শেষবার অনুরোধ হঠকারিতা বন্ধ হোক, মানুষ বাঁচুক

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 April 2020, 02:08 PM
Updated : 8 April 2020, 02:08 PM

সবাই জানত গাণিতিক না জ্যামিতিক হারে বাড়বে সংখ্যা। বারবার বলার পরও কী করা হলো? শুধু সরকারের দোষ? তাদের ব্যর্থতা যে প্রশাসনিক সেটা এখন স্পষ্ট। সরকারের নাকের ডগায় জনপ্রিয় প্রাক্তন মেয়রের বিধবা পত্নী যে কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন তাতে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও শঙ্কায়। এই নারী এরশাদ আমলেও এমন করতেন। ছাত্র-জনতা যখন প্রাণ দিচ্ছিল তিনি গেলেন এরশাদের দালালি করতে। ধরে নিয়ে যাওয়া তার স্বামী (তখন অবশ্য হননি) আনিসুল হক তার চাইতে অনেক জনপ্রিয় হবার পরও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ইনি বলেন আমি অনুষ্ঠান করব। আর এই সময়ে এসেও তাই জনগণের চাইতে, শ্রমিকদের জীবনের চাইতে টাকা, অর্ডার এগুলোকে বড় মনে করে তিনি করোনাকে দিয়েছেন নতুন গতি। কে সামলাবে এখন? মহামারী ভাইরাসকে অবজ্ঞা করা আমেরিকা, ইতালি আর স্পেনের অবস্থা দেখুন। তারপরও কি আমরা শিখব না?

মিডিয়ায় দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সামিন সোমবার সন্ধ্যায় তার ফেইসবুকে ওয়ালে এক পোস্টে মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ করেন। তার বাবা দুদকের পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঐদিন সকালেই মারা যান।

সামিন রহমান ফেইসবুকে লিখেছেন, "আমার বাবা জীবিকার তাগিদে সরকারি আদেশ না আসা পর্যন্ত ২২ মার্চ পর্যন্ত অফিস করেছিলেন, তারপর থেকে তিনি বাসাতেই ছিলেন, কিন্তু তবুও রক্ষা পাননি। তাই এখনও যারা ঘরে থাকার বিধিনিষেধ মানছেন না, তাদের সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না বর্তমানে এই মুহূর্তে আমার এবং আমার পরিবারের উপর দিয়ে যা যাচ্ছে, সেটা আমার শত্রুকেও মোকাবেলা করতে হোক।"

এমন মর্মস্পশী চিঠি যেন আমাদের আর পড়তে না হয়। আমরা কেন সাবধান হচ্ছি না? দেখুন শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে কী লাভ? সরকার কী করবে একা? মন্ত্রীসভার বৈঠকে বলা হয়েছে ঘরে না থাকলে এই সমস্যার সমাধান নেই। কিন্তু নানা অজুহাতে মানুষ ঘুরছে, বেড়াচ্ছে। ফাইনের পরিমান দেখুন। এই লোকগুলো কিছু কিনতে যায়নি। কেউ কেউ খামোখা বেড়াতে বেরিয়েছিল। ভিডিওতে দেখলাম প্রশ্নের উত্তরে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা লোকজন বলছে বাসায় নাকি মন টেকে না তাই বাইরে। এদের কী করা উচিৎ? কেন এরা বুঝতে পারছে না একজন লোক বাইরে মানে একশজনের বিপদ। একহাজার লোকের মৃত্যু ডেকে আনা। কে এদের বোঝাবে?

আমরা নানা দেশে কারফিউ দেখছি। এই আইন কি তবে বাংলাদেশেও দিতে হবে? সবাই মিলে চেষ্টা না করলে কী হবে সেটা টিভি বা খবর দেখেও বুঝতে পারছে না এরা। আমেরিকার নিউইয়র্কের মেয়র সাফ জানিয়েছেন এখন আর কবর দেয়া সম্ভব না। পাশের একটা আইল্যান্ডে ফেলে দেয়া হবে লাশগুলো। অথবা সৎকার করে ফেলা হবে। যারা মারা গেলেন তাদের মুখ তো দূরের কথা কোনো চিহ্নও আর থাকবে না। এমন অবস্থা বাংলাদেশে না হোক। আমাদের জনবহুল দেশে এমন অবস্থা থেকে বাঁচতে কি করতে হবে সবাই জানেন। তারপরও এই অবহেলা!

কদিন আগে পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে যা করা হলো তা রীতিমতো মানুষ হত্যার অপরাধ। তিনি যেই হন আর যাই হন কীভাবে এটা সম্ভব হলো? কীভাবে তিনি ঘোষণা দিলেন? আবার তাদের ফেরত যেতে বলার মতো জঘন্য অমানবিক অপরাধও দেখি এখন পর্যন্ত আইনের আওতায় এলো না। এদিকে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন এই ঘটনার কারণে নিভে আসা করোনার সলতে আবার জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। কঠোরভাবে সরকারি আইনে এদের বিচার হোক। বুঝিয়ে দেয়া হোক শেখ হাসিনার আমলে অপরাধী যেই হোক না কেন তার ছাড় নাই।

