরা দুচোখ দিয়ে যা দেখি, মন দিয়ে যা ভাবি, এর প্রতিটি চিহ্নের এক-একটি বার্তা আছে। এই স্থিরচিত্রেরও একটি বার্তা আছে, যা চিহ্নবিদ্যায় ব্যবচ্ছেদ জরুরি।
চিহ্নবিদ্যা বলতে আমরা কী বুঝি? ''চিহ্নবিদ্যা পড়তে গিয়ে এমনসব বস্তুকে চিহ্ন বলে আমরা চিনতে পারি যেগুলোকে চিহ্ন বলে ভাবার কথা অভাবনীয়। চিহ্নবিদ্যা চিনিয়ে দেয় কোনটি কিসের চিহ্ন, কোন চিহ্ন কোন প্রকারের, কী চিহ্নে কী আসে যায়। আমরা যাকে বলি 'অর্থ' (Meaning) সেটা কিভাবে তৈরি হয়; আমরা যাকে বলি 'বাস্তবতা' সেটা কীভাবে নির্মিত হয়- এসব নিয়ে পঠন-পাঠন করে চিহ্নবিদ্যা'' (সূত্র: কবির, এহসানুল; ২০০৯: 'চিহ্নবিদ্যার অ আ', আলম খোরশেদ সম্পাদিত বিশদ সংবাদ, প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা) চিহ্নবিদ্যা পাঠ করে এই স্থিরচিত্রের প্রতীক ব্যাখ্যা আমাদেরকে এই সত্য জানায় যে, আমরা যা দেখছি তার ভিতরে এর আসল অর্থটা লুকিয়ে নেই; বরং একটা অর্থ আমরাই তৈরি করতে পারি। চিহ্নের পার্সিয় মডেলের তিনটি অংশ-চিহ্নধারক (Representamen), চিহ্নবাহক (Interpretant) ও নির্দেশক চিহ্ন (Indexical Sign)। আমরা জানি, কোন একটি বস্তুর অবয়বটিই হলো চিহ্নধারক। চিহ্নধারক আমাদের চিন্তাজগতে যে মানসিক ভাবের জন্ম দেয় তা হলো চিহ্নবাহক। এবং চিহ্নধারক ব্যবহার করে বাস্তবের যে বস্তু বা অবস্থার প্রতি নির্দেশ করা হয় তা হলো নির্দেশক চিহ্ন বা বস্তু। চিহ্নের পার্সিয় মডেলের চিত্রটি খেয়াল করি।
এই চিত্রে চিহ্নধারক হলো নামাজে সেজদা-রত ব্যক্তি, চিহ্নবাহক হলো সেই ব্যক্তির সাথে বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক। অর্থাৎ আনুগত্য। চিহ্নধারক ও চিহ্নবাহকের মধ্যে এবং চিহ্নবাহক ও বস্তুর মধ্যে রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক। আর চিহ্নধারকটি ব্যবহার করে বাস্তবের যে বস্তুর মধ্যে সম্পর্কটি সেটি আপতিক বা নির্মিত; সেটি হলো ওই বুড়ো কার্লমার্ক্স মহাশয়! তাই সেটিকে দেখানো হয়েছে ভগ্নরেখা দিয়ে! অর্থাৎ তিনি নামাজটি ওই ব্যাকগ্রাউন্ডে না পড়লেই ছবিটির কোন আলাদা মিনিং থাকতো না। ব্যাকগ্রাউন্ডই এখানে ফোরগ্রাউন্ডকে আলাদা গুরুত্ববাহী করেছে। যোগযোগবিদ্যা থেকে আসুন মুখ ফেরাই সমাজবিদ্যায়।
পৃথিবীর জ্বর এখন। পুরো দেশ লকডাউন। এই যে সবাই সমাজবিচ্ছিন্ন বা শারিরীকভাবে দূরে থাকা, কারণ 'একা' লাগা বোধে তাড়িত আমরা। এই 'একা লাগা' চিন্তার একটা সূত্র পাই আমরা মার্কসেরই 'নিঃসঙ্গতাবোধ (Loneliness) তত্ত্ব থেকে। যে নিঃসঙ্গতাবোধ আসে বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) থেকে। যা নিয়ে মার্কস বহু পাতার বই লিখে গেছেন। সারকথা হলো, মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, সর্বহারা তার উৎপাদিত শ্রমের ফল থেকে নিজেই দিনদিন বিচ্ছিন্ন হবে। এরপর সমাজের শ্রেণিবিভাজন ক্রমে ক্রমেই মানুষকে অপর মানুষ থেকে বিছিন্ন করবে। নিজের স্বার্থ, নিজের লোভ আর নিজের মুনাফা এই ত্রিভুজ মানুষকে আপন সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। যার নাম পুঁজিবাদী সমাজ। এইভাবে নিজের শ্রম থেকে উৎপাদিত সবকিছু থেকে একজন উৎপাদকের নিজের বিচ্ছিন্নতা ঘটবে। ফলে মানুষের মনে নিঃসঙ্গতাবোধের জন্ম হয়। আজ করোনাক্রান্তিতে পৃথিবীজুড়ে নিঃসঙ্গতাবোধ। এই সংকট তো মার্কস আগেই বলেছিলেন, একটি সমাজে শ্রমিক যত সম্পদ উৎপাদন করবে, তার উৎপাদন-ক্ষমতা তত বৃদ্ধি পাবে, আবার সে যত বেশি পণ্য উৎপাদন করবে, নিজে ততই নিঃস্ব হবে! দিন দিন সে নিজেই সস্তা পণ্যে পরিণত হবে। আগামীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পর, রোবটিক সোসাইটিতে তা গিয়ে কোথায় দাঁড়াবে, তার জন্য আজকের পৃথিবীতে মার্কসপাঠ নতুনভাবে শুরু হয়েছে। মার্কসের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে সারা পৃথিবীর মার্কসসেবীরা তাই ভেবেছেন।
