খাদ্য সংকটে মানুষের সহমর্মিতা বনাম রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা

জাহিদুল ইসলাম সজীব
Published : 5 April 2020, 06:47 AM
Updated : 5 April 2020, 06:47 AM

ডনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, তার দেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সর্বোচ্চ দুই লাখের মধ্যে রাখতে পারলেই সেটিকে নিজ সরকারের সাফল্য মনে করবেন তিনি। ইতোমধ্যে দেশটিতে ১ লক্ষ মরদেহের ব্যাগ প্রস্তুতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ ঠিক এক মাস আগেও ট্রাম্প মনে করতেন 'এটি একদিন—অলৌকিকভাবে—নিজেই হারিয়ে যাবে।' আর জানুয়ারির শেষের দিকে বলেছিলেন 'এটি (করোনা ভাইরাস) আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে'। অন্যদিকে ইতালির সরকারও সময় থাকতে এই ভাইরাসের ইস্যুটিকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কিন্তু এ মুহূর্তে আর পেছনে ফিরে যাবার উপায় নেই। সর্বশক্তি নিয়োজিত করেও মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা যাচ্ছে না দেশটিতে।

এই যদি হয় ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা, তবে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তা নিয়ে ভাবতেও সাহস হচ্ছে না। যে ডাক্তার-নার্স চিকিৎসা দেবেন তাদের নেই ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই)। ইতোমধ্যে রোগীর সংস্পর্শে এসে রাজধানীর ডেল্টা হাসপাতালের একজন ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এ দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারি পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা না করে ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ নানাভাবে নিজ নিজ পেশা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে পিপিই সরবরাহের উদ্দেশ্যে উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি ফেসবুকে দ্রুত একটি গ্রুপ খোলেন যেখানে তিনি আরো অনেক উদ্যোক্তাকে যুক্ত করেন যারা নিজ নিজ বুটিক ও পোশাক কারখানায় পিপিই তৈরিতে এগিয়ে আসতে পারেন। ফেসবুকেই বিভিন্ন মানুষ তাদের এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে নানাভাবে সাহায্যের চেষ্টা করেন। অনেকে আর্থিক সহায়তা দিতে চান। আবার ডাক্তাররা এই গ্রুপের মাধ্যমে পিপিই সংগ্রহের চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে কিছু কারখানা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেয়ে পিপিই উৎপাদন শুরু করেছে।

কারখানা বন্ধ ঘোষণা করলেও আশুলিয়ার আজমত অ্যাপারেলসের পাঁচ হাজার শ্রমিকের ৫০০ জন ছুটিতে না গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে তৈরি করেছেন ৫০ হাজার পিপিই। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আজমত রহমান জানিয়েছেন তাঁরা বিনামূল্যে এই পিপিই বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করবেন। (জাগো নিউজ২৪.কম)

আজ থেকে প্রায় একমাস আগে থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। একই রকম উদ্যোগ নিতে দেখা যায় যুব ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশনসহ আরো অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে ১৪ দিনের ছুটি ঘোষণার পর দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে শিথিল হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই মূলত নিম্নআয় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে খাবারের অনিশ্চয়তা গ্রাস করে। রংপুরের পীরগাছার সত্তরোর্ধ অসহায় মালতী রানীর ভাষ্য হল, "সবাই খালি হাত ধুবার কয়, খাবার দেয় না"। (কালের কণ্ঠ)

নাটোরের গুরুদাসপুরে এক দিনমজুর কাজের অভাবে রোজগার না থাকায় বাধ্য হয়ে পকেটমারি করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। (প্রথম আলো) মানুষের এমন অসহায় সময়ে মানুষই মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ফেসবুকের অনেক বন্ধুদেরই দেখছি নিজ নিজ উদ্যোগে কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন। বাংলাদেশে এই সংকটকালে কর্মহীন হয়ে পড়েছে প্রায় দুই কোটি দিনমজুর। (বণিক বার্তা) এর বাইরে রয়েছে আরো নানা ছোট ছোট দোকানি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। লকডাউন বা টানা ছুটির মত সময়ে এরা সবাই খাদ্যের অনিশ্চয়তায় পড়বেন। সময়ের সাথে সাথে এ সংকট বাড়তেই থাকবে।

