সুশাসনের অভাবে ঈদ উদযাপনে যত সংকট

চিন্ময় মুৎসুদ্দী
Published : 27 August 2012, 03:31 PM
Updated : 27 August 2012, 03:31 PM

ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ৭০ লাখ মানুষ তাদের নিকটজনের সঙ্গে ঈদ পালন করেছেন তাদের 'দেশ'র বাড়িতে। যাওয়ার পথের সকল ভোগান্তি ভুলে গেছেন। তবে অনেকেই ভাবছেন ভালোয় ভালোয় ঢাকায় ফিরে যেতে পারলে হয়। কেউ কেউ আসা শুরু করলেও রোববার ২৬ তারিখই অফিস করেন অধিকাংশ মানুষ। ভালোয় ভালোয় ফেরার ভাবনাটা নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই এই ভাবনা তাদের পেয়ে বসে। গত কয়েক দশক ধরেই এমন দুশ্চিন্তার স্বাক্ষর পাওয়া যায় ঢাকার সংবাদপত্রে। ১৯৭০ সালে ঈদের দুদিন আগে চট্রগ্রামের উদ্দেশে রাতের ট্রেনের কক্ষে ঢুকেছিলাম জানালা দিয়ে। এবছর দেখলাম নারী শিশু বৃদ্ধ ঝুলন্ত অবস্থায় ট্রেনের ছাদে উঠছে। এটাকে কী বলব, উন্নয়ন? ওপরে ওঠাতো!

প্রশ্ন দশকের পর দশক একই সমস্যা থেকে যাচ্ছে কেন? ঢাকার বাসিন্দা যখন কয়েক লাখ তখনও ছিল এই সমস্যা। অনিয়ম, দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা সর্বত্র; সড়কপথ, রেলপথ, নৌপথ এমনকি আকাশপথেও। সমস্যা এখনও আছে। মানুষ যেমন বেড়েছে, যানবাহনও বেড়েছে। কিন্তু 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চলছে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। পুরো যানবাহন সেক্টরে যে নৈরাজ্য রয়েছে তার কিছু কিছু নিদর্শন আমরা মাঝে মাঝে সংবাদ মাধ্যমে দেখি। গত কয়েক মাসে নিয়মিত দেখেছি। গতবারের ঈদে রাস্তাঘাটে ছিল ভীতিকর পরিবেশ। সবদিকে ভাঙ্গাচোড়া অবস্থা। এবার মন্ত্রী আগে থেকে সতর্ক হয়েও তেমন কিছু করতে পারেননি। ঈদের ছুটির সঙ্গে আরো ছুটি আগে থেকে যোগ হওয়ায় জনপথের (হাইওয়েজ) অবস্থা শেষ দিকে কিছুটা হাল্কা হলেও চাঁদাবাজির কারণে কয়েকটিতে যানজট লেগে যায়। এটাও সুশাসনের অভাব। মন্ত্রী প্রাইভেট সংগঠনের প্রকাশ্য চাঁদাবাজি অনুমোদন দেন, ব্যক্তিরাও তাই উৎসাহী হয়ে ওঠেন চাঁদাবাজিতে। আর প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের।

এবার ট্রেনের ওপর চাপ ছিল বেশি। এখানেও মানুষের দুর্ভোগ ছিল অনেক। তবে রেল মন্ত্রী একটা সত্য কথা বলেছেন। সম্ভবত সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রীর সত্য বলা নিকট অতীতে কেউ শোনেননি। ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার আগে অন্য মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়ন প্রকাশ করতেন মিডিয়ার কাছে। এবার নিজের মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা বলেছেন অকপটে। ঈদের আগে রেলযাত্রীদের উদ্দেশে তিনি কোনো আশার বাণী শোনাননি। বলেছেন ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখা যাবে না। এজন্য তিনি দু:খ প্রকাশ করেছেন। অন্য মন্ত্রীদের মতো বলেননি "ট্রেন কি আমি চালাই"? (ট্রেন দুর্ঘটনার পর এক মন্ত্রীকে দায়িত্বের কথা বলা হলে তিনি এরকম কথা বলেছিলেন সাংবাদিকদের)। মন্ত্রীকে তাই ধন্যবাদ জানাতে হয়। একসময় তিনি সাংবাদিক ছিলেন, দৈনিক বাংলার বাণী'তে। ঈদে বাড়ি যেতে মানুষের ভোগান্তির অবসান চেয়ে উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। এখন দেখা যাক আগামী ঈদে তিনি কি করতে পারেন।

