মহামারী ও কুসংস্কার

ফারুক মঈনউদ্দীন
Published : 8 April 2020, 04:01 PM
Updated : 8 April 2020, 04:01 PM

(দ্য হিন্দু পত্রিকার নিবন্ধ থেকে অনুবাদ। মূল লেখক অমিতাংশ আচার্য যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার এবং অস্ট্রিয়ার কনরাড লরেঞ্জ ইনস্টিটিউটের ফেলো।)

রোগ কোনো জাত-পাত বিচার করে না। তবু এটির জন্য জাতিগোষ্ঠি, লিঙ্গ, যৌন অভিরুচি আর ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতে দায় চাপানোর প্রবণতা চলছেই।

১৯ শতকের প্রথমদিকে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডের ধনী মহল্লায় একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখা যায়।  সেখানকার অনেক নাগরিক রহস্যজনকভাবে টাইফয়েডে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। একটা ছিমছাম স্বচ্ছল জনপদে নোংরা আর দরিদ্র পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত এই রোগটির প্রাদুর্ভাব  নগরীর স্বাস্থ্য দপ্তরকে বিচলিত করে তোলে।

জর্জ সোপার নামে একজন স্যানিটারি ইজ্ঞিনিয়ারকে বিষয়টা তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি আবিষ্কার করেন যে মেরি ম্যালন নামের এক মধ্যবয়স্ক আইরিশ মহিলা কমপক্ষে যে আটটি বাড়িতে কাজ করেছেন, সেসব বাড়িতেই টাইফয়েড হানা দিয়েছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ম্যালন এক বাড়ি থেকে কাজ ছেড়ে অন্য বাড়িতে যোগ দেওয়ার পর প্রতিটি বাড়িতে এই রোগ ধরা পড়েছে। তাই সোপার সেই মহিলার খোঁজে নামেন। ম্যালনের যাবতীয় ব্যাক্তিগত তথ্য নিয়ে চুপিসারে অনুসরণ করে মহিলার বাড়ি খুঁজে বের করেন সোপার। টাইফয়েড বহনকারী হিসেবে তাকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন তিনি। কিন্তু ম্যালন কোনো সহযোগিতা কিংবা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে দিতেও অস্বীকার করেন। এমন অবস্থায় মহিলাকে গ্রেপ্তার করার জন্য সোপারকে পুলিশের সহায়তা নিতে হয়।

সম্পূর্ণ ধারণার বশবর্তী হয়ে, ম্যালনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার প্রস্রাব, মল এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল এলে নমুনার মধ্যে সালমোনেলা টাইফি নামের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। ফলে জনরোষের ফাঁস দ্রুতই তার গলায় এসে পড়ে।

নিজেরা আক্রান্ত না হয়েও রোগবাহী জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া 'সুস্থ বহনকারী'র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সোপার বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। আর অমর্যাদায় নিন্দিত ম্যালন ইতিহাসে নাম লেখান 'টাইফয়েড মেরি' হিসেবে। দশকের পর দশক ধরে অবজ্ঞাসূচক এই নামটি সেই দরিদ্র, অশিক্ষিত, অভিবাসী, যত্নশীল ও দক্ষ রাঁধুনি মহিলাটির প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অপমানের সাথে একীভুত হয়ে গিয়েছিল। ম্যালনকে পৈচাশিকীকরণ করেছিল স্বাস্থ্য দপ্তর, আর সংবাদমাধ্যমগুলো নাম দিয়েছিল 'সুপার স্প্রেডার', যার ভূমিকা গণহত্যাকারীর মতোই। ধারণা করা হয় ৫১ জন মানুষকে সংক্রমিত করেছিলেন তিনি, যাদের মধ্যে তিনজন মারা গিয়েছিলেন, তবু সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা ছিল কঠিন। 