আজ পৃথিবীজুড়ে ভয়াবহ করোনাক্রান্তির জন্য উন্নত বা উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশ হাবুডুবু খাচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে অর্থ ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে যে ধরনের অবহেলা এই দেশগুলি এতদিন দেখিয়েছে তার মাশুল দিচ্ছে জনগণ। চীন থেকে ইতালি, আমেরিকা থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশ; লাখো মৃত্যু বরণের মধ্য দিয়ে এই সংকট উঠে এসেছে অভূতপূর্ব মহামারী হিসেবে। তুলনামূলকভাবে আমরা দেখছি, সমাজতন্ত্রের প্রতি কিছুটা হলেও আস্থা রেখে চলছে যে দেশগুলো যেমন কিউবা, ভেনেজুয়েলা বা ভিয়েতনাম – সেগুলো ভালো কাজ করছে জনকল্যাণে। প্রশ্ন হলো, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই করোনা-মৃত্যু মিছিল কি ধনতন্ত্রের পতন ডেকে আনতে পারবে? না। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের অতি মুনাফার রাজনীতির শিকার আজকের মানুষ। কিন্তু, এই পরিবর্তনের ভগীরথ কোথায়? করোনা মোকাবেলায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধাক্কা খেয়েছে ঠিকই, তাই বলে পুঁজিবাদের পতন ঘটবে, এটা বলা বালসুলভ চপলতা। চীন? চীনের মডেল কিভাবে পারলো করোনাভাইরাস সংক্রমণ সামাল দিকে? চীনতো কোনমতেই সমাজতান্ত্রিক দেশ নয় এখন, বরঞ্চ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। তবে, এটাও ঠিক-রাশিয়া বা চীনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আদলে তৈরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুফল পাচ্ছে ঠিকই।
সমাজবিজ্ঞান তথা যোগাযোগবিদ্যার ছাত্র হিসেবে আমরা এই পরিস্থিতিকে দেখতে পারি, আধুনিক সভ্যতার উন্মেষের পর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকট হিসেবে। এই আলোচনাটি শুরু হয়েছিলো মার্কসের সাথে পথিকের কাল্পনিক সংলাপ বা রসিকতা দিয়ে। মাঝখানে এসে সন্ধিগ্ন মনের ভাবনা রেখেছি আমি। লেখাটি শেষ করবো- কর্তব্যের টানাপড়েন জারি রেখে। আমার কাছে মনে হয়, এই করোনাক্রান্তি পুরো বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকেই আরো মজবুত করবে। এই করোনা-সংকট রাষ্ট্রকে আরও কর্তৃত্ববান করবে, ক্ষমতাবান করবে। কারণ, কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর ভেতর দিয়ে জনসাধারণকে মনিটরিং করার অভূতপূর্ব কৌশল এখন সরকারগুলোর হাতে আরো সহজপ্রাপ্য। দেশেদেশে অনিরাপদ, অসচেতন, মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠি বাছবিচারহীনভাবে সরকারের সমস্ত নজরদারির কাজকে সমর্থন করে বসে আছে। যেন বিশ্বজুড়ে অন্তহীন জরুরি অবস্থা ডেকে আনছি সবাই। কারণ, অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে আমরা গনতন্ত্রীরাই সমাজে লকডাউন, শহরে জরুরি অবস্থার ডাক দিয়েছি বা সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছি। আমরাই তো রাষ্ট্রকে সবার জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশের ক্ষমতা তুলে দিয়েছি। আমরাই এখন আমাদের হাতের স্মার্টফোনকে গুরু-শিষ্যের মধ্যকার পূর্ণসমর্পণের নামে রাষ্ট্রের নজরদারিতে সঁপে দিয়েছি। তাই না?