ঢাকা দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এ কারণে এখানে সবাইকে আসতে হয়। প্রয়োজনে বাসিন্দা হতে হয়। ক'দিন আগে সাপ্তাহিক ইকনমিস্ট পত্রিকা বলেছে ঢাকা পৃথিবীতে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর। এক জরিপের ফলাফলে ঢাকা ১৪০টি শহরের সবার নীচে স্থান পেয়েছে। গতবার ঢাকার স্থান ছিল ১৩৯। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো-এ পাঁচ বিষয়ের মোট ৩০টি বিবেচনার ভিত্তিতে তালিকাটি করা হয়েছে। সবচেয়ে অযোগ্য কি না জানি না। তবে ঢাকা যে ক্রমশ অধপতনে যাচ্ছে এটা ঢাকায় যারা থাকেন তারা অবশ্য বুঝেন। ইকনমিস্টের জরিপ তাদের না হলেও চলে।

ঢাকার আশেপাশের খালবিল সব দখল হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা নদী এখন আবর্জনার পাত্র। এর কুল কিনারা দখল করে বানানো হয়েছে কল কারখানা। অনেক কষ্টে বিজয় স্মরণীর সাথে তেজগাঁর সংযোগ আটকে দেয়া অবৈধ র‌্যাংগস ভবনটি ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হয়। কিন্তু জলাভূমির গতি আটকানো বিজিএমইএ ভবনটি ঢাকার দুঃখ হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট নাগরিক সংগঠন প্রতিদিন মানববন্ধন করছে নদী ও খাল পুনরুদ্ধার করে প্রবহমান করার জন্য। বেলা, ব্লাস্টসহ অনেকে ঢাকা-কে বাঁচাবার জন্য মামলা মোকদ্দমা করছে, কিন্তু ঢাকা আছে ঢাকাতেই। ক্রমাগত শ্রী হারাচ্ছে এই মহানগর। কেন এমন হচ্ছে? উত্তর, সুশাসনের অভাব।

সুশাসন নির্ভর করছে রাজনৈতিক সততা ও প্রজ্ঞার ওপর। দেখে মনে হয় রাষ্ট্র পরিচালকদের এই দুটি গুণাবলীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে। এটা সবাই জানে। এবার পণ্য পর্যাপ্ত ছিল, তবু দাম বেড়েছে। যদিও মুসলিম প্রধান অন্য দেশে এমনটি হয় না। তেহরানে দেখেছি এ নিয়ে কোনো চাঞ্চল্য নেই ব্যবসায়ীদের মাঝে। সংবাদপত্রে দেখলাম আবুধাবি, দুবাই, শারজায় বা কুয়ালালামপুরে সরবরাহ বাড়ে কিন্তু দাম বাড়ে না। পূজায় দিওয়ালিতে কলকাতা, কাঠমান্ডুতে কেনাকাটার ধুম পড়ে যায় কিন্তু খাবার দাবারের দাম বাড়ে না। বড়দিনে এবং নববর্ষে লন্ডনে, নিউইয়র্কে মানুষ পাগলা হয়ে যায় উৎসবের আনন্দে, কেনাকাটা করে সাধ্যমত কিন্তু সেখানেও আমাদের দেশের মত নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে না।

