১.
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯। দিনটি অনেকের কাছে এখন পরিচিত। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথাজনিত উপসর্গ নিয়ে অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ অসুস্থ হওয়ার খবরটি চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কে জানায়। জানতে বাকি থাকে না যে এটি সার্স-মার্স গোত্রের করোনা (Corona) ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগ, কোভিড-১৯ (Covid-19)। আমেরিকা, ইউরোপসহ পৃথিবীর বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ প্রথমে একে পাত্তাই দেয়নি। জীবাণুকে নিয়ে চলে রাজনৈতিক বক্তব্য! ফলাফল, যে চীন দেশে রোগটি প্রথম দেখা দেয় তারা তিন মাসের ভেতরে রোগ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে, আর যারা পাত্তা দেয়নি তারা দেশের জনগণকে এক অনিশ্চিত আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দেয়। WHO-এর তথ্যমতে ৫ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত এ রোগে আমেরিকায় সর্বোচ্চ আক্রান্ত ২,৭৩,৮০৮ জনের মধ্যে মৃত ৭,০২০ জন; স্পেনে ১,২৪,৭৩৬ জনে ১১,৭৪৪; ইতালিতে ১,২৪,৬৩২ জনে ১৫,৩৬২ জন। তাছাড়া ইরানে ৫৫,৭৪৩ জনে মৃত ৩,৪৫২; ইংল্যান্ডে ৪১,৯০৭ জনে ৪,৩১৩ জন। অন্যদিকে, সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে চীনে আক্রান্ত ৮২,৯৩০ জনে মৃত ৩,৩৩৮ জন; কোরিয়ায় ১০,২৩৭ জনে ১৮৩; সিঙ্গাপুরে ১,১৮৯ জনে ৫ জন। আর বাংলাদেশ এ সংখ্যা ৭০ আক্রান্ত, ৮ মৃত্যু। যদিও মূল হিসাব অবশ্যই এর চেয়ে বেশি, কেননা জ্বর-কাশি-গলাব্যথা থাকা সত্ত্বেও অনেকের টেস্ট করা হয়নি, বলা হয়েছে এরা নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। আর বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করা আর একটা কাজ করা হয়েছে, মৃত্যুর পর টেস্ট! এবং কারও কারও টেস্ট পজিটিভ।
২.
বিশ্ব বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশে মন্ত্রীরা প্রথম থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটাতে অবদান রাখেন। ফলশ্রুতিতে, বিদেশফেরতদেরকে 'আলাদা' রাখা, সন্দেহভাজনদেরকে পরীক্ষা এবং চিকিৎসা না করা বা করতে যেমন বিলম্ব হয়, তেমনি ছুটির ঘোষণায় অঘোষিত লকডাউনও করা হয় সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান না করে। এর মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের একবার ঢাকায় এনে আবার ফেরত যাবার নির্দেশ পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যায়। ২০ দিনের ছুটির এই সময়ে সাধারণ মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ, তখন এলো ৭২,৭৫০ কোটি টাকার সুদনির্ভর ঋণের প্রণোদনা প্যাকেজ। এ প্যাকেজে সরকারের মাত্র প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা সুদভর্তুকি দিতে হবে (তা-ও জনগণের ট্যাক্সের টাকা)। তাতে কি দায় শেষ হয়ে যায়? Covid-19 এর কারণে কাজ না থাকায় খেটে খাওয়া মানুষ, দোকানদার এবং তাদের স্বল্পবেতনের লাখ-লাখ কর্মচারীরা যে ক্ষতিগ্রস্থ হলো এবং হবে – তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে? এই মালিকেরা কি ঋণ নিয়ে বেতন দেবেন? তাছাড়া যাদের ঋণ দরকার নেই, সেসব নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত স্বনির্ভর মানুষ বাঁচবেন কীভাবে? করোনা নির্মূলে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও প্যাকেজে নেই! প্রশ্ন হলো, কাদের পরামর্শে সরকার চলে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তোষণ ব্যাতিরেকে Covid-19 জনিত বৈজ্ঞানিক তথ্য দেবার মতো একজন লোকও কি আশেপাশে নেই?
৩.
করোনা রাজনীতি বোঝে না, কিন্তু করোনা-র অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-বৈজ্ঞানিক প্রভাব না বুঝলে এর মাশুল দিতে হবে পুরো দেশকে, দেশের সাধারণ জনগণকে। তাই দায়হীন অঘোষিত নয় বরং দায়িত্ব নিয়ে ঘোষিত লকডাউন, টেস্ট, আইসোলেশন আর চিকিৎসার বিকল্প নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তার জনগণের তিন মাসের জীবনযাত্রার দায়িত্ব নিতে পারলে, আমরা পারব না কেন? ডিজিটাল বাংলাদেশ বলা হচ্ছে, কিন্তু ভারতের মতো সকল নাগরিকের ব্যাংক একাউন্ট করার ব্যবস্থা এত বছরে কেন করা হয়নি যাতে সরকারের সাহায্য সরাসরি মানুষের নিজ একাউন্টে চলে যায়? তাহলে মাঝখানে ত্রাণ নিয়ে হয়রানি, চেনা লোককে বণ্টন, আর চুরির ঘটনা কি ঘটত?
জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথায় যারা মারা যাচ্ছেন, তারা প্রায় সব করোনাভাইরাস রোগী। No/less test, No/less result নীতি বদলিয়ে, ঐসব লক্ষণের সবাইকে টেস্ট করলে, মূল হিসাবটা পাওয়া যাবে। আর, সাধারণ মানুষের ১/২ মাসের সকল খরচ নির্বাহ করে সবকিছু বন্ধ না করলে করোনাভাইরাস নির্মূল সম্ভব হবে না। তখন হয়তো অনেক মানুষের মৃত্যুর পর প্রাকৃতিক Herd immunity'র ওপর নির্ভর করতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। প্রশ্ন হল, হাজার হাজার মৃত্যু সরকার বা জনগণ মেনে নিতে প্রস্তুত কি না। যেখানে উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রীরা এই পরিস্থিতিতে জনগণের করণীয় নিজে ব্রিফিং করেন (সাথে থাকেন মুখ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা) এবং কর্মহীন জনগণের জন্য পাক্ষিক/মাসিক বরাদ্দ ঘোষণা করেন সেখানে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে তার স্বাস্থ্যজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন জাগা কি স্বাভাবিক নয়? জনগণের সেবা করার মানসিকতার প্রশ্নে, আমরা আর কবে উন্নত হব? ব্রিটিশদের কেরানি তৈরির শিক্ষার ফলস্বরূপ আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা বদলে, সেবার মানসিকতা তৈরিতে আমরা কতদূর এগিয়ে?
৪.
যে দেশে শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ কম বা অবহেলা করা হয়, সে দেশ কখনও নিজেকে 'উন্নত' বলে দাবি করতে পারে না। উল্লেখিত প্যাকেজে করোনাভাইরাস নির্মূলে কোনো গবেষণা বরাদ্দ/প্রকল্প/সহায়তার কথাও নেই! দেশটা কি ব্যবসায়ী-নেতা আর আমলাদের কথায়/স্বার্থে চলবে, নাকি জনগণের স্বার্থে? যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা শুধু রাজনীতিচর্চায় নিয়োজিত না থেকে গবেষণায় নিয়োজিত থাকতেন পর্যাপ্ত গবেষণা বরাদ্দের দাবি আদায় করে, তাহলে তারাও বিশ্বমানের আবিষ্কার করতেন, শুধু হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে অতৃপ্তি ঘোচাতেন না। শনাক্ত হবার অল্প কিছুদিন পর চীনের বিজ্ঞানীরা এই করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স (Genome sequence) আবিষ্কার করেন। সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা যে যার জায়গা থেকে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গবেষণা শুরু করেন মূলত সরকারি মিলিয়ন/বিলিয়ন ডলারের সহায়তায়। আর আমাদের দেশে এটা নিয়ে গবেষণা, গবেষণাগার বানানোর পরিকল্পনা কিংবা বরাদ্দ কিছুই দেখলাম না! এমনকি হাসপাতালগুলোতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ, প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, এমনকি পর্যাপ্ত কিটও নেই! যে RT-PCR মেশিন দিয়ে রোগ নির্ণয় হবে, তার স্বল্পতা, দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাব—এসব কিছুই হতো না, যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত গবেষণাবরাদ্দ দেওয়া যেত। মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাসি, বোটানি, জুওলজি বিভাগগুলোতে গবেষণায় এই RT-PCR মেশিন অতি জরুরি। প্রশ্ন হল, কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি আছে, এবং কেন নেই? আজ যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ৫ হাজার কোটি টাকা শুধু গবেষণার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার নিশ্চিত বৈজ্ঞানিক সুফল ভোগ করবে মানুষ। জনগণের জীবন বাঁচাতে যদি ৫ হাজার কোটি টাকার স্বাস্থ্য উপকরণ কেনা হয়, ডাক্তার-রোগী উভয়ের জীবন রক্ষা পাবে। প্রণোদনা প্যাকেজে এমন কিছু তো দেখলাম না।
মানুষ করোনার হাত থেকে যেমন বাঁচতে চায়, তেমনি ক্ষুধা থেকেও বাঁচতে চায়, আর চায় আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা আমলা (গণ-কর্মচারী?), এমপি, মন্ত্রী আর কবে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা-অধিকারের মূল্য দেবেন? বুদ্ধিজীবীরাইবা ঘুমাচ্ছেন কেন! নগর পুড়লে তো দেবালয় এড়ায় না। সমর্থন আর তোষামোদি এক না, এটা না বোঝার ভান আর কত! আসুন করোনাকালীন এই সময়ে জনগণের স্বার্থ নিয়ে কথা বলা, কাজ করার শিক্ষাই হোক করোনা বিপর্যয় থেকে নেওয়া সবচেয়ে বড় শিক্ষা।