দেশের এই সংকট মুহুর্তে নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসছে বহু মানুষ। আল মামুন শেখ নামে একজন নিজের ফেসবুকে লিখেছেন "…. আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় করোনা ঝুঁকিতে জীবিকা বন্ধ হওয়া অসহায় ৭ টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি। …আপনিও কমপক্ষে একটি পরিবারের পাশে দাঁড়ান।"

রাজধানীর তাকওয়া মসজিদ এলাকার বাসিন্দা হানিউম মারিয়া চৌধুরী নামের ভদ্রমহিলা মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ায় মুসল্লিদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার আশংকার কথা ব্যক্ত করার পাশাপাশি এ পরিস্থিতিতে মসজিদকে ঘিরে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মাঝে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ইমামদের এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন তিনি। তার মতে যাকাতের জন্য সঞ্চিত টাকা এখনই মসজিদগুলোর মাধ্যমে দান করা উচিত।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ভাসমান ও হতদরিদ্র মানুষের খাবারের যোগান দিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর সংগঠনের নাম। প্রতিদিন ৮-১০ হাজার মানুষের খাবারের যোগান দিচ্ছে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যাদের ব্যানারে লেখা থাকে 'স্পন্সরড বাই পিপল অব বাংলাদেশ'। তাদের উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু মানুষ। ১০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকার সহায়তা এসেছে তাদের ফান্ডে। আর্থিক সহায়তা ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুকনো খাবার দিয়েও সহায়তা করছে। বিনা পারিশ্রমিকে রান্নার কাজ করছে একাধিক রোস্তোরা যাদের এ মুহূর্তে কোনো ক্রেতা নেই। মানুষের ফেলে দেওয়া নানা উচ্ছিষ্ট খেয়ে যে কুকুরগুলো বেঁচে থাকে আজ তারাও বিপন্ন। ঢাকায় এসব কুকুরগুলোর কথা চিন্তা করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে পথে পথে খাবার বিলিয়ে দেওয়ার।

কিন্তু বিদ্যানন্দের মতো আগে থেকেই মানুষের সহায়তায় কাজ করা সংগঠনের বাইরে এ মুহূর্তে ব্যক্তি উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষও অনেক। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের কথাই ধরা যাক। 'চাল,ডাল, আলু। বাঁচার জন্য। ৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ' এই নামে খোলা একটি ফেসবুকের গ্রুপের মাধ্যমে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন যারযার সাধ্য মত সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলোর অন্তত এক সপ্তাহের নূন্যতম খাবারের যোগানে এগিয়ে আসতে। ইতোমধ্যে তার এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী ও বস্তিবাসী ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠন এগিয়ে এসেছে যাদের মাধ্যমে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৯৩টি পরিবারের মধ্যে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। এই ফেসবুক গ্রুপেই মৌরি সিদ্দিকা নামে একজন জানিয়েছেন তিনি ইতোমধ্যে ৮১ জন গৃহকর্মীর তালিকা করেছেন যাদের খাদ্য সরবরাহ করবেন। এবং শুক্রবার নাগাদ ৪৮ জনকে তিনি তা সরবরাহ করতে পেরেছেন।

ফারহানা হাফিজ একটি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে কিছু অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করেছেন যা তিনি তুলে দিয়েছেন মারজিয়া প্রভাসহ বেশক'জন স্বেচ্ছাসেবীর হাতে। তারা মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় ২১টি পরিবারের মধ্যে সে সহায়তা পৌঁছে দেন।