গত কয়েক যুগ ধরেই এদেশের মানুষ প্রশ্ন করে আসছিলেন 'রমজান মাসে জিনিসের দাম বাড়ে কেন?' এবার অবশ্য সে প্রশ্ন করার সুযোগ তারা পাননি। ব্যবসায়ীরা এই অপবাদ থেকে মুক্ত ছিলেন। কারণ রমজান মাস শুরু হওয়ার দুই/তিন সপ্তাহ আগেই তারা দাম যা বাড়ানোর বাড়িয়ে দেন। যেসব পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা করতে নিষেধ করে সরকার, জুন মাস শেষ হওয়ার আগেই তা বাজারে বিক্রি হয় ৬ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে। সংবাদপত্র তথ্যপ্রমানসহ রিপোর্ট করলেও এর কোনো বিহিত হয়নি। দাম ক্রমাগত বেড়েছে রমজানের প্রায় প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এই বাজার সবসময় ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণে, কৌশলটা তারা প্র্যাকটিস করছিলেন কয়েকবছর আগে থেকে। এবারই এর ব্যাপক সাফল্য দেখা গেল। রমজানের শুরুতে মিডিয়ায় নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে কিছুটা বলাবলি-লেখালেখি হলেও কয়েকদিনের মধ্যে এর তীব্রতা কমে যায়। কারণ দাম বাড়ছে এ তথ্য আর দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়েছেন নানানভাবে-১. বাড়তি মুনাফা ১৫/২০ দিন আগে থেকে করতে পেরেছেন, ২. রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর অপবাদ থেকে মুক্ত ছিলেন, ৩. মানুষও তাদের সেই চিরাচরিত প্রশ্নটি করার সুযোগ পাননি। এবারো তাই জয় হয়েছে ব্যবসায়ীদের, ভোগান্তি হয়েছে সাধারণ মানুষের। সরকার মুনাফার হার নির্ধারণ করে দিলেও তা কেন কার্যকর করতে পারেনি ? কারণ সুশাসনের অভাব।

বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের দেশ দুটি; নাগরিক অর্থে বাংলাদেশ, আর জন্মসুত্রে পৈত্রিক গ্রাম। ঢাকা থেকে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ গ্রামে গেলেন ঈদ করতে। অনেক ধকল তারা সয়েছেন, ফিরছেনও হাজারো ধকল মাথায় নিয়ে। না ফিরে তো উপায় নেই। জীবিকার জন্যে থাকতে হবে ঢাকায়, বা অন্য কোনো বড় শহরে।

নদীর ওপর একাধিক সেতু নির্মান করে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর চারদিকে নাগরিক সুবিধাসহ উপ শহর গড়তে না পারলে আগামী ১০ বছর পর হয়তো ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন ঈদে। তখন কি বাস, ট্রেন, লঞ্চ ধারণ করতে পারবে তাদের? কী হবে তাহলে? এত এত মানুষের একসঙ্গে যাতায়াতের পরিবেশ নির্বিঘ্ন করার চেয়ে ঢের সহজ হবে উপ শহর গড়ে তোলা। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা প্রভৃতি শহরকে ঢাকার সঙ্গে ট্রেনে দুই ঘন্টার আওতায় আনতে পারলে ঢাকার ওপর চাপ এমনিতেই কমে যাবে। সবাই প্রতিদিন সেই সব শহর থেকে আসা যাওয়া করবেন নিজ বাড়ি থেকে। এক দেশে দুই দেশের কথা বলার বিড়ম্বনা থেকে তারা মুক্ত হবেন। প্রতিদিন দেশেই থাকতে পারবেন। সেটা সম্ভব, কিভাবে? সুশাসনের মাধ্যমে।

সুশাসন নেই বলে ঈদ উদযাপনে এত সংকট। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ক্ষমতায় গিয়ে নিজের আয় বাড়ানোর ব্যাপারেই বেশি তৎপর হন। নতুন এমপিরা ট্যাক্স মুক্ত গাড়ি কিনে, মন্ত্রী-এমপিরা বিশেষ কোটায় সরকারি আবাসিক জমি নিয়ে, নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়েন। আর দখল চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত থাকেন একটি অংশ। কোথায় কে কোন পণ্যের দাম বাড়ালেন তা দেখার সময় নেই শাসক গোষ্ঠীর।

রোজা এলে বরাবরই নিত্যপণের দাম বাড়ে, এবার রমজানের দুই/তিন সপ্তাহ আগে বেড়েছে। এর প্রধান কারণ এই বাজার ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণে। ওদের হটাতে না পারলে এমন অবস্থার অবসান হবে না। ট্রেনের গতি দ্রুত করে সংখ্যা বাড়িয়ে সম্ভব দেশের মানুষকে দেশে রাখা। সঙ্গে শৃঙ্খলা আনতে হবে মহাসড়কে ও নৌপথে। এই কাজগুলো কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব সেটা। আর সেই জন্য প্রয়োজন সুশাসনের। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ কি সুশাসন নিয়ে ভাবছেন?