শত্রুর খোঁজে   

ম্যালনকে নর্থ ব্রাদার আইল্যান্ডের রিভারসাইড হাসপাতালে ২৬ বছরের জন্য অন্তরীণে পাঠানো হয়, সেখানেই মারা যান তিনি ১৯৩৮ সালে। অবশেষে ৬৩ বছর পর এই দোষক্ষালন ঘটে এক অপ্রত্যাশিত মহল থেকে, অবশ্য তাতে বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু ছিল না। টাইফয়েড মেরি: অ্যান আরবান হিস্টরিক্যাল (২০০১) গ্রন্থে অ্যান্থনি বোরডেইন তার সহকর্মী রাঁধুনির প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে লেখেন, "রাঁধুনিরা অসুস্থ হয়েও কাজ করে। সবসময়ই ওদের অসুখ থাকে। বেশিরভাগ জায়গায় যদি কাজ না করো, বেতন পাবে না। সর্দিগড়ানো নাকবন্ধ অবস্থায় গলাব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে উঠেছ? কাজ চালিয়ে যাও। কাজ শেষ করার সময় রয়েছে। গলায় একটা তোয়ালে পেঁচিয়ে রেখে কাজগুলো শেষ করার সবরকম চেষ্টা করতে হয় তোমাকে। ব্যথাবেদনা আর অসুস্থতা নিয়ে কাজ করা গর্বের বিষয়।"

নিউ ইয়র্ক সিটিতে টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব নতুন কিছু ছিল না, কিন্তু রোগটির চেয়ে বেশি মারাত্মক জনশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল ম্যালনকে। মনে হয় তার মূল অপরাধ ছিল ধনী ও ক্ষমতাধরদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে লং আইল্যান্ড আর ব্রনক্সকে আলাদা করে রাখা শ্রেণিভেদকে জীবাণুরা খুব বেশি সম্মান দেখায় না।

***

এক কঠিন বিবর্তনমূলক সম্পর্ক এই মানুষ আর জীবাণুর কাহিনী। জীবাণুরা বেঁচে থেকে বেড়ে উঠতে চায়। তাই তাদের আশ্রয়স্থল মানুষটিকে খুন করা হতো একটা আত্মহননের প্রক্রিয়া। তাই উভয়পক্ষই চেষ্টা করে টিকে থাকার জন্য। একটিা নির্দিষ্ট সময়ের পর উভয়ই একটা অস্বস্তিকর চুক্তিতে পৌঁছায়, ফলে জীবাণুদের নিয়েই বেঁচে থাকে মানুষ। এটা আমরা আগেও অনেকবার করেছি, আর সেটা নোভেল করোনাভাইরাস নিয়েও করতে হবে আমাদের।

একটা মহামারী থেকে উদ্ভুত এই জৈবিক সহাবস্থান সামাজিক অভিঘাতের সম্পূর্ণ বিপরীত। রোগশোকের কোনো সামাজিক পছন্দ নেই, আর জীবাণুরাও বর্ণ, শ্রেণি, ধর্ম, লিঙ্গ কিংবা অন্য পরিচয় দিয়ে আক্রান্তদের মধ্যে পার্থক্য করে না। যা হোক, ইতিহাসে দেখা যায় যতবারই একটা মহামারী এসেছে ততবারই গভীর সামাজিক কুসংস্কারগুলোর পুনরাবির্ভাব ঘটেছে, আর তার ফলাফল প্রায়ই ছিল আতঙ্কজনক।

 ইউরোপে ১৩৪৮ সালের ব্যুবোনিক প্লেগের সময় ক্যাথলিক গির্জা কর্তৃপক্ষের কাছে নিশ্চিতভাবে প্রতীয়মান হয় যে এই সব মৃত্যু খ্রিস্টধর্মকে খাটো করার জন্য ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। রোগটি ছড়ানোর জন্য জলের কুয়োগুলোতে বিষপ্রয়োগ করার অভিযোগে অভিযুক্ত ইহুদিরা শিকার হয় ভয়ঙ্কর নির্যাতনের, এবিষয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য করা হয় তাদের। ফলে হাজার হাজার ইহুদির মাংসপোড়া পূতিগন্ধ ভেসে বেড়াতে থাকে স্ট্রসবার্গ, কলোন, বাসেল আর মেইনজের বাতাসে। 

ইউরোপের রোমও হয় একইরকম নির্যাতনের স্বীকার। জর্জিও ভিয়াজ্জিও তার স্তোরিয়া দেইই জিংগারি ইন ইতালিয়া (১৯৯৭) (ইতালিতে জিপসীদের ইতিহাস) গ্রন্থে ১৪৯৩ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত জিংগারিদের (জিপসীদের অবজ্ঞাসূচক নাম- অনুবাদক) চলাচলের নিষেধাজ্ঞা সংবলিত ১২১ টি আইনের দলিল উপস্থাপন করেছেন। এসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল অংশত এমন সংস্কার থেকে যে এরা মহামারীর উৎস ও বিস্তারের জন্য দায়ী।