কেবল ঢাকাতেই নয়। বরং এসব উদ্যোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও। বাগেরহাটে গুড় (গ্রেটার ইউনিটি ফর রিয়েলিটি) নামে একটি সমবায়ের অধীন পরিচালিত ভূমি ক্যাফে ও রেস্ট হাউজ হোম ডেলিভারি ব্যতীত সকল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে সব কর্মীকে নিয়ে ফেস মাস্ক ও পিপিই বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে এসব মাস্ক স্বল্প ও বিনামূল্যে ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করেছেন তারা। গুড়-এর পক্ষ থেকে বাগেরহাট জেলা পুলিশের কাছেই হস্তান্তর করা হয়েছে ২০০০ পিস মাস্ক। এছাড়াও ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১১৫০টি পরিবারে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন তারা।

মোটামুটি সামর্থবান মানুষের পাশাপাশি এমন মানুষও এসময় নিজের সর্বোচ্চটুকু নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন যারা নিজেরাই রয়েছেন অনিশ্চয়তায়। এমন একজন মানুষ হলেন সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ স্বপন মিয়া। তিনি রিকশা চালকদের বিনামূল্যে সবজি বিতরণ করছেন এমন একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন মেহেদি হাসান হৃদয় নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। ভিডিওটি ফেসবুকে অনেক মানুষের প্রশংসা কুড়ায়। এর মধ্যেই মরিয়ম নূর ইউনুস নামে একজন ভিডিও ধারণকারীর সাথে যোগাযোগ করে স্বপন মিয়ার পরিবারের এক মাসের খাবারের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

নাটোরের এক দম্পতি যাদের নিজেদের কোনো জমি নেই। রেলের পরিত্যক্ত জমিতে ঘর তুলে বাস করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চালান। স্ত্রী জটিল রোগে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা করানোর জন্য এক লাখের বেশি টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকা ব্যয় করছেন ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে। নিজেরাই চাল, ডাল, আলু, তেল কিনে এনে ঘরে বসে প্যাকেট করে পৌঁছে দিচ্ছেন মানুষের ঘরে ঘরে। (প্রথম আলো)

কিন্তু মানুষের স্বতঃ:স্ফূর্ত এসব পদক্ষেপ এ মুহূর্তে আয়হীন ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় মোটেও যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে খাদ্য পৌঁছে দিতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা যেমন সংক্রমিত হওয়ার আশংকা আছে আবার এক জায়গায় জড়ো হয়ে সাহায্য গ্রহণ করতে আসা মানুষের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যায়ের এসব উদ্যোগকে সরকারিভাবে একটি সমন্বয়ের মধ্যে আনতে না পারলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।

ইতালিতে টানা লকডাউনে খাদ্য সংকটের কারণে নিরুপায় মানুষ কিছু কিছু জায়গায় লুটপাট ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নতুন করে ৪০০ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ ঘোষণা করেন। পাশের দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যের বামপন্থী সরকার এই করোনা সংকটকালে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের পরিবার প্রতি ৩৫ কেজি ও সাধারণ পরিবারগুলোকে ১৫ কেজি করে চাল সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও যারা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবে তাদের জন্য চাল, ডাল, গম, চিনি, লবণ, ভোজ্য তেল সরবরাহ করা হবে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কেরালা রাজ্য সরকার এই মাসের শেষ দিন পর্যন্ত রাজ্যের সব অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র (শিশু কেয়ার) ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এরপর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শিশুদের বাড়ি বাড়ি দুপুরের খাবার পৌঁছে দেওয়ারও ব্যবস্থা করছে কেরালা সরকার, যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। এছাড়া 'কুদামবসরী' নামে নারীদের একটি বৃহৎ সমবায়ের অধীনে ১০০০টি ছোট ছোট খাবারের দোকান খোলা হয়েছে যার জন্য ২০০০ কোটি রুপী ঋণও দেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। এই দোকানগুলোতে ২০ রুপিতে একবেলার খাবার পাওয়া যাবে এবং এ সময় সকল রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য খাবার নিশ্চিত করেছে তারা। করোনা সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ রাজ্য সরকার ইতোমধ্যে ২০ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ করেছে।