পৃথিবীর জ্বর এখন। এই জ্বরে আক্রান্ত সবকটি দেশ। দেখুন, এই ক্রান্তিকাল বড় অদ্ভুত। অদৃশ্য শত্রু নিজের অজান্তে জড়িয়ে ধরছে সবাইকে। পৃথিবীজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। কী এক অদৃশ্য জীবাণুর কাছে সুদৃশ্য পৃথিবী অচল! মক্কা-মদিনা বন্ধ, ভ্যাটিকানে ছুটি, তিরুপতি-বালাজি বন্ধ, বুদ্ধগয়ায় ঢল নেই। খোদার দুনিয়ায় সবাই মুখোশ পরে চলছি। অথচ পৃথিবীর সব হাসপাতাল খোলা। জরুরি বিভাগ খোলা। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ডাক্তার। চিকিৎসাবিজ্ঞান জেগে আছে হাসপাতালে হাসপাতালে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে গিয়ে আমরা অসহায় হয়ে দেখছি এক অদৃশ্য জীবাণু কিভাবে এই সুদৃশ্য পৃথিবীকে অচল করে দিল!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পৃথিবী কি আসলেই সুদৃশ্য ছিল? না। ক্যাপিটালিজম এই পৃথিবীতে যে গতি এনেছিল, আজ সে নিজের কবর খুঁড়ছে। বহুল আলোচিত 'ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম'র মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। দুর্যোগ-পুঁজিবাদের পর এক নতুন পৃথিবী গড়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকেই। করোনা আমার কাছে একটি 'ধর্মনিরপেক্ষ' রোগই নয় কেবল; বরং সে সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, একমুখী, শ্রেণিবৈষম্যহীন, যুক্তিবাদী এবং সাম্যবাদী রোগ। এটি একটি জাত, পাত, আশরাফ, আতরাফ ভেদাভেদহীন এমন রোগ যা 'সকলের জন্য ভাইরাস' নিশ্চিত করতে পৃথিবীর দেশে দেশে অবিরাম শ্রেণীসংগ্রাম করে চলছে। কোথাও তার বিপ্লব ব্যর্থ হচ্ছে, কোথাও বিপ্লব সফল হচ্ছে। সারা পৃথিবী আজ তাই নতুন বিপ্লবী পার্টির (করোনার প্রতিষেধক) খোঁজ করতে বাধ্য!
আবার দেখুন, এই রোগের সমাধান আরো অদ্ভুত! কেবল হাত ধুয়ে ঘরে বসে থাকো। সারা দুনিয়ায় এখন এটাই যুদ্ধ। অবাক হলেও সত্যি সভ্যতার ইতিহাসে এটাই প্রথম কোন যুদ্ধ, প্রত্যেকটা দেশ যার যার মিত্রপক্ষ! কিন্তু প্রত্যেক মানুষ প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও আসল শত্রুকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, অথচ তার ভয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করে গুটিসুটি মেরে নিজেকে সঙ্গরোধ করে রেখেছি। রোগতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, যোগাযোগবিদ্যা আর চিকিৎসাশাস্ত্রের সকল সমীকরণ উল্টে দিয়ে নয়া রোগের বিশ্বায়ন জারি হয়েছে পৃথিবীতে। এই অভিনব যুদ্ধের পর পৃথিবীর কেমন চেহারা দাঁড়াবে? ভাবছি!
কী সেই চেহারা?