মধ্যযুগের ইউরোপে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের জন্য ঐতিহ্যবাহী ওষুধ চর্চা করেন এমন লোকজনদের দায়ী করা হতো। এদেরকে 'ডাইনী' অপবাদ দিয়ে করা হতো নির্যাতন। ইতিহাসবিদ ব্রায়ান লেভাক (২০০৬) হিসাব করে দেখান যে ইউরোপে ৯০ হাজার মানুষকে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়। আমাদের কাছে সঠিক হিসাব না থাকলেও এটির মূল আঘাত সইতে হয়েছিল মূলত নারীদের। 

***

জীবাণুতত্ত্ব আবিষ্কারের পর প্লেগ বহনকারীদের সম্পর্কে মধ্যযুগীয় বিশ্বাস ঘুচে যায়। মানুষের মাধ্যমে রোগ ছড়ায় না, ছড়ায় ক্ষুদ্রাণু জীবকোষ কিংবা জীবাণুদের মাধ্যমে। এরা বাতাস, জল কিংবা মানব ও জড়পদার্থের মধ্যকার সংস্পর্শের মাধ্যমে চলাফেরা করতে পারে। আমরা জেনেছি সামাজিক শ্রেণিভেদ নিয়ে জীবাণুদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। কেউ ধরে নিয়েছিল মাইক্রোস্কোপের পরিষ্কার লেন্সের ভেতর দিয়েই দেখা যাবে আবিষ্কৃত অরাজনৈতিক ও নীতিহীন এই 'জীবাণু'ই মহামারী সৃষ্টি করে, কুসংস্কারে রঙিন চশমার কাচ দিয়ে নয়।

কিন্তু মাইক্রোস্কোপ কেবল আবিষ্কারের কোনো হাতিয়ারমাত্র ছিল না, এটা ছিল সাম্রাজ্যের যন্ত্র। উষ্ণমণ্ডলের দেশগুলো ইঙ্গ-ইউরোপীয় শাসকদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রোগে ভর্তি ছিল। মনে হতো মশাগুলো ঔপনিবেশিক প্রজাদের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্রোহী ছিল। মাইক্রোস্কোপ "উষ্ণমণ্ডলের রোগ"গুলোকে বোঝার বিষয়টিকে একটা কাঠামোর মধ্যে এনে দেয়। ১৮১৭ সালে ইউরোপে 'এশিয়াটিক কলেরা'র দ্রুত বিস্তার ঘটলে উপনিবেশগুলোতে উৎপন্ন রোগ হানা দেওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রোগটির এই নাম দেওয়া হয় এমন বিশ্বাস থেকে যে এটি ভারতীয় গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত।

এর ফলে নিবিড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়। উনিশ শতকের চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগব্যাধিকে স্থানীয়করণের চেষ্টার বিষয়ে সূক্ষ্ম ছায়াপাতের মাধ্যমে ইতিহাসবিদ প্রতীক চক্রবর্তী ২০১০ সালে লেখেন রবার্ট কোচের আবিষ্কৃত দেখতে কমা চিহ্নের মতো জীবাণু ভিবরিও কলেরাকে কীভাবে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পরিবেশ ও মানুষের রোগ বলে তকমা আঁটা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে ঔপনিবেশিক প্রজাদের অন্ত্র ও পৈত্তিক দেহযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছিল।

তারপর ছিল কুষ্ঠরোগ বা লেপ্রসি। নামটি এতই কলঙ্কময় যে 'লেপার' (leper) শব্দটি সামাজিকভাবে পতিতদের সাথে সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। মনুস্মৃতিতে কুষ্ঠরোগীদের 'পাপী' গণ্য করে একঘরে করার ব্যাপারে অনুমোদন ছিল। এমনকি ১৮৯১ সালে লেপ্রসি কমিশনের রিপোর্টের উপসংহারে "ছোঁয়াচের পরিমাণ এতই নগন্য যে এটিকে উপেক্ষা করা যায়" এমন মন্তব্য করা হলেও ভারতীয় ও ইউরোপীয় উঁচুশ্রেণির মানুষেরা আক্রান্তদের জনসমক্ষে আসার বিপক্ষে সক্রিয় প্রচারণা চালিয়েছিলেন, কারণ, এদের দেখলে বিরক্তি আর বিতৃষ্ণার উদ্রেক হয়। এই কারণে প্রণীত হয় ১৮৯৮ সালের লেপ্রসি অ্যাক্ট, যেটিতে জন্মরোধ করার জন্য এমনকি লৈঙ্গিক বিচ্ছিন্নতা আরোপের মাধ্যমে কুষ্ঠরোগীদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়। এসবই করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক এলিটশ্রেণির নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতিকে তুষ্ট করার জন্য। 

ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান যেখানে মহামারীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয়করণের ব্যাপারে অবদান রাখে, এটিকে আরো পোক্ত করে সাহিত্য। জলের মধ্যবর্তী একটা শহরে কলেরার প্রাদুর্ভাবের পটভূমিতে লেখা থমাস মানের ডেথ ইন ভেনিস উপন্যাসিকাতে রোগটিকে 'ইন্ডিয়ান কলেরা' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা, ". . . অনিয়ন্ত্রিত ও অনুপযুক্ত পতিত জমির পূতিগন্ধসহ নেমে আসা গঙ্গা বদ্বীপের গুমোট জলাভূমিতে উৎপন্ন হয়, সেই বিজনপ্রদেশ মানববিবর্জিত. . .।"

মহামারীর প্রাচ্যনীতি

গবেষক আলেকজান্দ্রে হোয়াইট ২০১৮ সালে তার অভিসন্দর্ভে এসব ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যার বিষয়টিকে "মহামারীর প্রাচ্যনীতি" হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই তত্ত্বটি রোগের নামকরণ যেভাবে হয় তার একটা ছাঁদ তৈরি করে দিয়েছে, তেমনই কয়েকটার নাম উল্লেখ করা যায়- এশিয়াটিক কলেরা (১৮২৬), এশিয়াটিক প্লেগ (১৮৪৬), এশিয়াটিক ফ্লু (১৯৫৬), রিফট ভ্যালি ফিভার (১৯০০ শতাব্দী), মিডলইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (২০১২), হংকং ফ্লু (১৯৬৮)। অবশ্য এখন নিরপেক্ষ জাতিবাচক নামে সংক্রামক রোগের নামকরণের বাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।

যাই হোক, সামাজিকভাবে মহামারী আর রোগব্যাধির সাথে বর্ণ, লিঙ্গ, যৌনঅভিরুচি এবং ভৌগলিক অবস্থানের তকমা এঁটে দেওয়া হয়। ট্রাম্প প্রশাসন কোভিড-১৯ কে বারবার 'চায়নিজ ভাইরাস' নামে বলে আসছে, আবার কেউ এটাকে বলছেন 'কুং ফ্লু'। এসব নামকরণ কুসংস্কারকে আরো দৃঢ়মূল করে। এইচআইভি/এইডস রোগের নাম দেওয়া হয়েছিল GRID — Gay Related Immuno deficiency, অর্থাৎ সমকাম সম্পর্কিত প্রতিরোধ ঘাটতি। অল্পদিনের জন্য হলেও আশির দশকে আমেরিকান টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মবক্তারা এইডসকে 'গে প্লেগ' নামে অভিহিত করতেন, যেটিকে বলা হতো যৌন অনাচারের জন্য দৈব শাস্তি। বিভিন্ন দেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সমকামীদের মধ্যে এইচআইভি/ এইডস রোগের প্রকোপ বেশি এই বিশ্বাস থেকে এদের রক্তদান কিংবা অঙ্গদান নিষিদ্ধ করা হয়।

 ***

ইতিহাস থেকে যদি কোনো শিক্ষা আমরা নিই, সেটি হচ্ছে আমাদের ভেতরে প্রোথিত কুসংস্কারের চেয়ে তুলনামূলক উল্লেখযোগ্যভাবে রোগবাহী জীবাণুদের কবজা করতে পেরেছি আমরা। মহামারী ঘৃণার সৃষ্টি করে না, তবে তাকে বিস্তৃত করতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বাস করতে চাইবে যে এটা চীন সরকারের অব্যস্থাপনা এবং ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে আমেরিকাকে অস্থিতিশীল করার এক ষড়যন্ত্র। এই ধারণা ক্যাথলিক চার্চের প্রচারিত pestis manufacta (অশুভ উদ্দেশে তৈরি করা রোগ) মতবাদটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যাতে খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের জন্য দায়ী করা হয় ইহুদিদের। একইভাবে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের করোনাভাইরাসের বাহক হিসেবে  চিহ্নিত করে ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ লে পেন এবং সালভিনি প্রমুখের বর্ণবাদী কটূক্তিপূর্ণ মন্তব্য ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরের সাথে মিলে যায়। চারবছর আগে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় মেক্সিকান অভিবাসীদের সাথে "মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে" বলে 'প্লেগ বিস্তারকারী' মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ধারণাটির পুনরুজ্জীবন ঘটান ট্রাম্প। তবে পরিহাস হচ্ছে, আজ সেই মেক্সিকোই আমেরিকা থেকে রোগবাহী মানুষদের দেশটিতে ঢুকতে বাধা দেওয়ার জন্য সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে।