আমাদের দেশে সরকার ইতোমধ্যে খোলা বাজারে ১০ টাকায় চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ৬৪ জেলায় এ পর্যন্ত নগদ ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা এবং ৩১ হাজার ২১৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করেছে। কিন্তু করোনার মত দুর্যোগে মানুষকে খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে ঘরে আটকে রাখতে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য এসব উদ্যোগ যে একেবারেই অপ্রতুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো যেমন জরুরি তেমনি রাষ্ট্রকেও বাধ্য করতে হবে তার নিজস্ব ভূমিকা পালনে। তা না হলে আমাদের এসব মানবতাবোধ দিন শেষে সরকারের ব্যর্থতায় সৃষ্ট ক্ষতের উপর মলম হিসেবে কাজ করবে কেবল।

ফেসবুকে নাম না জানা এক শিল্পীর একটি চিত্রকর্মের ছবিতে দেখা যাচ্ছে লকডাউনের সময় কিছু মানুষ দালানগুলোর বারান্দায় মোবাইল ফোনে কিংবা চায়ের কাপ হাতে আলস সময় কাটাচ্ছে আর রাস্তা দিয়ে হাজারো অসহায় মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে কোনো এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। লকডাউন যখন কারো কাছে কেবলি ঘরবন্দী একঘেঁয়ে জীবন তখন অন্য কারো কাছে এটি ভাইরাসের সম্ভাব্য আতঙ্কের চেয়েও বেশি শঙ্কার।

পৃথিবীর মানুষ আজ এমন এক ব্যাধির মুখোমুখি হয়েছে যা ধনী-গরীব সকলের জন্যই আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। সম্পদের পাহাড় থাকলেও এ রোগে চিকিৎসার নিশ্চয়তা কিংবা রোগকে প্রতিরোধ করার জন্য আলাদা কোনো উপায় কারও কাছে নেই। সকলকে একসাথেই এ অবস্থার মোকাবেলা করতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে অবশ্যই কল্যাণমুখী হতে হবে। এক সময় যারা দেশের টাকা লুটপাট করে বিদেশে টাকার পাহাড় বানিয়েছিলো তারাও আজ শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। এমন সময়েও যদি মানুষ রাষ্ট্রকে সর্বজনের জন্য মৌলিক সেবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে বাধ্য করতে না পারে তবে ক্ষতি সকলেরই।

জাতিসঙ্ঘের দেওয়া তথ্য মতে ২০১৮ সালে পৃথিবীতে ৮২ কোটি ১ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষ তাদের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারেনি। অর্থাৎ ঐ বছর পৃথিবীর প্রতি ৯ জনে ১ জন মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। করোনাভাইরাসের কোনো বালাই কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কারে পৃথিবী এখনো সফল হয়নি বলে এতে আক্রান্ত বহু মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে হচ্ছে এবং অনাগত দিনগুলোতে মৃতের সংখ্যা লাখ ও কোটির ঘর ছাড়াতে পারে। কিন্তু ক্ষুধা নিবারণে কোনো প্রতিষেধক বা ঔষধের প্রয়োজন নেই। অথচ প্রতিবছর ৩১ লক্ষ শিশু পুষ্টিহীনতায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। (ইউনিসেফ ২০১৮) কেন পৃথিবীর কাছে এই মৃত্যুগুলোর কোনো ব্যঞ্জনা নেই! করোনাভাইরাস পৃথিবীকে এই শিক্ষাই হয়ত দিয়ে যাবে যে মানুষকে বাঁচতে হবে একে অন্যের প্রতি সহমর্মী হয়েই। একদিকে সম্পদের পাহাড় অন্যদিকে ক্ষুধায় শিশুর মৃত্যু—এমন পৃথিবী থেকে মুক্ত হতে হলে সকল রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতা কাঠামোকে জোরেশোরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে হবে—কেন আজও মানুষকে খাবারের জন্য হাহাকার করতে হবে! যে উন্নয়ন মানুষকে খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারে না সে উন্নয়ন কার জন্য? একদিকে যেমন নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াব তেমনি সাথেসাথে এ প্রশ্নগুলোও জারি রাখতে হবে। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে অন্তত ক্ষুধায় কোনো মানুষ মরবে না এমন নিশ্চয়তা সকল রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দিতেই হবে।