মেডিকেল ভর্তি প্রক্রিয়া: আমরা গিনিপিগ হতে চাই না

তূর্য রহমান
Published : 20 August 2014, 08:05 PM
Updated : 29 August 2012, 12:55 PM

মেডিকেল ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে মিডিয়ায় অনেক আলোচনা উঠে আসছে। একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে আজ কিছু প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, আশা করি উত্তর পাব।

বর্তমান সিদ্ধান্ত ভালো না খারাপ এ ব্যাপারে বহু কথা হয়েছে। নীতি নির্ধারকগণ পাবলিক পরীক্ষার (এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি) ফলকে মেধা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট মনে করছেন, বলা হচ্ছে আগের পদ্ধতিরই কেবল ৫০% বাদ দেয়া হয়েছে এবং এ পদ্ধতি 'দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ' হবে।

তাত্ত্বিকভাবে এগুলো যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য তবুও এ সিদ্ধান্ত বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে যার প্রথম ও প্রধান কারণ পুরো প্রক্রিয়াটি আমাদের কাছে স্বচ্ছ নয়। এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি কোন পরীক্ষারই নম্বর প্রকাশ করা হয় না। তাহলে একজন শিক্ষার্থী কিভাবে বুঝবে তার অবস্থান কোথায় ? গোপন তথ্যের ভিত্তিতে মেডিকেল ভর্তির মত বড় একটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা কি খুব যুক্তিপূর্ণ ? এখন আবার শোনা যাচ্ছে কেবল গ্রেডের ভিত্তিতে না-কি ভর্তি করা হবে।

পাবলিক পরীক্ষা বিষয়ে কিছু কথা এখানে প্রাসঙ্গিক, সন্দেহ নেই, বর্তমানে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষার পরিবেশ অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ভালো। আবার এও সত্য, এমন কোন পরীক্ষার হল খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে 'খাতা দেখাদেখি' হয় না। একই প্রশ্ন বারবার আসা, কোচিং আর গাইডের সাজেশন, সুপার সাজেশনের বদৌলতে দেখা যায়, বইয়ের মাত্র ২০ – ৩০ শতাংশ পড়ে, মাত্র দুই-তিন মাসের শ্রমে অনেকে 'এ প্লাস' পাচ্ছে (এ কথা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়) এ কথা বলতে যদিও লজ্জা লাগে, তবে তা সত্য। আশা করা যায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর থেকে এ অবস্থার উন্নতি হবে। তবে, এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি-র বর্তমান প্রশ্নব্যবস্থা মেধা যাচাইয়ের অনুকূলে নয়। সেই সাথে সকল বোর্ডের প্রশ্নপত্র একরূপ হয় না। এই পরীক্ষা মূলত: রচনামূলক, আর একটি পরীক্ষার খাতা ফটোকপি করে দশজন শিক্ষকের কাছে দিলে দশ রকম মূল্যায়ন হবে। – এ বিষয়টিও নির্মম সত্য যে, ব্যবহারিক পরীক্ষার পদ্ধতি এবং নম্বর প্রদান – কোনটিই যথাযথ নয়। – এত ক্রটির পরেও ১টা সিটের পেছনে যেখানে ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী ছোটে, সেখানে ভর্তির নির্ণায়ক হিসেবে শুধুমাত্র পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নেয়া কতটা যুক্তিপূর্ণ।

এছাড়া প্রতি বছরই দেখা যায়, এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি তে গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে অনেকেই কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে নি, অথচ অপেক্ষাকৃত কম জিপিএধারী অনেকে শ্রমের দ্বারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছে।

আরেকটি প্রধান কারণ, ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের মত বড় একটি সিদ্ধান্ত কেন কোন আলোচনা ছাড়া হঠাৎ করেই 'চাপিয়ে দেয়া' হল। যেহেতু এর সাথে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জড়িত তাই শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সকলের সাথে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু তা না করে পরীক্ষার দেড়মাস আগে হঠাৎ করে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া কারোর কাম্য নয়।

মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভর্তি প্রক্রিয়ায় বারোটা ধাপ অনুসরণ করা হবে জানান। – এত জল ঘোলা হবার পরও কেন এখনো সে ধাপগুলো মিডিয়ায় প্রকাশিত হলো না। এ ছাড়া শোনা যায়, এরকম যন্ত্রনির্ভর ব্যবস্থায় বয়স, নামের বর্ণ – এ ধরনের বিষয়ও বিবেচনা করা হয়, যাকে হাস্যকর ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। মাননীয় মন্ত্রীর কথায় আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে, যে সব শিক্ষার্থী জীববিজ্ঞান চতুর্থ বিষয় (FOURTH SUBJECT) হিসেবে নিয়েছে তারা পিছিয়ে যাবে। তাই যদি হয় তবে কেন এ ব্যাপারটি আমরা বিষয় নির্বাচন করার সময় জানতে পরলাম না ? এ কারণে যদি কেউ পিছিয়ে পড়ে, তবে তার দায় কার ? শিক্ষার্থীর না-কি সিদ্ধান্ত প্রণেতাদের ?

কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হলে সরকার যেরকম খুশি হবে, শিক্ষার্থীরা তার চেয়েও বেশি খুশি হবে। কারণ কোচিং কোন আনন্দের বিষয় না, এক ধরনের মানসিক নির্যাতন, আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন এ পদ্ধতিতে কোচিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। সুতরাং কোচিং বন্ধ করার জন্য অন্য কোন পন্থা ভাবা প্রয়োজন এবং তা এখনই ভাবা প্রয়োজন।

জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী প্রায় ৫০ হাজার। জিপিএ-৫ দিয়েই যদি সব সরকারি বেসরকারি মেডিকেলের সিট পূর্ণ হয়ে যায়, তবে কেন বলা হচ্ছে জিপিএ-৪ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরাও আবেদন করতে পারবে ? বিষয়টি কী যথেষ্ট রহস্যজনক নয় ?

চিকিৎসা সেবার মত স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে যদি কম মেধাবীরা সুযোগ পায়, তবে পুরো সিস্টেম ঝুঁকির মুখে পড়বে। এর দায় নেবে কে ? ভর্তি প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ হওয়ায় তদবীর, সুপারিশ, কোটা বাণিজ্যের মাঝে মেধার যাচাই কতটা হবে, তা যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন।

বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন, বিচার প্রক্রিয়ায় কিছু সময় লাগাটাও যথেষ্ট স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শুধু মেডিকেল নয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও ভর্তির আবেদন করতে হবে। সুতরাং এ বিষয় ঝুলন্ত থাকায় মেডিকেল ভর্তিচ্ছুদের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

এ বছর থেকেই যদি জিপিএ-র ভিত্তিতে ভর্তি নেয়া হয় হবে দেখা যাবে, গত বছরে যারা ভালো জিপিএ ধারন করেও মেডিকেলে সুযোগ না পেয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তারাও আবেদন করতে পারবেন এবং কোন রকম পরিশ্রম ছাড়াই তাদের কেউ কেউ সুযোগ পেতে পারেন, এটা কোন ভাবেই ন্যায় সঙ্গত নয়।

ভর্তি পরীক্ষার জন্য একজন শিক্ষার্থীর সম্পূর্ণ বইয়ের উপর দখল থাকতে হয় এবং সত্য হল বেশিরভাগ শিক্ষার্থী (যারা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ছে) – এ জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমটা দেয় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত। কোচিং এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কোন মৌলিক জ্ঞান দেয় না, পরীক্ষায় এগিয়ে যাবার কিছু 'shortcut' 'technique' শেখায় মাত্র।

ভালো জিপিএ ধারণ করেও বর্তমানে গৃহীত পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ হল, পাঠ্যবইয়ের কিয়দংশের জ্ঞান নিয়ে একজন শিক্ষার্থী ভালো জিপিএ পেতে পারে, কিন্তু সে ঠিকভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যায়ন করতে পারবে কি ?

তবে একথাও ঠিক, কোন পদ্ধতি অনুসৃত হবে তা ঠিক করবেন নীতিনির্ধারকগণ, তবে একটাই আবেদন, কোন বিবেচনাহীন, হঠাৎ সিদ্ধান্তের ফেরে আমাদের গিনিপিগ বানাবেন না।

এ সময়ে হয়তো আমার পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র বা রসায়নের বিক্রিয়া চর্চা করার কথা, কিন্তু তার পরিবর্তে সুবিচারের জন্য ফরিয়াদ জানাচ্ছি। কেননা এই একটি প্রক্রিয়ার সাথে হাজারও শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জড়িত। সুতরাং কোন হেলাফেলা ধরনের সিদ্ধান্তে এ-কে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।

শেষ করার আগে একটা প্রস্তাবনা রাখতে চাই, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার ২ সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে, উচ্চ মাধ্যমিক-এর ফলাফলের পর দুটি মিলিয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকার ভিত্তিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে, ছাত্র-অভিভাবক-শিক্ষক সকলেই কি উপকৃত হবেন না ?

তূর্য রহমান: সর্বোচ্চ জিপিএ-প্রাপ্ত এবং মেডিকেল ভর্তিচ্ছু।