আসুন, আবার দেখি দেয়ালের গ্রাফিতিকে। গ্রাফিতির মার্কসকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে ফেরগ্রাউন্ডে নামাজি ভদ্রলোককে। ছবিতে কার্ল মার্কস রাগ করে মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন যেন। দু বছর আগেই দেশে-দেশে যার দুইশ বছর জন্মতিথি পালন করা হয়েছে, সেই এই মহামতি হয়তো জানেন না, মুমূর্ষু পুঁজিবাদ আজ অতিমুনাফার লোভে নিজেই ধ্বংস হওয়ার পথে। কথিত 'মানবিক পুঁজিবাদ'ও খোঁড়াচ্ছে ইউরোপের পথে পথে।
করোনাভাইরাস দেখিয়ে দিলো- কেন একটি রাষ্ট্রকেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের দায়িত্ব নিতে হবে। চিনের জনগণ রাষ্ট্রীয় লকডাউন মেনে গৃহবন্দি ছিল দিনের পর দিন। কারণ তারা জানতো, রাষ্ট্র তাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবে। কিউবার কমিউনিস্ট চিকিৎসক দল আজ ইতালিতে সেবা দিচ্ছে। কিউবার এই উদারতা দেখে করোনাক্রান্তির মুখেও মানুষ বলছে- সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্লোগান। করোনাক্রান্তির পর তোপখানা-পল্টনের বামাচারীরা বলবে, 'সমাজতন্ত্রই একমাত্র মুক্তির পথ' কিংবা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পওয়ালারা বলবে, 'মানবিক পুঁজিবাদ জিন্দাবাদ'। কিন্তু যে-যাই বলুক, একটি মানবিক দেশ ও মানবিক পৃথিবী কামনা আমরা নিঃসন্দেহে করতেই পারি। পুঁজিবাদের অসাড়তা বোঝার জন্য করোনাক্রান্তি তাই একটা দারুণ উপলক্ষ, বটে। তাই আমার কাছে মনে হয়, মার্কস যেন দেয়াল থেকে চেঁচিয়ে সেজদা-রতকে বলছেন, 'বহুবছর আগে বলেছিনু এই সংকটের কথা। মারীর কথা, মড়কের কথা। শোন নাই ভ্রাতা!' হ্যাঁ, মার্কস বলেছিলেন, সমাজে যতই মুনাফা বাড়বে, ততই দুর্দশা বাড়বে মানুষের। আর নামাজ শেষে পথিক বলছেন, 'এ তো দেখি এক উভয় সংকট। মানুষই যদি ভালো না থাকে, তাহলে যাদের জন্য বাজার ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থার কী হবে? সমাধান কী?'
মার্কস এর হয়তো বিনীত উত্তর থাকতো: 'এই করোনা নয় শুধু, পুরো পুঁজিবাদের বিপর্যয়ের পেছনে যে সব কারণ, যান তাহার স্বরূপ অনুসন্ধান করুন কমরেড। আপনার হৃদয়-উৎসারিত অনুসন্ধান বলিয়া দিবে, দুনিয়াটাকে এমন ভাবে বদলাইয়া ফেলিতে হইবে, যেথায় মানুষ তাহার ইচ্ছা মতো বাঁচিতে পারিবে। যতটুকু সামর্থ্য, তদানুযায়ী কাজ করিবে। কাজ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সামাজিক উৎপন্ন গ্রহণ করিবে। অতঃপর গ্রহণ অনুযায়ী ভোগ করিবে। ইহার পরই সাম্যবাদ! বড় কঠিন কর্ম, মহাশয়!'
মার্চ জুড়েই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়ালো। মার্চের ১৪ তারিখ, বাংলাদেশের মানুষ নড়েচড়ে বসলো করোনাভাইরাস নিয়ে। অবাক হলেও সত্যি, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জনক মহামতি কার্ল মার্কসের প্রয়াণ দিবসও ওই মার্চেরই ১৪ তারিখ। আজ পৃথিবীতে বা বঙ্গদেশে যারা তার নামটুকুও সহ্য করতে পারে না, তারাও স্বীকার করছেন, মার্কসের বাণী তো দেখি ফলে গেল! আমি আবারো দেয়ালচিত্রে মার্কসের চেহারাটি দেখি। দেয়ালচিত্র মতপ্রকাশেরই অপর নাম। মতপ্রকাশ মানেতো স্বাধীনতাই। দেয়াললিখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সামষ্টিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক টেক্সট। দেয়াল লিখন যেমন সমাজে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের বার্তা হিসেবে, তেমনি আশংকা