মনুষ্যত্ব শনাক্তকরণ কিট ‘করোনাভাইরাস’!

মো. জাকির হোসেন
Published : 11 April 2020, 06:43 PM
Updated : 11 April 2020, 06:43 PM

মানবসভ্যতার ইতিহাসে ভয়ংকরতম মহামারিসমূহের অন্যতম করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে মানুষের বড়াইকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের ওষুধ ও প্রতিষেধকের পাশাপশি নিশ্চিত ও দ্রুততার সাথে করোনাভাইরাস শনাক্ত করার নতুন নতুন কিট আবিষ্কারের প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে। ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট এর সাহায্যে পরীক্ষা করা হয় কারও শরীরে করোনাভাইরাস পজিটিভ না কি নেগেটিভ। অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা হয়। আর এ ভাইরাসটি তার ভয়ংকর ধ্বংসলীলার মাঝেও আদম সন্তানের মনুষ্যত্ব শনাক্তকরণের এক অনবদ্য ও কার্যকর কিট হিসেবে কাজ করছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণে মানুষের মত দেখতে প্রাণীগুলোর ভেতরের সত্তাকে প্রকাশ করে দিয়ে মানুষ আর অমানুষ শনাক্তকরণে দারুণভাবে কাজ করছে।

বাংলাদেশে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। মানবিক এই বিপর্যয়ে সরকার ও তার প্রশাসন যন্ত্র, সেনাবাহিনী, পুলিশ, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য পেশার মানুষেরা ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তায় দিশেহারা। এমন এক পরিস্থিতিতে কিছু দেশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই মুহূর্তে ফিরিয়ে আনতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। কুয়েত, মালদ্বীপ, বাহরাইন, সৌদি আরব ওমানসহ বেশ কিছু দেশ প্রায় দেড় লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীকে ফেরত আনার জন্য সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। কুয়েত সরকার দেশটিতে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। এই সময়ের মধ্যে কুয়েতে থাকা সকল অনিয়মিত বা অবৈধ কর্মীদের নিজ দেশে ফেরত যেতে বলেছে। এই কর্মীদের ফেরত না আনলে কুয়েত সরকার বাংলাদেশকে কালো তালিকাভুক্ত করার হুমকিও দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বৈধ কর্মীদের ইকামা নবায়ন না করা এবং নতুন করে কোনো কর্মী না নেয়ার মতো হুমকিও দিয়ে রেখেছে কুয়েত সরকার। সৃষ্টিকর্তার দান তেল কুয়েতকে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। কুয়েতের অর্থনীতি পেট্রোলিয়ামভিত্তিক অর্থনীতি। কুয়েতি দিনার বিশ্বের মুদ্রাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যবান একক। বিশ্বব্যাংকের মতে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে কুয়েত বিশ্বের চতুর্থ ধনী দেশ। আর জিসিসি দেশেগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ধনী দেশ (কাতারের পরে)। অর্থনৈতিক দিক থেকে ধনী হলেও মনুষ্যত্বের দিক থেকে কুয়েত দরিদ্র। এই ভয়ংকর করোনাকালে তাই মাত্র কয়েক হাজার বাংলাদেশীকে জবরদস্তি বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বে খাদ্য অপব্যয়কারী রাষ্ট্রের তালিকার শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব। প্রতিবছর প্রায় ৮৩ লাখ টন খাবার নষ্ট হয় দেশটিতে। সম্প্রতি সৌদি আরবের পরিবেশ, পানি ও কৃষি অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন মারফত তথ্যটি জানা গেছে। প্রতিবছর গড়ে একজন সৌদি ২৫০ কেজি খাবার নষ্ট করেন। সৌদি আরবের পরিবেশ, পানি ও কৃষি অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, উৎপাদিত প্রায় ৩০ শতাংশ খাদ্য অপব্যয়ের বার্ষিক হিসেব করলে, তার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৪৯ বিলিয়ন রিয়াল সৌদি রিয়েলেরও বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। একটু সচেতন হয়ে খাদ্য অপচয় কমালে সৌদি সরকার কয়েক হাজার বাংলাদেশির পিছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না করেই তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারত। ফলে বাংলাদেশ এ দুঃসময়ে প্রবাসীদের ফেরত আনতে বাধ্য হতো না। উচ্চ মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশের একটি তালিকা তৈরি করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইটসজিআরনাইন। সেখানে ওমানের অবস্থান ২৩তম আর বাহরাইন ১২তম ধনী দেশ। ওমানের মাথাপিছু জিডিপি ৪৫ হাজার ৯০৩ ডলার আর বাহরাইনের ৫২ হাজার ৮৩০ ডলার। জিডিপিতে ধনী হলেও করোনাভাইরাসের বিপর্যয়কালে কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে ওমান ও বাহরাইন থেকে ফেরত পাঠানোর চাপ মনুষ্যত্বের দৈন্যতাই প্রকাশ করে। মালদ্বীপ অনিয়মিত বিদেশি কর্মীদের নিজেদের (মালদ্বীপের) খরচে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এরইমধ্যে বাংলাদেশি ৩৮ হাজার অনিয়মিত কর্মী দেশে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট মিশনে নিবন্ধিত হয়েছে। এই কর্মীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য মালদ্বীপ সরকারের পক্ষ থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এতদিন ধরে আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশিদের বৈধ ডকুমেন্টের অভাবের সুযোগ নিয়ে শ্রমশোষণ করে মালদ্বীপ লাভবান হয়েছে। আর এখন করোনায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনতে তাগাদা দিচ্ছে। করোনা কীট শনাক্ত করেছে মালদ্বীপ সরকারও মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় পজিটিভ নন।

এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণে বড় বিপদে পড়েছেন শিক্ষার্থীসহ ১০ হাজার বাংলাদেশি। ভাইরাসের চেয়েও এ বিপর্যয় তাদের কাছে বড়। আচমকা অস্ট্রেলিয়ার সরকার প্রধানের এক ঘোষণায় বিদেশি শিক্ষার্থী ও হলিডে ওয়ার্কার্সদের মাথায় কার্যত আকাশ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন কোনো রকম রাখঢাক না করেই বলেছেন, "সরি, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, কঠিন এই সময়ে আমরা আমাদের নাগরিকদের দিকেই নজর দিতে চাই। কোভিড-১৯ এর এই দুর্যোগে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ছাড়া আর কারো দায়িত্ব নিতে পারছে না সরকার। ফলে এ দেশে যারা অস্থায়ী ভিসা নিয়ে আছেন, তাঁদের বিকল্প হচ্ছে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া। বিদেশি শিক্ষার্থী যারা চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা নার্সিং পড়ছেন না তাদেরকেও আমরা উৎসাহিত করছি ফিরে যেতে।"

স্কট মরিসন এ-ও বলেন, "অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলে তার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের।"

সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে দ্য কাউন্সিল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অস্ট্রেলিয়া নামের সংগঠন। তারা বলছে, অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের বিরাট ভূমিকা আছে। একজন ছাত্র গড়ে ৪০ হাজার ডলার টিউশন ফি দিয়ে থাকেন। প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরকার ৩২ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী স্কট বর্ণবাদী বক্তব্য রেখেছেন এবং তিনি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন। এখন অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ সীমান্ত বন্ধ। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ লকডাউনে। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া সরকারের এই ঘোষণা অমানবিক। তবে অস্ট্রেলিয়ার সরকার যে সব বিদেশি শিক্ষার্থী নার্সিং বিষয়ে পড়ছেন তাদেরকে অস্ট্রেলিয়া না ছাড়তে পরামর্শ দিয়েছে। কারণ কোভিড-১৯ এর জন্য সরকার ইতোমধ্যে দেশের সব প্রাইভেট হাসপাতাল এবং বেশ কয়েকটি পাঁচতারকা হোটেল দ্রুত চিকিৎসা সুবিধার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে এসেছে। সেখানে প্রচুর নতুন চিকিৎসক ও নার্স প্রয়োজন। অন্যদিকে, যারা হলিডে ওয়ার্কিং ভিসায় কেবল ফল ও সবজি বাগানে কাজ করেন তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে সরকার l অস্ট্রেলিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী মাইকেল মাসিকর্মাক বলেছেন, "আমাদের এই মুহূর্তে প্রচুর ফল ও সবজি প্রয়োজন, তাই এখন আমরা কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারবো না যে, গাছে ফল পেকে ঝরে যাচ্ছে, না তোলার কারণে সবজি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।" তার মানে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ষোল আনাই নিজের দেশের কথা চিন্তা করেছেন, অন্যের জীবনের বিনিময়ে হলেও। রাষ্ট্রের সীমানা দিয়ে তারা মনুষ্যত্বের সীমানাকেও বন্দি করে ফেলেছ। করোনাভাইরাস শনাক্ত করে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার শাসকগোষ্ঠীর মনুষ্যত্বের টেস্ট নেগেটিভ। আর এটাই অষ্ট্রেলিয়ার পক্ষে স্বাভাবিক। যারা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস পড়েছেন তারা জানেন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা যারা আনুমানিক ৭০ হাজার বছর ধরে বাস করছে তাদের ভূমিকে 'টেরা নুলিয়াস' তথা মালিকানবিহীন ভূমি আখ্যা দিয়ে আদিবাসীদের জোর করে বিতাড়িত করে অস্ট্রেলিয়ার গোড়াপত্তন হয়।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে হস্তচ্যুত হবার ফলে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য বিকল্প উপনিবেশ খুঁজতে শুরু করে ব্রিটিশরা। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্রিটিশদের নির্বাসনে পাঠানোর জন্য হাতছাড়া হওয়া ম্যারিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়ার পরিবর্তে অন্য কোন দ্বীপের সন্ধানও জরুরী হয়ে পড়ে। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ১৭৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট জেমস কুক এইচ এম এস এন্ডেভার নামক জাহাজ নিয়ে তাহিতি ভ্রমণ করলেন। ১৭৭০ সালে এন্ডেভার অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে ভিড়লে জেমস কুক পূর্ব উপকূলকে ব্রিটেনের পক্ষে দাবি করে বসেন। তিনি প্রথমে প্রতিরোধের মুখোমুখি হলেও আস্তে আস্তে সেই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে মহাদেশের অন্যান্য অন্যান্য জায়গায় উপনিবেশ স্থাপন করতে থাকল। ফলে সাড়ে সাত লাখ আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ায় আস্তে আস্তে সংখ্যালঘু ও দুর্বল হতে থাকল।