একইভাবে কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি জেগে উঠেছে ভারতের সুপ্ত কুসংস্কারগুলো। ভবন মালিকেরা তাদের বাড়িতে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। লোকজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলার সময় ব্যবহার করছে বর্ণভেদ আর অস্পৃশ্যতার ভাষা। উত্তরপূর্ব ভারতের নাগরিকদের সহ্য করতে হচ্ছে বর্ণবাদী মন্তব্য ও বহিষ্কারের হুমকি। যে সরকার বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার জন্য বিমান পাঠিয়েছিল, সেই সরকারই ব্যর্থ হয়েছে অভিবাসী দরিদ্র শ্রমিকদের আশ্রয় দিতে কিংবা নিরাপদে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। চলমান লকডাউনের সময় দেখা গেছে রাস্তায় ঘুমিয়ে, খাবার আর পানির জন্য যুদ্ধ করতে করতে শতশত মাইল দুর্গম পথে বাড়িমুখো শ্রমিকদের গণযাত্রা। এসব জায়গায় এযাবত মারা গেছে বিশজনের মতো। এই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর সরকার তাড়াহুড়ো করে যারা থেকে যেতে চায় তাদের জন্য তৈরি করছে রিলিফ ক্যাম্প, আর যারা চলে যেতে চায় তাদের জন্য করছে পরিবহনের ব্যবস্থা। আর উত্তর প্রদেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের ওপর হোস পাইপ দিয়ে ছিটানো হচ্ছে মেঝে পরিষ্কার করার জীবাণুনাশক, যেন তারাই জীবাণু। তার সাথে নতুন দিল্লির নিজামুদ্দীন এলাকায় তাবলিগি জামাত সম্মেলনের কাঁধে চড়ে ছড়িয়েছে ধর্মীয় কুসংস্কারের নতুন ভাইরাল।

*** 

জীবাণুরা কোনো নির্দিষ্ট জাত কিংবা স্থানের খোঁজ করে না- তাদের দরকার একটা উষ্ণ, আর্দ্র এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ মানবদেহ, এই সত্যটা প্রমাণ করে বিজ্ঞানের উচিত ছিল মানুষকে তাদের অযৌক্তিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত করা। এমনকি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আশ্রয়দাতা, রোগবাহী কীট এবং বাহক সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহকেও অধিকার করে নেওয়া হয়েছে সামাজিক কুসংস্কারগুলোকে দৃঢ়মূল করার জন্য। একটা মহামারীর মন্থনে উঠে আসা কলঙ্কচিহ্ন দীর্ঘদিন থেকে যায়। মেরি ম্যালনের চেয়ে ভালো করে কেউ বুঝতে পারেনি এটা। জীবনের চারভাগের একভাগ সময় অন্তরীণ থাকার পরও তার নাম একটা রোগের সমার্থক রয়ে গেছে। 

আক্রান্তদের ওপর একই রকম আগ্রাসী হয়রানি এখনও চলছে। কোয়ারেন্টিন চালু রাখতে মরিয়া সরকারগুলো রোগীদের নাম-ধাম প্রকাশ করছে, দরজায় সাঁটিয়ে দিচ্ছে স্টিকার, শরীরের চামড়ার ওপর লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে অমোচনীয় কালির মোহর, যার সবগুলোই চিকিৎসা নীতিমালার লঙ্ঘণ, যা একঘরে করার দিকেও ঠেলে দিতে পারে। 

বিশ শতকের প্রথমদিকে এক দরিদ্র অভিবাসী নারী সমাজের কাছে যে প্রশ্ন রেখেছিল, আজ আমরা একই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্য মানবতাকে উপেক্ষা করা কি খুব বেশি প্রয়োজনীয়?