আছে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে ব্যক্তি পূজা আর ব্যঞ্জনা-বন্দনায়ও। বাংলাদেশের সবশেষ জরুরি অবস্থাসম্পন্ন অনির্বাচিত সরকার দেয়ালশিল্প নিষিদ্ধ করে কার্যত বিরাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়াকে কায়দা করে জারি রেখেছিল। দেয়াল লিখনের বদলে ইতিহাসকেই মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন তারা। দেয়ালে মার্কসবাদ লেখাটির দিকে দেখি। ক্লান্ত ঘর্মাক্ত সেজদা-রত মহান মানুষটির দিকেও দেখি। দেখি ফুটপাতের দিকে। মার্কসের চেহারায় ক্রোধ, পথিকের চেহারায় ক্লান্তি। সামনে জায়নামাজ করে রাখা হয়েছে বাজারের থলিকে। শূন্য বাজারের থলিতে সেজদা দিয়ে দেয়ালের ক্রোধ আর নামাজির ক্লান্ত চেহারা থেকেই হয়তো কখনো জন্ম নেবে প্রজ্ঞা। দেয়ালের 'মার্কসবাদ' গ্রাফিতিটি যেন অনাগত কালকে বহু দূর পর্যন্ত দেখা দিচ্ছে আমাকে। সমাজে পুঁজির কেন্দ্রিভবন, একচেটিয়া মুনাফা, অসাম্য, হানাহানানি, যুদ্ধবাজেট বনাম স্বাস্থ্যখাত ইত্যাদি মিলিয়ে মানুষ কিভাবে আজ চার্লি চ্যাপলিন-এর 'মর্ডান টাইমস' সিনেমার মতো যন্ত্রে পরিণত হলো, সেই ভাবনায় তাড়িত করে আমাকে। মার্কসবাদ কোন জ্যোতিষচর্চা নয়, রাশিবিজ্ঞানও নয়, মার্কসপাঠ নির্ভুল নয়।
পশ্চিমবঙ্গের লেখক, অধ্যাপক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা চমৎকার বই পড়েছিলাম। বছর তিনেক আগে বইটির নাম, 'ভূতুড়ে মোলাকাত: মার্ক্সের সঙ্গে আড্ডা গুলতানি' (প্রকাশক- তালপাতা)। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের অসাধারণ বই 'অলৌকিক সংলাপ' পড়েছিলাম। ভালোবাসা, বর্ডার আর শ্রেণিসংগ্রাম নিয়ে মালায়ালাম সিনেমা সিআইএ (কমরেড ইন আমেরিকা) দেখেছিলাম। এই বই দু'টি পড়তে পড়তে আর সিনেমাটি দেখে মার্কসের সাথে লেখক/নায়কের কাল্পনিক কথোপকোথনের কতগুলো ভাবনার বুদবুদ এসেছিল আমার নিজের মাথায়। ভাবছি, মার্কস যদি আজ এই বঙ্গে ফিরতেন, তবে মিরপুরের মেট্রোরেল উন্নয়ন প্রকল্প, ঝাঁ-চকচকে বসুন্ধরা শপিং মল, জাতীয় সংসদ ভবন, কারওয়ানবাজার বস্তি ইত্যাদি সকাল থেকে ঘুরে-ঘুরে টৈ টৈ করে দেখে ক্লান্ত হয়ে যেতেন নিশ্চয়ই। কিন্তু ভাবছি, সন্ধ্যায় তোপখানা রোডে বসে বা পল্টনে দাঁড়িয়ে কী বলতেন?
সে যাই ভাবুক বা বলুক; লোকরঞ্জনবাদী শাসন ব্যবস্থার কর্তৃত্ববাদী এই সিস্টেমে মার্কস বরং দেয়ালেই সেঁটে থাকুন, সেই ভালো। দিনে দেখা যাবে তাকে, রাতে নিয়ন আলোকিত অংশে ঝিমাবেন। করোনাক্রান্তিতে এই স্থিরচিত্রের সেমিওটিক এনালাইসিস করা জরুরি ছিল। তাই আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে মনে করি, 'মানুষই তার ইতিহাস গড়ে, কিন্তু সেটা সে যেভাবে চায় সেভাবে গড়তে পারে না… তাকে তা গড়তে হয় বিদ্যমান— অতীত থেকে প্রবাহিত— পরিমণ্ডলের মধ্যেই।'
করোনাভাইরাসের শেষ হবে একদিন, পৃথিবীর জ্বর সারবে। তখন দেয়ালের মার্ক্সের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করবো, যিনি আপনাকে পাশে রেখে সেজদা দিলেন মহান সৃষ্টিকর্তার দিকে, তাকেও ভাবাবেন প্লিজ, কিভাবে তৈরি হলো এই অসাম্যের পৃথিবী? হে মহামতি কার্ল মার্কস, আপনিই তো বলেছিলেন, 'পৃথিবীতে নানা দার্শনিক নানা ভাবে এ সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন। এখন দরকার সমাজটাকে বদলানো'! প্রিয় পাঠক, করোনাক্রান্তির মার্কসপাঠে তাই প্রশ্ন রাখছি, নামের পরে 'বাদ' দিয়েও যাকে বাদ দেয়া যায় না, তারই নাম কি 'মার্কসবাদ'?