আদিবাসীরা যুদ্ধের চেয়ে ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত রোগ বালাই তথা মহামারিতে সবচেয়ে পর্যুদস্ত হয়েছে। ইউরোপের মানুষ বনের পশু-পাখি পোষ মানানোর প্রক্রিয়ায় পশু-পাখির মারাত্মক রোগ ও মহামারী গুটি বসন্ত, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপীয়দের শরীরে আ্যন্টিবডি তৈরি হলেও অস্ট্রেলিয়া আদিবাসীদের কাছে এ রোগ-মহামারী ছিল অজানা।

ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে এসে আদিবাসীরা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মনোবলবিহীন হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়। কথিত আছে অস্ত্রের মজুত ফুরিয়ে গেলে প্যারামাট্টা পর্যন্ত বসতি স্থাপনের জন্য আদিবাসী নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজনে ব্রিটিশ নৌবাহিনী আদিবাসীদের বসতিতে জলবসন্ত ছড়িয়ে দিলে তা মহামারী রূপ নেয় তাসমানিয়ায় আদিবাসীদের সংখ্যা কয়েকশ'তে নেমে আসে।

অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ আগমনের ইতিহাস হচ্ছে বর্বরতা, শোষণ ও বঞ্চনায় পরিপূর্ণ। যেভাবেই হোক দখল ও আধিপত্য বিস্তার ছিল একমাত্র লক্ষ্য। সেই ব্রিটিশ দখলদারদের বংশধররাই অস্ট্রেলিয়া শাসন করছে। কাজী জুবেরী মোস্তাক মানবতার খোঁজে কবিতায় লিখেছেন, 'গিয়েছিলাম একটুকরো মানবতার খোঁজে/তোমাদের ঐ ঘূণে ধরা ভঙ্গুর জনপদে/অলি-গলি ঘুরেছি, শহর থেকে শহরে ছুটেছি/আর বিপন্ন মানবতাকে পথে প্রান্তরে দেখেছি৷'

যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের কারণে আফ্রিকান-আমেরিকানরা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ব্যাপকহারে মারা যাচ্ছে। লুসিয়ানা, মিশিগান, ইলিনয় ও নিউইয়র্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এ কথা জানা গেছে। লুসিয়ানায় করোনাভাইরাসে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি কৃষ্ণাঙ্গ। মিশিগানের করোনাভাইরাসের কারণে আফ্রিকান-আমেরিকানদের মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ। নিউ ইয়র্কেও করোনাভাইরাসে বেশি মৃত্যু ঘটছে অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গের মধ্যে বৈষম্যের ইঙ্গিত করা হয়েছে। করোনাভাইরাস শনাক্ত করেছে আমেরিকান শাসকরা মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় 'সবার উপরে মানুষ সত্য' এর পরিবর্তে সবার উপরে 'শ্বেতাঙ্গ' সত্য, তাহার ওপরে নাই ধারণাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

বাংলাদেশ দরিদ্র বলে তার সুযোগ নিয়ে যারা বাংলাদেশের দুঃসময়ে প্রবাসীদের ফেরত আনতে চাপ সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, বাংলাদেশ এমন ছিলনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্রিটিশরা উপনিবেশ স্থাপন করার আগে এ দেশ শুধু অপূর্ব রূপময়ই ছিল না, অমিত ঐশ্বর্যশালীও ছিল। ব্রিটিশ শাসনের আগে জীবনযাত্রার মান ছিলো উন্নত। অসাধারণ প্রাচুর্যের এ দেশে দারিদ্র ছিল অজানা। বাংলাদেশ তাই মোগল আমলে "জান্নাত-আবাদ"(স্বর্গপুরী) ও জান্নাত-আল-বিলাদ (জনপদসমূহের স্বর্গ) নামে পরিচিত ছিল।

জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগেও অনেকে যান্ত্রিক ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু পুঁজির অভাবে শিল্পবিপ্লব হতে পারেনি। একথা সর্বজনবিদিত যে, ইংল্যান্ড এর শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক পুঁজি ও কাঁচামাল জুগিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলার লুট হওয়া সম্পদ ইংল্যান্ড এর শিল্প বিপ্লবের ভিত গড়েছে, তার সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ব্যয় জুগিয়েছে। আজকের রাজকীয় লন্ডন নির্মাণ ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এর বিস্তার হয়েছে বাংলার লুণ্ঠিত সম্পদের দৌলতেই। ব্রিটিশদের নির্মম লুণ্ঠনে বাংলা অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল, দরিদ্র হয়ে পড়লেও মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় আজও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। গণহত্যা, ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে দেড় মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে দরিদ্র বাংলাদেশ। মানবতাকে রাষ্ট্রীয় সীমানায় গণ্ডিবদ্ধ করেনি কোন অজুহাতে। করোনাভাইরাসে নিজে হিমশিম খেলেও এই কঠিন বিপদে কোন বিদেশিকে চলে যাওয়ার নির্দেশনা জারি করেনি। বরং রোহিঙ্গাদের মাঝে যাতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।

করোনাভাইরাসের কারণে কয়েকটি দেশ থেকে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশি কর্মীদের দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও যেসব দেশ বাংলাদেশিদের ফেরত না নিলে তাদের অসুবিধায় ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে, সেসব দেশ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কুয়েত থেকে ৩১৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে ফেরত আনা হবে। কুয়েতের সেই ফিরতি ফ্লাইটে ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া ইপিএসের আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত ১৫০ জন কর্মী এবং সেখানে অধ্যয়নরত ২৬ জন শিক্ষার্থীকে আনতে বাংলাদেশ বিমানের একটি চার্টার্ড ফ্লাইট কোরিয়ায় পাঠানো হবে। প্রবাসীদের কঠিন সময়ে বাংলাদেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। খাদ্যসংকটে পড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের জরুরি খাদ্য সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস। প্রবাসী বাংলাদেশিদের চিকিৎসাসেবা দিতে প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে চিকিৎসক দল।

ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, "চিনি আর লবণ একই রকম দেখতে, পার্থক্য শুধু স্বাদে। তেমনি মানুষ আর অমানুষ দেখতে একই রকম, পার্থক্য শুধু আচরণে।" বাংলাদেশে ক্ষুধার্ত মানুষের গ্রাস ত্রাণের চাল চুরি করছে কিছু মানুষ। ত্রাণ দেয়ার কথা বলে ডেকে এনে দিনমজুরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে এক জনপ্রতিনিধি। হাসপাতালে ভর্তি না নেয়ায় রাস্তায় সন্তান প্রসব করেছেন একজন মা। লাশ বহনে মসজিদের খাটিয়া না দেয়ায় খালি কাঁধে কাফনে আবৃত মরদেহ বহন করে দাফন করেছে বাবা-ভাইয়েরা। ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন চাকমাকে করোনার রোগী ভেবে কোন হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে রাজি না হওয়ায় হোমিও চিকিৎসকের ওষুধ খাওয়ার ২৪ দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সুমন চাকমা। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রধান সরঞ্জাম পিপিই, মাস্ক ও করোনা টেস্টিং কীট এর জন্য হাহাকারের মধ্যেই খবর বেরিয়েছে ঘুস না দেয়ায় বিমানবন্দরে ১৫দিন ধরে আটকে আছে পিপিই, মাস্ক ও টেস্টিং কিটের চালান। এসব খবর বলে দিচ্ছে লাগামহীন লোভ আর স্বার্থপরতার দাসত্বে বন্দি অনেকের মনুষ্যত্ব।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আতংকের নাম এখন করোনাভাইরাস। তবে এই করোনাভাইরাসই শনাক্ত করেছে পৃথিবীতে মনুষ্যত্বের ঘাটতি চলছে। মানবাধিকার, অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার এসবের চেয়ে মনুষ্যত্বের আবাদ বাড়াতে আরও মনোযোগী হতে হবে। মনুষ্যত্ব থাকে মানুষের হৃদয়ে, চেহারায় বা অবয়বে নয়, কোনও দেশ ধনী না দরিদ্র- সে বিবেচনায়ও নয়। মনুষ্যত্বের মজুত বাড়াতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে আবারও মানুষ হয়ে ওঠতে হবে।