আর একটা অবাক ব্যাপার হলো বিত্তবানদের নীরবতা। আগে ধনী মানুষেরা লোক দেখানো হোক আর যাই হোক সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এখন হয়তো তারা আগাম ভয়ে কাবু। মধ্যবিত্ত এই ক্রাইসিসে দাঁড়াতে পারবে না। তাদের নিজেদের পাত খালি। সীমিত আয় আর স্বল্প পুঁজির মানুষজনের সাধ্য নাই ঝুঁকি নেয়ার। তাই ধনী নামের লুটেরাদের এগিয়ে আসা দরকার সবার আগে। এটা মনে রাখবেন আপনার অঢেল টাকা গিলে খেতে পারবেন না। শেষে কিছুই পাবেন না খাবারের জন্য। এই কঠিন সত্য বুঝুন।

যে সব বিনোদন কর্মী বা আর্ট কালচারের মানুষ শিল্পকে জীবন হিসেবে বেছে নিয়েছিল তাদের কি হবে আসলে? তারা কারো কাছে হাত পাততে পারে না। আবার ত্রাণও পায় না। উন্নত দেশের আদলে সরকার সাহায্য দিয়েছে কিন্তু কে না জানে এখানেও ভাগ বসাবে চাটুকারের দল। মিসিং হবে কোটি কোটি টাকা। এতসব জানার পরও বুদ্ধিবৃত্তি নীরব।

এটা তোষামোদী বা দালালির সময় না। দুনিয়া আবেগে চলে না। উন্নত দেশগুলো হাতেনাতে ধরা খেয়ে এখন তাদের লেজেগোবরে অবস্থা। এটা কে না জানে তাদের একশ ভাগের এক ভাগ পরিষেবা বা সহায়তা দেয়ার সামর্থ্য নেই দেশের। জনসংখ্যার চাপে দিশেহারা সমাজে হাজার কয়েক আকাশ-বাতাস ফাটানো ধনীরা কুমীরের ছানার মতো। পৃথিবীকে তাদের দেখিয়ে, আমরা বড়লোক হয়ে গেছি বলার মতো আনন্দ এখন বেমানান।

পরিসংখ্যান ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কড়া হুঁশিয়ারী ভারত পাকিস্তানের কলজে ঠান্ডা করে দিয়েছে। দেখবেন মোদী, ইমরান খান সবাই এখন শান্তির ভাষায় কথা বলছে। উগ্র রগচটা মমতা দিদিকে এমন চেহারায় কখনো দেখিনি। চোখে জল হাত জোড় করে বারবার মাফ চাইছেন। তার মিটিংগুলো দেখলেই বোঝা যায় আন্তরিকতা কোথায় ও কতটা।

আমাদের একদিকে চলছে অন্ধত্ব অন্যদিকে পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে মশকরা। মিসেস হকের পর আরেক নারী ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়াকে সাবধান করে দিলেন। তার কথা হলো অর্ডার আছে ওগুলো বন্ধ করা যাবে না। এই অর্ডার যাদের দিয়ে বানানো হয় তিনি নাকি তাদের পালেন। ম্যাডাম ভুল বললেন।

ওরা রক্ত পানি করে শ্রম দিয়ে আপনাদের পালে, পোষে ধনী বানায়। আর বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাবেন না। অন্য যেসব অর্ডার সেগুলো কিনবে কে? আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডায় মানুষ টয়লেট টিস্যু কিনতে পারছে না। তারা যাবে ফ্যাশন পোশাক কিনতে? গতকাল আমি সিডনির এক চেইনশপ থেকে ভাগ্যজোরে আট রোলের টয়লেট টিস্যু কিনে বেরুবার সময় হাতে প্যাকেট দেখে চোখ ছানাবড়া অজি মহিলারা চেঁচিয়ে বলছিলো, লুক লুক হি গট টিস্যু। এসে দেখে যান হীরে গয়নার দোকানে তালা। কাপড় কিনতে কোনো পাগল যাবে না এখন। রেশনিং চলছে। তিনটা পাস্তার ছোট প্যাকেট নেয়ার পর দাম দিতে গেলে একটা রেখে দিল, বলল তুমি হয়তো খেয়াল করোনি মাথাপিছু দুটো। এমনকি ঔষধের দোকানেও বলল, না। রেকর্ড বলছে আগের ঔষধ ফুরোয়নি সুতরাং পরে আসো। আর আপনি বলছেন অর্ডার। খোলসা করে বলুন কফিন ও লাশবাহী ব্যাগের অর্ডার।

ব্যাংকগুলোতে কী ভীড়। দোকানপাটে উপচে পড়ছে মানুষ। সঠিক দিক নির্দেশনা নেই। যারা ভরসা দেবেন তাদের দেখা নেই। যে কয়েকজন ক্যামেরায় আসেন তাদের একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কোনোদিন ভাল করে তার চেহারা দেখিনি। আরব্য গল্পের আলীবাবার গুহা থেকে মাথা বের করে আবার ঢুকে যান।

কারো মুখে উদ্বিগ্নতার চিহ্ন নাই। শঙ্কাও না। জ্যামিতিক হারে বাড়ন্ত সংখ্যা কি পরিচিত জনদের মুখ আড়াল করে দেবে? তা হয় না। হতে পারে না।

আতঙ্ক পরিণত হোক শক্তিতে। শুধু ঘরে থাকা নিয়ম মানায় বন্ধ হবে রাস্তায় পড়ে থাকা। এত ক্রাইসিসেও বুদ্ধিজীবীদের কোন বিবৃতি বা ভূমিকা নেই। ঘরে বসে দু'একজন লড়াই করছেন। হায়রে পাঠক, দর্শক, শ্রোতাই যদি না থাকে কে পুছবে আপনাদের?

বাংলাদেশ তুমি সাবধান, সাবধান প্রিয় জন্মভূমি।